সম্ভাবনার সীমানা শুধু আকাশ by এম আবদুল হাফিজ
একটি ইতিবাচক ধারণা পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে। কখনও কি শুনেছেন যে, একজন মরক্কোবাসী আরব মহিলা ফাতিমা-আল-ফিহরি বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন অথবা একজন ইরাকি বিজ্ঞানী আল হাইথাম এক হাজার বছরের অধিক আগে ক্যামেরা যন্ত্রের ব্লুপ্রিন্ট দিয়েছিলেন।
তিনি ঙঢ়ঃরপং সম্পর্কিত কিছু বই রচনা করেছিলেন, যার পথ ধরে শেষ পর্যন্ত ক্যামেরা আবিষ্কৃত হয়। আমরা আজ আকাশ ভ্রমণের যে সুবিধা এবং গতিবেগ উপভোগ করি, ঘুণাক্ষরেও জানি না যে, কর্ডোভার জনৈক আব্বাস বিন ফিরনাস আকাশ যান আবিষ্কারের অগ্রপথিক ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের রাইটস ভ্রাতৃদ্বয় যখন আরও উন্নত এবং অগ্রসর পন্থায় আকাশ ছুঁয়ে উদ্যোগী আব্বাসের প্রচেষ্টাকে দেখতে হবে তারও হাজার বছর আগেকার একটি উদ্যোগ হিসেবে।
আজকাল নিউইয়র্কে নাকি অভিনব এবং অভূতপূর্ব প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে, যাতে শত শত এমন সব অগ্রপথিককে তুলে ধরা হয়েছে। আনন্দের কথা এই যে, এতে আল ফিরনাস থেকে ইবনে সিনা প্রমুখ পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। একই প্রকার প্রদর্শনী ইতিপূর্বে লন্ডন ও ইস্তাম্বুলে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুনেছি লন্ডন ও ইস্তাম্বুল প্রদর্শনীতে অন্তত ৮ লাখ দর্শনার্থীর কাছে একটি ঐন্দ্রজালিক সহস্রাব্দ যা নাকি পৃথিবীকে বদলে দিয়েছিল তা তুলে ধরা হয়। পাঁচশ' বছর আগে গ্যালিলিওর আবিষ্কার যে পৃথিবী গোলাকৃতির এবং এই আবিষ্কারের জন্য চার্চ তাকে কঠিন শাস্তিও দিয়েছিল। তারও অনেক আগে মুসলিম বিজ্ঞানীরা এই তথ্য মানবজাতিকে উপহার দিয়েছিল।
বিশ্বাসের সাম্রাজ্য যা এক সময় স্পেন থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে চীন পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছিল সেই সাম্রাজ্য জুড়ে সর্বক্ষণ নতুন চিন্তার অঙ্কুরোদ্গম হতো, এমন হওয়াকে উৎসাহিতও করা হতো। জ্ঞানের জন্য এ সর্বগ্রাসী ক্ষুধা আরব মুসলিমদের ক্ষমতা, সমৃদ্ধি এর বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের চূড়ায় নিয়েছিল। একটি শক্তির অবস্থান থেকেই তারা বুদ্ধিবৃত্তির লড়াই করেছিল এবং চিন্তা ও মতাদর্শের জগতে নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। সমকালীন বিশ্বের সর্বোত্তমের দিকেই তাদের দৃষ্টি নিক্ষেপিত হতো এবং সেটাকেই তারা আলিঙ্গনাবদ্ধ করত। এভাবেই তারা ভারত থেকে গণিত শাস্ত্র এবং গ্রিস থেকে গ্রিক দর্শন আহরণ করেছিল এবং সেগুলোকে অবশিষ্ট পৃথিবীতে হস্তান্তর করত। সত্যি কথা বলতে কি, পাশ্চাত্য সভ্যতাগত পাঁচ শতকে যে অগ্রগতি করেছে আরবদের সেখানে এক বিশেষ অবদান রয়েছে।
আরবদের মধ্যে সবসময়ই একটি সর্বোৎকৃষ্টতা অর্জনের প্রবণতা ছিল। তাদের দিগ্গি্বজয়ের অন্যতম কারণই ছিল বিজিত ভূখণ্ড থেকে শেখার একটি প্রবল আকুলতা। ইউরোপে অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজ স্থাপিত হওয়ার আগে মুসলিম অধিকৃত ভূখণ্ডগুলোই ছিল সমমানে বিশ্ববিদ্যালয় ও লাইব্রেরির আবাস। মোঙ্গল বাহিনীর মধ্যপ্রাচ্য অভিযানের সময় তারা বাগদাদ, দামেস্ক এবং আলেকজান্দ্রিয়ার মতো ক্ষমতা ও শিক্ষাকেন্দ্রগুলোকে ধ্বংস করেছিল।
