তিনি কি জানতেন, বেশি দিন বাঁচবেন না by আজিজুল পারভেজ
হুমায়ূন আহমেদ কি টের পেয়েছিলেন আর বেশি দিন বাঁচবেন না? ছয় সন্তানের মধ্যে সবার ছোট নিনিত বাবার কোনো স্মৃতি না নিয়েই বড় হবে- এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন নিজেই। ২০১১ সালের বইমেলায় প্রকাশিত 'বাদশাহ নামদার' বইয়ের উৎসর্গপত্রে তিনি এ আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
তিনি লিখেছেন, 'আমার কেবলই মনে হচ্ছে পুত্র নিনিত পিতার কোনো স্মৃতি না নিয়েই বড় হবে। সে যেন আমাকে মনে রাখে এ জন্য নানা কর্মকাণ্ড করছি। আমি ছবি তুলতে পছন্দ করি না। এখন সুযোগ পেলেই নিনিতকে কোলে নিয়ে ছবি তুলি। এই বইয়ের উৎসর্গপত্রও স্মৃতি মনে রাখা প্রকল্পের অংশ।'
নিনিত, হুমায়ূনের ছয় সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। বয়স এক বছর ১০ মাস। আগামী ৭ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় জন্মদিনে বাবাকে পাশে পাবে না নিনিত। সব মায়া কাটিয়ে গত ১৯ জুলাই রাতে তার বাবা চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। তবে নিনিত যাতে বাবার স্মৃতি খুঁজে নিতে পারে, শেষ দিনগুলোতে সেই চেষ্টা করে গেছেন হুমায়ূন।
ছোট্ট নিনিত শেষবেলায় হুমায়ূন আহমেদের সব আনন্দের উৎসে পরিণত হয়েছিল। এই অকৃত্রিম আনন্দ উপভোগের জন্য বেঁচে থাকার আকুতিও জেগে উঠেছিল হুমায়ূনের মধ্যে। বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষায় ৩৭ বছরের পুরনো 'সিগারেট বন্ধু'কে ত্যাগ করেন তিনি। গেল বছর ১৩ নভেম্বর জন্মদিনে প্রকাশিত লেখায় তিনি লিখেছেন, 'আরো কিছুদিন অতিরিক্ত বেঁচে থাকার জন্য মানুষ অনেক কিছু ত্যাগ করে। মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ কী? গলিত স্থবির ব্যাঙও নাকি দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে। অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে। আমি কখনো অতিরিক্ত কিছুদিন বাঁচার জন্য সিগারেটের আনন্দ ছাড়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমি ভেবে রেখেছিলাম ডাক্তারকে বলব, আমি একজন লেখক। নিকোটিনের বিষে আমার শরীরের প্রতিটি কোষ অভ্যস্ত। তোমরা আমার চিকিৎসা করো, কিন্তু আমি সিগারেট ছাড়ব না।
তা হলে কেন ছাড়লাম? ছেলে নিনিত হামাগুড়ি থেকে হাঁটা শিখেছে। বিষয়টা পুরোপুরি রপ্ত করতে পারেনি। দু-এক পা হেঁটেই ধুম করে পড়ে যায়। ব্যথা পেয়ে কাঁদে। একদিন বসে আছি। টিভিতে খবর দেখছি। হঠাৎ চোখ গেল নিনিতের দিকে। সে হামাগুড়ি পজিশন থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। হেঁটে হেঁটে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। তার ছোট্ট শরীর টলমল করছে। যেকোনো সময় পড়ে যাবে এমন অবস্থা। আমি ডান হাত তার দিকে বাড়িয়ে দিতেই সে হাঁটা বাদ দিয়ে দৌড়ে হাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বিশ্বজয়ের ভঙ্গিতে হাসল। তখনই মনে হলো, এই ছেলেটির সঙ্গে আরো কিছুদিন আমার থাকা উচিত। সিগারেট ছাড়ার সিদ্ধান্ত সেই মুহূর্তেই নিয়ে নিলাম।'
