বিশেষ সাক্ষাৎকার : ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ-বর্তমান মন্ত্রিসভা সবচেয়ে অনভিজ্ঞ ও দুর্নীতিবাজ
দেশ পরিচালনায় সরকার কতটা সফল, বিরোধী দল কি যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে, রোজার পর দেশের রাজনীতি কী রূপ নিতে পারে ও দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে কালের কণ্ঠের মুখোমুখি হয়েছিলেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ও এলডিপির সভাপতি ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলী হাবিব ও মোশাররফ বাবলু
কালের কণ্ঠ : সাড়ে তিন বছর পার করল মহাজোট সরকার। সরকারের এই সময়টাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
অলি আহমদ : অতি অহঙ্কার, প্রতিশোধপরায়ণতা, অদক্ষতা, অদূরদর্শিতা, সব পর্যায়ে দুর্নীতির বিস্তার, সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, অর্ধশিক্ষিত ও অদক্ষ ব্যক্তিদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন এবং দলীয়করণ এই সরকারের জন্য অশনিসংকেত হয়ে দেখা দিয়েছে। কৃষি খাত ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ বা সমর্থন পেতে পারে এমন উল্লেখযোগ্য কোনো বড় ধরনের কাজ চোখে পড়ার মতো নয়।
কালের কণ্ঠ : বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। এ অবস্থায় সরকার কী ব্যবস্থা নিতে পারত বলে আপনি মনে করেন?
অলি আহমদ : বাজারদরের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। সরকারের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা যায়নি। বিগত অর্থবছরে সরকার বিভিন্ন খাতে প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। এর অধিকাংশ টাকা দুর্নীতিবাজদের পকেটে গেছে। সরকারের উচিত ছিল অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা খাদ্যসামগ্রীতে ভর্তুকি দেওয়া। তাহলে সরকারকে জনসমর্থন হারাতে হতো না। দলের অভিজ্ঞ নেতাদের প্রতি অবজ্ঞা ও অর্বাচীনদের প্রাধান্য দেওয়ায় সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের দক্ষতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। আপনার মূল্যায়ন কী? আপনার কি মনে হয় মন্ত্রীদের কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ম্লান হয়েছে বা হচ্ছে?
অলি আহমদ : আমার মতে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বর্তমান মন্ত্রিসভা সবচেয়ে অনভিজ্ঞ ও দুর্নীতিবাজ। নিজের মন্ত্রণালয় পরিচালনা করার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতারও অভাব রয়েছে অনেকের। শুধু মন্ত্রিসভা নয়, দলের সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীর মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি এবং জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তা নিয়ন্ত্রণ সরকারকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।
কালের কণ্ঠ : সামগ্রিক বিবেচনায় সরকার সফল না ব্যর্থ?
অলি আহমদ : এই সরকারের কাছে জনগণের অনেক বড় প্রত্যাশা ছিল। জনগণ হতাশ। শুধু হতাশ বললে ভুল হবে, জনগণ সব ক্ষেত্রে রীতিমতো বঞ্চনার শিকার। ন্যায়বিচার নেই। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যায়, সরকারের সাফল্যের কোনো চিহ্ন কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সাফল্যের চিহ্ন না থাকলে তো ধরে নিতেই হবে, সরকারের কোনো সাফল্য নেই। সাফল্য না থাকার মানেই হচ্ছে ব্যর্থতা। অর্থাৎ সরকার ব্যর্থ।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি কি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারছে?
