অটোগ্রাফ by আশীফ এন্তাজ
হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আমার মাত্র দুটো ইচ্ছা ছিল। প্রথম ইচ্ছাটা খুব কঠিন কিছু না, ওনার অটোগ্রাফসহ একটি বই জোগাড় করা। দ্বিতীয় ইচ্ছাটাই বরং বেশ জটিল। নিজের লেখা একটি বই অটোগ্রাফসহ স্যারকে দেওয়া। এ জন্য প্রথম কাজ হচ্ছে, একটি বই লিখে ফেলা,
দ্বিতীয় কাজ একজন বোকাসোকা, সাহিত্যানুরাগী, তরুণ লেখকবান্ধব, ত্যাগী, সাহসী এবং আত্মঘাতী প্রকাশক খুঁজে বের করা। যিনি অম্লানবদনে বই ছেপে ধরা খাবেন।
প্রথম ইচ্ছাপূরণের গল্পটাই আগে বলি।
দুপুর এবং বিকেলের মাঝামাঝি একটা সময়। গোটা বইমেলা ঝিম মেরে আছে। শুধু একটা স্টলের সামনে দারুণ ভিড়। ভিড়ের রহস্য হুমায়ূন আহমেদ। কেউ তাঁকে দেখছে, কেউ অটোগ্রাফ নিচ্ছে, কেউ ছবি তোলার চেষ্টা করছে। আমি সর্বশক্তি দিয়ে স্যারের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। নিউটন বলেছিলেন, প্রত্যেক ক্রিয়ারই বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে এবং সেই প্রতিক্রিয়াটি সমান। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ এমনই এক চিজ, যেখানে স্বয়ং নিউটনের গতিসূত্র ফেল মেরে গেল। আমি যে শক্তিতে স্যারের কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করলাম, উপস্থিত জনতা তার দ্বিগুণ শক্তিতে আমাকে ঠেলে ভিড়ের বাইরে ফেলে দিল। আমি আবার চার গুণ শক্তি নিয়ে ভিড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। শার্টের তিনটা বোতাম শহীদ হলো। চতুর্থ বোতাম ছেঁড়ার আগেই ওনার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম।
দেখলাম, একটা মোচওয়ালা লোক স্যারের দিকে বই বাড়িয়ে দিয়েছেন, স্যার, একটা অটোগ্রাফ।
স্যার জিজ্ঞাসা করলেন, নাম কী আপনার?
লোকটা গাঢ় স্বরে বললেন, পারুল।
হুমায়ূন আহমেদ একটু থমকালেন।
লোকটা ব্যাখ্যা দিলেন, স্যার, বইটা আসলে আমার ইয়ের জন্য।
স্যার কথা বাড়ালেন না, অটোগ্রাফ দিয়ে দিলেন।
এরপর আমি বই বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, স্যার আমার নাম রবি।
উনি আমাকেও নিরাশ করলেন না। সেই বইটি বুকে জড়িয়ে বইমেলা থেকে বেরিয়ে এলাম। পেয়েছি, আমি পেয়েছি, স্যারের অটোগ্রাফ পেয়েছি। পরে বইটার মলাট ওল্টানোর পর মাথায় পুরো সৌরজগৎসহ আকাশ ভেঙে পড়ল। র এর ফোটা পড়েনি, রবি হয়ে গেছে ববি। ববিকে শুভেচ্ছাসহ হুমায়ূন আহমেদ।
এর কয়েক বছর পর আমার একটি বই বের হয়। প্রকাশক আমাকে ১০টি সৌজন্য কপি দেন। তার একটিতে আমি লিখি, হুমায়ূন আহমেদকে শুভেচ্ছাসহ আশীফ এন্তাজ রবি। এখন হুমায়ূন আহমেদকে কোথায় পাওয়া যায়? বই হাতে নিয়ে সারা মেলা চষে বেড়াই, স্যার নেই। শুনি কালকে আসবেন, পরদিন গিয়েও পাই না।
একদিন মেলা শেষে টিএসসিতে বসে আড্ডা মারছি, এমন সময় শোনা গেল, হুমায়ূন আহমেদ বইমেলায় এসেছেন। আমি ছুটে গেলাম। বইমেলার গেটে পুলিশ আটকে দিল। মেলার সময় শেষ, এখন আর ঢোকা যাবে না। আমি সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে পুলিশদের দ্রবীভূত করার চেষ্টা করলাম। পুলিশ দ্রবীভূত হলো না, শোলার মতো ভেসে রইল। এরপর আমি সাংবাদিক থেকে ডাইরেক্ট হিমু হয়ে গেলাম। পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে কাল্পনিক হুমায়ূন আহমেদকে ফোন করলাম, স্যার কাণ্ডটা দেখছেন? পুলিশ আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না। না, না, না, স্যার, আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। এরপর লাইনটা কেটে গলায় কেজি খানেক মধু ঢেলে পুলিশকে বললাম, দেখুন, খুবই দরকারি অ্যাপয়েন্টমেন্ট। স্যার, আমার জন্য ওয়েট করছেন। না গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। কাম অন, ইটস অ্যান ইমারজেন্সি।