৬৪ বছরের জীবনে হুমায়ূন আহমেদ মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন আরো অন্তত দুই বার। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন একাত্তরে। একাত্তরের ঘটনা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, 'আমার সাজানো অতি পরিচিত ভুবন ভেঙে পড়ল ১৯৭১ সালে। ...ভাইবোন নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালাচ্ছি। জীবন বাঁচানোর জন্য মাদ্রাসার ছাত্র হিসেবে ভর্তি হতে গেছি শর্ষীনার পীর সাহেবের মাদ্রাসায়। পাকিস্তান মিলিটারি মাথায় গুলির বাক্স তুলে দিয়েছে। অকল্পনীয় ওজনের গুলির বাক্স নিয়ে সৈন্যদের সঙ্গে বারহাট্টা থেকে হেঁটে হেঁটে এসেছি নেত্রকোনা পর্যন্ত। মিলিটারির বন্দিশিবিরে কাটল কিছু সময়। কী ভয়ঙ্কর অত্যাচার! এক সকালে মিলিটারিদের একজন এসে আমার হাতে বিশাল সাইজের একটা সাগরকলা ধরিয়ে দিয়ে বলল, তোমাকে কাল সকালে গুলি করে মারা হবে। এটা তোমার জন্য ভালো। তুমি যদি নিরপরাধ হও, সরাসরি বেহেশতে চলে যাবে। আর যদি অপরাধী হও, তাহলে মৃত্যু তোমার প্রাপ্য শাস্তি।'
ওপেন হার্ট সার্জারির সময় দ্বিতীয়বার তাঁর মুক্তিযুদ্ধের একটি উপন্যাস লেখার জন্য বেঁচে থাকার আকুতি জাগে। তিনি লিখেছেন, 'একসময় মনে হলো, মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় ধরে রাখার জন্য একটা উপন্যাস লেখা উচিত। ...লেখা শুরু করলাম। 'জোছনা ও জননীর গল্প' ধারাবাহিকভাবে ভোরের কাগজে ছাপা হতে লাগল। আমি কখনোই কোনো ধারাবাহিক লেখা শেষ করতে পারি না। এটিও পারলাম না। ...একদিন হঠাৎ টের পেলাম। অনেক সময় আমার হাতে নেই। সময় শেষ হয়ে গেছে। 'জোছনা ও জননীর গল্প' আর লেখা হবে না। তখন আমি শুয়ে আছি সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালের একটি ট্রলিতে। ...ওপেন হার্ট সার্জারি হবে। আমাকে একটা ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। ...যখন অচেতন হতে শুরু করেছি, তখন মনে হলো 'জোছনা ও জননীর গল্প' তো লেখা হলো না। আমাকে যদি আরেকবার পৃথিবীতে ফিরে আসার সুযোগ দেওয়া হয়- আমি এই লেখাটি অবশ্যই শেষ করব। অচেতন হওয়ার আগ মুহূর্তে হঠাৎ আনন্দে অভিভূত হলাম। কারণ তখনই টের পেলাম আমি আসলেই একজন লেখক। মৃত্যুর খুব কাছাকাছি যাওয়ার আগের মুহূর্তে অসমাপ্ত লেখার চিন্তাই ছিল আমার একমাত্র চিন্তা।'
হুমায়ূন আহমেদ শেষ করেছিলেন 'জোছনা ও জননীর গল্প'। এটি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে একুশের বইমেলায়। মুক্তিযুদ্ধের নিরীক্ষাধর্মী এই উপন্যাসটিকে তিনি তাঁর একটি বড় কাজ বলে মনে করেন।
মৃত্যু নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের তেমন আফসোস ছিল না। তবে আক্ষেপ ছিল মানুষের আয়ুর সীমা নিয়ে। ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার পর এক সাক্ষাৎকারে জানতে চাওয়া হয়- মৃত্যু তো অনিবার্য। এই মৃত্যু নিয়ে আপনার বিবেচনা কী? উত্তরে তিনি বলেন, 'মৃত্যু নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই। মরে গেলাম তো ফুরায়ে গেলাম। তবে এটা আমার কাছে খুব পেইনফুল। একটা মানুষ এত ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে আসে, ৭০ বা ৮০ বছর বাঁচে। তারপর শেষ। আর একটা কচ্ছপ সাড়ে তিন শ বছর বাঁচে। হোয়াই? কচ্ছপের মতো একটা প্রাণীর এত বছর বাঁচার প্রয়োজন কী? তাহলে এত সৃষ্টিশীল মানুষের আয়ু এত কম কেন?'
