আত্মবিশ্বাসী হোন by মোঃ আরিফুর রহমান
অরুণ এই তো বেশ কিছুদিন আগে লেখাপড়া শেষ করেছে। এখন নানা জায়গায় একটি চাকরি পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে। চাকরির জন্য সে মাস্টার্স চলাকালীন থেকেই লেখাপড়া করে এসেছে। সাধারণ জ্ঞান, বাংলা, ইংরেজী, গণিতের পাশাপাশি তার নিজের বিষয়ভিত্তিক লেখাপড়া নিয়মিতই সম্পন্ন করেছে।
স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে ভাল ফল এবং চাকরির পরীক্ষার ভাল প্রস্তুতি সত্ত্বেও সে চাকরি পেতে ব্যর্থ হচ্ছে বারংবার। লিখিত পরীক্ষায় অসাধারণ ফল করতে সক্ষম হলেও ইন্টারভিউ বোর্ডে গিয়ে সে যেন সবকিছু গুলিয়ে ফেলে। সাক্ষাতগ্রহণকারীর মুখোমুখি হলেই তার আত্মবিশ্বাস যেন কমে যায়। প্রশ্নের জবাব ঠিকমতো দিতে পারে না। আমতা আমতা করা, জড়তার সঙ্গে উত্তর দেয়া অনেক সময়ই সাক্ষাতগ্রহণকারীর বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অরুণ বুঝতে পারে না কিভাবে সে এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাবে। ফলে তার উপর নেমে আসছে বারবার ব্যর্থতার খড়গ। হতাশা দিন দিন গ্রাস করছে তাকে। অরুণের মতো অনেক শিক্ষিত চাকরি প্রার্থী সাক্ষাতকার বা ভাইভার দুর্বল পারফর্ম্যান্সের কারণে চাকরি নামক সোনার হরিণটির নাগাল পাচ্ছে না। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে নিজেকে ভাইভা বোর্ড সফলভাবে মোকাবিলার জন্য ধীরে ধীরে প্রস্তুত করতে হবে।
চাকরি প্রার্থীদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে, ইন্টারভিউতে নিজেদের যথার্থভাবে উপস্থাপন করতে না পারা। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের কাক্সিক্ষত কাজ পেতে অসুবিধা হয়। প্রথমেই আপনাকে মনে রাখতে হবে আপনি ইন্টারভিউতে ডাক পেয়েছেন মানেই হচ্ছে সাক্ষাতগ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ আপনাকে কাজটি বা চাকরির জন্য উপযুক্ত মনে করেছে। অযোগ্য লোককে নিয়োগ দেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করবে না। আপনার সিভি দেখেই চাকরিদাতা সিদ্ধান্ত নেন আপান চাকরি পাবার উপযোগী কিনা। উপযোগী মনে হলেই কিন্তু তারা আপনাকে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার জন্য কল করেন। অতএব নিজেকে যথার্থভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে আপনাকে চাকরিটা পেতে হবে। এবং আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে যে, আপনি চাকরিটি পাবার উপযোগী। যদি আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি থাকে তবে আপনি হেরে যাবেন। এই ক্ষেত্রে আপনাকে মনে রাখতে হবে চাকরির জন্য অনেক আবেদনপত্র জমা পড়লেও অল্পকিছুু মানুষই কিন্তু ভাইভার ডাক পেয়েছে। অর্থাৎ আপনি চাকরি পাওয়ার উপযুক্ত এবং আপনার চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক উজ্জ্বল। তাই আপনার কল্পিত ভীতির আসলেই কোন কারণ নেই। তাই ভাইভা বোর্ডে নিজেকে যথার্থভাবে উপস্থাপনে আপনি সক্ষম হবেন এই আত্মবিশ্বটি প্রথমেই আপনার নিজের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। যেহেতু আপনার সিভি বা বায়োডাটা দেখে আপনাকে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার জন্য কল করা হয়েছে তাই আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে আপনার বায়োডাটার কোন দিকটা চাকরিদাতাকে আকর্ষণ করেছে এবং সেই দিকটিকে আরও ভালভাবে শাণিত করতে হবে। কারণ চাকরিদাতা ঐ বিষয়টিকে নিয়েই অনেক সময় আপনাকে প্রশ্ন করবেন। তাই বায়োডাটায় আপনি নিজের যে দক্ষতার কথা লিখেছেন সেগুলোতে কোন ঘাটতি থাকলে তা শীঘ্রই দূর করতে সচেষ্ট হতে হবে আপনাকে। আপনি জেনে আশ্চর্য