শেষের ইংরেজি বাক্যটি ম্যাজিকের মতো কাজ করল। পুলিশ আমাকে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিল, তবে আমার সঙ্গে একজন পুলিশ যাবে। সে গিয়ে দেখবে আসলেই আমার সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের কোনো ঘনিষ্ঠতা আছে কি না, অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে কি না, আদৌ কোনো কাজ আছে কি না। না থাকলে আমার খবর আছে।
আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে, ফাঁকা বইমেলায় অন্যমনস্কভাবে হুমায়ূন আহমেদ স্টলে বসে সিগারেট ফুঁকছেন। আমি তাঁর সামনে গিয়ে প্রায় হাহাকার করে, স্যার, আপনি যদি আমার সঙ্গে কথা না বলেন, তাইলে এই পুলিশ ব্যাটা আমাকে অ্যারেস্ট করবে। আমি বহু নাটক করে ঢুকছি। আমি বলছি, আপনার সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
হুমায়ূন আহমেদ খুব সম্ভবত এই জাতীয় পাগলা ভক্ত সামাল দিতে অভ্যস্ত। তিনি বললেন, আরে না, পুলিশ তোমারে কিছু করবে না। তারপর উনি পুলিশকে হাত দিয়ে ইশারা দিয়ে জানালেন, সব ঠিক আছে।
পুলিশ চলে গেল।
এবার আমি আমার বইটা ওনার হাতে তুলে দিলাম। উনি মলাট উল্টে একটু মুচকি হাসলেন। আমি বললাম, স্যার, বইটা ভালো, একটু পইড়েন। শেষের গল্পটা দারুণ!
উনিও খুবই সিরিয়াসলি বললেন, আমি খুবই আগ্রহ করে পড়ব।
আমি বললাম, স্যার, ভালো লাগলে একটু জানায়েন। আপনার ফিডব্যাকের দরকার আছে।
উনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, অবশ্যই জানাব।
এ ঘটনার পর আমি কয়েক দিন খুব অ্যালার্ট থাকলাম। কোনো ফোন এল না। তার মানে কি আমার লেখা ওনার পছন্দ হয়নি? আমি ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বসলাম। ভাবতে ভাবতে হিমু থেকে মিসির আলি হয়ে গেলাম। আমার মুখে হাসি ফুটে উঠল।
ফোন আসবে কীভাবে? আমি তো শুধু অটোগ্রাফ দিয়েছি, ফোন নম্বর তো দিইনি।
প্রথম ইচ্ছাপূরণের গল্পটাই আগে বলি।
দুপুর এবং বিকেলের মাঝামাঝি একটা সময়। গোটা বইমেলা ঝিম মেরে আছে। শুধু একটা স্টলের সামনে দারুণ ভিড়। ভিড়ের রহস্য হুমায়ূন আহমেদ। কেউ তাঁকে দেখছে, কেউ অটোগ্রাফ নিচ্ছে, কেউ ছবি তোলার চেষ্টা করছে। আমি সর্বশক্তি দিয়ে স্যারের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। নিউটন বলেছিলেন, প্রত্যেক ক্রিয়ারই বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে এবং সেই প্রতিক্রিয়াটি সমান। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ এমনই এক চিজ, যেখানে স্বয়ং নিউটনের গতিসূত্র ফেল মেরে গেল। আমি যে শক্তিতে স্যারের কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করলাম, উপস্থিত জনতা তার দ্বিগুণ শক্তিতে আমাকে ঠেলে ভিড়ের বাইরে ফেলে দিল। আমি আবার চার গুণ শক্তি নিয়ে ভিড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। শার্টের তিনটা বোতাম শহীদ হলো। চতুর্থ বোতাম ছেঁড়ার আগেই ওনার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম।
দেখলাম, একটা মোচওয়ালা লোক স্যারের দিকে বই বাড়িয়ে দিয়েছেন, স্যার, একটা অটোগ্রাফ।
স্যার জিজ্ঞাসা করলেন, নাম কী আপনার?