অলি আহমদ : সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হত্যা, গুম, ধর্ষণ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, ও টেন্ডারবাজির প্রায় আট হাজার মামলা এরই মধ্যে তুলে নেওয়া হয়েছে। এমনকি হত্যার দায়ে দণ্ডিত ২৩ জন ফাঁসির আসামিকেও ক্ষমা করা হয়েছে। এটি ক্ষমতার চরম অপব্যবহার। পক্ষান্তরে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর কোনো নেতা-কর্মীর মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি। উল্টো অনেক প্রবীণ নেতা ও কর্মীর বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন মামলা দিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হচ্ছে, হয়রানি করা হচ্ছে। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের হয়রানির এক নতুন নজির স্থাপন করেছে সরকার। বিগত কোনো সরকার কোনো প্রবীণ নেতা বা দলের প্রধানদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে জেলহাজতে পাঠায়নি। সুতরাং সরকারই বিএনপি ও এলডিপিকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা থেকে বিরত রেখেছে।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ধারায় আপনার নিজের দল এলডিপিকে আপনি কোন অবস্থানে দেখতে চান?
অলি আহমদ : এলডিপি বাংলাদেশের এক নম্বর নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। আমাদের দলের গঠনতন্ত্র ও ম্যানিফেস্টো অন্য দলগুলোর চেয়ে আলাদা। নতুন নতুন গ্রহণযোগ্য সংস্কার বাস্তবায়নসহ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে আমরা কাজ করছি। বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে বর্তমানে আমরা পঞ্চম অবস্থানে আছি। আমরা আশা করি, ভবিষ্যতে এলডিপি একটি সম্মানজনক অবস্থানে থাকবে।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দলের জোট সম্প্রসারিত হয়েছে। আপনার দলও এই জোটের শরিক। এই জোট দেশের রাজনীতিতে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারবে বলে মনে করেন আপনি?
অলি আহমদ : আমি তো মনে করি, ভবিষ্যতে এই জোটই দেশের নেতৃত্ব দেবে ইনশাল্লাহ। বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা আকাশচুম্বী। সঠিক নেতৃত্ব ও নেতা নির্বাচন এই জোটের অবস্থান জনগণের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে আমি মনে করি।
কালের কণ্ঠ : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। এই বিচার-প্রক্রিয়াকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
অলি আহমদ : যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে কারো অমত কিংবা দ্বিমত নেই। এই বিচার-প্রক্রিয়ায় কেউ বাধাও দিচ্ছে না। আমাদের দাবি হচ্ছে, এই বিচার হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের। সেখানে স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা থাকবে। প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধস্পৃহায় কাউকে বা কোনো দলকে ধ্বংস করার জন্য যেন বিচার-প্রক্রিয়া পরিচালিত না হয়, সেটাই আমাদের চাওয়া। বিচার-প্রক্রিয়া যেন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হয়।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
অলি আহমদ : দেশে বর্তমানে গণতন্ত্র নেই। দেশ পরিচালিত হচ্ছে কিছুসংখ্যক রাজনীতিবিদের খেয়ালখুশি অনুযায়ী। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনো প্রতিফলন সেখানে নেই। এই পরিবেশ দেশ ও জনগণকে কিছুই দিতে পারে না। বর্তমান অবস্থা দেখে তো মনে হয়, দেশে কোনো রাজনীতি নেই- আছে দুর্নীতি।
কালের কণ্ঠ : দেশের সাধারণ মানুষ কেমন আছে বলে মনে হয় আপনার?