হবেন ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে প্রার্থী বাছাই নির্ভরযোগ্য কোন ব্যবস্থাপনা কৌশল নয়। এটা আপনার জন্য সুবিধাজনক। নিজের অর্জন ও যোগ্যতাকে তুলে ধরার জন্য এক্ষেত্রে নিজেকে সুমন্বিতভাবে গড়ে তুলতে হবে। আপনাকে মনে রাখতে হবে সাক্ষাতকারে সত্য বলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তবে সাক্ষাতকার পূর্ব চিন্তা, অনুশীলন এবং সাক্ষাতকারপূর্বক প্রস্তুতি আপনাকে চাকরিদাতার কাছে আকর্ষণীয় যোগ্য ও ইতিবাচক হিসাবে তুলে ধরতে সাহায্য করবে।
আরেকটি বিষয়, সকল সাক্ষাতকারগ্রহণকারীই মানুষÑ তাদের সন্দেহ ও দ্বিধা আছে, আছে অন্যদের মতো আশা ও খুঁত খুঁতে মনোভাব। তাই নিজের আবেদনপত্র বা সিভিটি তাদের দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করুন। সামান্য পরিকল্পনা এবং চিন্তার মাধ্যমে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন আপনাকে কোন ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তাদের প্রতিষ্ঠান এবং যে পদের জন্য আবেদনপত্র চাওয়া হয়েছে তার জন্য প্রার্থিত যোগ্যতা সম্পর্কে আপনাকে ভাবতে হবে। তারপর নিজেকেই প্রশ্ন করুন “আমি হলে কী কী প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতাম?” এই চিন্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই আপনি বুঝতে পারবেন আপনাকে কী কী প্রশ্ন করা হতে পারে এবং সেই অনুযায়ী আপনাকে উত্তর তৈরি করতে হবে।
সাক্ষাতকারে ভাল পারফরমেন্সের জন্য চাই ভাল প্রস্তুতি। আপনার প্রস্তুতির ওপর নির্ভর করবে আপনি চাকরি পাবেন কিনা।
মনে রাখবেন চাকরিদাতা আপনাকে দেখার পূর্বেই আপনাকে নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন। তাই আপনাকে প্রস্তুতি নিয়েই যেতে হবে। সঠিক প্রস্তুতি না নিয়ে গেলে আপনার ভাইভা বোর্ডে অপদস্থ হওয়ার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেয়া যাবে না।
সঠিক প্রস্তুতি পর্বে প্রথমেই আসবে পেশাদারিত্বের ছাপ আছে এমনভাবে তৈরি একটি চমৎকার জীবনবৃত্তান্ত যেখানে আপনি সুস্পষ্টভাবে আপনার দক্ষতা ও পারদর্শিতা ফুটিয়ে তুলেছেন। এরপর আপনাকে উন্নতমানের একটি কভার লেটার তৈরি করতে হবে যেখানে কাজটির জন্য আপনার উপযুক্ততার বিস্তৃত বিবরণ থাকবে। এখানে নিজের আকর্ষণীয় দিকগুলো ভালভাবে ফুটিয়ে তুলতে হবে। এই সকল প্রাক নির্বাচনী কৌশলের মাধ্যমেই নিজেকে প্রাথমিকভাবে সর্বোৎকৃষ্ট প্রার্থী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করতে হবে।
অনেক সময়ই আমরা আমাদের কিছু দুর্বলতার জন্য ইন্টারভিউয়ের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসী হতে পারি না যেমন একটি দুর্বলতা হতে পারে যে, আপনি একদমই ফ্রেশার বা নবীন। আপনাকে এক্ষেত্রে মনে করতে হবে সাক্ষাতকারগ্রহণকারী আপনার এই সকল সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েছেন বলেই আপনাকে সাক্ষাতকার দেয়ার জন্য ডেকেছেন।
কারণ সাক্ষাতকার নেয়ার জন্য সাক্ষাতকারগ্রহণকারী আপনাকে তখনই সময় দেবেন যখন আপনাকে যোগ্য মনে করবেন। তাই আপনার মনের দুর্বলতাগুলো ঝেড়ে ফেলতে হবে।
সাক্ষাতকারকালীন আপনি যদি কোন প্রশ্নের উত্তর বিশদভাবে না জানেন তবে সে বিষয়ে কোন কিছু না বলাই ভাল। এক্ষেত্রে প্রশ্নের উত্তর করবেন না তবে সাড়া দিবেন।
আর প্রশ্নের যে উত্তর আপনি দিবেন সেটির ওপর আপনার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরী। কেননা আপনার খেই হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা নাকচ করে দেয়া যায় না। আপনাকে যদি ক্যারিয়ার স্টেটমেন্ট সম্পর্কে বলতে বলা হয় তবে আপনি যে ধরনের চাকরির জন্য এসেছেন সেই ধরনের স্টেটমেন্ট তুলে ধরুন। ক্যারিয়ার স্টেটমেন্ট সাক্ষাতকার গ্রহণকারীর মধ্যে আপনার সম্পর্কে আশানুরূপ ধারণা জাগিয়ে তোলে। তাই ভাইভা দিতে না যাওয়ার আগেই উপযুক্ত ক্যারিয়ার স্টেটমেন্ট তৈরি করা একান্তই দরকার।