নিনিত, হুমায়ূনের ছয় সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। বয়স এক বছর ১০ মাস। আগামী ৭ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় জন্মদিনে বাবাকে পাশে পাবে না নিনিত। সব মায়া কাটিয়ে গত ১৯ জুলাই রাতে তার বাবা চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। তবে নিনিত যাতে বাবার স্মৃতি খুঁজে নিতে পারে, শেষ দিনগুলোতে সেই চেষ্টা করে গেছেন হুমায়ূন।
ছোট্ট নিনিত শেষবেলায় হুমায়ূন আহমেদের সব আনন্দের উৎসে পরিণত হয়েছিল। এই অকৃত্রিম আনন্দ উপভোগের জন্য বেঁচে থাকার আকুতিও জেগে উঠেছিল হুমায়ূনের মধ্যে। বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষায় ৩৭ বছরের পুরনো 'সিগারেট বন্ধু'কে ত্যাগ করেন তিনি। গেল বছর ১৩ নভেম্বর জন্মদিনে প্রকাশিত লেখায় তিনি লিখেছেন, 'আরো কিছুদিন অতিরিক্ত বেঁচে থাকার জন্য মানুষ অনেক কিছু ত্যাগ করে। মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ কী? গলিত স্থবির ব্যাঙও নাকি দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে। অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে। আমি কখনো অতিরিক্ত কিছুদিন বাঁচার জন্য সিগারেটের আনন্দ ছাড়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমি ভেবে রেখেছিলাম ডাক্তারকে বলব, আমি একজন লেখক। নিকোটিনের বিষে আমার শরীরের প্রতিটি কোষ অভ্যস্ত। তোমরা আমার চিকিৎসা করো, কিন্তু আমি সিগারেট ছাড়ব না।
তা হলে কেন ছাড়লাম? ছেলে নিনিত হামাগুড়ি থেকে হাঁটা শিখেছে। বিষয়টা পুরোপুরি রপ্ত করতে পারেনি। দু-এক পা হেঁটেই ধুম করে পড়ে যায়। ব্যথা পেয়ে কাঁদে। একদিন বসে আছি। টিভিতে খবর দেখছি। হঠাৎ চোখ গেল নিনিতের দিকে। সে হামাগুড়ি পজিশন থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। হেঁটে হেঁটে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। তার ছোট্ট শরীর টলমল করছে। যেকোনো সময় পড়ে যাবে এমন অবস্থা। আমি ডান হাত তার দিকে বাড়িয়ে দিতেই সে হাঁটা বাদ দিয়ে দৌড়ে হাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বিশ্বজয়ের ভঙ্গিতে হাসল। তখনই মনে হলো, এই ছেলেটির সঙ্গে আরো কিছুদিন আমার থাকা উচিত। সিগারেট ছাড়ার সিদ্ধান্ত সেই মুহূর্তেই নিয়ে নিলাম।'
৬৪ বছরের জীবনে হুমায়ূন আহমেদ মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন আরো অন্তত দুই বার। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন একাত্তরে। একাত্তরের ঘটনা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, 'আমার সাজানো অতি পরিচিত ভুবন ভেঙে পড়ল ১৯৭১ সালে। ...