এই যদি আরবদের অতীত হয়ে থাকে তাহলে কীভাবে আমরা তাদের বর্তমান স্থবিরতাকে ব্যাখ্যা করব, জ্ঞান বিকাশের বিপ্লবে তারা কেন এখন আর শরিক নয়? একটি সভ্যতার ধারক হিসেবে তাদের সব শক্তি কি নিঃশেষিত? এটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয় যে, আরবরা যখন জ্ঞানের নতুন দিগন্ত অনুসন্ধান থেকে বিরত হয়েছে, তাদের এক সহস্রাব্দের সব অর্জন হাতছাড়া হতে শুরু হয়েছে। তদবধি আরবরা ইবনে রুশদ বা ইবনে সিনার সমকক্ষ ওই মাপের মনীষী আর সৃষ্টি করতে পারেনি। আজ সমগ্র আরব বিশ্বে যে ক'টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য বা ভারতের একটি প্রদেশে সেই সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। আমরা আজ উদ্দেশ্যহীন আত্মপ্রতারণায় ভুগি এবং অযথা বিতর্কে সময়ক্ষেপণ করি; কিন্তু কোনো গঠনমূলক এবং ইতিবাচক আলোচনার প্রবৃত্ত হই না, যাতে করে আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক বনবাস থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। এমন এক সময় ছিল যখন প্রায় সব আরব দেশই হতদরিদ্র এবং প্রাকৃতিক সম্পদ বঞ্চিত ছিল। অথচ তখন সেই মরুতেই ফুল ফুটেছিল। আমাদের এখন সুসময় সন্ধান করি পরশ্রীকাতরতার বা পরস্পরের প্রতি কটাক্ষবাণ নিক্ষেপে। কিন্তু জ্ঞান বা বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশে আমাদের আগ্রহ সামান্যই। কিন্তু বিশ্ব সে সময় এখন পার করছে তা চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির উৎকর্ষে। এর কোনো বিকল্প নেই এবং এর থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখে কেউ অতীতনির্ভর হয়ে সামনে এগোতে পারবে না। তবে আরব বিশ্বে আজও কিন্তু প্রতিভার অভাব নেই। তারা কি এখনও পাশ্চাত্যের উচ্ছিষ্টলোভী থাকবে, না তাদের মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ অবস্থানে থাকতে চাইবে। আরব বিশ্ব যদি একটি ইতিবাচক চিন্তাধারাকে আঁকড়ে ধরে, কোনো সন্দেহ নেই যে তাদের সম্ভাবনার সীমানা শুধু আকাশ।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
আজকাল নিউইয়র্কে নাকি অভিনব এবং অভূতপূর্ব প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে, যাতে শত শত এমন সব অগ্রপথিককে তুলে ধরা হয়েছে। আনন্দের কথা এই যে, এতে আল ফিরনাস থেকে ইবনে সিনা প্রমুখ পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। একই প্রকার প্রদর্শনী ইতিপূর্বে লন্ডন ও ইস্তাম্বুলে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুনেছি লন্ডন ও ইস্তাম্বুল প্রদর্শনীতে অন্তত ৮ লাখ দর্শনার্থীর কাছে একটি ঐন্দ্রজালিক সহস্রাব্দ যা নাকি পৃথিবীকে বদলে দিয়েছিল তা তুলে ধরা হয়। পাঁচশ' বছর আগে গ্যালিলিওর আবিষ্কার যে পৃথিবী গোলাকৃতির এবং এই আবিষ্কারের জন্য চার্চ তাকে কঠিন শাস্তিও দিয়েছিল। তারও অনেক আগে মুসলিম বিজ্ঞানীরা এই তথ্য মানবজাতিকে উপহার দিয়েছিল।
