তত্ত্বাবধায়ক ভ্রান্তি বিভ্রান্তি ও রাজনীতি by ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে যেসব বক্তব্য সরকার ও বিরোধী দলের নেতারা দিয়ে থাকেন, তার বেশির ভাগই গুরুত্বসহকারে নেওয়ার পর্যায়ে পড়ে না। তাঁদের বেশির ভাগ বক্তব্যই গতানুগতিক। তত্ত্বাবধায়ক সমস্যা নিয়ে কোনো ধরনের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও সমাধানের উপায় তাতে থাকে না, যা আমাদের বা সাধারণ মানুষকে সঠিক ধারণা


দিতে পারে। এক কথায় এসব বক্তব্য দলীয় অবস্থাননির্ভর, মেঠো বক্তৃৃতার চরিত্র ও সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ হয়ে থাকে। এতে জনমনে তত্ত্বাবধায়ক এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে নানা অস্পষ্টতা, ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তি দিন দিন বেড়ে চলেছে। প্রকট হচ্ছে আস্থা-অনাস্থার সমস্যাও। জটিল যেকোনো রাজনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোকেই তথ্য-উপাত্তসহ বোধগম্য ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে হয়। সেই কাজটি দেশে তেমন একটা হচ্ছে না। অন্যদিকে পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোতেও বস্তুনিষ্ঠ ধারণা দেওয়ার চেষ্টা খুব একটা লক্ষ করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিমত এখানে তুলে ধরছি। ১৯৯৪-৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটি যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছিল তা সবারই জানা। তবে এমন একটি ধারণাকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করে সীমিতসংখ্যক উপদেষ্টা-সদস্য নিয়ে দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতা বিশেষভাবে কাজে লেগেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আসলে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কার্যকারিতা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত বিষয় হওয়া সত্ত্বেও বাস্তবে এর মর্যাদা বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি; বরং ক্রমেই নির্বাচন কমিশনকে সরকারের একটি আজ্ঞাবাহী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছিল। সত্তরের দশকে হ্যাঁ-না ভোট, আশির দশকের সব কয়টি জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন সরকারি অন্য যেকোনো অনুগত প্রতিষ্ঠানের মতোই ভূমিকা রেখেছে। মিডিয়া ক্যু, ভুয়া ফলাফল ঘোষণা ইত্যাদি কারণে একসময় দেশের নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এটি বড়জোর একটি সিলমারা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। তা থেকেই নির্বাচন নয়, সরকার উৎখাতের আন্দোলন ১৯৯০ সালে জোরদার হয়েছিল। তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর দেশে নির্বাচন নিয়ে আপাতত একটু স্বস্তি ফিরে আসে। তবে এখানেও নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার তেমন কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি যে নির্বাচনটি দেশে অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা দেখার জন্য মানুষ মোটেও প্রস্তুত ছিল না। এরশাদ যুগের নির্বাচনগুলোকেও তা হার মানায়। অথচ বিএনপি ১৯৯১ সালে অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনে জনগণের ভোটেই জয়লাভ করেছিল। কিন্তু বিএনপিই ১৫ ফেব্রুয়ারির কলঙ্কজনক নির্বাচন অনুষ্ঠানে কমিশনকে বাধ্য করেছিল। ফলে দেশে অসহযোগ আন্দোলন, সংঘর্ষ ও রক্তপাত ছড়িয়ে পড়ে। পরিণতি বুঝতে পেরে বিএনপি তড়িঘড়ি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেয়। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী গৃহীত হয়। বিএনপি ক্ষমতা ত্যাগ করে প্রথম তত্ত্বাবধায়কের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা বাস্তবে রূপ নিল। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য ৯০ দিনের একটি বিশেষ ধরনের সরকারব্যবস্থা চালু করা হলো, যার নজির পৃথিবীর কোথাও নেই।
