উপাচার্য হওয়ার আন্দোলন? নাকি ন্যায্য কোন আন্দোলন? by মুনতাসীর মামুন
দেশে এখন আন্দোলন করছে বিএনপি এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। না, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের। তেমনি ১৮ দলীয় জোট থাকলেও আন্দোলন করছে বিএনপি, আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে গর্জন সিং ওরফে মির্জা ফখরুল। বাংলাদেশের মানুষের মানসিকতার প্রধান বৈশিষ্ট্য নৈরাজ্য।
সুতরাং বাংলাদেশে আন্দোলনমুখী পরিস্থিতি সবসময় বিরাজ করবে। তবে, সংসদীয় ব্যবস্থার ব্যাপারে সারাদেশের মানুষ কম-বেশি ঐকমত্যে পৌঁছেছে। ফলে, কে সংসদে যাবে কী যাবে না সেটি আর এখন মূল বিষয় নয়, সংসদ থাকবে এবং সংসদের কাজ করে যাবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে যে সংসদ বয়কট করবে তারই ক্ষতি হবে বেশি। তবে, সংসদে ৩০ কি ৫০ দিন [মারাত্মক অসুখ বা অন্য কোন গুরুতর কারণ ব্যতীত] অনুপস্থিত থাকলে সংসদ পদ বাতিলের একটি আইন করা উচিত। কারণ, তিনি তখন আর তার নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধিত্ব করেন না। শুধু তাই নয়, উপস্থিতির ভিত্তিতেই তার সুযোগ-সুবিধা নির্ধারিত হওয়া উচিত। দেশের সব মানুষের এক ধরনের দায়বদ্ধতা থাকবে আর তাদের থাকবে না, এটি হতে পারে না। আর সংসদ একটানা বর্জন করে জনগণের কথা বলবে এটিও একধরনের সংসদ বিরোধিতা, যে প্রসঙ্গে এ কথা এলো, তা’ হলো, নির্বাচিত সংসদ ও সরকার পাঁচ বছর থাকবেই। এর আগে পতন হবে না। এটি এক ধরনের স্বস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছে দেশে। অর্থাৎ, যে যত আন্দোলনই করুন না কেন, নির্বাচিত সরকার তার মেয়াদ পূরণ করবেই। সেদিক থেকে এ ধরনের আন্দোলন এক ধরনের অর্থের আর সময়ের অপচয়। তবে, সরকার খুনী আচরণ করলে আন্দোলন ন্যায্যতা পায় যেমনটি পেয়েছিল ২০০১-০৬ সালে বিএনপি-জামায়াতের খুনী সময়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন সবসময় হয়েছে এবং আন্দোলন হলেই তা ‘ষড়যন্ত্রের নীলনক্সা’ বলে দেখার কোন কারণ নেই। হ্যাঁ, এ কথা বলা চলে, ষাট-সত্তর দশকে শিক্ষকরা যখন আন্দোলন করেছেন, তখন তার মধ্যে রাজনৈতিক দাবি ছিল, নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দাবিও ছিল। আশির দশকের পর থেকে ধীরে ধীরে দলীয়করণ শুরু হয়, তবে সেটি তেমন চোখে পড়ার মতো ছিল না। এরপর থেকে যা হচ্ছে, তাকে বলা যায় ভোটার নিয়োগ। যে পক্ষই ক্ষমতায় আসেন সে পক্ষেরই বড় কাজ হয়ে দাঁড়ায় ভোটার নিয়োগ, এছাড়া আর তার উপায় থাকে না। এ প্রক্রিয়ায়, রাজনৈতিক দাবি মূলত গণতন্ত্র বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে নয়, হয়ে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ বা বিএনপির বিরুদ্ধে দাবি এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের দাবি।
আমি গত চার দশক দেশের সবচেয়ে বড় এবং রাজনীতিমনস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত। তরুণ বয়সে ‘দল’ রাজনীতি করেছি প্রবলভাবে, গত এক দশক এসব কিছু থেকে সরে এসেছি। এখন ক্লাস নেয়া ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই না। এর একটি কারণ, আমার মনে হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিকরণ অতিমাত্রায় হয়েছে, এখন কোন সিদ্ধান্ত দলীয় দৃষ্টিকোণ ছাড়া নেয়া অসম্ভব। শিক্ষকদের দায়িত্ববোধ হ্রাস পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশসমূহ অপব্যবহার করা হচ্ছে। এসবের জন্য আমরাই দায়ী। সরকার আমাদের এসব কাজ করতে বলেনি। আমরাই করছি। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমার মনে হয়েছে এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে আন্দোলন চলছে তা’ হলো ভিসি বা উপাচার্য হওয়ার আন্দোলন। আর এক্ষেত্রে আবার সরকার দায়ী।