আপনি এমনিতে অনেক বাকপটু হলেও ইন্টারভিউ সময়কালীন মানুষিক উদ্বেগ ও পরিস্থিতি সামান্য হলেও আপনার বাকপটুতা ব্যাহত করতে পারে। এই জন্য নিজে নিজেই কথা বলুন। অনেকে হয়ত আপনাকে পাগল ভাবতে পারে। কিন্তু সে বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে সাক্ষাতকার দেয়া প্রস্তুতিস্বরূপ নিজেকে নিজেকেই বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করুন এবং উত্তর দিন। এভাবেই দেখবেন আপনার বাকপটুতা বৃদ্ধি পাবে যা সাক্ষাতকারকালীন কাজে লাগবে। প্রতিটি কর্মক্ষেত্রেই পেশাভিত্তিক কিছু নিজস্ব শব্দাবলী প্রচলিত থাকে। এই বাজওয়ার্ডগুলো আপনাকে আয়ত্ত করতে হবে ইন্টারভিউ দেয়ার আগেই কেননা এই বাজওয়ার্ড দিয়ে যদি কোন প্রশ্ন করা হয়, আর আপনি যদি না পারেন তবে তা আপনার জন্য মাইনাস পয়েন্ট হবে।
আবার শুরুর দিকের সেই আত্মবিশ্বাসের কথায় আসি। হেনরী ফোর্ড বলেছেন, “যদি চিন্তা করেন আপনি পারবেন তাহলে পারবেন, আর যদি চিন্তা করেন যে পারবেন না তাহলে পারবেন না, দু’ভাবেই আপনি সঠিক।” সাক্ষ্যকালীন সময়ে আপনি যদি কোন বিষয় সম্পর্কে আনন্দিত হন বা আপনার আত্মবিশ্বাস কম থাকে তবে তা কিন্তু সাক্ষাতকারগ্রহণকারীর কাছে লক্ষণীয় হয়ে উঠবে। কখনও কখনও আপনি কিছু না বললেও আপনার আচরণ আপনার মধ্যকার অবস্থা প্রকাশ করবে। তাই সাক্ষাতকারে অংশগ্রহণের পূর্বেই আপনাকে আত্মবিশ্বাসী হিসাবে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে।
কোন ব্যক্তিই কোন কাজের জন্য পুরোপুরি যোগ্য নাও হতে পারে। সাক্ষাতকার গ্রহণকারী প্রার্থীর অভিজ্ঞতা এবং অতীত অর্জনের মধ্য থেকে সেই দিকগুলোই খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন যা প্রার্থিত কাজটির সঙ্গে মেলে না। তাই সাক্ষাতকারের প্রস্তুতি পর্বে নিজেই নিজের দুর্বলতা খুঁজে বের করুন এবং উত্তর তৈরি করুন। সাক্ষাতকারগ্রহণকারীদের তুলনায় আপনি নিজেকে ভাল চেনেন এবং আপনি ভাল জানবেন কোন কোন ক্ষেত্রে আপনার দক্ষতার মান আশানুরূপ নয়, তাই এইসব সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের উত্তর চর্চা করা আপনার জন্য অনেক জরুরী। আপনাকেই বের করতে হবে যে সকল অযোগ্যতা না অদক্ষতা আপনার রয়েছে সেগুলো তেমন কোন সমস্যা হবে না বলে আপনি কিভাবে সাক্ষাতকারগ্রহণকারীকে নিশ্চয়তা দিবেন।
আমাদের একটি প্রচলিত ধারণা হচ্ছে ইন্টারভিউ বোর্ডে আত্মপ্রচার না করা উত্তম। এটি ভুল ধারণা কারণ ইন্টারভিউ বোর্ডে আপনি যদি নিজের সম্পর্কে না বলেন, তাহলে আপনি কতটা ভাল তা তারা জানতে পারবে না। তাই সাক্ষাতকার দেয়ার পূর্বেই আপনাকে ভাবতে হবে আপনি কিভাবে নিজেকে জাহির করবেন। এর জন্য আপনি একটি তালিকাও প্রস্তুত করতে পারেন যেখানে আপনি আপনার খারাপ গুণ এবং দোষগুলো লিপিবদ্ধ করবেন এবং আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভালভাবে উপস্থাপনের অনুশীলন করুন। আরেকটি কথা, ইংরেজী ভাষার দক্ষতাটি কিন্তু আপনার সাক্ষাতারে প্লাস পয়েন্ট হতে পারে, তাই ভাষাটি ভালভাবে রপ্ত করুন। আপনার কথা বলার সময় হয়তো কিছু মুদ্রাদোষ রয়েছে সেগুলোও দূর করতে হবে। তাছাড়া ভাষার আঞ্চলিক টানও আপনাকে পরিহার করতে হবে।
সাক্ষাতকার দেয়ার পূর্বে আপনি যদি এই সকল বিষয়ে সতর্ক হন তবে তা আপনার সাক্ষাতকারের জন্য ইতিবাচক ফল নিয়ে আমার সম্ভাবনা বহু গুণ বাড়িয়ে দেবে। সাক্ষাতকার দেয়ার সময় আপনি কী কি করবেন তা নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করা হবে।
No comments