অলি আহমদ : দেশের মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত। দেশে বাক্স্বাধীনতা নেই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের কাছে দেশের মানুষ জিম্মি। দিন দিন বেকার সমস্যা বাড়ছে। বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। মূল্যস্ফীতি রোধ করা যাচ্ছে না। কোনো প্রতিকার নেই। ফলে মানুষ হতাশ, অসহায় বোধ করছে।
কালের কণ্ঠ : নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
অলি আহমদ : বেগম খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন আমার সার্বিক তত্ত্বাবধানে যমুনা সেতু নির্মিত হয়েছে। এত বড় প্রকল্প এর আগে বাংলাদেশে হয়নি। আমি যোগাযোগমন্ত্রী থাকাবস্থায় বিশ্বব্যাংক, জাপান ও এডিবি বলেছিল, তারা এই সেতুতে অর্থায়ন করবে না। কারণ এই সেতু দেশের অর্থনীতিতে কোনো ভূমিকা রাখবে না। কিন্তু আমি ও যমুনা সেতু বিভাগের তৎকালীন সচিব মোহাম্মদ আলীসহ সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী রাতদিন আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখি। আমাদের সততা ও আন্তরিকতা দিয়ে তাদের আমরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম যে এই সেতু দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আল্লাহর মেহেরবানীতে কেউ এর বিরুদ্ধে সমালোচনা করেনি। শুধু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যমুনা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দিন হরতাল ডেকেছিল। যমুনা সেতু নির্মিত হোক, তখন এটা তারা চায়নি। কিন্তু সেতু নির্মাণের পর বীরদর্পে উদ্বোধন করেছে। আমরা এই সেতুর প্রায় ৭০ থেকে ৮০ ভাগ কাজ শেষ করেছিলাম। অথচ সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বা আমাকে দাওয়াত পর্যন্ত করা হয়নি। আমরা সবাই চাই পদ্মা সেতু হোক। এই সেতুর জন্য আমাদের পূর্ণ সমর্থন থাকবে। তবে আমাদের আশঙ্কা, সম্পূর্ণ নিজেদের অর্থায়নে এই সেতুর নির্মাণকাজ হাতে নিলে দেশের অর্থনীতিতে ধস নামবে। এই সরকারের মেয়াদ রয়েছে বছর দেড়েক। শুধু ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেই তো কাজ শেষ হবে না।
কালের কণ্ঠ : আগামী দেড় বছরে দেশ ও দেশের মানুষের ব্যাপারে সরকারের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
অলি আহমদ : আশা নেই, আশঙ্কা আছে। দেড় বছর অনেক দীর্ঘ সময়। এই সময়ে দেশ অর্থনৈতিকভাবে আরো সমস্যায় পড়তে পারে। বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হবে। আমার ধারণা, আগামী দেড় বছরে দেশের মানুষের দুর্ভোগ আরো বাড়বে।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির গতি-প্রকৃতি কী হওয়া উচিত বলে মনে করেন আপনি?
অলি আহমদ : যেসব দেশ অতীতে এবং বর্তমানে বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে চিহ্নিত, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক আরো জোরদার করা উচিত। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, তা হচ্ছে না। দেশের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে না।
কালের কণ্ঠ : তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন- এই নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন সরব। এ ব্যাপারে আপনার মতামত জানতে চাই।
অলি আহমদ : বর্তমানে দেশ যে পর্যায়ে গেছে, এটা কারো কাম্য নয়। সর্বত্র অবিশ্বাস। বিরোধী দলকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। হয়রানি করা হচ্ছে। সরকারের মনোভাব অসহিষ্ণু। দেশের এখন যা অবস্থা তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন সম্ভব নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ আদৌ নির্বাচনে যাবে কি না, সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে।
কালের কণ্ঠ : দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করতে সংলাপের বিকল্প নেই- এমন কথা বলছেন অনেকেই। আপনার কী মত?
অলি আহমদ : সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ একান্ত প্রয়োজন। সবাইকে আস্থায় এনে সরকারকেই সংলাপের উদ্যোগ নিতে হবে।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দলের লাগাতার সংসদ বর্জনকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন আপনি?