লোকটা গাঢ় স্বরে বললেন, পারুল।
হুমায়ূন আহমেদ একটু থমকালেন।
লোকটা ব্যাখ্যা দিলেন, স্যার, বইটা আসলে আমার ইয়ের জন্য।
স্যার কথা বাড়ালেন না, অটোগ্রাফ দিয়ে দিলেন।
এরপর আমি বই বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, স্যার আমার নাম রবি।
উনি আমাকেও নিরাশ করলেন না। সেই বইটি বুকে জড়িয়ে বইমেলা থেকে বেরিয়ে এলাম। পেয়েছি, আমি পেয়েছি, স্যারের অটোগ্রাফ পেয়েছি। পরে বইটার মলাট ওল্টানোর পর মাথায় পুরো সৌরজগৎসহ আকাশ ভেঙে পড়ল। র এর ফোটা পড়েনি, রবি হয়ে গেছে ববি। ববিকে শুভেচ্ছাসহ হুমায়ূন আহমেদ।
এর কয়েক বছর পর আমার একটি বই বের হয়। প্রকাশক আমাকে ১০টি সৌজন্য কপি দেন। তার একটিতে আমি লিখি, হুমায়ূন আহমেদকে শুভেচ্ছাসহ আশীফ এন্তাজ রবি। এখন হুমায়ূন আহমেদকে কোথায় পাওয়া যায়? বই হাতে নিয়ে সারা মেলা চষে বেড়াই, স্যার নেই। শুনি কালকে আসবেন, পরদিন গিয়েও পাই না।
একদিন মেলা শেষে টিএসসিতে বসে আড্ডা মারছি, এমন সময় শোনা গেল, হুমায়ূন আহমেদ বইমেলায় এসেছেন। আমি ছুটে গেলাম। বইমেলার গেটে পুলিশ আটকে দিল। মেলার সময় শেষ, এখন আর ঢোকা যাবে না। আমি সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে পুলিশদের দ্রবীভূত করার চেষ্টা করলাম। পুলিশ দ্রবীভূত হলো না, শোলার মতো ভেসে রইল। এরপর আমি সাংবাদিক থেকে ডাইরেক্ট হিমু হয়ে গেলাম। পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে কাল্পনিক হুমায়ূন আহমেদকে ফোন করলাম, স্যার কাণ্ডটা দেখছেন? পুলিশ আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না। না, না, না, স্যার, আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। এরপর লাইনটা কেটে গলায় কেজি খানেক মধু ঢেলে পুলিশকে বললাম, দেখুন, খুবই দরকারি অ্যাপয়েন্টমেন্ট। স্যার, আমার জন্য ওয়েট করছেন। না গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। কাম অন, ইটস অ্যান ইমারজেন্সি।
শেষের ইংরেজি বাক্যটি ম্যাজিকের মতো কাজ করল। পুলিশ আমাকে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিল, তবে আমার সঙ্গে একজন পুলিশ যাবে। সে গিয়ে দেখবে আসলেই আমার সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের কোনো ঘনিষ্ঠতা আছে কি না, অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে কি না, আদৌ কোনো কাজ আছে কি না। না থাকলে আমার খবর আছে।
আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে, ফাঁকা বইমেলায় অন্যমনস্কভাবে হুমায়ূন আহমেদ স্টলে বসে সিগারেট ফুঁকছেন। আমি তাঁর সামনে গিয়ে প্রায় হাহাকার করে, স্যার, আপনি যদি আমার সঙ্গে কথা না বলেন, তাইলে এই পুলিশ ব্যাটা আমাকে অ্যারেস্ট করবে। আমি বহু নাটক করে ঢুকছি। আমি বলছি, আপনার সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
হুমায়ূন আহমেদ খুব সম্ভবত এই জাতীয় পাগলা ভক্ত সামাল দিতে অভ্যস্ত। তিনি বললেন, আরে না, পুলিশ তোমারে কিছু করবে না। তারপর উনি পুলিশকে হাত দিয়ে ইশারা দিয়ে জানালেন, সব ঠিক আছে।
পুলিশ চলে গেল।
এবার আমি আমার বইটা ওনার হাতে তুলে দিলাম। উনি মলাট উল্টে একটু মুচকি হাসলেন। আমি বললাম, স্যার, বইটা ভালো, একটু পইড়েন। শেষের গল্পটা দারুণ!
উনিও খুবই সিরিয়াসলি বললেন, আমি খুবই আগ্রহ করে পড়ব।
আমি বললাম, স্যার, ভালো লাগলে একটু জানায়েন। আপনার ফিডব্যাকের দরকার আছে।
উনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, অবশ্যই জানাব।
এ ঘটনার পর আমি কয়েক দিন খুব অ্যালার্ট থাকলাম। কোনো ফোন এল না। তার মানে কি আমার লেখা ওনার পছন্দ হয়নি? আমি ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বসলাম। ভাবতে ভাবতে হিমু থেকে মিসির আলি হয়ে গেলাম। আমার মুখে হাসি ফুটে উঠল।
ফোন আসবে কীভাবে? আমি তো শুধু অটোগ্রাফ দিয়েছি, ফোন নম্বর তো দিইনি।
No comments