কালের আয়নায়-অভিজ্ঞ ও দক্ষ সরকার সম্পর্কে মন্ত্রীর বালখিল্য মন্তব্য by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
১৯৯৬ সালের শেখ হাসিনা এবং ২০০৮ সালের শেখ হাসিনা একই নেত্রী নন। ১৯৯৬ সালে তিনি দলনেত্রী হিসেবে কিছুটা অভিজ্ঞ হলেও প্রধানমন্ত্রী ও সরকারপ্রধান হিসেবে নতুন ও অনভিজ্ঞ। ২০০৮ সালের শেখ হাসিনা মোটেই তা নন। তিনি এখন পূর্ব অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ প্রধানমন্ত্রী
বাংলায় একটা কথা প্রচলিত আছে_ 'বোকা বন্ধুর চাইতে বুদ্ধিমান শত্রু ভালো।' মেকিয়াভেলি বলেছেন আরেকটি কথা, 'সৎ কিন্তু অযোগ্য শাসকের চাইতে অসৎ কিন্তু যোগ্য শাসক অনেক বেশি কাম্য।' আমার মনে হয় বর্তমান বাংলাদেশের বেলায় দুটি কথাই প্রযোজ্য। একটু বেশিভাবে প্রযোজ্য। কারণ, বর্তমান সরকারের সমর্থক শিবিরে বোকা মিত্র বহু আছেন, কিন্তু শত্রু শিবিরেও বুদ্ধিমান শত্রু আছে কি? বিএনপি-জামায়াতের সাবেক সরকারের দেশ শাসনে যেটুকু যোগ্যতা ছিল, তা তাদের অসাধুতা ও দুর্নীতির আড়ালে চাপা পড়ে গেছে। বর্তমান আওয়ামী সরকার তাদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক সৎ, কিন্তু অনভিজ্ঞতা ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অযোগ্যতার জন্য তারা অনেক ভালো কাজ করা সত্ত্বেও দেশকে সুশাসন উপহার দিতে পারছেন না।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা জনগণের বিরাট ম্যান্ডেট পেয়ে যখন বেশিরভাগ নতুন ও অনভিজ্ঞ মুখ নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন, তখন মন্ত্রিসভার সদস্যদের তালিকা দেখেই আওয়ামী লীগের অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষীর মতো আমিও শঙ্কিত হয়েছিলাম। নতুন মন্ত্রীদের নাম সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতেই আমি দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখে শিরোনাম দিয়েছিলাম_ 'আশা হারাইনি, আশাহত হয়েছি।'
লেখাটি পাঠ করে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো বন্ধু আমাকে ঈষৎ ভর্ৎসনার সুরে বলেছিলেন, 'নতুন মন্ত্রিসভার যাত্রা শুরুতেই বাগড়া দিলেন? আপনি না ওয়ান-ইলেভেনের সময়ের সেই দারুণ দুর্দিনের আওয়ামী লীগকে অন্ধভাবে সমর্থন দিয়েছেন? এই বন্ধুদের বলেছি, আওয়ামী লীগ ও হাসিনা নেতৃত্বকে সমর্থন না জানিয়ে কোনো উপায় ছিল না। আওয়ামী লীগ এবার ক্ষমতায় না এলে দেশ ধ্বংস হয়ে যেত। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো বাংলাদেশে। এখনও যে তা হতে পারে না তা নয়, কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসায় সে আশঙ্কা সাময়িকভাবে কেটে যায়।
আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের বন্ধুরা আমার জবাবে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন কি-না জানি না। তাদের অনেকেই যে হননি তার প্রমাণ পরে পেয়েছি। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিশাল বিজয়ে আমি যেমন আনন্দিত, তেমনি শঙ্কিত হয়েছিলাম। আনন্দিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে, দেশটা আপাতত বেঁচে গেল। শঙ্কিত হয়েছিলাম এটা চিন্তা করে যে, এই বিশাল জয় আওয়ামী লীগ নেতাদের মনে অতি গর্ব ও অতি প্রত্যয় সৃষ্টি না করে এবং তারা পথভ্রষ্ট না হয়। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আরও বিশাল জয় এবং একটি সশন্ত্র মুক্তিযুদ্ধে সাফল্য লাভের পরও মাত্র সাড়ে তিন বছরে সেই জয় ও সাফল্য এবং জনপ্রিয়তা ধ্বংস হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বর্তমান আওয়ামী লীগ শিক্ষা গ্রহণ করেছে বলে আমি আশা করেছিলাম।