নিয়ম অনুযায়ী তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হয়েছে চারটি। শেষের দুটির কোনোটিই সংবিধান মেনে হয়নি। তিনটি নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে পরাজিতদের প্রতিক্রিয়া ছিল প্রায় অভিন্ন। তবে কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারই স্বস্তিতে সময় পার করতে পারেনি। শঙ্কা ও নানা ষড়যন্ত্রের আয়োজন তৈরি হয়েছিল। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান অনেকটা অনুকূল পরিবেশেই প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন; কিন্তু তাঁর ৯০ দিনের সময়ও শান্তিপূর্ণ ছিল না। যে রাষ্ট্রপতি পাঁচ বছর প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া একটি কবর জিয়ারতেও হয়তো যাননি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হওয়ার পর তিনি বেশ নড়েচড়েই উঠলেন। প্রধান উপদেষ্টাকে ঘন ঘন রাষ্ট্রপতির উপদেশ নিতে বঙ্গভবনে যেতে হলো। ক্ষমতার রশি আসলে বঙ্গভবনে, নাকি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে, নাকি অন্য কোনো অদৃশ্য ভবনে ছিল- এই প্রশ্নের তেমন কোনো সদুত্তর আজও পাওয়া যায়নি। একটা দ্বৈত সরকারের টানাপড়েন শুরু হয়। তেমন অবস্থায়ই ঘটতে যাচ্ছিল সেনা অভ্যুত্থান। ব্যর্থ সেই অভ্যুত্থানের শক্তি কোথায় ছিল জানি না। তবে দেশ সত্যিই একটি ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়েছিল। প্রধান উপদেষ্টার গভীর প্রজ্ঞা সেবার জাতিকে ভয়াবহ সংকট এড়াতে সাহায্য করেছিল। ক্ষমতার ভাগাভাগির সরকার দিয়ে দেশের পরিস্থিতি আদৌ নিয়ন্ত্রণে নেওয়া যায় কি? সেবার পরিত্রাণ পাওয়া গেলেও ২০০৭ সালে পাওয়া যায়নি।
দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমান শপথ নেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সচিবালয়ে প্রথম প্রলয় ঘটে গিয়েছিল। সেবার রাষ্ট্রপতিকে আগের রাষ্ট্রপতির মতো তৎপর হতে দেখা গেল না। নির্বাচনের মাঠে নানা ধরনের তৎপরতা চলছিল, যা অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে মস্ত বড় প্রশ্ন তুলেছিল। অধিকন্তু নির্বাচনের দিন থেকে পরাজিতদের নিরাপত্তাদানে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দেশে হত্যা, ভাঙচুর, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া, ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা প্রতিহত করার কোনো উদ্যোগ নিতে তৎপর বলে মনে হয়নি সরকারকে। কাদের ইঙ্গিতে বা ইশারায় এসব করা হলো, ঘটনাগুলো সংঘটিত হলো, তা বোঝা গেল না। তবে সেই সময় জোরজবরদস্তির ব্যাপকতা অস্বীকার করা যাচ্ছে না।
তৃতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়ে সংবিধান সংশোধনসহ অনেক কিছুই দেশে ঘটে গেছে, যা দেশটাকে নতুন করে রাজনৈতিক সংকটে ফেলে দেয়। নির্বাচন কমিশনকে তখন কয়েকজন ভাঁড়ের আখড়ায় পরিণত করা হয়েছিল। ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আয়োজন প্রকাশ্যেই সমাপ্ত করে রাখা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বঙ্গভবনের সবচেয়ে দুর্বল রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ পেছনের বিদ্যুৎশক্তিতে মহাশক্তিধর হয়ে উঠলেন। প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বটাও কেড়ে নিলেন।
একটু স্মরণ করুন তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের কথা। মনে পড়ে কি সিইসি আজিজ, মাহফুজ, জাকারিয়া সাহেবদের কথা! এসব স্মরণ করলে কী মনে হয় আপনাদের কাছে জানি না। আমার কাছে তাঁদের নগরসভ্যতা ধ্বংসকারী বর্বর আক্রমণকারী গথ, ভিসিগথ, হুন, মোঙ্গলদের মতোই মনে হচ্ছিল, গত সাড়ে তিন বছরের নির্বাচনী অভিজ্ঞতা আমাদের আশাব্যঞ্জক। তবে এখনো অনেক কিছু করার বাকি রয়ে গেছে। পাড়ি দিতে হবে অনেক পথ। কিন্তু বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা হলো, রাজনীতিবিদ, নাগরিক সমাজ ও মিডিয়া- কেউই এ নিয়ে সেভাবে ভাবছে না। সবারই মনোযোগ এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দিকে। যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেই দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত হয়ে যাবে। জানি না এমন সরল বিশ্বাসের ভিত্তি কী? যদি ধরেও নিই যে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় আবার ফিরে যাওয়া সম্ভব হলো, কিন্তু সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কে হবেন- এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে? দেশ এই প্রশ্নেই তো বেশ দ্বিধাবিভক্ত, উত্তপ্ত ও বিপর্যস্ত হতে পারে। তেমন পরিস্থিতিতে আবার রাজনীতিতে মহাদুর্যোগ নেমে আসার আশঙ্কা মাথা থেকে কেউ নামিয়ে ফেলতে পারবেন কি? আসলে আবেগ, অন্ধবিশ্বাস আর ভ্রান্তিবিলাস দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতাকে দেখা ও বিচার করা যায় না। সুতরাং অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনকে আরো স্বাধীন, আরো শক্তিশালী করার বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। তা না হলে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে না।
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
patioari54@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.