বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪৬২ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মো. আবদুল আজিজ, বীর প্রতীক সাহসী গেরিলা যোদ্ধা ১৯৭১ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ। মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরে খবর এল, বাংলাদেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে ৭ জুন জাতিসংঘের একটি পর্যবেক্ষক দল ঢাকায় আসবে।
তারা কয়েক দিন ঢাকায় থাকবে। এ সময় ঢাকা শহর ও আশপাশ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা অপারেশন করতে হবে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, এটা তাদের কাছে প্রমাণ করতে হবে।
এরপর ভারত থেকে ঢাকায় আসে একদল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। তারা কয়েকটি দলে বিভক্ত। একটি দলে ছিলেন মো. আবদুল আজিজ। তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা কীভাবে এই অপারেশন করলেন, সেই বিবরণ শোনা যাক তাঁর নিজ বয়ানে (১৯৮৯)।
‘আমরা ৪২ জনের দল মনতলি ক্যাম্প হয়ে ৬ জুন নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার থানার গোপালদী আসি। সেখানে ১০টি দলে বিভক্ত হয়ে যার যার লক্ষ্যস্থলে রওনা হলাম। অ্যাকশনের সময় নির্ধারণ করা হলো রাত দুইটা। প্রতি দলের জন্য একটি টার্গেট। আবার বিকল্প টার্গেটও দেওয়া হয়েছিল।
‘আমাদের দলে মাতুয়াইলের অলি, ঢাকার বাবুল (শহীদ আজিজুল ইসলাম বীর বিক্রম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চন্দ্রপুর-লাতুমুড়া যুদ্ধে শহীদ) ও আমি। আমার সঙ্গে আরও একজন ছিলেন। তাঁর নাম আমার এখন মনে নেই।
‘আমাদের টার্গেট ছিল যাত্রাবাড়ী ইলেকট্রিক সাবস্টেশন। রাত ১২টার দিকে যাত্রাবাড়ী পৌঁছে দেখতে পেলাম সেখানে ২০ জন পাকিস্তানি সেনা-পুলিশ পাহারায়। আরও আছে দুটি এলএমজি পোস্ট। আমাদের কাছে মাত্র একটা স্টেনগান। তাই বাধ্য হয়েই আমাদের যেতে হলো বিকল্প টার্গেট সায়েদাবাদ সেতুর নিচ দিয়ে নিয়ে যাওয়া মেইন ইলেকট্রিক কেব্ল লাইন ধ্বংস করতে।
‘সেখানে পৌঁছাতে সময় ঘনিয়ে গেল। সেতুর নিচে আমরা যখন কেবেল এক্সপ্লোসিভ লাগাতে ব্যস্ত, তখন বিকট আওয়াজ পেলাম। অর্থাৎ আমাদের কোনো একটি দলের অপারেশন।
‘আমাদের কাছে ছিল ৩০ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ। অভিজ্ঞতার অভাবে আমরা সব এক্সপ্লোসিভ কেবেল লাগিয়ে টাইম ফিউজে আগুন দিয়ে দৌড় দিলাম। অনেক দূর যাওয়ার পরও দেখি বিস্ফোরণ হচ্ছে না। সেখানে আবার ফিরে যাব কি না ভাবছি, এমন সময় বিদ্যুৎ চমকের আলো ছড়িয়ে ঘটল প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। এর ধাক্কায় আমরা চারজনই মাটিতে পড়ে গেলাম।
‘পাঁচ পাউন্ড হলেই কাজ হতো। সেখানে দিয়েছি ৩০ পাউন্ড। অবস্থা সহজেই অনুমেয়। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন। এরপর আমরা পালিয়ে যাই। পরদিন ছদ্মবেশে সেখানে গিয়ে দেখতে পাই, সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচল বন্ধ। সেতুর বিভিন্ন স্থানে মারাত্মক ফাটল ধরেছে। তিনটি ফাটল বেশ বড়। বড় ফুটো হয়ে গেছে।’
মো. আবদুল আজিজ ১৯৭১ সালে ঢাকা কলেজের বিএ (পাস) ক্লাসের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ছাত্র রাজনীতিও করতেন। তখন ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি ছিলেন। মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসের শেষে ভারতে যান। মে মাসের মাঝামাঝি সময় যুদ্ধে যোগ দেন। সায়েদাবাদের অপারেশন ছিল তাঁর প্রথম অপারেশন। পরে অপারেশন করেন গ্রিন রোডসহ আরও কয়েকটি স্থানে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. আবদুল আজিজকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩১৮।