আমার এই আশা পোষণের একটা বড় কারণও ছিল। ১৯৯৬ সালের শেখ হাসিনা এবং ২০০৮ সালের শেখ হাসিনা একই নেত্রী নন। ১৯৯৬ সালে তিনি দলনেত্রী হিসেবে কিছুটা অভিজ্ঞ হলেও প্রধানমন্ত্রী ও সরকারপ্রধান হিসেবে নতুন ও অনভিজ্ঞ। ২০০৮ সালের শেখ হাসিনা মোটেই তা নন। তিনি এখন পূর্ব অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ প্রধানমন্ত্রী এবং একটি দলের নেতার পদে আছেন তাও প্রায় তিন দশক পূর্ণ হতে চলেছে।
এত দীর্ঘকাল ইউরোপ-আমেরিকার কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেতা যতই জনপ্রিয় হোন, দল বা সরকারের নেতৃত্বে থাকতে পারেন না। কিন্তু বাংলাদেশে শেখ হাসিনা দীর্ঘকাল একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতৃত্ব পদে থাকায় এ অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছেন। আল্লাহ যখন সেই সুযোগ তাকে দিয়েছেন, তখন ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় এসে একজন অভিজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী এবং দলনেত্রী হিসেবে তিনি বুঝতে পারবেন, নির্বাচনে তার বিশাল জয়টাই বড় কথা নয়। এটা একটা স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ দেশে সাধারণ নির্বাচন-জয় নয়। এটা যে দেশটিতে গণতন্ত্র চতুর্দিক থেকে শক্তিশালী শত্রুবেষ্টিত এবং দেশটিও বিরাট বিরাট সংকট দ্বারা জর্জরিত সেই দেশে আওয়ামী লীগের অপ্রত্যাশিত বিরাট নির্বাচন-জয় এবং এই জয়কে ধরে রাখার জন্য অসম্ভব শক্তিশালী শত্রুকে (তারা নির্র্বাচনে পরাজিত হয়েছেন বটে, রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হননি) এবং সংকটগুলোকে মোকাবেলা করার জন্য আওয়ামী লীগকে একটি অত্যন্ত অভিজ্ঞ এবং শত্রু ও সংকট মোকাবেলায় অত্যন্ত দক্ষ একটি সরকার গঠন করতে হবে।
কিন্তু ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনে আশাতীত জয়লাভের পর শেখ হাসিনা যখন অধিকাংশ নতুন ও অনভিজ্ঞ মুখ নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন, তখন আমি আরও অনেকের মতো এই ভেবে শঙ্কিত হয়েছি যে, বিরাট নির্বাচন-জয়ের আনন্দাতিশয্যে জননেত্রী সম্ভবত দেশি ও বিদেশি শত্রু শিবিরের শক্তিকে তুচ্ছ মনে করছেন এবং তার চারদিকে সংকটের পাহাড়কে গণনায় আনছেন না। গণনায় আনলে তিনি হয়তো এই ভয়াবহ সংকট ও শত্রুর মোকাবেলায় একটি দক্ষ ও অভিজ্ঞ এবং শক্তিশালী মন্ত্রিসভা গঠন করতেন। এ ধরনের শক্তিশালী মন্ত্রিসভা গঠিত না হওয়ায় আমি হতাশা প্রকাশ না করে পারিনি। আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের অনেকেই তাতে খুশি হননি।
আমি তাদের একথা বোঝাতে পারিনি যে, নতুন মন্ত্রিসভায় যেসব নতুন মুখ এসেছে, তাদের কারও সঙ্গেই আমার ব্যক্তিগত কোনো প্রকার বিরোধ নেই, বরং বন্ধু ও বড় ভাই-ছোট ভাইয়ের মতো সম্পর্ক। তারা মন্ত্রী হয়েছেন তাতে আমি অখুশি নই; কিন্তু আওয়ামী লীগের বর্তমান মন্ত্রিসভা গঠনে ব্যক্তিগত আনুগত্যের বদলে দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা বিচারকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত ছিল। যাকে প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী করে আগে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল, তাকে সহসা পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া, দেশে ও দেশের রাজনীতিতে দীর্ঘকাল অনুপস্থিত এবং দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহী এক ব্যক্তিকে সবচেয়ে বড় মন্ত্রীর দফতর এবং আওয়ামী লীগের মতো সুপ্রাচীন বিরাট একটি দল পরিচালনায় দায়িত্ব একইসঙ্গে দেওয়া সমীচীন হয়েছে কি-না এই প্রশ্নটির জবাব কি মাত্র দু'বছরের মধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে না?
