ঢামেকে সেই ডাক্তারের ইন্ধনে এবার আক্রান্ত সাংবাদিকরা

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. শহীদ হোসেনের হাতে অস্ত্রোপচার হওয়া এক রোগী লাঞ্ছিত হওয়ার সংবাদ প্রকাশ করে বিপদেই পড়েছেন সেখানে দায়িত্ব পালনকারী সাংবাদিকরা।


গত বৃহস্পতিবার ২১৪ নম্বর ওয়ার্ডে এক ইন্টার্নি চিকিৎসকের সঙ্গে কথাকাটাকাটির জের ধরে আরিফুল হক চৌধুরী রিপন নামের ওই রোগীকে মারধর করে ছাড়পত্র দেন অধ্যাপক শহীদ হোসেন। এ ঘটনার সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় নিজের অপকর্ম ঢাকতে এবার ইন্টার্নি চিকিৎসকদের উদ্বুদ্ধ করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামিয়েছেন তিনি।
এ ছাড়া অধ্যাপক শহীদের লেলিয়ে দেওয়া বহিরাগত সন্ত্রাসীরা গতকাল রবিবার ঢামেকে দায়িত্ব পালন করতে গেলে ইলেকট্র্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকের ওপর হামলা চালায়। সন্ত্রাসী হামলায় আহত হয়েছেন- একুশে টিভির প্রতিবেদক মুজাহিদ হাসান, বাংলাভিশনের প্রতিবেদক রাসেল আহমেদ ও একই চ্যানেলের ক্যামেরাম্যান উজ্জ্বল দাস। হামলাকারীরা বাংলাভিশনের ক্যামেরা ভাঙচুর করে। আহত মুজাহিদকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়েছে।
এদিকে গতকাল দুপুরে ঢামেকে পুলিশ ক্যাম্পের পাশে সাংবাদিকদের জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষটিতে বিক্ষোভ মিছিল করে এসে হামলা চালান কয়েকজন ইন্টার্নি চিকিৎসক। এ সময় ঢামেকে কর্মরত বিভিন্ন প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ার প্রতিনিধিরা পালিয়ে নিজেদের রক্ষা করেন। হামলাকারীরা সাংবাদিকদের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেন। জানা গেছে, এর আগে গত শনিবার ইন্টার্নি চিকিৎসকরা বিক্ষোভ মিছিল করে হাসপাতালের পরিচালকের কাছে স্মারকলিপি দেন। ওই স্মরকলিপিতে রোগীকে ছাড়পত্র দেওয়ার পরও পরিচালক কেন হাসপাতালে রাখলেন, তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে ঢামেকে সাংবাদিকদের প্রবেশ বন্ধ করা, সংবাদ প্রকাশের জন্য ক্ষমা চাওয়ার ব্যবস্থা করাসহ সাত দফা দাবি উপস্থাপন করা হয়। ওই দাবি বাস্তবায়নের জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন বিক্ষোভকারীরা। এরপর গতকাল দুপুরে ঘটে হামলার ঘটনা। চিকিৎসকদের এমন আচরণে হতবাক হাসপাতালের রোগী ও স্টাফরা।
খবর পেয়ে ঢামেকে যান ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) ও বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশেনের (ক্র্যাব) নেতারা। তাঁরা হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে দেখা করলে তিনি ঘটনার সুষ্ঠু সমাধানের আশ্বাস দেন।
উল্লেখ্য, গত ২৭ জুন ঝিনাইদহ সদরে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন আরিফুল হক রিপন নামের এক যুবক। এরপর তাঁকে রাজশাহী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে গত ২৯ জুন তাঁকে ঢামেক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ওই দিনই রিপনের একটি অস্ত্রোপচার হয়। দুর্ঘটনায় তাঁর পাকস্থলীর দুটি নাড়িতে প্যাঁচ লেগেছিল। অস্ত্রোপচারের পর রিপন ঢামেক হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের ২১৪ নম্বর ওয়ার্ডে ৯ নম্বর শয্যায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। রিপনের স্ত্রী দিলারা চৌধুরী বন্যা ও বন্যার মা নাসিমা বেগম অভিযোগ করেন, গত মঙ্গলবার ওই ওয়ার্ডের ইন্টার্নি চিকিৎসক ডা. লাভলী রিপনকে বিছানা থেকে দ্রুত উঠে বসতে বলেন। রিপন চিকিৎসককে বলেন, পেটে সেলাইয়ের ঘায়ের কারণে তিনি বসতে পারছেন না; বসতে একটু দেরি হবে। এ নিয়ে চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। ডা. লাভলী এ ঘটনায় সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শহীদ হোসেনের কাছে অভিযোগ করেন। কিছু সময় পর শহীদ হোসেন ওয়ার্ডে গিয়ে রিপন ও তাঁর স্বজনদের বকাঝকা করেন। রিপনকে দ্রুত হাসপাতাল ছাড়ারও নির্দেশ দেন তিনি। মঙ্গলবার বিকেলের পর থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত রিপনের সেলাইয়ের স্থানে একবারও ড্রেসিং করেনি কেউ। চিকিৎসকরাও তাঁর কোনো খোঁজ নেননি। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে রিপনকে ছাড়পত্র দেওয়া হয় এবং তাঁর ফাইল নিয়ে যায় বিভাগীয় প্রধান। রিপন ও তাঁর স্বজনরা হাসপাতাল থেকে যাবেন না বলে জানালে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন অধ্যাপক শহীদ হোসেন। ওই দিন দুপুর ১২টার দিকে তিনি ২১৪ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে রিপনের ওপর চড়াও হন। বাগ্বিতণ্ডার একপর্যায় অধ্যাপক শহীদ রিপনকে প্রশ্ন করেন, 'তুই কী করিস?।' রিপন নিজেকে ঠিকাদার পরিচয় দিলে তিনি বলেন, 'ঠিকাদাররা সবাই চোর।' একপর্যায়ে ডাক্তার তাঁকে চড় মারেন এবং দ্রুত হাসপাতাল না ছাড়লে অবস্থা খারাপ হবে বলে হুমকি দেন। রোগী ও তাঁর স্বজনদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকরা ঘটনাটি জানতে ওয়ার্ডে যান। ঢামেকের পরিচালককে সাংবাদিকরা ঘটনাটি জানালে তিনি দ্রুত রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। রিপনকে তৃতীয় তলার ৪৮ নম্বর কেবিনে স্থানান্তরিত করা হয়। এ ব্যাপারে অভিযুক্ত চিকিৎসক শহীদের বক্তব্যসহ প্রচারমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
জানা গেছে, বিভিন্ন পত্রিকায় চিকিৎসকের হাতে রোগী লাঞ্ছিত হওয়ার খবর প্রকাশিত হলে বিপাকে পড়েন অধ্যাপক শহীদ। তাই ইন্টার্নি চিকিৎসকদের উসকানি দিয়ে পরিচালকের কাছে অভিযোগ করান। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল দুপুর ১২টার দিকে কিছু ইন্টার্নি চিকিৎসক আউটডোর থেকে মিছিল নিয়ে জরুরি বিভাগের দিকে যান। এ সময় থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরা কিছু বহিরাগত যুবকও ছিল। ওই সময় দায়িত্ব পালন করতে সেখানে গেলে একুশে টিভির রিপোর্টার মুজাহিদ হাসান, বাংলাভিশনের রিপোর্টার রাসেল ও ক্যামেরাম্যান উজ্জ্বল দাসের ওপর হামলা চালায় তারা। হামলায় তিনজনই গুরুতর আহত হন। পরে সহকর্মীরা মুজাহিদকে উদ্ধার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করেন। বিক্ষোভকারীরা জরুরি বিভাগের ফটকের কাছে পুলিশ ক্যাম্পের পাশে সাংবাদিকদের জন্য বরাদ্দ কক্ষটিতে হামলা চালায়। কক্ষ থেকে সব আসবাবপত্র বের করে ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে তারা। ওই সময় পুলিশ ক্যাম্প ইনচার্জ মোজাম্মেল হকের বাধায় সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরে সাংবাদিকদের কক্ষে একটি তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। দুপুর পৌনে ২টার দিকে বিক্ষোভকারীরা জরুরি বিভাগের সামনে থেকে চলে যায়। ঢামেকে কর্তব্যরত সাংবাদিকরা বলেন, এ ঘটনার পর তাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় আছেন।
এদিকে গতকাল বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ডিআরইউ সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা, সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু, ক্র্যাব সভাপতি আখতারুজ্জামান লাবলু ও সাধারণ সম্পাদক ইসারফ হোসেন ঈসাসহ সাংবাদিক নেতারা ঢামেকে যান। তাঁরা উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ব্যাপারে পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেন। গতকাল রাত পর্যন্ত সাংবাদিকদের কক্ষটিতে তালা ঝুলছিল।
গতকাল অধ্যাপক শহীদ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি এসব খবর রাখি না। কারো খবর রাখি না। আমি জানি না। যারা বদনাম করে, তারা মানুষের বাচ্চা না। এসব কথা বলতে চাই না।'

No comments

Powered by Blogger.