আর কটা দিন থেকে গেলেই পারতে! by জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরী
হুমায়ূন আহমেদ শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন! মৃত্যুটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো হয়ে আসেনি সত্য, তবুও হঠাৎ করে চিরদিনের মতো চলে যাবেন, সেটা কারও ভাবনায় ছিল না। তাই তার তিরোধান সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। নির্মম সত্যটি মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে যে, হুমায়ূন আহমেদ আর নেই। ৬৪ বছর কি সাহিত্যিকের জন্য যথেষ্ট?
সাধারণত কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে লিখতে গেলে শুরুতেই তার পরিচয় দিতে হয়। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের কোনো পরিচয়ের প্রয়োজন নেই। সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে এ নামটি যে আবেগ, অনুভূতি, জনপ্রিয়তা এবং ভালোবাসার সঞ্চারণ ঘটায় সেটা আগে কবে পরিলক্ষিত হয়েছে আমার অন্তত জানা নেই। সবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলা যেতে পারে, সাহিত্যের জগতে অনেকটা 'একচ্ছত্র' বাদশা হয়ে আগে কারও আবির্ভাব হয়েছিল কিনা এবং আগামীতে এমনি জনপ্রিয় সাহিত্যিকের উদ্ভব হবে কিনা সেটা একটি বড় প্রশ্ন হয়েই বিচরণ করবে।
হুমায়ূন আমার সমসাময়িক ছিলেন। খুব যে একটা দেখা হতো কিংবা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল তা নয়। খুব কাছের বন্ধুদের মধ্যেও আমি ছিলাম না। তবুও দেখা হলেই গভীর চশমার আড়াল থেকে যে শব্দটি বেরিয়ে আসত তা হলো_ 'দোস্ত, আছ কেমন?' মৃদু হেসে বন্ধুত্বের পরশ নিয়েই পুরনো অনেকের কথা জিজ্ঞেস করতেন, যাদের সঙ্গে অনেক বছর দেখা হয়নি। আমি হেসে বলতাম, 'তুমি সেলিব্রেটি মানুষ_ সাহিত্যের হার্টথ্রব, তোমার সময় কোথায়?' হুমায়ূন স্বীকার-অস্বীকার না করে বলতেন, পুরনো বন্ধুদের দেখা হলে বলো, আমি দুর্বল মুহূর্তে সেই দিনগুলো মনে করি।
আমরা একই সময়ে কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করি। হুমায়ূন খুব ভালো ছাত্র ছিলেন, এসএসসিতে মেধা তালিকায় স্থান ছিল তার। বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়েছেন, আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞান। হুমায়ূন ভালো করেছে অনার্স এং এমএসসিতে এবং পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পিএইচডি করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের স্বাভাবিক একটি পথ শিক্ষকতা ছেড়ে সার্বক্ষণিক সাহিত্যিক হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পর বহুদিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি। আমরা যার যার পেশা এবং জীবনধারণের পন্থা নিয়ে ব্যস্ত। আশির দশকে সাহিত্য জগতে সে নামটি দারুণভাবে উচ্চারিত হতে থাকে, সেটা হলো হুমায়ূন আহমেদ। আমি জানতাম, তিনি আমাদের হুমায়ূন। কেননা দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই মুহসীন হলে থাকা অবস্থায়ই হুমায়ূন লেখালেখি শুরু করেন। সে সময় আমাদের এসএম হলের সাহিত্য সংক্রান্ত কর্মসূচিতেও হুমায়ূন আসতেন।
হুমায়ূনের ক্ষিপ্রগতিতে সাহিত্যের আকাশে নক্ষত্রের মতো উত্থানে আমরা গর্ববোধ করতাম। সবার মুখেই তখন ওর নাম। আমিও আমারই অজান্তে তার নাটকের বড় ভক্ত হয়ে উঠলাম। টেলিভিশনে 'এইসব দিন রাত্রি', 'বহুব্রীহি' কিংবা 'কোথায়ও কেউ নেই' দেখার জন্য যেখানেই থাকি না কেন অস্থির হয়ে বাসায় ফিরে আসতাম কিংবা অন্য কোথায়ও দেখতাম। যখন তার লেখা সংলাপগুলো আসাদুজ্জামান নূর, বুলবুল আহমেদ কিংবা সারা যাকেরের কণ্ঠে শুনতাম তখন মনে হতো আমাদের বাংলা নাটক সাফল্যের স্বর্ণালী অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে।
আসাদুজ্জামান নূরও আমার সেই ১৯৬৭ সাল থেকে বন্ধু। তিনি আমার কিছুটা বড়, 'নূর ভাই' বলেই ডাকি। একই ছাত্র সংগঠন করতাম। ১৯৮২ সালে আলী যাকের-নূর ভাইরা নতুন দিলি্লতে 'নূরল দীনের সারা জীবন' নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিলেন মাভালাংকার হলে। আমি তখন ভারতীয় রাজধানীতে বাসসের সংবাদদাতা। সেই নাটকটি দেখতে অনেক বাঙালি এসেছিলেন। মনে পড়ছে অনেকেই তখন জিজ্ঞেস করছিলেন বাংলাদেশের হুমায়ূন আহমেদের কথা।
হুমায়ূনের শরীর খারাপ হওয়ার আগের একটি ঘটনা মনে পড়ছে। ঢাকা ক্লাবে স্ত্রী শাওন, ঘনিষ্ঠ বন্ধু স্থপতি করিম এবং আরও কয়েকজনকে নিয়ে খাচ্ছেন হুমায়ূন। আমাকে দেখে ডাকল_ 'দোস্ত, আমাদের সঙ্গে জয়েন কর।' সেদিন অনেকক্ষণ ওর সঙ্গে ছিলাম। একটার পর একটা সিগারেট খেয়েই যাচ্ছে। এক পর্যায়ে শাওন বলল, আপনার বন্ধুকে থামান। কিন্তু কে কার কথা শোনে!