মো. আবদুল আজিজ ১৯৯৯ সালে মারা যান। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার ষাটশালা গ্রামে। তবে বাস করতেন ঢাকার ধানমন্ডিতে (বাসা পুরাতন ৬৪৫, সড়ক ২১)। তাঁর বাবার নাম এম আবদুল মজিদ। মা সুফিযা মজিদ। স্ত্রী নীলুফার আজিজ। তাঁদের দুই ছেলে।
সূত্র: নীলুফার আজিজ, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২ এবং আমাদের সংগ্রাম চলবেই, অপরাজেয় সংঘ।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
এরপর ভারত থেকে ঢাকায় আসে একদল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। তারা কয়েকটি দলে বিভক্ত। একটি দলে ছিলেন মো. আবদুল আজিজ। তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা কীভাবে এই অপারেশন করলেন, সেই বিবরণ শোনা যাক তাঁর নিজ বয়ানে (১৯৮৯)।
‘আমরা ৪২ জনের দল মনতলি ক্যাম্প হয়ে ৬ জুন নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার থানার গোপালদী আসি। সেখানে ১০টি দলে বিভক্ত হয়ে যার যার লক্ষ্যস্থলে রওনা হলাম। অ্যাকশনের সময় নির্ধারণ করা হলো রাত দুইটা। প্রতি দলের জন্য একটি টার্গেট। আবার বিকল্প টার্গেটও দেওয়া হয়েছিল।
‘আমাদের দলে মাতুয়াইলের অলি, ঢাকার বাবুল (শহীদ আজিজুল ইসলাম বীর বিক্রম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চন্দ্রপুর-লাতুমুড়া যুদ্ধে শহীদ) ও আমি। আমার সঙ্গে আরও একজন ছিলেন। তাঁর নাম আমার এখন মনে নেই।
‘আমাদের টার্গেট ছিল যাত্রাবাড়ী ইলেকট্রিক সাবস্টেশন। রাত ১২টার দিকে যাত্রাবাড়ী পৌঁছে দেখতে পেলাম সেখানে ২০ জন পাকিস্তানি সেনা-পুলিশ পাহারায়। আরও আছে দুটি এলএমজি পোস্ট। আমাদের কাছে মাত্র একটা স্টেনগান। তাই বাধ্য হয়েই আমাদের যেতে হলো বিকল্প টার্গেট সায়েদাবাদ সেতুর নিচ দিয়ে নিয়ে যাওয়া মেইন ইলেকট্রিক কেব্ল লাইন ধ্বংস করতে।
‘সেখানে পৌঁছাতে সময় ঘনিয়ে গেল। সেতুর নিচে আমরা যখন কেবেল এক্সপ্লোসিভ লাগাতে ব্যস্ত, তখন বিকট আওয়াজ পেলাম। অর্থাৎ আমাদের কোনো একটি দলের অপারেশন।
‘আমাদের কাছে ছিল ৩০ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ। অভিজ্ঞতার অভাবে আমরা সব এক্সপ্লোসিভ কেবেল লাগিয়ে টাইম ফিউজে আগুন দিয়ে দৌড় দিলাম। অনেক দূর যাওয়ার পরও দেখি বিস্ফোরণ হচ্ছে না। সেখানে আবার ফিরে যাব কি না ভাবছি, এমন সময় বিদ্যুৎ চমকের আলো ছড়িয়ে ঘটল প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। এর ধাক্কায় আমরা চারজনই মাটিতে পড়ে গেলাম।
‘পাঁচ পাউন্ড হলেই কাজ হতো। সেখানে দিয়েছি ৩০ পাউন্ড। অবস্থা সহজেই অনুমেয়। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন। এরপর আমরা পালিয়ে যাই। পরদিন ছদ্মবেশে সেখানে গিয়ে দেখতে পাই, সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচল বন্ধ। সেতুর বিভিন্ন স্থানে মারাত্মক ফাটল ধরেছে। তিনটি ফাটল বেশ বড়। বড় ফুটো হয়ে গেছে।’
মো. আবদুল আজিজ ১৯৭১ সালে ঢাকা কলেজের বিএ (পাস) ক্লাসের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ছাত্র রাজনীতিও করতেন। তখন ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি ছিলেন। মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসের শেষে ভারতে যান। মে মাসের মাঝামাঝি সময় যুদ্ধে যোগ দেন। সায়েদাবাদের অপারেশন ছিল তাঁর প্রথম অপারেশন। পরে অপারেশন করেন গ্রিন রোডসহ আরও কয়েকটি স্থানে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. আবদুল আজিজকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩১৮।
মো. আবদুল আজিজ ১৯৯৯ সালে মারা যান। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার ষাটশালা গ্রামে। তবে বাস করতেন ঢাকার ধানমন্ডিতে (বাসা পুরাতন ৬৪৫, সড়ক ২১)। তাঁর বাবার নাম এম আবদুল মজিদ। মা সুফিযা মজিদ। স্ত্রী নীলুফার আজিজ। তাঁদের দুই ছেলে।
সূত্র: নীলুফার আজিজ, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২ এবং আমাদের সংগ্রাম চলবেই, অপরাজেয় সংঘ।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments