রঙের বাড়ৈ by রোমেন রায়হান

এমন ভয়াবহ দৃশ্যের সময় বন্ধুর নাক ডাকা নাসিকা গর্জনের চূড়ান্ত রূপ নিল। এবার আর দু-একজন নয়, বড় সংখ্যার লোকজন চরম অবিশ্বাস আর বিরক্তি নিয়ে তাঁদের দিকে তাকানো শুরু করায় হুমায়ূন আহমেদ বুঝলেন, আর বসে থাকা নিরাপদ নয়


‘হুমায়ূন আহমেদ আবার কোনো লেখক নাকি!’—এই অস্বীকারের ভেতর হয়তো এক ধরনের স্মার্টনেস আছে। আফসোস! এই স্মার্টনেসের ছিটেফোঁটাও আমার ভেতরে নেই।
জি, আমি বরাবরের মতোই হুমায়ূনগ্রস্ত। আমার পাঠাভ্যাসের বিশাল অংশজুড়ে তাই হুমায়ূন আহমেদ। খ্যাতিমান তিন ভাইয়ের প্রতিই আমার সীমাহীন মুগ্ধতা থাকলেও এর প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন। উন্মাদ-এ লেখালেখি এবং উন্মাদ অফিসে নিয়মিত আড্ডার কারণেই কনিষ্ঠ ভাই উন্মাদ সম্পাদক আহসান হাবিবের সঙ্গেই আমার ঘনিষ্ঠতা ও সখ্য। উন্মাদ-এর পাতায় ‘এলেবেলে’ পড়েই রসিক হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার ব্যাপক পরিচয়। বইয়ে উল্লেখ নেই—এমন অসংখ্য হাস্যরসাত্মক নিত্য ঘটনা জানার বাড়তি সুযোগ পাওয়া গেছে উন্মাদ-এর অফিস-আড্ডার সুবাদে। সূত্র আহসান হাবিব। সেসব গল্প শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তে পড়তে আমার ভেতরে ঈর্ষা জেগেছে, বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে, এই পরিবারকে ঘিরেই মজার ঘটনা ঘটবে—এমনটাই বোধহয় স্থির হয়ে আছে।
দীর্ঘদিন আহসান হাবিবের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও হুমায়ূন আহমেদের আড্ডায় থাকার প্রথম ডাক এল অনেক পরে। হুমায়ূন আহমেদ বিটিভির জন্য ঈদের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান বানাবেন। ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের আইডিয়াবাজ হিসেবে উন্মাদ-এর সম্পাদক আহসান ভাই আর নির্বাহী সম্পাদক আমি যথাসময়ে চ্যানেল আইয়ের সিদ্ধেশ্বরী অফিসে হাজির।
ময়মনসিংহের আঞ্চলিকতা দোষে দুষ্ট কথার টানে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বসে থাকা একজন মানুষ কীভাবে আড্ডার মধ্যমণি হয়ে ওঠেন, তা দেখার সুযোগ হলো এই প্রথম। হুমায়ূন আহমেদ যে আড্ডায় থাকবেন, সেখানে তিনিই হবেন বক্তা, আর বাকিরা মুগ্ধ শ্রোতা—এটাই যেন নিয়তি।
হুমায়ূন আহমেদ কিছুদিন আগেই বইমেলা উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। সেই গল্পই শোনাচ্ছেন—
প্লেনে লম্বা ভ্রমণ করে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেছেন। নেমেই শুনলেন প্রেক্ষাগৃহে টাইটানিক দেখানো হচ্ছে। ভাবলেন, বড় পর্দায় এমন আলোচিত ও বিখ্যাত ছবি দেখার সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। বন্ধুসহ গেলেন সিনেমা দেখতে। জেটল্যাগের কারণেই হয়তো অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে বন্ধুটি ঘুমিয়ে পড়লেন, সঙ্গে মৃদু নাক ডাকা। আশপাশ থেকে দু-একজন বিরক্তি নিয়ে তাঁদের দিকে তাকাচ্ছে। হুমায়ূন আহমেদ হালকা কাঁধ ঝাঁকিয়ে হেসে ‘ব্যাপার না’-জাতীয় একটা ভাব করে পার করার চেষ্টা করলেন। আইসবার্গের সঙ্গে ধাক্কা লেগে টাইটানিক ভেঙে পড়ছে—এমন ভয়াবহ দৃশ্যের সময় বন্ধুর নাক ডাকা নাসিকা গর্জনের চূড়ান্ত রূপ নিল। এবার আর দু-একজন নয়, বড় সংখ্যার লোকজন চরম অবিশ্বাস আর বিরক্তি নিয়ে তাঁদের দিকে তাকানো শুরু করায় হুমায়ূন আহমেদ বুঝলেন, আর বসে থাকা নিরাপদ নয় এবং বাকি অংশ ডিভিডিতেই দেখতে হবে। বন্ধুকে জোর ধাক্কা দিয়ে জাগালেন। আসন থেকে উঠে ‘স্যরি, এক্সকিউজ মি’ বলে বের হয়ে যাচ্ছেন। তখন বিশালবপু, মারদাঙ্গা চেহারার এক আমেরিকান নারী জিজ্ঞেস করল, ‘হোয়ার আর ইউ ফ্রম?’ হুমায়ূন আহমেদ ভাবলেন, এই নারী নির্ঘাত সারা জীবন বাংলাদেশিদের শিল্পরসবোধ নিয়ে লোকজনকে উপহাসের গল্প শোনাবে। চট করে ‘উই আর ফ্রম...’ অন্য একটি দেশের নাম বলে হাঁটা দিলেন। একের পর এক গল্প বলছেন। আমি বুঁদ হয়ে ভাবছি, হালকা রসিকতার ভেতরেও এমন দেশাত্মবোধের মিশেল হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া আর কে দিতে পারেন!
হুমায়ূন আহমেদ টিভি ম্যাগাজিন বানিয়েছিলেন এই একটিই। নাম ‘রঙের বাড়ৈ’।
হুমায়ূন আহমেদ তাঁর গল্প, উপন্যাস, নাটক ও চলচ্চিত্রের মতো এতেও সফল। ম্যাগাজিন তৈরির বিভিন্ন ধাপে তাঁর সঙ্গে বারবার দেখা হয়েছে, আড্ডা হয়েছে। আড্ডা হয়েছে মানে মুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা ও গল্প শুনেছি। বাংলা সাহিত্যের সুরসিক এমন একজন লেখক পেতে আমাদের কত শত বছর অপেক্ষা করতে হবে, কে জানে!

No comments

Powered by Blogger.