মৃত্যুতেও হুমায়ুন কারও কথা না শুনে চলে গেলেন! আমাদের গর্ব, হুমায়ূনকে এখন বলতে ইচ্ছা করছে, দোস্ত, তুমি চলেই গেলে! কয়েকটা বছর পরে গেলে হতো না?
জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরী :জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক
হুমায়ূন আমার সমসাময়িক ছিলেন। খুব যে একটা দেখা হতো কিংবা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল তা নয়। খুব কাছের বন্ধুদের মধ্যেও আমি ছিলাম না। তবুও দেখা হলেই গভীর চশমার আড়াল থেকে যে শব্দটি বেরিয়ে আসত তা হলো_ 'দোস্ত, আছ কেমন?' মৃদু হেসে বন্ধুত্বের পরশ নিয়েই পুরনো অনেকের কথা জিজ্ঞেস করতেন, যাদের সঙ্গে অনেক বছর দেখা হয়নি। আমি হেসে বলতাম, 'তুমি সেলিব্রেটি মানুষ_ সাহিত্যের হার্টথ্রব, তোমার সময় কোথায়?' হুমায়ূন স্বীকার-অস্বীকার না করে বলতেন, পুরনো বন্ধুদের দেখা হলে বলো, আমি দুর্বল মুহূর্তে সেই দিনগুলো মনে করি।
আমরা একই সময়ে কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করি। হুমায়ূন খুব ভালো ছাত্র ছিলেন, এসএসসিতে মেধা তালিকায় স্থান ছিল তার। বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়েছেন, আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞান। হুমায়ূন ভালো করেছে অনার্স এং এমএসসিতে এবং পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পিএইচডি করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের স্বাভাবিক একটি পথ শিক্ষকতা ছেড়ে সার্বক্ষণিক সাহিত্যিক হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পর বহুদিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি। আমরা যার যার পেশা এবং জীবনধারণের পন্থা নিয়ে ব্যস্ত। আশির দশকে সাহিত্য জগতে সে নামটি দারুণভাবে উচ্চারিত হতে থাকে, সেটা হলো হুমায়ূন আহমেদ। আমি জানতাম, তিনি আমাদের হুমায়ূন। কেননা দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই মুহসীন হলে থাকা অবস্থায়ই হুমায়ূন লেখালেখি শুরু করেন। সে সময় আমাদের এসএম হলের সাহিত্য সংক্রান্ত কর্মসূচিতেও হুমায়ূন আসতেন।
হুমায়ূনের ক্ষিপ্রগতিতে সাহিত্যের আকাশে নক্ষত্রের মতো উত্থানে আমরা গর্ববোধ করতাম। সবার মুখেই তখন ওর নাম। আমিও আমারই অজান্তে তার নাটকের বড় ভক্ত হয়ে উঠলাম। টেলিভিশনে 'এইসব দিন রাত্রি', 'বহুব্রীহি' কিংবা 'কোথায়ও কেউ নেই' দেখার জন্য যেখানেই থাকি না কেন অস্থির হয়ে বাসায় ফিরে আসতাম কিংবা অন্য কোথায়ও দেখতাম। যখন তার লেখা সংলাপগুলো আসাদুজ্জামান নূর, বুলবুল আহমেদ কিংবা সারা যাকেরের কণ্ঠে শুনতাম তখন মনে হতো আমাদের বাংলা নাটক সাফল্যের স্বর্ণালী অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে।
আসাদুজ্জামান নূরও আমার সেই ১৯৬৭ সাল থেকে বন্ধু। তিনি আমার কিছুটা বড়, 'নূর ভাই' বলেই ডাকি। একই ছাত্র সংগঠন করতাম। ১৯৮২ সালে আলী যাকের-নূর ভাইরা নতুন দিলি্লতে 'নূরল দীনের সারা জীবন' নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিলেন মাভালাংকার হলে। আমি তখন ভারতীয় রাজধানীতে বাসসের সংবাদদাতা। সেই নাটকটি দেখতে অনেক বাঙালি এসেছিলেন। মনে পড়ছে অনেকেই তখন জিজ্ঞেস করছিলেন বাংলাদেশের হুমায়ূন আহমেদের কথা।
হুমায়ূনের শরীর খারাপ হওয়ার আগের একটি ঘটনা মনে পড়ছে। ঢাকা ক্লাবে স্ত্রী শাওন, ঘনিষ্ঠ বন্ধু স্থপতি করিম এবং আরও কয়েকজনকে নিয়ে খাচ্ছেন হুমায়ূন। আমাকে দেখে ডাকল_ 'দোস্ত, আমাদের সঙ্গে জয়েন কর।' সেদিন অনেকক্ষণ ওর সঙ্গে ছিলাম। একটার পর একটা সিগারেট খেয়েই যাচ্ছে। এক পর্যায়ে শাওন বলল, আপনার বন্ধুকে থামান। কিন্তু কে কার কথা শোনে!
মৃত্যুতেও হুমায়ুন কারও কথা না শুনে চলে গেলেন! আমাদের গর্ব, হুমায়ূনকে এখন বলতে ইচ্ছা করছে, দোস্ত, তুমি চলেই গেলে! কয়েকটা বছর পরে গেলে হতো না?
জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরী :জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক
No comments