ভাইবোন নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালাচ্ছি। জীবন বাঁচানোর জন্য মাদ্রাসার ছাত্র হিসেবে ভর্তি হতে গেছি শর্ষীনার পীর সাহেবের মাদ্রাসায়। পাকিস্তান মিলিটারি মাথায় গুলির বাক্স তুলে দিয়েছে। অকল্পনীয় ওজনের গুলির বাক্স নিয়ে সৈন্যদের সঙ্গে বারহাট্টা থেকে হেঁটে হেঁটে এসেছি নেত্রকোনা পর্যন্ত। মিলিটারির বন্দিশিবিরে কাটল কিছু সময়। কী ভয়ঙ্কর অত্যাচার! এক সকালে মিলিটারিদের একজন এসে আমার হাতে বিশাল সাইজের একটা সাগরকলা ধরিয়ে দিয়ে বলল, তোমাকে কাল সকালে গুলি করে মারা হবে। এটা তোমার জন্য ভালো। তুমি যদি নিরপরাধ হও, সরাসরি বেহেশতে চলে যাবে। আর যদি অপরাধী হও, তাহলে মৃত্যু তোমার প্রাপ্য শাস্তি।'
ওপেন হার্ট সার্জারির সময় দ্বিতীয়বার তাঁর মুক্তিযুদ্ধের একটি উপন্যাস লেখার জন্য বেঁচে থাকার আকুতি জাগে। তিনি লিখেছেন, 'একসময় মনে হলো, মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় ধরে রাখার জন্য একটা উপন্যাস লেখা উচিত। ...লেখা শুরু করলাম। 'জোছনা ও জননীর গল্প' ধারাবাহিকভাবে ভোরের কাগজে ছাপা হতে লাগল। আমি কখনোই কোনো ধারাবাহিক লেখা শেষ করতে পারি না। এটিও পারলাম না। ...একদিন হঠাৎ টের পেলাম। অনেক সময় আমার হাতে নেই। সময় শেষ হয়ে গেছে। 'জোছনা ও জননীর গল্প' আর লেখা হবে না। তখন আমি শুয়ে আছি সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালের একটি ট্রলিতে। ...ওপেন হার্ট সার্জারি হবে। আমাকে একটা ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। ...যখন অচেতন হতে শুরু করেছি, তখন মনে হলো 'জোছনা ও জননীর গল্প' তো লেখা হলো না। আমাকে যদি আরেকবার পৃথিবীতে ফিরে আসার সুযোগ দেওয়া হয়- আমি এই লেখাটি অবশ্যই শেষ করব। অচেতন হওয়ার আগ মুহূর্তে হঠাৎ আনন্দে অভিভূত হলাম। কারণ তখনই টের পেলাম আমি আসলেই একজন লেখক। মৃত্যুর খুব কাছাকাছি যাওয়ার আগের মুহূর্তে অসমাপ্ত লেখার চিন্তাই ছিল আমার একমাত্র চিন্তা।'
হুমায়ূন আহমেদ শেষ করেছিলেন 'জোছনা ও জননীর গল্প'। এটি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে একুশের বইমেলায়। মুক্তিযুদ্ধের নিরীক্ষাধর্মী এই উপন্যাসটিকে তিনি তাঁর একটি বড় কাজ বলে মনে করেন।
মৃত্যু নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের তেমন আফসোস ছিল না। তবে আক্ষেপ ছিল মানুষের আয়ুর সীমা নিয়ে। ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার পর এক সাক্ষাৎকারে জানতে চাওয়া হয়- মৃত্যু তো অনিবার্য। এই মৃত্যু নিয়ে আপনার বিবেচনা কী? উত্তরে তিনি বলেন, 'মৃত্যু নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই। মরে গেলাম তো ফুরায়ে গেলাম। তবে এটা আমার কাছে খুব পেইনফুল। একটা মানুষ এত ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে আসে, ৭০ বা ৮০ বছর বাঁচে। তারপর শেষ। আর একটা কচ্ছপ সাড়ে তিন শ বছর বাঁচে। হোয়াই? কচ্ছপের মতো একটা প্রাণীর এত বছর বাঁচার প্রয়োজন কী? তাহলে এত সৃষ্টিশীল মানুষের আয়ু এত কম কেন?'
No comments