বিশ্বাসের সাম্রাজ্য যা এক সময় স্পেন থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে চীন পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছিল সেই সাম্রাজ্য জুড়ে সর্বক্ষণ নতুন চিন্তার অঙ্কুরোদ্গম হতো, এমন হওয়াকে উৎসাহিতও করা হতো। জ্ঞানের জন্য এ সর্বগ্রাসী ক্ষুধা আরব মুসলিমদের ক্ষমতা, সমৃদ্ধি এর বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের চূড়ায় নিয়েছিল। একটি শক্তির অবস্থান থেকেই তারা বুদ্ধিবৃত্তির লড়াই করেছিল এবং চিন্তা ও মতাদর্শের জগতে নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। সমকালীন বিশ্বের সর্বোত্তমের দিকেই তাদের দৃষ্টি নিক্ষেপিত হতো এবং সেটাকেই তারা আলিঙ্গনাবদ্ধ করত। এভাবেই তারা ভারত থেকে গণিত শাস্ত্র এবং গ্রিস থেকে গ্রিক দর্শন আহরণ করেছিল এবং সেগুলোকে অবশিষ্ট পৃথিবীতে হস্তান্তর করত। সত্যি কথা বলতে কি, পাশ্চাত্য সভ্যতাগত পাঁচ শতকে যে অগ্রগতি করেছে আরবদের সেখানে এক বিশেষ অবদান রয়েছে।
আরবদের মধ্যে সবসময়ই একটি সর্বোৎকৃষ্টতা অর্জনের প্রবণতা ছিল। তাদের দিগ্গি্বজয়ের অন্যতম কারণই ছিল বিজিত ভূখণ্ড থেকে শেখার একটি প্রবল আকুলতা। ইউরোপে অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজ স্থাপিত হওয়ার আগে মুসলিম অধিকৃত ভূখণ্ডগুলোই ছিল সমমানে বিশ্ববিদ্যালয় ও লাইব্রেরির আবাস। মোঙ্গল বাহিনীর মধ্যপ্রাচ্য অভিযানের সময় তারা বাগদাদ, দামেস্ক এবং আলেকজান্দ্রিয়ার মতো ক্ষমতা ও শিক্ষাকেন্দ্রগুলোকে ধ্বংস করেছিল।
এই যদি আরবদের অতীত হয়ে থাকে তাহলে কীভাবে আমরা তাদের বর্তমান স্থবিরতাকে ব্যাখ্যা করব, জ্ঞান বিকাশের বিপ্লবে তারা কেন এখন আর শরিক নয়? একটি সভ্যতার ধারক হিসেবে তাদের সব শক্তি কি নিঃশেষিত? এটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয় যে, আরবরা যখন জ্ঞানের নতুন দিগন্ত অনুসন্ধান থেকে বিরত হয়েছে, তাদের এক সহস্রাব্দের সব অর্জন হাতছাড়া হতে শুরু হয়েছে। তদবধি আরবরা ইবনে রুশদ বা ইবনে সিনার সমকক্ষ ওই মাপের মনীষী আর সৃষ্টি করতে পারেনি। আজ সমগ্র আরব বিশ্বে যে ক'টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য বা ভারতের একটি প্রদেশে সেই সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। আমরা আজ উদ্দেশ্যহীন আত্মপ্রতারণায় ভুগি এবং অযথা বিতর্কে সময়ক্ষেপণ করি; কিন্তু কোনো গঠনমূলক এবং ইতিবাচক আলোচনার প্রবৃত্ত হই না, যাতে করে আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক বনবাস থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। এমন এক সময় ছিল যখন প্রায় সব আরব দেশই হতদরিদ্র এবং প্রাকৃতিক সম্পদ বঞ্চিত ছিল। অথচ তখন সেই মরুতেই ফুল ফুটেছিল। আমাদের এখন সুসময় সন্ধান করি পরশ্রীকাতরতার বা পরস্পরের প্রতি কটাক্ষবাণ নিক্ষেপে। কিন্তু জ্ঞান বা বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশে আমাদের আগ্রহ সামান্যই। কিন্তু বিশ্ব সে সময় এখন পার করছে তা চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির উৎকর্ষে। এর কোনো বিকল্প নেই এবং এর থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখে কেউ অতীতনির্ভর হয়ে সামনে এগোতে পারবে না। তবে আরব বিশ্বে আজও কিন্তু প্রতিভার অভাব নেই। তারা কি এখনও পাশ্চাত্যের উচ্ছিষ্টলোভী থাকবে, না তাদের মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ অবস্থানে থাকতে চাইবে। আরব বিশ্ব যদি একটি ইতিবাচক চিন্তাধারাকে আঁকড়ে ধরে, কোনো সন্দেহ নেই যে তাদের সম্ভাবনার সীমানা শুধু আকাশ।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
No comments