হুমায়ূন আহমেদ ও বাংলাদেশ by মোহীত উল আলম
বাংলাদেশের ১৫ কোটি লোক এবং এর বাইরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সবচেয়ে প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুতে যে স্বতঃস্ফূর্ত শোক-বিহ্বলতা লক্ষ করছি, তাতে বোঝা যায় সবার হৃদয়ের মণিকোঠায় ছিল তাঁর জন্য ভালোবাসা।
এটা প্রায় স্মরণকালে দেখিনি যে জাতীয় প্রচারমাধ্যমগুলো একজন লোকের মৃত্যুতে এভাবে সাড়া দিয়েছে। জাতীয় পত্রিকাগুলো পর পর দুই দিন অতিরিক্ত চার পৃষ্ঠার প্রচ্ছদ-সংকলন বের করেছে এবং সব টিভি চ্যানেলে হুমায়ূন আহমেদের জীবনের ওপর যেমন আলেখ্য প্রকাশ হচ্ছে, তেমনি তাঁর বন্ধু, সহকর্মী ও কর্মীদের সাক্ষাৎকার ও টকশো প্রায় দিনব্যাপী প্রচারিত হচ্ছে। যদিও ক্ষণটা হলো মৃত্যুর, কিন্তু শোকের বহিঃপ্রকাশ যেন শক্তিময় জাগরণে রূপান্তরিত হয়েছে। মনে হচ্ছে বাংলাদেশে যেন একটি পুনর্জাগরণ চলছে। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর জনপ্রিয়তার আড়ালে আড়ালে আসলে ছিলেন ফিনিঙ্ পাখির মতো, যাঁর মৃত্যুগর্ভ থেকে যেন নতুন বাংলাদেশের জন্ম হচ্ছে। সাহিত্যের ইতিহাসে এ রকম খুব কম দেখা যায়। একজন সাহিত্যিকের মৃত্যুকে উপলক্ষ করে একটি জাতীয় জাগরণ হওয়া খুবই বিস্ময়কর এবং সেটা হওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ।
যেদিন, সেই ৪০ বছর আগে, হুমায়ূন আহমেদ অবতীর্ণ হলেন বাংলার সাহিত্যাকাশে তাঁর অতি ক্ষুদ্র অবয়বের উপন্যাস 'নন্দিত নরকে' নিয়ে, সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে, অনুষদগুলোর করিডরে করিডরে একমাত্র আলোচনা ছিল 'নন্দিত নরকে'। কেন? আমি যাঁর কাছ থেকে এক সন্ধ্যায় মুহসীন হলের একটি কামরা থেকে বইটি পড়ার জন্য ধার নিয়েছিলাম, তাঁর নাম ছিল দিবাকর বড়ুয়া, ইংরেজির ছাত্র। পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতে করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে স্থায়ীভাবে অধ্যাপনা শুরু করেন। তিনি আমাকে বইটা দেওয়ার সময় বলেছিলেন, পড়লেই বুঝতে পারবেন। তিনি নিজে কোনো মন্তব্য করে আমাকে প্রভাবিত করতে চাননি, কিন্তু আমি সে সন্ধ্যায়ই এক বসায় বইটি পড়ে যখন ঘুমোতে গেলাম, তখন দেখলাম গল্পটির মধ্যে যে একটি গভীর বিষাদের সুর ছিল, সেটিই আমাকে টানছে। দুঃখ এত ভারী, কিন্তু তার প্রকাশ এত সহজ!
হুমায়ূন আহমেদকে তরুণ সমাজ যাকে বলে লুফে নিল। কিন্তু বাংলাদেশে একটা অধ্যাপক পক্ষ আছে না, তাঁরা হুমায়ূন আহমেদের অভ্রংলিহ জনপ্রিয়তা দেখে মুহূর্তে দুটি সিদ্ধান্তে এলেন। এক. হুমায়ূন আহমেদ সস্তা জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন; দুই. তাঁর জনপ্রিয়তা পাঠকসমাজকে সিরিয়াস সাহিত্য পাঠ থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। এখন প্রয়াত, তাঁর সমসাময়িক কিন্তু অগ্রজ, এবং ক্ষুরধার বিশ্লেষণী ক্ষমতার অধিকারী হুমায়ুন আজাদ বললেন, হুমায়ূন আহমেদ এবং তাঁর পরবর্তী জনপ্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলন সম্পর্কে যে তাঁরা উপন্যাস না 'অপন্যাস' লিখছেন। তিনি আরো বললেন, সিরিয়াস সাহিত্য ওইভাবে চকোলেট গেলার মতো করে পড়া যায় না, বিশ্বের দ্রুপদী সাহিত্য পড়তে হয় ধীরে ধীরে এবং সেখানে শুধু মজার পর মজা থাকে না, থাকে দীর্ঘ জীবন-বিশ্লেষণী আলোচনা। হুমায়ুন আজাদের সমালোচনার পক্ষে এবং বিপক্ষে বহু বিষয়ের অবতারণা করা যায়, সেগুলোর উপলক্ষ আজকে না, কিন্তু যে কথাটা আমি বলতে চাই, সেটি হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর মতো করে কোনো কথা না বলে যাননি। একজন লেখকের সত্য উপলব্ধির স্থান সব সাহিত্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত চিরকালীন সাহিত্য টিকে থাকে সত্য বলার বা ধ্রুপদী কথা বলার গুণে।
