নুহাশপল্লীর বিষণ্ন লিচুগাছগুলো by নওশাদ জামিল
'নুহাশপল্লীর গাছপালার কী খবর, ওরা কেমন আছে?' অন্য কিছু নয়, প্রথমেই তিনি খোঁজ নিতেন গাছপালার। কোন গাছে ফুল এলো, কোন গাছে ফল, কোনোটার রোগ-বালাই হলো কি না কিংবা কোথাও আগাছা জন্মাল কি না- সব খুঁটিয়ে দেখতেন তিনি।
বাংলা সাহিত্যের রাজপুত্র হুমায়ূন আহমেদ যখনই তাঁর স্বপ্নের নুহাশপল্লীতে আসতেন, গাড়ি থেকে নেমে আগে বাগানে যেতেন। দেখতেন গাছগুলোর হাল-অবস্থা। আলতো ছোঁয়ায় হাত বোলাতেন গাছের গায়ে। গাছের সঙ্গে কথাও বলতেন বিড়বিড় করে।
'বাগানে ঘুরে ঘুরে শেষে এসে থামতেন ওই লিচুতলায়। জায়গাটা ছিল স্যারের খুব প্রিয়।' কোন লিচুতলা?
নুহাশ পল্লীর ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম বুলবুল উত্তর দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। চোখ মুছতে মুছতে বলেন, 'ওই যে দেখছেন, তিনটা লিচুগাছ। ওই জায়গাটাই স্যারের খুব প্রিয় ছিল।'
ছায়াঢাকা সে জায়গাটার একপাশে তিনটি মাঝারি আকারের লিচুগাছ, অন্যপাশে সারি সারি আম, জাম, লটকনসহ নানা জাতের গাছগাছালি। নুহাশ পল্লীর মূল ফটক থেকে ২০০ গজ উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এ জায়গার নামই 'লিচুতলা'। পাশেই বেশ কয়েকটি জাম, জলপাই ও তেঁতুলগাছ। গাছগুলোর মাঝখানে একখণ্ড ফাঁকা জায়গা সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত। দক্ষিণে শেফালি, কামিনী ফুলসহ অন্যান্য গাছ। তিনটি লিচুগাছের গোড়া বাঁধানো। সেখানেই তিনি বসে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে যেতেন বাংলোয়।
নুহাশ পল্লীর ম্যানেজার জানান, এখনো তাঁর কাছে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি, হুমায়ূন আহমেদের দাফন কোথায় হবে। নুহাশ পল্লীতে, না ঢাকায়। তিনি বলেন, 'এখানে যদি দাফন করা হয় তাহলে স্যারের পছন্দের জায়গা লিচুতলাতেই দাফন হবে।'
গতকাল রবিবার সকালে সরেজমিনে নুহাশ পল্লী ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামবাসী থেকে শুরু করে নুহাশ পল্লীর কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই তাঁদের প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে এখনো গভীর শোকে মুহ্যমান।
নুহাশ পল্লীতে ১৫ বছর ধরে কাজ করছেন বৃদ্ধ নুরুল হক। তিনি বলেন, 'স্যার নুহাশ পল্লীতে এলে তাঁর সেবাযত্ন, বিছানাপত্র ঠিক করে দেওয়া, চা করে দেওয়া, খাবার এনে দেওয়ার কাজ করতাম।' নুহাশ পল্লীর কর্মচারী কামরুল বলেন, 'স্যার গাছ খুব ভালোবাসতেন। স্যার তাঁর পছন্দের গাছ সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন। এসেই আমাদের ডাকতেন। নতুন নতুন গাছ লাগাতে ও তাদের যত্ন নিতে বলতেন।'