দ্রব্যমূল্য, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট, শেয়ারবাজারে ধস, ছাত্রসন্ত্রাস দমন, এমনকি ইউনূস বিতর্কের মোকাবেলা করার ক্ষেত্রেও কি দেখা যাচ্ছে না যে, সরকারের আন্তরিকতার অভাব নয়, তাদের অধিকাংশ মন্ত্রীর অনভিজ্ঞতা, অযোগ্যতাই এই সংকট মোচনে অগ্রগতি না হওয়ার জন্য বেশি দায়ী? এই অযোগ্যতা ও অদক্ষতার সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে এক শ্রেণীর মন্ত্রীর বাচালতা। আবার তাদের পরস্পরের বাগাড়ম্বরের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিরোধিতাও দেখা যায়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন যেদিন বলেন, দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, সেদিনই দেখা যায় তার নিজের নির্বাচনী এলাকায় দিনদুপুরে আনসার ক্যাম্প লুট হয়ে গেছে। বাজারে রটনা, বাণিজ্যমন্ত্রী কথা বললেই নাকি বাজারে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। আর যে পূর্ণ মন্ত্রী দলের চিফ স্পোকসম্যান হিসেবে রাষ্ট্রীয়-পররাষ্ট্রীয় সব ব্যাপারে অর্বাচীন কথাবার্তা বলেন, তার মন্ত্রণালয়ে জরুরি ফাইল দিনের পর দিন স্তূপাকৃত হতে থাকে, দলের কাজেও তার দর্শন পেতে দলের নেতাকর্মীরা গলদঘর্ম হন। সংগঠন দিন দিন দুর্বল হচ্ছে।
দেশের, দলের এবং সরকারের এই অবস্থা দেখেই আওয়ামী লীগের এবং গণতন্ত্রের প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষীরা শঙ্কিত এবং আমার মতো তাদেরও অনেকে আওয়ামী লীগ সরকারকে সতর্ক করার চেষ্টা করছেন। এতে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড বিরক্ত। তারা শুভাকাঙ্ক্ষীদের সতর্কবাণীকেও শত্রুতা বলে গণ্য করেন এবং সময় থাকতে ভুল শোধরানোর পথে এগোবার কোনো আগ্রহই দেখাচ্ছেন না। সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষীরা আশা করছিলেন, নতুন মুখ নিয়ে গত দুই-আড়াই বছরের এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল দৃষ্টে প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিসভায় মধ্যবর্তী রদবদল (সরফঃবৎস ৎবংযঁঢ়ঢ়ষব) ঘটাবেন এবং মন্ত্রিসভাকে দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে ঢেলে সাজাবেন।
আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষীদের এবং সাধারণভাবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষেরও এই আশা সফল হয়নি। বরং প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছেন, '১৯৯৬ সালেও তো তিনি অধিকাংশ নতুন মন্ত্রী নিয়ে সরকার গঠন করেছেন, যাদের আগে মন্ত্রিত্ব করার অভিজ্ঞতা ছিল না। তাদের চেয়ে তার বর্তমান মন্ত্রিসভা আরও ভালোভাবে কাজ করছে।' প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর তার চিফ স্পোকসম্যান (যার সম্পর্কে দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহ ও অযোগ্যতার অভিযোগ বেশি) আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে ২৯ মার্চ রাতে দলের প্রেসিডিয়ামের বৈঠক শেষে এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, '১৯৯৬-এর মন্ত্রিসভায় আবদুস সামাদ আজাদ ছাড়া আর কোনো অভিজ্ঞ মন্ত্রী ছিলেন না। এবারের মন্ত্রিসভায় অনেকেরই মন্ত্রিত্বের অভিজ্ঞতা রয়েছে।' এক কথায় তিনি সাংবাদিকদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, বর্তমান মন্ত্রিসভায় কোনো রদবদল হবে না এবং রদবদলের কোনো দরকার নেই।
ঢাকার দৈনিকে প্রকাশিত মন্ত্রীর এই বাচালতার অংশটি আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের এক শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু মন্তব্য যোজনা করেছেন যে, 'আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভায় রদবদল করবে না। রদবদলের প্রয়োজন আছে বলেও মনে করে না। তার পরিণাম কি এই হবে যে, জনগণই ত্যক্তবিরক্ত হয়ে 'ভোটের বাক্সে সামগ্রিকভাবে এই রদবদলটি ঘটাবে?' আমি তাকে জবাব পাঠিয়েছি_ বালাইষাট, অমন কথা ভুলেও মুখে আনবেন না। ফুলস প্যারাডাইস বলে একটা কথা আছে। বর্তমান সরকারের অনেক মন্ত্রী সেই প্যারাডাইসে এখন বাস করছেন।