প্রথমে নিজেদের কথা একটু বলে নিই। আমরা পদাধিকার বলে বুদ্ধিজীবী সুতরাং দায়দায়িত্বহীনভাবে আমরা বিভিন্ন বক্তব্য দিই এবং কাজ করি। আমরা মনে করি এটি আমাদের অধিকার। আমাদের অধিকাংশের জগৎ খুব ছোট। বিশ্ববিদ্যালয়টিকেই আমরা বাংলাদেশ মনে করি। যেহেতু আমাদের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়, বিপরীতে সরকারের সঙ্গে যোগ থাকলে আর্থিক ও অন্যান্য অবস্থার সুযোগ থাকে সে জন্য আমাদের উচ্চাকাক্সক্ষা থাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ভিসি বা কোন সংস্থার প্রধানের পদ পাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষেত্রে হাউস টিউটর, প্রভোস্ট বা প্রক্টর হওয়া। মনের দীনতা দিন দিন বাড়ছেই। এছাড়া নতুন আরেকটি ধারা লক্ষণীয়, তা’হলো, আঞ্চলিকতা। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ছাড়া অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা কাউকে নিয়োগ দিতে আগ্রহী নয়। এর ফলে এক ধরনের ইনসুলার অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। সে জন্যই বলছিলাম অধিকাংশ আন্দোলন ভিসি হওয়ার আন্দোলন।
প্রথমেই বিচার্য ভিসি পদে কারা নিয়োগ পাচ্ছেন। গত প্রায় দু’দশক ধরে দেখা যাচ্ছে, শাসক বদল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে বদল হয়। অধ্যাদেশগুলোতে একটি ধারা আছে, যার জোরে যাকে যখন খুশি অপসারণ করা যায়। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মী প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হলে একটু অসুবিধা হতে পারে। লক্ষণীয় ভিসি বদলের সুযোগ করে দেন অনির্বাচিত নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যরা। সরকার বদলের আগেই চেষ্টা তদ্বির শুরু হয়। নতুন সরকার এলেই প্রথম যে কটি কাজ করেন তার একটি হলো ভিসি বদল। এবং প্রায় ক্ষেত্রেই সরকার এমন সব অধ্যাপককে নিয়োগ দেন যাদের প্রায় পরিচিতি নেই ক্যাম্পাস ছাড়া, বা পরিচিতিই নেই, যারা পার্টি লাইনের বাইরে কথা বলবেন না এবং শিক্ষামন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর বশংবদ হবেন। গত দু’দশকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাদের নিয়োগ করা হয়েছে তাদের এ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে তেমন জোর ছিল না। কিন্তু তদ্বিরের জোর ছিল। ফলে, এরা এ্যাকাডেমিক জগতে তেমন সমীহ পান না। তাই নিয়োগ পাওয়ার পর তারা বিশ্ববিদ্যালয় বিধি অনুযায়ী নির্বাচনী প্রক্রিয়ার দিকে যান না। সরকারী জোরে থাকতে চান। এ প্রক্রিয়ায় তারা সরকারী ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে ‘সমঝোতা’ করে চলতে চান। যখনই কেউ ছাত্র সংগঠনের ওপর নির্ভর করে তখনই তিনি জিম্মি হয়ে যান। কারণ, এখনকার ছাত্র সংগঠনগুলো মূলত ব্যবসায়ী সংগঠন। আদর্শবাদ অনেক আগেই লুপ্ত।