অলি আহমদ : না, বিরোধী দল লাগাতার সংসদ বর্জন করেনি। ১৯৯১ সালের পর আওয়ামী লীগই দেশে প্রথম এই সংস্কৃতি চালু করেছিল।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশকে আগামীতে কী অবস্থায় দেখতে চান? আপনার স্বপ্নের বাংলাদেশের কথা বলুন।
অলি আহমদ : ইনশা আল্লাহ, আগামীতে বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে একটি শক্তিশালী আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশে কোনো কিছুর অভাব নেই। শুধু প্রয়োজন দৃঢ়চেতা মনোভাব ও সৎ নেতৃত্ব- যোগ্য নেতাদের যথাস্থানে পদায়ন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে পারলে এই দেশ বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
অলি আহমদ : আপনাদেরও ধন্যবাদ।
কালের কণ্ঠ : সাড়ে তিন বছর পার করল মহাজোট সরকার। সরকারের এই সময়টাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
অলি আহমদ : অতি অহঙ্কার, প্রতিশোধপরায়ণতা, অদক্ষতা, অদূরদর্শিতা, সব পর্যায়ে দুর্নীতির বিস্তার, সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, অর্ধশিক্ষিত ও অদক্ষ ব্যক্তিদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন এবং দলীয়করণ এই সরকারের জন্য অশনিসংকেত হয়ে দেখা দিয়েছে। কৃষি খাত ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ বা সমর্থন পেতে পারে এমন উল্লেখযোগ্য কোনো বড় ধরনের কাজ চোখে পড়ার মতো নয়।
কালের কণ্ঠ : বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। এ অবস্থায় সরকার কী ব্যবস্থা নিতে পারত বলে আপনি মনে করেন?
অলি আহমদ : বাজারদরের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। সরকারের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা যায়নি। বিগত অর্থবছরে সরকার বিভিন্ন খাতে প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। এর অধিকাংশ টাকা দুর্নীতিবাজদের পকেটে গেছে। সরকারের উচিত ছিল অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা খাদ্যসামগ্রীতে ভর্তুকি দেওয়া। তাহলে সরকারকে জনসমর্থন হারাতে হতো না। দলের অভিজ্ঞ নেতাদের প্রতি অবজ্ঞা ও অর্বাচীনদের প্রাধান্য দেওয়ায় সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের দক্ষতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। আপনার মূল্যায়ন কী? আপনার কি মনে হয় মন্ত্রীদের কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ম্লান হয়েছে বা হচ্ছে?
অলি আহমদ : আমার মতে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বর্তমান মন্ত্রিসভা সবচেয়ে অনভিজ্ঞ ও দুর্নীতিবাজ। নিজের মন্ত্রণালয় পরিচালনা করার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতারও অভাব রয়েছে অনেকের। শুধু মন্ত্রিসভা নয়, দলের সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীর মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি এবং জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তা নিয়ন্ত্রণ সরকারকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।
কালের কণ্ঠ : সামগ্রিক বিবেচনায় সরকার সফল না ব্যর্থ?
অলি আহমদ : এই সরকারের কাছে জনগণের অনেক বড় প্রত্যাশা ছিল। জনগণ হতাশ। শুধু হতাশ বললে ভুল হবে, জনগণ সব ক্ষেত্রে রীতিমতো বঞ্চনার শিকার। ন্যায়বিচার নেই। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যায়, সরকারের সাফল্যের কোনো চিহ্ন কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সাফল্যের চিহ্ন না থাকলে তো ধরে নিতেই হবে, সরকারের কোনো সাফল্য নেই। সাফল্য না থাকার মানেই হচ্ছে ব্যর্থতা। অর্থাৎ সরকার ব্যর্থ।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি কি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারছে?
অলি আহমদ : সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হত্যা, গুম, ধর্ষণ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, ও টেন্ডারবাজির প্রায় আট হাজার মামলা এরই মধ্যে তুলে নেওয়া হয়েছে। এমনকি হত্যার দায়ে দণ্ডিত ২৩ জন ফাঁসির আসামিকেও ক্ষমা করা হয়েছে। এটি ক্ষমতার চরম অপব্যবহার। পক্ষান্তরে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর কোনো নেতা-কর্মীর মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি। উল্টো অনেক প্রবীণ নেতা ও কর্মীর বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন মামলা দিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হচ্ছে, হয়রানি করা হচ্ছে। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের হয়রানির এক নতুন নজির স্থাপন করেছে সরকার। বিগত কোনো সরকার কোনো প্রবীণ নেতা বা দলের প্রধানদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে জেলহাজতে পাঠায়নি। সুতরাং সরকারই বিএনপি ও এলডিপিকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা থেকে বিরত রেখেছে।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ধারায় আপনার নিজের দল এলডিপিকে আপনি কোন অবস্থানে দেখতে চান?