সবচেয়ে হাস্যকর দলের ও সরকারের চিফ স্পোকসম্যানের ভূমিকায় অবতীর্ণ মন্ত্রীর প্রেসিডিয়াম সভা-পরবর্তী কথাবার্তা। তার সম্ভবত ধারণা, অভিজ্ঞ মন্ত্রী বলতে আগে মন্ত্রিত্ব করাকে বোঝায়, যেমন তিনি '৯৬ সালের মন্ত্রিসভায় একটি কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী দফতরের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন এবং বর্তমানের মতোই দায়িত্ব পালন করেছেন। তার পক্ষে একথা বোঝা অসম্ভব যে, অভিজ্ঞ মন্ত্রী বলতে আগে মন্ত্রিত্ব করাকে বোঝায় না। বোঝায় দীর্ঘকালের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা। দীর্ঘকালের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা একজন রাজনীতিককে প্রশাসন সম্পর্কেও অভিজ্ঞ করে তোলে। তাকে আমলাদের মতো হাতে-কলমে প্রশাসন চালাতে হয় না। তিনি তার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা দ্বারা প্রশাসনের নীতিনির্ধারণ করেন। প্রশাসনের সাফল্য এই নীতির ওপর নির্ভর করে।
শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় কেবল আবদুস সামাদ আজাদ অভিজ্ঞ মন্ত্রী ছিলেন একথা বলা বালখিল্যতা। তখন হাসিনা সরকারের মন্ত্রী, স্পিকার, উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত ছিলেন দেশের অত্যন্ত অভিজ্ঞ এবং দক্ষ ব্যক্তিরা। যেমন শাহ মোহাম্মদ কিবরিয়া, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এবং আরও কয়েকজন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর আমলে রাষ্ট্রদূত এবং এরশাদের আমলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। শাহ মোহাম্মদ কিবরিয়া জাতীয় ও আন্তর্জাতীয় সংস্থায় এমন কোনো উচ্চপদ নেই, যাতে কাজ করেননি। প্রথম হাসিনা সরকারের আমলেও শেয়ারবাজারে ধস নেমেছিল। কিন্তু তিনি যেভাবে তা দ্রুততার সঙ্গে মোকাবেলা করেছেন তার তুলনা নেই। এখানেই দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার দাম। তার প্রজ্ঞা ও দক্ষতার ফলে সেই আমলে মুদ্রামূল্য ও দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ছিল। একটি দুর্ভিক্ষ ঘটতে গিয়ে ঘটতে পারেনি। অবশ্যই এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার কৃতিত্বই অধিক। কিন্তু যোগ্য ও অভিজ্ঞ সহকারী ছিলেন বলেই তিনি সেই কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছিলেন। বর্তমানে দেখাতে পারছেন না কেন?
ছিয়ানব্বইয়ের হাসিনা-মন্ত্রিসভায় তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ নতুন মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু অনভিজ্ঞ ও অযোগ্য মন্ত্রী ছিলেন কি? তোফায়েল, রাজ্জাক তো '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক; মুক্তিযুদ্ধের যুব নায়ক এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের গোটা আমলে তোফায়েল তার রাজনৈতিক সচিব ছিলেন। তিনি যখন হাসিনা-মন্ত্রিসভায় যোগ দেন, তখন হাসিনার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা নিয়ে তার মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। আবদুর রাজ্জাক সম্পর্কেও একই কথা বলা চলে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তো বঙ্গবন্ধুর আমল থেকেই একজন দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে পরিচিত।
বর্তমানে একশ্রেণীর অযোগ্য ও অদক্ষ মন্ত্রী কাদের অনভিজ্ঞতা ও অদক্ষতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে লোক হাসাচ্ছেন? নিজেদের চেহারা তো আয়নায় দেখে তা অন্যের বলে ভাবলে চলবে না। আর যাদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে, গত দুই-আড়াই বছরে মন্ত্রিত্ব করে তারা দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তাদের অধিকাংশের গত দুই-আড়াই বছরে দেশের সংকট মোচনে পারফরম্যান্স দেখে কি সে কথার কিছু মাত্র সমর্থন মেলে? আর এসব মন্ত্রী যদি দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দুই-ই অর্জন করে থাকেন, তাহলে তাদের মাথার ওপর ব্যাঙের ছাতার মতো একটি উপদেষ্টা পরিষদ বসিয়ে রেখে দ্বৈত শাসন (ফঁবষ ধফসরহরংঃৎধঃরড়হ) চালানোর দরকারটা কি?