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা ধরুন। ছাত্র হত্যা থেকে বোধহয় আন্দোলনের উদ্ভব, তারপর তা দাঁড়াল ভিসি বদলের আন্দোলনে। আন্দোলনকারীদের সংখ্যা সীমিত এবং পত্রপত্রিকায় লেখা হয়েছে তারা বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষক। আওয়ামী লীগের একাংশও নাকি এর সঙ্গে যুক্ত। আওয়ামীপন্থী কেউ জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলন করবে এটি খানিকটা বিস্ময়কর। তবে তা হতে পারে যদি উপাচার্য এমন কিছু করেন যা সামাজিক বা রাজনৈতিকভাবে মানা সম্ভব নয়। কিন্তু অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির তেমন কিছু করেছেন বলে জানি না। অধ্যাপক আবদুল মান্নান জনকণ্ঠে প্রকাশিত তাঁর নিবন্ধেও এই ধরনের বক্তব্য রেখেছেন, স্বদেশ রায়ের প্রকাশিত নিবন্ধটির বক্তব্যও প্রায় একই রকম।
লক্ষণীয় যারা আন্দোলনকারীদের বিরোধী তারা তেমন উচ্চকণ্ঠও ছিলেন না, সমাবেশও করেননি। আবদুল মান্নান লিখেছেন, ‘একজন শিক্ষক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন তখন প্রায় সময় তাদের কেউ কেউ মনে করেন [যারা বেশি দলবাজি করেন] আসলে তাদেরই একজন উপাচার্য হওয়া উচিত ছিল। সুতরাং সরকারের ভুল শোধরানোর জন্য আন্দোলন ছাড়া কী করার আছে? জাহাঙ্গীরনগরেও কিছু অন্তিমে ভিসি নির্বাচনই মুখ্য হয়ে উঠল।
বুয়েটে ভেবেছিলাম শিক্ষকরা গণ-পদত্যাগ করবেন। কারণ তারা যেভাবে আন্দোলনমুখী তাতে সে ধারণা হওয়া স্বাভাবিক। করলেন না। হয়ত আশঙ্কা করছিলেন সরকার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে ফেলবে। এতে প্রমাণিত হচ্ছে, তাদের মূল আন্দোলন উপাচার্য সরানো। কিন্তু, কোন উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে হবে সেই দাবিগুলো স্পষ্ট করা হয়নি। ছাত্ররাও শিক্ষকদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। কিন্তু, তাতে লাভ কী? বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকবে, তাদেরই ক্ষতি হবে, শিক্ষকদের নয়। তারা যোগ্য, কনসালট্যান্সি করবেন, বিদেশ চলে যাবেন। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে কথায় কথায় সবাই এমনভাবে বিবেচনা করেন যে এটি না থাকলে বাংলাদেশের সমূহ বিপদ। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই একটি শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। কিন্তু, বাংলাদেশের সমাজে অর্থশালী বলতে সবসময় প্রকৌশলীদেরই বোঝায়। পুলিশ, কাস্টমস অফিসারদের মতোই তাদের সুনাম। এ রকম একটি বিদ্যাপীঠ থেকে কেন শুধু এ রকম পেশাজীবীই হবেন।’ মানুষ তাই অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষকদের দাবি বা আন্দোলনকে যতটা গুরুত্ব দেয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে ততটা গুরুত্ব দেয় না। সরকার গুরুত্ব দিতে চাইলে অবশ্যই ভিসি বদল করে দিতে পারে। কিন্তু পরবর্তী ভিসির চেহারাও তো পছন্দসই না হতে পারে। আর যদি বিপাকে সরকার পড়ে থাকে তা’হলে তার কারণ তারাই। তারা এমন কাউকে উপাচার্য করে কেন যিনি আগে আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে পারেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন যারা নিয়োজিত তাদের চামচামি কী পর্যায়ে গেছে দেখুন। বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর টাকা নেই তারা পদ্মা সেতুর জন্য টাকা দিচ্ছেন। কোন্ ফান্ড থেকে দিচ্ছেন? প্রধানমন্ত্রী কি চেয়েছেন? ফান্ডে টাকা দিলেই কি আরেক টার্ম নিশ্চিত হবে? যদি শিক্ষকরা স্বেচ্ছায় তাদের বেতন দিতেন সেটি গ্রহণযোগ্য ছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝামেলা শুরু হয়েছে, পদ্মা সেতু নিয়ে টাকা ওঠানো হয়েছে ইত্যাদি। তা’ছাড়া সেখানে নির্বাচন দেয়া হয়নি, চাটগাঁয়, ঢাকায়ও না। এগুলোতে ‘আন্দোলন’ হবে না কে বলল?