সরেজমিনে দেখা গেছে, নুহাশ পল্লীজুড়ে বিরাজ করছে শোকের ছায়া। যার কাছেই হুমায়ূন আহমেদের কথা জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, তিনিই কেঁদে ফেলছেন।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে হোতাপাড়া বাজার। বাজার থেকে পশ্চিমে আট কিলোমিটার দূরে পিরুজালী গ্রাম। ১৯৯৭ সালে পিরুজালীতে ৪০ বিঘা জমিতে বড় ছেলে নুহাশের নামে 'নুহাশ পল্লী' গড়ে তোলেন হুমায়ূন আহমেদ। এখানে তিনি দুর্লভ আড়াই শ প্রজাতির বৃক্ষ ও গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ লাগিয়েছেন। গাছ ছাড়াও হাঁস, রাজহাঁস, গরু, কবুতরসহ বিভিন্ন প্রাণী এখানে রয়েছে। এই নুহাশ পল্লীতেই হুমায়ূন আহমেদ গড়ে তুলেছেন শুটিং স্পট, দিঘি, তিনটি সুদৃশ্য বাংলো আর অনেক ভাস্কর্য। দিঘিটি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী শাওনের গর্ভে মৃত কন্যা লীলাবতির নামে। বিশাল দিঘির ওপর রয়েছে একটি কাঠের সেতু। দিঘির মাঝখানে ছোট্ট দ্বীপ।
নুহাশ পল্লীতে রয়েছে বিশাল এক ঔষধি গাছের বাগান। সেটির নামকরণ করেছেন প্রথম স্ত্রী গুলতেকিনের গর্ভে জন্ম নেওয়া প্রয়াত শিশুপুত্র রাশেদ হুমায়ূনের নামে। তিনটি বাংলোর একটির নাম 'বৃষ্টিবিলাস'। ওপরে টিনের চাল। বৃষ্টির দিনে এখানে তিনি শুনতেন বৃষ্টির নূপুর। দিঘির পশ্চিম পাড়ে একটি বাংলোর নাম 'ভূতবিলাস'। অন্য বাংলোটিতে থাকতেন তিনি। সেটি কর্মচারীদের কাছে স্যারের বাংলো নামে পরিচিত।
সবুজ নিসর্গ, পাখপাখালি আর নুহাশ পল্লীর কর্মচারীরা এখন অভিভাবকহীন। শোকে ম্রিয়মাণ সব। মনে হয় প্রাণহীন দাঁড়িয়ে থাকা একের পর এক পাথরের ভাস্কর্য মা ও শিশু, রাক্ষস, ডাইনোসর, শালিক, মৎস্যকন্যা- সবার মধ্যে ছড়িয়ে গেছে থমথমে শোক।
বিকেলে ঢাকায় ফেরার পথে শুরু হয় অঝোর বৃষ্টি। অগ্যতা আরো কিছুক্ষণ থাকতে হয় সেখানে। আমরা একদৌড়ে ঢুকি বৃষ্টিবিলাসে। টিনের চালে ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে বৃষ্টির নাচন। বৃষ্টি থামলে আমরা যখন বের হই, তখন গাছপালা, ঘন শালবনের পাতা চুইয়ে চুইয়ে পড়ছিল বৃষ্টির কণা। নুহাশ পল্লীর মূল ফটকের দিকে আসার পথেই পড়ে লিচুগাছ। সরু সরু লিচুপাতা থেকে টুপটাপ পড়ছিল বৃষ্টিফোঁটা। মনে হচ্ছিল, যেন কাঁদছে ওই তিনটি নির্বাক লিচুগাছ!
'বাগানে ঘুরে ঘুরে শেষে এসে থামতেন ওই লিচুতলায়। জায়গাটা ছিল স্যারের খুব প্রিয়।' কোন লিচুতলা?
নুহাশ পল্লীর ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম বুলবুল উত্তর দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। চোখ মুছতে মুছতে বলেন, 'ওই যে দেখছেন, তিনটা লিচুগাছ। ওই জায়গাটাই স্যারের খুব প্রিয় ছিল।'
ছায়াঢাকা সে জায়গাটার একপাশে তিনটি মাঝারি আকারের লিচুগাছ, অন্যপাশে সারি সারি আম, জাম, লটকনসহ নানা জাতের গাছগাছালি। নুহাশ পল্লীর মূল ফটক থেকে ২০০ গজ উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এ জায়গার নামই 'লিচুতলা'। পাশেই বেশ কয়েকটি জাম, জলপাই ও তেঁতুলগাছ। গাছগুলোর মাঝখানে একখণ্ড ফাঁকা জায়গা সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত। দক্ষিণে শেফালি, কামিনী ফুলসহ অন্যান্য গাছ। তিনটি লিচুগাছের গোড়া বাঁধানো। সেখানেই তিনি বসে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে যেতেন বাংলোয়।
নুহাশ পল্লীর ম্যানেজার জানান, এখনো তাঁর কাছে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি, হুমায়ূন আহমেদের দাফন কোথায় হবে। নুহাশ পল্লীতে, না ঢাকায়। তিনি বলেন, 'এখানে যদি দাফন করা হয় তাহলে স্যারের পছন্দের জায়গা লিচুতলাতেই দাফন হবে।'