শেখ হাসিনা চারজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রবীণ নেতা ও সাবেক মন্ত্রীকে এবার তার মন্ত্রিসভায় নেননি; তার একটি কারণ বোঝা যায়। তাদের বিরুদ্ধে ওয়ান-ইলেভেনের সময় 'সংস্কারপন্থি' হওয়ার অভিযোগ ছিল।
কিন্তু সংস্কারপন্থি হননি এমন বহু অভিজ্ঞ ও দক্ষ প্রবীণ ও নবীন নেতাকর্মী আওয়ামী লীগ এবং মহাজোটের সংসদীয় দলে আছেন, যাদের মন্ত্রিসভায় নেওয়া হলে সরকারের দক্ষতা ও সুনাম বাড়ত এবং এখনও নেওয়া হলে সরকারের প্রতি জনসাধারণের আস্থা বাড়বে। এ নেতারা সকলে জননেত্রীর সাবজেলে বন্দি থাকার সময় রোজ জেলগেটে দাঁড়িয়ে ধরনা দেননি বটে, কিন্তু নেত্রীর মুক্তি ও ওয়ান-ইলেভেনের থাবা থেকে দেশকে মুক্ত করার ব্যাপারে তাদের ভূমিকা ছিল সাহসী এবং শক্তিশালী। কিন্তু সুবিধাবাদী ও চাটুকারদের দ্বারা তারা আজ পরাজিত।
আমার ধারণা, দেশকে, দলকে এবং দেশের গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারকে জঞ্জালমুক্ত করার লক্ষ্যে মন্ত্রিসভায় আজ হোক কাল হোক রদবদল ঘটাবেনই। আমার আশঙ্কা, এই রদবদলে বেশি দেরি না হয়ে যায়। সময়ের এক ঘা অসময়ের দশ ঘায়ের চেয়ে অনেক বেশি সাফল্য নিশ্চিত করে।
লন্ডন, ১ এপ্রিল, শুক্রবার, ২০১১
২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা জনগণের বিরাট ম্যান্ডেট পেয়ে যখন বেশিরভাগ নতুন ও অনভিজ্ঞ মুখ নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন, তখন মন্ত্রিসভার সদস্যদের তালিকা দেখেই আওয়ামী লীগের অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষীর মতো আমিও শঙ্কিত হয়েছিলাম। নতুন মন্ত্রীদের নাম সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতেই আমি দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখে শিরোনাম দিয়েছিলাম_ 'আশা হারাইনি, আশাহত হয়েছি।'
লেখাটি পাঠ করে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো বন্ধু আমাকে ঈষৎ ভর্ৎসনার সুরে বলেছিলেন, 'নতুন মন্ত্রিসভার যাত্রা শুরুতেই বাগড়া দিলেন? আপনি না ওয়ান-ইলেভেনের সময়ের সেই দারুণ দুর্দিনের আওয়ামী লীগকে অন্ধভাবে সমর্থন দিয়েছেন? এই বন্ধুদের বলেছি, আওয়ামী লীগ ও হাসিনা নেতৃত্বকে সমর্থন না জানিয়ে কোনো উপায় ছিল না। আওয়ামী লীগ এবার ক্ষমতায় না এলে দেশ ধ্বংস হয়ে যেত। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো বাংলাদেশে। এখনও যে তা হতে পারে না তা নয়, কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসায় সে আশঙ্কা সাময়িকভাবে কেটে যায়।
আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের বন্ধুরা আমার জবাবে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন কি-না জানি না। তাদের অনেকেই যে হননি তার প্রমাণ পরে পেয়েছি। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিশাল বিজয়ে আমি যেমন আনন্দিত, তেমনি শঙ্কিত হয়েছিলাম। আনন্দিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে, দেশটা আপাতত বেঁচে গেল। শঙ্কিত হয়েছিলাম এটা চিন্তা করে যে, এই বিশাল জয় আওয়ামী লীগ নেতাদের মনে অতি গর্ব ও অতি প্রত্যয় সৃষ্টি না করে এবং তারা পথভ্রষ্ট না হয়। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আরও বিশাল জয় এবং একটি সশন্ত্র মুক্তিযুদ্ধে সাফল্য লাভের পরও মাত্র সাড়ে তিন বছরে সেই জয় ও সাফল্য এবং জনপ্রিয়তা ধ্বংস হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বর্তমান আওয়ামী লীগ শিক্ষা গ্রহণ করেছে বলে আমি আশা করেছিলাম।
আমার এই আশা পোষণের একটা বড় কারণও ছিল। ১৯৯৬ সালের শেখ হাসিনা এবং ২০০৮ সালের শেখ হাসিনা একই নেত্রী নন। ১৯৯৬ সালে তিনি দলনেত্রী হিসেবে কিছুটা অভিজ্ঞ হলেও প্রধানমন্ত্রী ও সরকারপ্রধান হিসেবে নতুন ও অনভিজ্ঞ। ২০০৮ সালের শেখ হাসিনা মোটেই তা নন। তিনি এখন পূর্ব অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ প্রধানমন্ত্রী এবং একটি দলের নেতার পদে আছেন তাও প্রায় তিন দশক পূর্ণ হতে চলেছে।