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হওয়ার আন্দোলন, দলীয়করণের মাত্রা ইত্যাদি হ্রাস করতে হলে কিছু পদক্ষেপ নেয়া জরুরী হয়ে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি সবসময় ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু আগে দলীয়করণ এমন ছিল না। এখন শিক্ষক সমিতি বা সিন্ডিকেটে যে দল নির্বাচিত হয় সে দল তার রাজনৈতিক নেতার মধ্যে সাক্ষাত করতে ছোটে কেন? কারণ, তারা কিছু চান। আগে এ প্রবণতা ছিল না, কেননা সরকারের কাছ থেকে কিছু পাওয়া তাদের ‘দাবি’ ছিল না। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক থেকে অধ্যাপক রেহমান সোবহান এরা বঙ্গবন্ধুর নিকটজন ছিলেন। কেউ শোনেনি তারা নিজেদের কোন কাজে বঙ্গবন্ধুর কাছে গেছেন। বঙ্গবন্ধুই তাদের ডেকে সরকারী পদ দিয়েছেন এবং ভাল না লাগায় তা তারা ছেড়েও চলে এসেছেন। বিএনপি আমলে, এক প্রো-ভিসি ভিসি হওয়ার জন্য জনাব ফালু এমপি নির্বাচিত হওয়ায় তাকে মালা দিতে গিয়ে পা ভেঙ্গে ফেলেছিলেন। এরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বোঝাস্বরূপ। সরকারের সমর্থক হলেই তাকে উপাচার্য বা কোন সংস্থার প্রধান করা হবে এ ধরনের যে ধারণা সৃষ্টি হয়েছে তা আগে ভাঙ্গা উচিত। তা’হলে অনেক জায়গার ‘আন্দোলন’ হ্রাস পাবে। তবে, সঙ্গে সঙ্গে এটিও বলা ভাল, সরকার যাদের নিয়োগ করছে এবং যারা নির্বাচিত হতে চান না তারা এমন সব কাজ করছেন, যা অন্তিমে সরকারের ক্ষতি করছে। সরকারের এ বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া দরকার। এরা যেহেতু মনে করেন প্রধানমন্ত্রীই তাদের নিয়োগকর্তা তাই তারা এমন সব আচরণ করেন যেন তিনি একজন সামন্ত রাজা। বিশ্ববিদ্যালয় আর যা হোক সামন্ত রাজা মানতে রাজি নয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সাধারণত গুরুত্ব দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার ওপর। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তাদের এক ধরনের ভয় আছে আর্মির মতো। কখন কী করে বলা যায় না। এখন সময় এসেছে উচ্চশিক্ষার জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় করা। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০০-এর ওপর। অধিকাংশের কোন নিয়মনীতি নেই। যাদের আছে তারাও তা মানতে চান না। এগুলোর নিবিড় মনিটরিং দরকার। আসলেও, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভেতরের অবস্থা তেমন ভাল নয়।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বলি, সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একই ধরনের আইন হওয়া দরকার এবং নির্বাচন প্রথা সীমিত করে দেয়া বাঞ্ছনীয় বিশেষ করে ডিন নির্বাচনের ক্ষেত্রে। সিনেট ও সিন্ডিকেটের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকা উচিত। সিনেটের কোন সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয় না। শুধু ভিসি নির্বাচন সিনেটের একমাত্র কাজ হতে পারে না। অধ্যাদেশ অনুযায়ী সাময়িক নিয়োগের বিধান হলে সে ‘সাময়িক’ কতদিনের তা নির্ধারণ করা উচিত। আর অধ্যাদেশ না থাকলে অন্য কথা। যেসব বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ দ্বারা পরিচালিত, যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ পর্যালোচনা করা উচিত। শিক্ষক নিয়োগের ও স্থায়ী করার বিধান সংস্কার করা উচিত। এখন একজন লেকচারার নিয়োগ হওয়া মাত্রই তিনি নিজেকে এমন একজন মনে করেন যার এখনই ভিসি হওয়া উচিত। তিনি কারও কথা শোনেন না, কেননা তার প্রমোশন হয় অটোমেটিক। ক্লাসরুম, গবেষণা ও প্রশাসনÑ কোন ক্ষেত্রে তার পারফর্মেন্সের বিচার হয় না। বিভাগীয় চেয়ারম্যান, এ্যাকাডেমিক কমিটি বা উন্নয়ন কমিটির পক্ষে কাজ করা মুশকিল হয়ে ওঠে। সবাই স্বাধীন, সবাই দায়হীন। হ্যাঁ, আইন দিয়ে সব করা যায় না জানি। কিন্তু, আইন না মানলে তাকে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে সে অবস্থা তো সৃষ্টি করা যেতে পারে।
এসব পরামর্শ আমার সহকর্মীদের ভাল লাগবে না কারণ বর্তমানে যে স্বার্থের জমি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে তা অভিঘাত হানবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসি হওয়ার আন্দোলন বন্ধ করতে একটা জায়গায় দাঁড়াতেই হবে। অতীতে ন্যায্য রাজনৈতিক বা সামাজিক দাবিতে যখন শিক্ষকরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করেছেন তখন এসব প্রশ্ন ওঠেনি। ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০, ২০০৮ সালের আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্ররা আন্দোলন করেছেন। সমাজ তাতে সায় দিয়েছে, এখন কেন দিচ্ছে না।’
যে কোন সরকারই আসে একটি বিষয় বিবেচনা করে দেখুন। ধরা যাক, বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টির জন্য বিরোধী দল ইন্ধন দিচ্ছে কিন্তু সেই ইন্ধন বিনাশের জন্য সরকার পক্ষ যদি নিষ্ক্রিয়ই থাকে তা’হলে শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতির প্রশ্রয় দিয়ে লাভ কী?