অলি আহমদ : এলডিপি বাংলাদেশের এক নম্বর নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। আমাদের দলের গঠনতন্ত্র ও ম্যানিফেস্টো অন্য দলগুলোর চেয়ে আলাদা। নতুন নতুন গ্রহণযোগ্য সংস্কার বাস্তবায়নসহ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে আমরা কাজ করছি। বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে বর্তমানে আমরা পঞ্চম অবস্থানে আছি। আমরা আশা করি, ভবিষ্যতে এলডিপি একটি সম্মানজনক অবস্থানে থাকবে।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দলের জোট সম্প্রসারিত হয়েছে। আপনার দলও এই জোটের শরিক। এই জোট দেশের রাজনীতিতে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারবে বলে মনে করেন আপনি?
অলি আহমদ : আমি তো মনে করি, ভবিষ্যতে এই জোটই দেশের নেতৃত্ব দেবে ইনশাল্লাহ। বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা আকাশচুম্বী। সঠিক নেতৃত্ব ও নেতা নির্বাচন এই জোটের অবস্থান জনগণের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে আমি মনে করি।
কালের কণ্ঠ : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। এই বিচার-প্রক্রিয়াকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
অলি আহমদ : যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে কারো অমত কিংবা দ্বিমত নেই। এই বিচার-প্রক্রিয়ায় কেউ বাধাও দিচ্ছে না। আমাদের দাবি হচ্ছে, এই বিচার হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের। সেখানে স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা থাকবে। প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধস্পৃহায় কাউকে বা কোনো দলকে ধ্বংস করার জন্য যেন বিচার-প্রক্রিয়া পরিচালিত না হয়, সেটাই আমাদের চাওয়া। বিচার-প্রক্রিয়া যেন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হয়।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
অলি আহমদ : দেশে বর্তমানে গণতন্ত্র নেই। দেশ পরিচালিত হচ্ছে কিছুসংখ্যক রাজনীতিবিদের খেয়ালখুশি অনুযায়ী। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনো প্রতিফলন সেখানে নেই। এই পরিবেশ দেশ ও জনগণকে কিছুই দিতে পারে না। বর্তমান অবস্থা দেখে তো মনে হয়, দেশে কোনো রাজনীতি নেই- আছে দুর্নীতি।
কালের কণ্ঠ : দেশের সাধারণ মানুষ কেমন আছে বলে মনে হয় আপনার?
