জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: সাংস্কৃতিক কর্মীদের ওপর হামলা-ছাত্রলীগের আট কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ by ইফতেখার মাহমুদ ও শামসুজ্জামান

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনার সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আটজন ছাত্র ওই হামলা করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। গত ২৮ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক জোটের কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় গঠিত চার সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এসব ছাত্র ছাত্রলীগের কর্মী বলে অভিযোগ রয়েছে।


বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত চার সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এসব কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন: বাংলা বিভাগের অধ্যাপক খালেদ হোসাইন, ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক আহমেদ রেজা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ আলী। ১৯টি সভার মাধ্যমে এই কমিটি মোট ২২ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ পর্যালোচনা করে। আটজন অভিযোগকারীসহ সব অভিযুক্ত এবং নয়জন শিক্ষক-কর্মকর্তার সাক্ষ্য নিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। ওই হামলার ঘটনায় সাংস্কৃতিক জোটের ছয়জন নেতা-কর্মী আহত হন।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে হামলাকারী হিসেবে আটজন ছাত্রকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে ৩৬তম ব্যাচের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র এস এম মাহতাব মেহেদি আক্রমণের হুকুমদাতা ছিলেন বলে প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। তিনি মওলানা ভাসানী হলের আবাসিক ছাত্র। হামলায় জড়িত অন্যরা হলেন: বাংলা বিভাগের ৩৭তম ব্যাচের ছাত্র মো. জাহাঙ্গীর আলম, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৩৬তম ব্যাচের ছাত্র সাইফুর রহমান, বিবিএ প্রোগ্রামের ৩৮তম ব্যাচের ছাত্র মিঠুন কুমার কুন্ডু, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের ৩৬তম ব্যাচের ছাত্র মাহমুদুর রহমান, দর্শন বিভাগের ৩৭তম ব্যাচের ছাত্র এম জি রাব্বী, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এমফিল গবেষক শেখ শরিফুল ইসলাম এবং সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৩৭তম ব্যাচের ছাত্র ফেরদৌস আহমেদ।
হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ: তদন্তে হামলাকারী হিসেবে নাম আসা আট ছাত্রের মধ্যে মাহতাব মেহেদি ও সাইফুল ইসলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা রাশেদ রেজা হত্যাচেষ্টা এবং শেখ শরিফুল ইসলাম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সামিউল বাসির হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি। এ ছাড়া এঁদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজি, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর ও সশস্ত্র মহড়া দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
২০১০ সালের আগস্ট মাসে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির সহসভাপতি রাশেদ রেজা নয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে হত্যাচেষ্টার মামলা করেন। চলতি বছরের ১১ মার্চ মাহতাব ও সাইফুল ওই মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে গেলে আদালত তাঁদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ১৪ মার্চ তাঁরা জামিনে বেরিয়ে আসেন। বের হওয়ার মাত্র তিন দিন পরেই তাঁরা সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে কেক কাটেন। ২৮ এপ্রিল সাংস্কৃতিক কর্মীদের ওপর হামলার পর ছাত্রলীগের কর্মীরা তৎকালীন উপাচার্য শরীফ এনামুল কবিরের পক্ষে স্লোগানও দিয়েছিলেন। অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শেখ শরিফুল ইসলামসহ ১৫-২০ জনকে পুলিশের সহায়তায় ১ ফেব্রুয়ারি প্রতিপক্ষ ছাত্রলীগ কর্মীদের বের করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে তুলে দেয়।
সাবেক উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রশাসনিক দায়িত্বে নেই। ফলে তদন্তে কাদের নাম এসেছে, তা আমার জানা নেই। যাঁদের নাম বলা হচ্ছে, তাঁরা আদৌ হামলায় জড়িত ছিল কি না, তা-ও আমি নিশ্চিত নই। ফলে এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।’
গতকাল রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিসিপ্লিনারি কমিটিতে ওই তদন্ত প্রতিবেদন উত্থাপন করা হয়। তবে অভিযুক্ত ছাত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে গতকাল কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে বলে জানা গেছে।
উপাচার্য মো. আনোয়ার হোসেন ওই তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবেদনটি যথেষ্ট বস্তুনিষ্ঠ হয়েছে। তবে এ নিয়ে এখনই কিছু বলা যাবে না। পরবর্তী সিন্ডিকেট সভায় তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো উত্থাপন করা হবে। সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
অভিযুক্তদের বক্তব্য ও সুপারিশ: তদন্ত কমিটির কাছে অভিযুক্ত ছাত্ররা নিজেদের নির্দোষ বলে দাবি করেছেন। অভিযুক্ত ছাত্ররা হামলার ঘটনার সঙ্গে তাঁদের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেননি। তাঁরা আরও বলেছেন, সাংস্কৃতিক জোটের কর্মীদের সঙ্গে তাঁদের কোনো শত্রুতাও নেই। তবে কেউ কেউ বলেছেন, তাঁরা ছাত্রলীগ করেন, মিছিল-মিটিং করেন, সেই জন্য সাংস্কৃৃতিক জোটের কর্মীরা তাঁদের নামে নালিশ করতে পারেন।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কবে শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক তপন কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিন্ডিকেটকে সুপারিশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারাই সবকিছু ঠিক করবে। এ ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই।’

No comments

Powered by Blogger.