আজ যারা উপাচার্য বদলের আন্দোলন করছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তা যদি ন্যায্য না হয় তা’হলে ভেবে দেখা দরকার বৃহত্তর সমাজের কাছে তা গ্রহণযোগ্য কিনা। গ্রহণযোগ্যতা না থাকলে বৃহত্তর সমাজের এটি মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে, আন্দোলনকারীরা সরকারকে অপদস্থ করতে চান। শিক্ষকদের মূল কাজ কি তাই?
বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন সবসময় হয়েছে এবং আন্দোলন হলেই তা ‘ষড়যন্ত্রের নীলনক্সা’ বলে দেখার কোন কারণ নেই। হ্যাঁ, এ কথা বলা চলে, ষাট-সত্তর দশকে শিক্ষকরা যখন আন্দোলন করেছেন, তখন তার মধ্যে রাজনৈতিক দাবি ছিল, নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দাবিও ছিল। আশির দশকের পর থেকে ধীরে ধীরে দলীয়করণ শুরু হয়, তবে সেটি তেমন চোখে পড়ার মতো ছিল না। এরপর থেকে যা হচ্ছে, তাকে বলা যায় ভোটার নিয়োগ। যে পক্ষই ক্ষমতায় আসেন সে পক্ষেরই বড় কাজ হয়ে দাঁড়ায় ভোটার নিয়োগ, এছাড়া আর তার উপায় থাকে না। এ প্রক্রিয়ায়, রাজনৈতিক দাবি মূলত গণতন্ত্র বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে নয়, হয়ে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ বা বিএনপির বিরুদ্ধে দাবি এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের দাবি।
আমি গত চার দশক দেশের সবচেয়ে বড় এবং রাজনীতিমনস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত। তরুণ বয়সে ‘দল’ রাজনীতি করেছি প্রবলভাবে, গত এক দশক এসব কিছু থেকে সরে এসেছি। এখন ক্লাস নেয়া ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই না। এর একটি কারণ, আমার মনে হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিকরণ অতিমাত্রায় হয়েছে, এখন কোন সিদ্ধান্ত দলীয় দৃষ্টিকোণ ছাড়া নেয়া অসম্ভব। শিক্ষকদের দায়িত্ববোধ হ্রাস পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশসমূহ অপব্যবহার করা হচ্ছে। এসবের জন্য আমরাই দায়ী। সরকার আমাদের এসব কাজ করতে বলেনি। আমরাই করছি। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমার মনে হয়েছে এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে আন্দোলন চলছে তা’ হলো ভিসি বা উপাচার্য হওয়ার আন্দোলন। আর এক্ষেত্রে আবার সরকার দায়ী।
প্রথমে নিজেদের কথা একটু বলে নিই। আমরা পদাধিকার বলে বুদ্ধিজীবী সুতরাং দায়দায়িত্বহীনভাবে আমরা বিভিন্ন বক্তব্য দিই এবং কাজ করি। আমরা মনে করি এটি আমাদের অধিকার। আমাদের অধিকাংশের জগৎ খুব ছোট। বিশ্ববিদ্যালয়টিকেই আমরা বাংলাদেশ মনে করি। যেহেতু আমাদের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়, বিপরীতে সরকারের সঙ্গে যোগ থাকলে আর্থিক ও অন্যান্য অবস্থার সুযোগ থাকে সে জন্য আমাদের উচ্চাকাক্সক্ষা থাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ভিসি বা কোন সংস্থার প্রধানের পদ পাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষেত্রে হাউস টিউটর, প্রভোস্ট বা প্রক্টর হওয়া। মনের দীনতা দিন দিন বাড়ছেই। এছাড়া নতুন আরেকটি ধারা লক্ষণীয়, তা’হলো, আঞ্চলিকতা। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ছাড়া অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা কাউকে নিয়োগ দিতে আগ্রহী নয়। এর ফলে এক ধরনের ইনসুলার অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। সে জন্যই বলছিলাম অধিকাংশ আন্দোলন ভিসি হওয়ার আন্দোলন।