এত দীর্ঘকাল ইউরোপ-আমেরিকার কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেতা যতই জনপ্রিয় হোন, দল বা সরকারের নেতৃত্বে থাকতে পারেন না। কিন্তু বাংলাদেশে শেখ হাসিনা দীর্ঘকাল একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতৃত্ব পদে থাকায় এ অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছেন। আল্লাহ যখন সেই সুযোগ তাকে দিয়েছেন, তখন ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় এসে একজন অভিজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী এবং দলনেত্রী হিসেবে তিনি বুঝতে পারবেন, নির্বাচনে তার বিশাল জয়টাই বড় কথা নয়। এটা একটা স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ দেশে সাধারণ নির্বাচন-জয় নয়। এটা যে দেশটিতে গণতন্ত্র চতুর্দিক থেকে শক্তিশালী শত্রুবেষ্টিত এবং দেশটিও বিরাট বিরাট সংকট দ্বারা জর্জরিত সেই দেশে আওয়ামী লীগের অপ্রত্যাশিত বিরাট নির্বাচন-জয় এবং এই জয়কে ধরে রাখার জন্য অসম্ভব শক্তিশালী শত্রুকে (তারা নির্র্বাচনে পরাজিত হয়েছেন বটে, রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হননি) এবং সংকটগুলোকে মোকাবেলা করার জন্য আওয়ামী লীগকে একটি অত্যন্ত অভিজ্ঞ এবং শত্রু ও সংকট মোকাবেলায় অত্যন্ত দক্ষ একটি সরকার গঠন করতে হবে।
কিন্তু ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনে আশাতীত জয়লাভের পর শেখ হাসিনা যখন অধিকাংশ নতুন ও অনভিজ্ঞ মুখ নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন, তখন আমি আরও অনেকের মতো এই ভেবে শঙ্কিত হয়েছি যে, বিরাট নির্বাচন-জয়ের আনন্দাতিশয্যে জননেত্রী সম্ভবত দেশি ও বিদেশি শত্রু শিবিরের শক্তিকে তুচ্ছ মনে করছেন এবং তার চারদিকে সংকটের পাহাড়কে গণনায় আনছেন না। গণনায় আনলে তিনি হয়তো এই ভয়াবহ সংকট ও শত্রুর মোকাবেলায় একটি দক্ষ ও অভিজ্ঞ এবং শক্তিশালী মন্ত্রিসভা গঠন করতেন। এ ধরনের শক্তিশালী মন্ত্রিসভা গঠিত না হওয়ায় আমি হতাশা প্রকাশ না করে পারিনি। আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের অনেকেই তাতে খুশি হননি।
আমি তাদের একথা বোঝাতে পারিনি যে, নতুন মন্ত্রিসভায় যেসব নতুন মুখ এসেছে, তাদের কারও সঙ্গেই আমার ব্যক্তিগত কোনো প্রকার বিরোধ নেই, বরং বন্ধু ও বড় ভাই-ছোট ভাইয়ের মতো সম্পর্ক। তারা মন্ত্রী হয়েছেন তাতে আমি অখুশি নই; কিন্তু আওয়ামী লীগের বর্তমান মন্ত্রিসভা গঠনে ব্যক্তিগত আনুগত্যের বদলে দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা বিচারকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত ছিল। যাকে প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী করে আগে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল, তাকে সহসা পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া, দেশে ও দেশের রাজনীতিতে দীর্ঘকাল অনুপস্থিত এবং দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহী এক ব্যক্তিকে সবচেয়ে বড় মন্ত্রীর দফতর এবং আওয়ামী লীগের মতো সুপ্রাচীন বিরাট একটি দল পরিচালনায় দায়িত্ব একইসঙ্গে দেওয়া সমীচীন হয়েছে কি-না এই প্রশ্নটির জবাব কি মাত্র দু'বছরের মধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে না?
দ্রব্যমূল্য, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট, শেয়ারবাজারে ধস, ছাত্রসন্ত্রাস দমন, এমনকি ইউনূস বিতর্কের মোকাবেলা করার ক্ষেত্রেও কি দেখা যাচ্ছে না যে, সরকারের আন্তরিকতার অভাব নয়, তাদের অধিকাংশ মন্ত্রীর অনভিজ্ঞতা, অযোগ্যতাই এই সংকট মোচনে অগ্রগতি না হওয়ার জন্য বেশি দায়ী? এই অযোগ্যতা ও অদক্ষতার সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে এক শ্রেণীর মন্ত্রীর বাচালতা। আবার তাদের পরস্পরের বাগাড়ম্বরের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিরোধিতাও দেখা যায়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন যেদিন বলেন, দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, সেদিনই দেখা যায় তার নিজের নির্বাচনী এলাকায় দিনদুপুরে আনসার ক্যাম্প লুট হয়ে গেছে। বাজারে রটনা, বাণিজ্যমন্ত্রী কথা বললেই নাকি বাজারে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। আর যে পূর্ণ মন্ত্রী দলের চিফ স্পোকসম্যান হিসেবে রাষ্ট্রীয়-পররাষ্ট্রীয় সব ব্যাপারে অর্বাচীন কথাবার্তা বলেন, তার মন্ত্রণালয়ে জরুরি ফাইল দিনের পর দিন স্তূপাকৃত হতে থাকে, দলের কাজেও তার দর্শন পেতে দলের নেতাকর্মীরা গলদঘর্ম হন। সংগঠন দিন দিন দুর্বল হচ্ছে।
দেশের, দলের এবং সরকারের এই অবস্থা দেখেই আওয়ামী লীগের এবং গণতন্ত্রের প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষীরা শঙ্কিত এবং আমার মতো তাদেরও অনেকে আওয়ামী লীগ সরকারকে সতর্ক করার চেষ্টা করছেন। এতে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড বিরক্ত। তারা শুভাকাঙ্ক্ষীদের সতর্কবাণীকেও শত্রুতা বলে গণ্য করেন এবং সময় থাকতে ভুল শোধরানোর পথে এগোবার কোনো আগ্রহই দেখাচ্ছেন না। সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষীরা আশা করছিলেন, নতুন মুখ নিয়ে গত দুই-আড়াই বছরের এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল দৃষ্টে প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিসভায় মধ্যবর্তী রদবদল (সরফঃবৎস ৎবংযঁঢ়ঢ়ষব) ঘটাবেন এবং মন্ত্রিসভাকে দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে ঢেলে সাজাবেন।
আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষীদের এবং সাধারণভাবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষেরও এই আশা সফল হয়নি। বরং প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছেন, '১৯৯৬ সালেও তো তিনি অধিকাংশ নতুন মন্ত্রী নিয়ে সরকার গঠন করেছেন, যাদের আগে মন্ত্রিত্ব করার অভিজ্ঞতা ছিল না। তাদের চেয়ে তার বর্তমান মন্ত্রিসভা আরও ভালোভাবে কাজ করছে।' প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর তার চিফ স্পোকসম্যান (যার সম্পর্কে দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহ ও অযোগ্যতার অভিযোগ বেশি) আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে ২৯ মার্চ রাতে দলের প্রেসিডিয়ামের বৈঠক শেষে এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, '১৯৯৬-এর মন্ত্রিসভায় আবদুস সামাদ আজাদ ছাড়া আর কোনো অভিজ্ঞ মন্ত্রী ছিলেন না। এবারের মন্ত্রিসভায় অনেকেরই মন্ত্রিত্বের অভিজ্ঞতা রয়েছে।' এক কথায় তিনি সাংবাদিকদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, বর্তমান মন্ত্রিসভায় কোনো রদবদল হবে না এবং রদবদলের কোনো দরকার নেই।
ঢাকার দৈনিকে প্রকাশিত মন্ত্রীর এই বাচালতার অংশটি আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের এক শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু মন্তব্য যোজনা করেছেন যে, 'আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভায় রদবদল করবে না। রদবদলের প্রয়োজন আছে বলেও মনে করে না। তার পরিণাম কি এই হবে যে, জনগণই ত্যক্তবিরক্ত হয়ে 'ভোটের বাক্সে সামগ্রিকভাবে এই রদবদলটি ঘটাবে?' আমি তাকে জবাব পাঠিয়েছি_ বালাইষাট, অমন কথা ভুলেও মুখে আনবেন না। ফুলস প্যারাডাইস বলে একটা কথা আছে। বর্তমান সরকারের অনেক মন্ত্রী সেই প্যারাডাইসে এখন বাস করছেন।
সবচেয়ে হাস্যকর দলের ও সরকারের চিফ স্পোকসম্যানের ভূমিকায় অবতীর্ণ মন্ত্রীর প্রেসিডিয়াম সভা-পরবর্তী কথাবার্তা। তার সম্ভবত ধারণা, অভিজ্ঞ মন্ত্রী বলতে আগে মন্ত্রিত্ব করাকে বোঝায়, যেমন তিনি '৯৬ সালের মন্ত্রিসভায় একটি কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী দফতরের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন এবং বর্তমানের মতোই দায়িত্ব পালন করেছেন। তার পক্ষে একথা বোঝা অসম্ভব যে, অভিজ্ঞ মন্ত্রী বলতে আগে মন্ত্রিত্ব করাকে বোঝায় না। বোঝায় দীর্ঘকালের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা। দীর্ঘকালের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা একজন রাজনীতিককে প্রশাসন সম্পর্কেও অভিজ্ঞ করে তোলে। তাকে আমলাদের মতো হাতে-কলমে প্রশাসন চালাতে হয় না। তিনি তার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা দ্বারা প্রশাসনের নীতিনির্ধারণ করেন। প্রশাসনের সাফল্য এই নীতির ওপর নির্ভর করে।
শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় কেবল আবদুস সামাদ আজাদ অভিজ্ঞ মন্ত্রী ছিলেন একথা বলা বালখিল্যতা। তখন হাসিনা সরকারের মন্ত্রী, স্পিকার, উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত ছিলেন দেশের অত্যন্ত অভিজ্ঞ এবং দক্ষ ব্যক্তিরা। যেমন শাহ মোহাম্মদ কিবরিয়া, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এবং আরও কয়েকজন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর আমলে রাষ্ট্রদূত এবং এরশাদের আমলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। শাহ মোহাম্মদ কিবরিয়া জাতীয় ও আন্তর্জাতীয় সংস্থায় এমন কোনো উচ্চপদ নেই, যাতে কাজ করেননি। প্রথম হাসিনা সরকারের আমলেও শেয়ারবাজারে ধস নেমেছিল। কিন্তু তিনি যেভাবে তা দ্রুততার সঙ্গে মোকাবেলা করেছেন তার তুলনা নেই। এখানেই দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার দাম। তার প্রজ্ঞা ও দক্ষতার ফলে সেই আমলে মুদ্রামূল্য ও দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ছিল। একটি দুর্ভিক্ষ ঘটতে গিয়ে ঘটতে পারেনি। অবশ্যই এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার কৃতিত্বই অধিক। কিন্তু যোগ্য ও অভিজ্ঞ সহকারী ছিলেন বলেই তিনি সেই কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছিলেন। বর্তমানে দেখাতে পারছেন না কেন?
