তাজউদ্দীন আহমদ- শ্রদ্ধাঞ্জলি

আজ ২৩ জুলাই। বাংলদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের জন্মদিন। এ বছর তাঁর ৮৭তম জন্মবার্ষিকী। ৮৭ বছর আগে হাজার বছরের শৃঙ্খলিত ও নিপীড়িত বাঙালীর মুক্তির লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করার জন্য তাজউদ্দীন আহমদ নামের এক দেদীপ্যমান আলোকবর্তিকার জন্ম হয়।


১৯২৫ সালে গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া গ্রামের এক সাধারণ পরিবারে ২৩ জুলাই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কালক্রমে তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন একজন অসাধারণ মানুষ এবং নেতারূপে। তাঁর বাবা মৌলবী মুহাম্মদ ইয়াসিন খান এবং মা মেহেরুন্নেসা খানম। তাঁরা ছিলেন চার ভাই ও ছয় বোন। তাজউদ্দীন আহমদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের মক্তবে, এরপর বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরবর্তী ভুলেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তিনি শৈশব থেকে প্রতিবাদী ও বিপ্লবী মনোভাব পোষণ করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং গ্রহণ করেন। তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৪২ সাল থেকে আজীবন বয়স্কাউট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত ছিলেন।
রাজনীতিতে মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও সততার প্রতীক ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। সেই ব্রিটিশ শাসনের শোষণ থেকে জাতির মুক্তির লক্ষ্যে সেই সময়কার মুসলিম লীগের হয়ে তিনি আন্দোলন-সংগ্রামের মশাল হাতে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। আর পরিসমাপ্তি ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বরে জেলখানায় খুনীদের গুলিতে।
ছাত্রজীবন থেকেই তাজউদ্দীন আহমদ সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িত হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স ডিগ্রি নিয়েছিলেন। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি এলএলবি পড়েন, তবে জেলখানা থেকে পরীক্ষা দিয়ে আইনের ডিগ্রী নেন। ১৯৪৩ সালে মুসলিম লীগের সক্রিয় সদস্য হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু। ১৯৪৪ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। পাকিস্তান আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে ও সুশাসনের প্রশ্নে তাজউদ্দীন আহমদ মুসলিম লীগ ত্যাগ করেন এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। তিনি সরকারের নীতির বিরোধিতায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিমের লীগের জন্ম হয়। (পরবর্তীতে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়) সেই দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে নতুনমাত্রা যোগ হয়। তখনকার তরুণ নেতা শেখ মুজিবের সান্নিধ্য লাভ, তাঁর সাথে বাঙালী জাতির মুক্তির লড়াইয়ে এগিয়ে যাওয়াই গণমানুষের এ নেতার অন্যতম কর্ম হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে কাপাসিয়া নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি কারাবরণের মাধ্যমে চলে যায় গত শতকের পঞ্চাশ দশকের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অধ্যায়। তাজউদ্দীন আহমদ বাংলা ভাষার অধিকার, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে সকল প্রকার আন্দোলনে সক্রিয় জড়িত ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তাজউদ্দীন আহমদ লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধীদলীয় সম্মেলনে যোগদান করেন। এই সম্মেলনেই বাঙালীর মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালীর মুক্তির সনদ ছয় দফা পেশ করেন। এই বছরই তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। এর আগে তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তাজউদ্দীন আহমদ জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরিক্রমায় দেখা যায় যে, এই নির্বাচনের পর তাঁর রাজনৈতিক জীবনে বড় ধরনের একটি অধ্যায়ের সূচনা হয়।
একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের আকাক্সক্ষা এই দেশের মানুষের বুকের মাঝে জাগ্রত করেন বাঙালী মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমিতে সাংগঠনিক দিকসমূহ পরিচালনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আস্থাভাজন সহযোগী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ অতুলনীয় দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার পর গ্রেফতার হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। তাঁর অনুপস্থিতিতে পুরো মুক্তিযুদ্ধে যিনি দক্ষতার সাথে পরিচালনা করেন, তিনি হলেন তাজউদ্দীন আহমদ। ”
মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্বদানকারী তাজউদ্দীন আহমদ যুদ্ধের শেষে বিজয়ের বেশে ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত তিনি সরকার পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ত্যাগ, নিষ্ঠা, দক্ষতা ও স্বদেশপ্রেম বাঙালী জাতির ইতিহাসে ভাস্বর হয়ে থাকবে।
তাজউদ্দীন আহমদ এ সমাজকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। তবে রাজনীতিকে তিনি কঠিন মানদ- দিয়ে বিচার করতেন। বিচার বিশ্লেষণে তাঁর আত্মসমালোচনা নিমর্ম। তিনি ছিলেন প্রচারবিমুখ এক ব্যক্তিত্ব। তাঁর অবলোকন দূরদর্শী। দেশপ্রেম ও দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসা যেন তাঁর প্রাণশক্তি। তাজউদ্দীন আহমদের অদম্য সাহস, আত্মত্যাগ, সাংগঠনিক দক্ষতা, নেতৃত্ব দানের কলাকৌশল, মানুষের আপনজন হওয়ার ও তাদের প্রতি বিশ্বাস অর্জনের মতো গুণাবলি তাঁকে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত করেছিল রাজনৈতিক কর্মী থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নায়কে। ৮৭তম জন্মবার্ষিকীতে তাজউদ্দীন আহমদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।

মোঃ মুজিবুর রহমান

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, কাজী আজিমউদ্দিন কলেজ

No comments

Powered by Blogger.