গতকাল রবিবার সকালে সরেজমিনে নুহাশ পল্লী ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামবাসী থেকে শুরু করে নুহাশ পল্লীর কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই তাঁদের প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে এখনো গভীর শোকে মুহ্যমান।
নুহাশ পল্লীতে ১৫ বছর ধরে কাজ করছেন বৃদ্ধ নুরুল হক। তিনি বলেন, 'স্যার নুহাশ পল্লীতে এলে তাঁর সেবাযত্ন, বিছানাপত্র ঠিক করে দেওয়া, চা করে দেওয়া, খাবার এনে দেওয়ার কাজ করতাম।' নুহাশ পল্লীর কর্মচারী কামরুল বলেন, 'স্যার গাছ খুব ভালোবাসতেন। স্যার তাঁর পছন্দের গাছ সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন। এসেই আমাদের ডাকতেন। নতুন নতুন গাছ লাগাতে ও তাদের যত্ন নিতে বলতেন।'
সরেজমিনে দেখা গেছে, নুহাশ পল্লীজুড়ে বিরাজ করছে শোকের ছায়া। যার কাছেই হুমায়ূন আহমেদের কথা জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, তিনিই কেঁদে ফেলছেন।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে হোতাপাড়া বাজার। বাজার থেকে পশ্চিমে আট কিলোমিটার দূরে পিরুজালী গ্রাম। ১৯৯৭ সালে পিরুজালীতে ৪০ বিঘা জমিতে বড় ছেলে নুহাশের নামে 'নুহাশ পল্লী' গড়ে তোলেন হুমায়ূন আহমেদ। এখানে তিনি দুর্লভ আড়াই শ প্রজাতির বৃক্ষ ও গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ লাগিয়েছেন। গাছ ছাড়াও হাঁস, রাজহাঁস, গরু, কবুতরসহ বিভিন্ন প্রাণী এখানে রয়েছে। এই নুহাশ পল্লীতেই হুমায়ূন আহমেদ গড়ে তুলেছেন শুটিং স্পট, দিঘি, তিনটি সুদৃশ্য বাংলো আর অনেক ভাস্কর্য। দিঘিটি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী শাওনের গর্ভে মৃত কন্যা লীলাবতির নামে। বিশাল দিঘির ওপর রয়েছে একটি কাঠের সেতু। দিঘির মাঝখানে ছোট্ট দ্বীপ।
নুহাশ পল্লীতে রয়েছে বিশাল এক ঔষধি গাছের বাগান। সেটির নামকরণ করেছেন প্রথম স্ত্রী গুলতেকিনের গর্ভে জন্ম নেওয়া প্রয়াত শিশুপুত্র রাশেদ হুমায়ূনের নামে। তিনটি বাংলোর একটির নাম 'বৃষ্টিবিলাস'। ওপরে টিনের চাল। বৃষ্টির দিনে এখানে তিনি শুনতেন বৃষ্টির নূপুর। দিঘির পশ্চিম পাড়ে একটি বাংলোর নাম 'ভূতবিলাস'। অন্য বাংলোটিতে থাকতেন তিনি। সেটি কর্মচারীদের কাছে স্যারের বাংলো নামে পরিচিত।
সবুজ নিসর্গ, পাখপাখালি আর নুহাশ পল্লীর কর্মচারীরা এখন অভিভাবকহীন। শোকে ম্রিয়মাণ সব। মনে হয় প্রাণহীন দাঁড়িয়ে থাকা একের পর এক পাথরের ভাস্কর্য মা ও শিশু, রাক্ষস, ডাইনোসর, শালিক, মৎস্যকন্যা- সবার মধ্যে ছড়িয়ে গেছে থমথমে শোক।
বিকেলে ঢাকায় ফেরার পথে শুরু হয় অঝোর বৃষ্টি। অগ্যতা আরো কিছুক্ষণ থাকতে হয় সেখানে। আমরা একদৌড়ে ঢুকি বৃষ্টিবিলাসে। টিনের চালে ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে বৃষ্টির নাচন। বৃষ্টি থামলে আমরা যখন বের হই, তখন গাছপালা, ঘন শালবনের পাতা চুইয়ে চুইয়ে পড়ছিল বৃষ্টির কণা। নুহাশ পল্লীর মূল ফটকের দিকে আসার পথেই পড়ে লিচুগাছ। সরু সরু লিচুপাতা থেকে টুপটাপ পড়ছিল বৃষ্টিফোঁটা। মনে হচ্ছিল, যেন কাঁদছে ওই তিনটি নির্বাক লিচুগাছ!
No comments