এক বয়সে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস পেলেই পড়ে ফেলার যে নেশা ছিল, বয়সের কারণে এবং অন্যান্য ব্যস্ততায় সেটা আর হয়ে উঠত না। হুমায়ূনের ইদানীংকালের টিভি নাটকগুলোতেও লক্ষ করতাম যেন পুনরুক্তির প্রবণতা। জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে একটি প্রবন্ধে বুদ্ধদেব বসু অনুযোগ করেছিলেন যে তাঁর 'সাতটি তারার তিমির'-এর পরের কাব্যগুলোতে ক্লান্তিকর পুনরুক্তি হয়েছে। তখন তিনি লিখলেন, প্রতিভাবানরা যখন পুনরুক্তি করেন, তখন দেবতারা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন। হয়তো হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস, টিভি নাটক ও চলচ্চিত্র নিয়েও দীর্ঘ নিঃশ্বাস কেউ কেউ ফেলবেন, কিন্তু এ দায় থেকে হুমায়ূন নিজেই আমাদের মুক্ত করে গেছেন। তিনি আশির দশকের মাঝামাঝি 'সাপ্তাহিক বিচিত্রায়' প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাঁকে যদি লোকে একদিন ভুলে যায়, তাঁর কোনো অনুযোগ থাকবে না।
যে সত্য কথা বলার প্রবণতার কথা বলেছিলাম, সেটি আমি গতকাল, পূর্বে-অপঠিত 'মাতাল হাওয়া' পড়েও পাচ্ছি। আয়ুব খান আমলের শেষ তিন বছরের কাহিনী নিয়ে এ উপন্যাসটি রচিত। আছে মোনায়েম খানের চরিত্রের সরস বয়ান। কিন্তু চূড়ান্ত সত্যভাবে আছে পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক চরিত্রের নিখুঁত বর্ণনা। যে কারণে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ বের হয়ে আসতে বাধ্য হলো। মোনায়েম খান বলেছেন, হিটলারের জার্মানি যেমন ইহুদিদের হাত থেকে মুক্তি পেতে তাদের নির্বংশ করতে চেয়েছিল, তেমনি পাকিস্তানের একমাত্র রাস্তা হলো মালাউনদের উৎখাত করা। পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কী সহজ-সরল সত্য কথা! সাম্প্রদায়িকতার এমন থিওরিটিক্যাল উচ্চারণ খুব কম সাহিত্যিকই সাহস রাখেন বলার। আরেক জায়গায় পাচ্ছি, গল্পের মূল চরিত্র অ্যাডভোকেট হাবীব, যিনি পাকিস্তানপন্থী কিংবা মেনায়েম খানের দূর-সম্পর্কের আত্মীয় বিধায় তাঁর বশংবদ- আগরতলার মামলার তোড়জোড় দেখে বলছেন, এবার শেখ মুজিব ধরা খাবে। ফাঁসিতে ঝুলতে হবে। তবে মিলিটারিরা ফাঁসির চেয়ে যেহেতু গুলি করে মারা পছন্দ করে, ফলে শেখ মুজিবকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মরতে হবে। এ কথাটাও লেখার মধ্যে হুমায়ূন কোনো রাজনৈতিক রিটরিক বলতে চেয়েছেন তা নয়, তিনি পাকিস্তানপন্থীরা যেভাবে দেখত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে, ঠিক সেভাবেই এঁকেছেন। এতে কোনো মিথ্যার অলংকার নেই। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক বিদ্যুৎ কুমার সেন তাঁর বিভাগীয় প্রধানকে গিয়ে বলছেন, আমি হিন্দু বলে আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। যেটি ছিল পাকিস্তান আমলে একটি সত্য প্রেক্ষাপট।
আবার ছাত্রসংগঠনগুলোর রাজনীতি নিয়েও তাঁর মন্তব্য তিনি যেভাবে দেখতেন বা বুঝতেন সেভাবে বলেছেন : ছাত্র ইউনিয়ন- সংস্কৃতিমান কিন্তু পলাতক মনোবৃত্তির; ছাত্রলীগ- মধ্যম মেধাবীর, সন্ত্রাস মনস্ক; ইসলামী ছাত্রসংঘ- পড়াশোনায় ভালো, গোছালো, আর এনএসএফ- গুণ্ডাদের আখড়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময়কার সন্ত্রাসী পাচপাত্তু আর খোকার বর্ণনা আছে, আর আছে শিক্ষকদের নতজানু ব্যবহারের কথা। তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য সংগ্রহ, রসায়নের ওপর একটি মূল্যবান বই কিছু সন্ত্রাসী ছাত্রের ছিঁড়ে ফেলার ঘটনাও আছে।
আমার মনে হয় হুমায়ূন আহমেদ জীবনযাপনে ও সাহিত্য নির্মাণে একটি ব্রতই মেনে চলেছেন- আর সেটি হলো নিজের বিবেকের কাছে সত্য থাকা। সততাই তাঁর সাহিত্যের প্রধান স্তম্ভ। এ জন্যই হয়তো তিনি চিরকালের বিচারে টিকে যাবেন। দেখা যাক।
লেখক : অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা।
No comments