প্রথমেই বিচার্য ভিসি পদে কারা নিয়োগ পাচ্ছেন। গত প্রায় দু’দশক ধরে দেখা যাচ্ছে, শাসক বদল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে বদল হয়। অধ্যাদেশগুলোতে একটি ধারা আছে, যার জোরে যাকে যখন খুশি অপসারণ করা যায়। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মী প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হলে একটু অসুবিধা হতে পারে। লক্ষণীয় ভিসি বদলের সুযোগ করে দেন অনির্বাচিত নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যরা। সরকার বদলের আগেই চেষ্টা তদ্বির শুরু হয়। নতুন সরকার এলেই প্রথম যে কটি কাজ করেন তার একটি হলো ভিসি বদল। এবং প্রায় ক্ষেত্রেই সরকার এমন সব অধ্যাপককে নিয়োগ দেন যাদের প্রায় পরিচিতি নেই ক্যাম্পাস ছাড়া, বা পরিচিতিই নেই, যারা পার্টি লাইনের বাইরে কথা বলবেন না এবং শিক্ষামন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর বশংবদ হবেন। গত দু’দশকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাদের নিয়োগ করা হয়েছে তাদের এ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে তেমন জোর ছিল না। কিন্তু তদ্বিরের জোর ছিল। ফলে, এরা এ্যাকাডেমিক জগতে তেমন সমীহ পান না। তাই নিয়োগ পাওয়ার পর তারা বিশ্ববিদ্যালয় বিধি অনুযায়ী নির্বাচনী প্রক্রিয়ার দিকে যান না। সরকারী জোরে থাকতে চান। এ প্রক্রিয়ায় তারা সরকারী ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে ‘সমঝোতা’ করে চলতে চান। যখনই কেউ ছাত্র সংগঠনের ওপর নির্ভর করে তখনই তিনি জিম্মি হয়ে যান। কারণ, এখনকার ছাত্র সংগঠনগুলো মূলত ব্যবসায়ী সংগঠন। আদর্শবাদ অনেক আগেই লুপ্ত।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা ধরুন। ছাত্র হত্যা থেকে বোধহয় আন্দোলনের উদ্ভব, তারপর তা দাঁড়াল ভিসি বদলের আন্দোলনে। আন্দোলনকারীদের সংখ্যা সীমিত এবং পত্রপত্রিকায় লেখা হয়েছে তারা বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষক। আওয়ামী লীগের একাংশও নাকি এর সঙ্গে যুক্ত। আওয়ামীপন্থী কেউ জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলন করবে এটি খানিকটা বিস্ময়কর। তবে তা হতে পারে যদি উপাচার্য এমন কিছু করেন যা সামাজিক বা রাজনৈতিকভাবে মানা সম্ভব নয়। কিন্তু অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির তেমন কিছু করেছেন বলে জানি না। অধ্যাপক আবদুল মান্নান জনকণ্ঠে প্রকাশিত তাঁর নিবন্ধেও এই ধরনের বক্তব্য রেখেছেন, স্বদেশ রায়ের প্রকাশিত নিবন্ধটির বক্তব্যও প্রায় একই রকম।
লক্ষণীয় যারা আন্দোলনকারীদের বিরোধী তারা তেমন উচ্চকণ্ঠও ছিলেন না, সমাবেশও করেননি। আবদুল মান্নান লিখেছেন, ‘একজন শিক্ষক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন তখন প্রায় সময় তাদের কেউ কেউ মনে করেন [যারা বেশি দলবাজি করেন] আসলে তাদেরই একজন উপাচার্য হওয়া উচিত ছিল। সুতরাং সরকারের ভুল শোধরানোর জন্য আন্দোলন ছাড়া কী করার আছে? জাহাঙ্গীরনগরেও কিছু অন্তিমে ভিসি নির্বাচনই মুখ্য হয়ে উঠল।
বুয়েটে ভেবেছিলাম শিক্ষকরা গণ-পদত্যাগ করবেন। কারণ তারা যেভাবে আন্দোলনমুখী তাতে সে ধারণা হওয়া স্বাভাবিক। করলেন না। হয়ত আশঙ্কা করছিলেন সরকার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে ফেলবে। এতে প্রমাণিত হচ্ছে, তাদের মূল আন্দোলন উপাচার্য সরানো। কিন্তু, কোন উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে হবে সেই দাবিগুলো স্পষ্ট করা হয়নি। ছাত্ররাও শিক্ষকদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। কিন্তু, তাতে লাভ কী? বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকবে, তাদেরই ক্ষতি হবে, শিক্ষকদের নয়। তারা যোগ্য, কনসালট্যান্সি করবেন, বিদেশ চলে যাবেন। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে কথায় কথায় সবাই এমনভাবে বিবেচনা করেন যে এটি না থাকলে বাংলাদেশের সমূহ বিপদ। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই একটি শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। কিন্তু, বাংলাদেশের সমাজে অর্থশালী বলতে সবসময় প্রকৌশলীদেরই বোঝায়। পুলিশ, কাস্টমস অফিসারদের মতোই তাদের সুনাম। এ রকম একটি বিদ্যাপীঠ থেকে কেন শুধু এ রকম পেশাজীবীই হবেন।’ মানুষ তাই অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষকদের দাবি বা আন্দোলনকে যতটা গুরুত্ব দেয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে ততটা গুরুত্ব দেয় না। সরকার গুরুত্ব দিতে চাইলে অবশ্যই ভিসি বদল করে দিতে পারে। কিন্তু পরবর্তী ভিসির চেহারাও তো পছন্দসই না হতে পারে। আর যদি বিপাকে সরকার পড়ে থাকে তা’হলে তার কারণ তারাই। তারা এমন কাউকে উপাচার্য করে কেন যিনি আগে আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে পারেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন যারা নিয়োজিত তাদের চামচামি কী পর্যায়ে গেছে দেখুন। বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর টাকা নেই তারা পদ্মা সেতুর জন্য টাকা দিচ্ছেন। কোন্ ফান্ড থেকে দিচ্ছেন? প্রধানমন্ত্রী কি চেয়েছেন? ফান্ডে টাকা দিলেই কি আরেক টার্ম নিশ্চিত হবে? যদি শিক্ষকরা স্বেচ্ছায় তাদের বেতন দিতেন সেটি গ্রহণযোগ্য ছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝামেলা শুরু হয়েছে, পদ্মা সেতু নিয়ে টাকা ওঠানো হয়েছে ইত্যাদি। তা’ছাড়া সেখানে নির্বাচন দেয়া হয়নি, চাটগাঁয়, ঢাকায়ও না। এগুলোতে ‘আন্দোলন’ হবে না কে বলল?
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হওয়ার আন্দোলন, দলীয়করণের মাত্রা ইত্যাদি হ্রাস করতে হলে কিছু পদক্ষেপ নেয়া জরুরী হয়ে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি সবসময় ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু আগে দলীয়করণ এমন ছিল না। এখন শিক্ষক সমিতি বা সিন্ডিকেটে যে দল নির্বাচিত হয় সে দল তার রাজনৈতিক নেতার মধ্যে সাক্ষাত করতে ছোটে কেন? কারণ, তারা কিছু চান। আগে এ প্রবণতা ছিল না, কেননা সরকারের কাছ থেকে কিছু পাওয়া তাদের ‘দাবি’ ছিল না। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক থেকে অধ্যাপক রেহমান সোবহান এরা বঙ্গবন্ধুর নিকটজন ছিলেন। কেউ শোনেনি তারা নিজেদের কোন কাজে বঙ্গবন্ধুর কাছে গেছেন। বঙ্গবন্ধুই তাদের ডেকে সরকারী পদ দিয়েছেন এবং ভাল না লাগায় তা তারা ছেড়েও চলে এসেছেন। বিএনপি আমলে, এক প্রো-ভিসি ভিসি হওয়ার জন্য জনাব ফালু এমপি নির্বাচিত হওয়ায় তাকে মালা দিতে গিয়ে পা ভেঙ্গে ফেলেছিলেন। এরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বোঝাস্বরূপ। সরকারের সমর্থক হলেই তাকে উপাচার্য বা কোন সংস্থার প্রধান করা হবে এ ধরনের যে ধারণা সৃষ্টি হয়েছে তা আগে ভাঙ্গা উচিত। তা’হলে অনেক জায়গার ‘আন্দোলন’ হ্রাস পাবে। তবে, সঙ্গে সঙ্গে এটিও বলা ভাল, সরকার যাদের নিয়োগ করছে এবং যারা নির্বাচিত হতে চান না তারা এমন সব কাজ করছেন, যা অন্তিমে সরকারের ক্ষতি করছে। সরকারের এ বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া দরকার। এরা যেহেতু মনে করেন প্রধানমন্ত্রীই তাদের নিয়োগকর্তা তাই তারা এমন সব আচরণ করেন যেন তিনি একজন সামন্ত রাজা। বিশ্ববিদ্যালয় আর যা হোক সামন্ত রাজা মানতে রাজি নয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সাধারণত গুরুত্ব দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার ওপর। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তাদের এক ধরনের ভয় আছে আর্মির মতো। কখন কী করে বলা যায় না। এখন সময় এসেছে উচ্চশিক্ষার জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় করা। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০০-এর ওপর। অধিকাংশের কোন নিয়মনীতি নেই। যাদের আছে তারাও তা মানতে চান না। এগুলোর নিবিড় মনিটরিং দরকার। আসলেও, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভেতরের অবস্থা তেমন ভাল নয়।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বলি, সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একই ধরনের আইন হওয়া দরকার এবং নির্বাচন প্রথা সীমিত করে দেয়া বাঞ্ছনীয় বিশেষ করে ডিন নির্বাচনের ক্ষেত্রে। সিনেট ও সিন্ডিকেটের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকা উচিত। সিনেটের কোন সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয় না। শুধু ভিসি নির্বাচন সিনেটের একমাত্র কাজ হতে পারে না। অধ্যাদেশ অনুযায়ী সাময়িক নিয়োগের বিধান হলে সে ‘সাময়িক’ কতদিনের তা নির্ধারণ করা উচিত। আর অধ্যাদেশ না থাকলে অন্য কথা। যেসব বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ দ্বারা পরিচালিত, যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ পর্যালোচনা করা উচিত। শিক্ষক নিয়োগের ও স্থায়ী করার বিধান সংস্কার করা উচিত। এখন একজন লেকচারার নিয়োগ হওয়া মাত্রই তিনি নিজেকে এমন একজন মনে করেন যার এখনই ভিসি হওয়া উচিত। তিনি কারও কথা শোনেন না, কেননা তার প্রমোশন হয় অটোমেটিক। ক্লাসরুম, গবেষণা ও প্রশাসনÑ কোন ক্ষেত্রে তার পারফর্মেন্সের বিচার হয় না। বিভাগীয় চেয়ারম্যান, এ্যাকাডেমিক কমিটি বা উন্নয়ন কমিটির পক্ষে কাজ করা মুশকিল হয়ে ওঠে। সবাই স্বাধীন, সবাই দায়হীন। হ্যাঁ, আইন দিয়ে সব করা যায় না জানি। কিন্তু, আইন না মানলে তাকে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে সে অবস্থা তো সৃষ্টি করা যেতে পারে।
এসব পরামর্শ আমার সহকর্মীদের ভাল লাগবে না কারণ বর্তমানে যে স্বার্থের জমি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে তা অভিঘাত হানবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসি হওয়ার আন্দোলন বন্ধ করতে একটা জায়গায় দাঁড়াতেই হবে। অতীতে ন্যায্য রাজনৈতিক বা সামাজিক দাবিতে যখন শিক্ষকরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করেছেন তখন এসব প্রশ্ন ওঠেনি। ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০, ২০০৮ সালের আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্ররা আন্দোলন করেছেন। সমাজ তাতে সায় দিয়েছে, এখন কেন দিচ্ছে না।’
যে কোন সরকারই আসে একটি বিষয় বিবেচনা করে দেখুন। ধরা যাক, বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টির জন্য বিরোধী দল ইন্ধন দিচ্ছে কিন্তু সেই ইন্ধন বিনাশের জন্য সরকার পক্ষ যদি নিষ্ক্রিয়ই থাকে তা’হলে শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতির প্রশ্রয় দিয়ে লাভ কী?
আজ যারা উপাচার্য বদলের আন্দোলন করছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তা যদি ন্যায্য না হয় তা’হলে ভেবে দেখা দরকার বৃহত্তর সমাজের কাছে তা গ্রহণযোগ্য কিনা। গ্রহণযোগ্যতা না থাকলে বৃহত্তর সমাজের এটি মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে, আন্দোলনকারীরা সরকারকে অপদস্থ করতে চান। শিক্ষকদের মূল কাজ কি তাই?
No comments