বিনাবিচারে কারাবাস-দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিন
জনপ্রিয় বাংলা গানের এই বাণী অস্বীকার করা যাবে না যে প্রতিদিন কাগজের পাতা ভরে অনেক খবর আসা সত্ত্বেও জীবন পাতার অনেক খবর আমাদের অগোচরে রয়ে যায়। কিন্তু কারও কারও জীবনই কীভাবে অগোচরের অন্ধকারে থেকে 'দুঃখের দহনে করুণ রোদনে তিলে তিলে' ক্ষয় হয়ে যায়, রোববার সমকালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে তার
খণ্ডচিত্র ফুটে উঠেছে। জানা যাচ্ছে, দেশের বিভিন্ন কারাগারে কয়েক হাজার বন্দিকে বিনাবিচারে বছরের পর বছর আটকে থাকার মূল কারণ দারিদ্র্য। জামিন কিংবা মামলা চালানোর মতো সামর্থ্য ও স্বজন না থাকায় তাদের আর আলোর মুখ দেখা হয় না। কখনও কখনও অপরাধের দণ্ডকালেরও বেশি সময় কাটাতে হয় কারাগারে। সমকালের প্রতিবেদনেই রয়েছে আগারগাঁওয়ের ফুটপাতে বেড়ে ওঠা কিশোরের কথা। পকেটে গাঁজার পুরিয়া পাওয়ার মতো লঘু অপরাধে_ যার দণ্ড সর্বোচ্চ দুই বছর_ তিন বছর বিনাবিচারে আটক থাকতে হয়েছে। আমরা মনে করি, অপরাধের অভিযোগে কাউকে বিনাবিচারে এভাবে আটকে রাখাও এক ধরনের অপরাধ। সুষ্ঠু ও সুস্থ সমাজের জন্য অপরাধের প্রতিকার যেমন জরুরি, তেমনই জরুরি প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার অক্ষুণ্ন রাখা। বিনাবিচারে আটক ব্যক্তিরা রাষ্ট্রীয় অবহেলার নামে যে আদতে রাষ্ট্রীয় অপরাধেরই শিকার, আমাদের স্বীকার করতে হবে। এও স্বীকার্য, অসচ্ছল ও হতদরিদ্রের জন্য সরকারি আইন সহায়তা প্রকল্পের আওতায় জেলায় জেলায় লিগ্যাল এইড ইউনিট চালু রয়েছে। কিন্তু সেগুলো কতটা কার্যকর সে নিয়ে উঠেছে বিস্তর প্রশ্ন। নাগরিক সংগঠনগুলোর অভিযোগ, প্যানেলভুক্ত আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসকরা এ ব্যাপারে উদ্যোগী নন। রয়েছে সমন্বয়েরও অভাব। আমরা জানি, সরকার দরিদ্রদের আইনি সহায়তার ব্যাপারে আন্তরিক। তবে নীতিনির্ধারকদের সদিচ্ছা মাঠপর্যায়েও প্রতিফলিত হতে হবে। লিগ্যাল এইড ইউনিটগুলো তহবিলের অপ্রতুলতার যে কথা বলে থাকে, তা আমলযোগ্য হলেও আইনি সহায়তার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হতে পারে না। আমরা মনে করি, নিছক অর্থের জন্য নয়_ মানবিক দিক বিবেচনা করেই আইনজীবীদের উচিত অসহায় বন্দির পাশে দাঁড়ানো। এ সংক্রান্ত কোঅর্ডিনেশন কমিটিরও উচিত দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়া। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকারি আইনি সহায়তার ব্যাপারে সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিনাবিচারে আটক বেশিরভাগ ব্যক্তি ও তার স্বজন জানেনই না যে কী প্রক্রিয়ায় আইনি সহায়তা পাওয়া যায়। বন্দি অধিকার ইস্যুতে কর্মরত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে। এ প্রসঙ্গে কারাগারে জন্ম নেওয়া শিশুদের প্রতিও নজর দেওয়ার আহ্বান জানাই আমরা। বেশিরভাগ কারাগারেই তাদের দেখাশোনার জন্য 'কেয়ার সেন্টার' নেই। নেই শিশুদের উপযোগী খাদ্যের বিশেষ ব্যবস্থা ও বরাদ্দ। নিষ্পাপ শিশুদের এভাবে জীবনের আলো ও রৌদ্র থেকে বঞ্চিত থাকা মেনে নেওয়া যায় না। আসলে গোটা জেল কোডেরই পর্যালোচনা প্রয়োজন। ঔপনিবেশিক আমলের বিদ্বেষমূলক নিয়মই কিন্তু বন্দিদের অধিকার সুরক্ষার পথে বড় ধরনের অন্তরায়। একই প্রশাসনিক ধারার অন্তর্ভুক্ত প্রতিবেশী ভারত ইতিমধ্যে তাদের কারা আইন সংস্কার করেছে। আমরা পিছিয়ে থাকব কেন? বিভিন্ন কারাগারে বিনাবিচারে আটক ব্যক্তিদের শনাক্তকরণ এবং তাদের আইনি সহায়তা প্রদানের মধ্য দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ সেই কাজটি সূচিত হোক না!
No comments