ছিয়ানব্বইয়ের হাসিনা-মন্ত্রিসভায় তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ নতুন মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু অনভিজ্ঞ ও অযোগ্য মন্ত্রী ছিলেন কি? তোফায়েল, রাজ্জাক তো '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক; মুক্তিযুদ্ধের যুব নায়ক এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের গোটা আমলে তোফায়েল তার রাজনৈতিক সচিব ছিলেন। তিনি যখন হাসিনা-মন্ত্রিসভায় যোগ দেন, তখন হাসিনার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা নিয়ে তার মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। আবদুর রাজ্জাক সম্পর্কেও একই কথা বলা চলে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তো বঙ্গবন্ধুর আমল থেকেই একজন দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে পরিচিত।
বর্তমানে একশ্রেণীর অযোগ্য ও অদক্ষ মন্ত্রী কাদের অনভিজ্ঞতা ও অদক্ষতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে লোক হাসাচ্ছেন? নিজেদের চেহারা তো আয়নায় দেখে তা অন্যের বলে ভাবলে চলবে না। আর যাদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে, গত দুই-আড়াই বছরে মন্ত্রিত্ব করে তারা দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তাদের অধিকাংশের গত দুই-আড়াই বছরে দেশের সংকট মোচনে পারফরম্যান্স দেখে কি সে কথার কিছু মাত্র সমর্থন মেলে? আর এসব মন্ত্রী যদি দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দুই-ই অর্জন করে থাকেন, তাহলে তাদের মাথার ওপর ব্যাঙের ছাতার মতো একটি উপদেষ্টা পরিষদ বসিয়ে রেখে দ্বৈত শাসন (ফঁবষ ধফসরহরংঃৎধঃরড়হ) চালানোর দরকারটা কি?
শেখ হাসিনা চারজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রবীণ নেতা ও সাবেক মন্ত্রীকে এবার তার মন্ত্রিসভায় নেননি; তার একটি কারণ বোঝা যায়। তাদের বিরুদ্ধে ওয়ান-ইলেভেনের সময় 'সংস্কারপন্থি' হওয়ার অভিযোগ ছিল।
কিন্তু সংস্কারপন্থি হননি এমন বহু অভিজ্ঞ ও দক্ষ প্রবীণ ও নবীন নেতাকর্মী আওয়ামী লীগ এবং মহাজোটের সংসদীয় দলে আছেন, যাদের মন্ত্রিসভায় নেওয়া হলে সরকারের দক্ষতা ও সুনাম বাড়ত এবং এখনও নেওয়া হলে সরকারের প্রতি জনসাধারণের আস্থা বাড়বে। এ নেতারা সকলে জননেত্রীর সাবজেলে বন্দি থাকার সময় রোজ জেলগেটে দাঁড়িয়ে ধরনা দেননি বটে, কিন্তু নেত্রীর মুক্তি ও ওয়ান-ইলেভেনের থাবা থেকে দেশকে মুক্ত করার ব্যাপারে তাদের ভূমিকা ছিল সাহসী এবং শক্তিশালী। কিন্তু সুবিধাবাদী ও চাটুকারদের দ্বারা তারা আজ পরাজিত।
আমার ধারণা, দেশকে, দলকে এবং দেশের গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারকে জঞ্জালমুক্ত করার লক্ষ্যে মন্ত্রিসভায় আজ হোক কাল হোক রদবদল ঘটাবেনই। আমার আশঙ্কা, এই রদবদলে বেশি দেরি না হয়ে যায়। সময়ের এক ঘা অসময়ের দশ ঘায়ের চেয়ে অনেক বেশি সাফল্য নিশ্চিত করে।
লন্ডন, ১ এপ্রিল, শুক্রবার, ২০১১
No comments