অলি আহমদ : দেশের মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত। দেশে বাক্স্বাধীনতা নেই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের কাছে দেশের মানুষ জিম্মি। দিন দিন বেকার সমস্যা বাড়ছে। বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। মূল্যস্ফীতি রোধ করা যাচ্ছে না। কোনো প্রতিকার নেই। ফলে মানুষ হতাশ, অসহায় বোধ করছে।
কালের কণ্ঠ : নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
অলি আহমদ : বেগম খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন আমার সার্বিক তত্ত্বাবধানে যমুনা সেতু নির্মিত হয়েছে। এত বড় প্রকল্প এর আগে বাংলাদেশে হয়নি। আমি যোগাযোগমন্ত্রী থাকাবস্থায় বিশ্বব্যাংক, জাপান ও এডিবি বলেছিল, তারা এই সেতুতে অর্থায়ন করবে না। কারণ এই সেতু দেশের অর্থনীতিতে কোনো ভূমিকা রাখবে না। কিন্তু আমি ও যমুনা সেতু বিভাগের তৎকালীন সচিব মোহাম্মদ আলীসহ সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী রাতদিন আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখি। আমাদের সততা ও আন্তরিকতা দিয়ে তাদের আমরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম যে এই সেতু দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আল্লাহর মেহেরবানীতে কেউ এর বিরুদ্ধে সমালোচনা করেনি। শুধু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যমুনা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দিন হরতাল ডেকেছিল। যমুনা সেতু নির্মিত হোক, তখন এটা তারা চায়নি। কিন্তু সেতু নির্মাণের পর বীরদর্পে উদ্বোধন করেছে। আমরা এই সেতুর প্রায় ৭০ থেকে ৮০ ভাগ কাজ শেষ করেছিলাম। অথচ সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বা আমাকে দাওয়াত পর্যন্ত করা হয়নি। আমরা সবাই চাই পদ্মা সেতু হোক। এই সেতুর জন্য আমাদের পূর্ণ সমর্থন থাকবে। তবে আমাদের আশঙ্কা, সম্পূর্ণ নিজেদের অর্থায়নে এই সেতুর নির্মাণকাজ হাতে নিলে দেশের অর্থনীতিতে ধস নামবে। এই সরকারের মেয়াদ রয়েছে বছর দেড়েক। শুধু ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেই তো কাজ শেষ হবে না।
কালের কণ্ঠ : আগামী দেড় বছরে দেশ ও দেশের মানুষের ব্যাপারে সরকারের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
অলি আহমদ : আশা নেই, আশঙ্কা আছে। দেড় বছর অনেক দীর্ঘ সময়। এই সময়ে দেশ অর্থনৈতিকভাবে আরো সমস্যায় পড়তে পারে। বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হবে। আমার ধারণা, আগামী দেড় বছরে দেশের মানুষের দুর্ভোগ আরো বাড়বে।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির গতি-প্রকৃতি কী হওয়া উচিত বলে মনে করেন আপনি?
অলি আহমদ : যেসব দেশ অতীতে এবং বর্তমানে বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে চিহ্নিত, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক আরো জোরদার করা উচিত। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, তা হচ্ছে না। দেশের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে না।
কালের কণ্ঠ : তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন- এই নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন সরব। এ ব্যাপারে আপনার মতামত জানতে চাই।
অলি আহমদ : বর্তমানে দেশ যে পর্যায়ে গেছে, এটা কারো কাম্য নয়। সর্বত্র অবিশ্বাস। বিরোধী দলকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। হয়রানি করা হচ্ছে। সরকারের মনোভাব অসহিষ্ণু। দেশের এখন যা অবস্থা তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন সম্ভব নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ আদৌ নির্বাচনে যাবে কি না, সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে।
কালের কণ্ঠ : দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করতে সংলাপের বিকল্প নেই- এমন কথা বলছেন অনেকেই। আপনার কী মত?
অলি আহমদ : সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ একান্ত প্রয়োজন। সবাইকে আস্থায় এনে সরকারকেই সংলাপের উদ্যোগ নিতে হবে।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দলের লাগাতার সংসদ বর্জনকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন আপনি?
অলি আহমদ : না, বিরোধী দল লাগাতার সংসদ বর্জন করেনি। ১৯৯১ সালের পর আওয়ামী লীগই দেশে প্রথম এই সংস্কৃতি চালু করেছিল।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশকে আগামীতে কী অবস্থায় দেখতে চান? আপনার স্বপ্নের বাংলাদেশের কথা বলুন।
অলি আহমদ : ইনশা আল্লাহ, আগামীতে বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে একটি শক্তিশালী আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশে কোনো কিছুর অভাব নেই। শুধু প্রয়োজন দৃঢ়চেতা মনোভাব ও সৎ নেতৃত্ব- যোগ্য নেতাদের যথাস্থানে পদায়ন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে পারলে এই দেশ বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
অলি আহমদ : আপনাদেরও ধন্যবাদ।
No comments