জন্মদিন-দেশ হারিয়েছে দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতা by মো. কামাল হোসেন
১৯৭৫ সালে জেলহত্যার পর যখন তাজউদ্দীন আহমদের মরদেহ সাত মসজিদ রোডের বাড়ির আঙিনায় আনা হয়, তখন কিছু সময়ের জন্য সম্বিৎ হারান। তারপরই তিনি চেতনার গভীরে উচ্চারণ করেন_ আমি হারালাম স্বামীকে, ছেলেমেয়েরা হারাল তাদের বাবাকে; কিন্তু দেশ হারাল কাকে! সত্যিই তো তাই।
তাজউদ্দীন আহমদ ৪১ বছর বয়সে দলের সাধারণ সম্পাদক হন। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন ৪৬ বছর বয়সে
গবেষণা কাজের সূত্র ধরে তাজউদ্দীন আহমদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আমার প্রথম সরাসরি পরিচয় ঘটে ২০০০ সালের এপ্রিলে। ধানমণ্ডির সাত মসজিদ রোডে ৭৫১ নং বাড়ি। বাড়ির সামনে_ প্রায় রাস্তার মাঝখানে মাথা উঁচু করে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে একটি আমগাছ। পরে জেনেছিলাম, গাছটি তাজউদ্দীন আহমদ নিজ হাতে লাগিয়েছিলেন ১৯৬৯ সালে। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। প্রথমে তানজিম আহমদ সোহেল তাজের সঙ্গে কথা। বছর দুয়েক আগে তিনি আমেরিকা থেকে বিজনেস স্টাডিজে মাস্টার্স করে এসেছেন। কথা বলছিলেন বাংলাদেশের আর্সেনিক সমস্যা নিয়ে। দেশের বেশ কিছু স্থানের আর্সেনিক সমস্যার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরলেন। তার উদ্বেগ_ যদি এখনই সতর্ক না হওয়া যায়, তাহলে আর্সেনিক মহামারী হিসেবে দেখা দিতে পারে। কিছুক্ষণ পরে এলেন সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন এবং সিমিন হোসেন রিমি। আমি তাদের আমার উদ্দেশ্যের কথা বললাম। ততক্ষণে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন মুক্তিযুদ্ধ, তার পরের ঘটনাবলি, বর্তমান অবস্থা প্রভৃতি নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন। রিমি আপা তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে এর প্রায় এক যুগ আগে কাজ শুরু করেছেন। এরপর বহুবার এই বাড়িতে গিয়েছি। এই বাড়িতে বসে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। আর আলাপচারিতা হয়েছে দেখা হলেই। এ ছাড়াও সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছি ডা. করিম (যিনি তাজউদ্দীন আহমদের প্রাথমিক রাজনৈতিক জীবনের বহু ঘটনার সাক্ষী), দলিলউদ্দীন (তাজউদ্দীন আহমদের ভাইপো), জনৈক বুলবুল (যিনি ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের মর্মন্তুদ ঘটনার পূর্বাপর বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করেন কারাবন্দি হিসেবে) প্রমুখের। তাজউদ্দীন আহমদ জেলখানাতে বসেই বিভিন্নভাবে দলের নেতাকর্মীদের কাছে সংবাদ পাঠানোর চেষ্টা করেন, যাতে মোশতাক আহমদ কোনোভাবেই সংসদ বসাতে না পারেন। তিনি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছিলেন, মোশতাক ৯০ দিনের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। বস্তুত মোশতাক আহমদ মাত্র ৮১ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। ১৯৭৩ সালের দিক থেকেই তাজউদ্দীন আহমদ বুঝতে পারেন, ভবিষ্যৎ খারাপ কিছুর দিকে মোড় নিচ্ছে। জোহরা তাজউদ্দীন স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে বলেন, 'তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার তুলনা হয় না। তিনি আগেই সবকিছু দেখতে, বুঝতে পারতেন। আমাকে তিনি বলতেন, তোমরা শিগগিরই বিধবা হচ্ছো। বেগম মুজিবসহ অন্যান্য ভাবীকেও একই কথা বলতেন।' তিনি আরও বলেন_ '১৯৭৫ সন। তাজউদ্দীন আহমদ তখন মন্ত্রিপরিষদে নেই। ২৭ কিংবা ২৮ জুলাই একদিন মধ্যরাতে খেয়াল করলাম খুব সাধারণ পোশাকে আমাকে কিছু না বলে বাইরে চলে গেলেন। ঘণ্টাখানেক পরে ফিরে এলেন। কোথায় কেন গিয়েছিলেন প্রশ্ন করেও জানতে পারিনি। ১৫ আগস্ট মুজিব ভাইকে সপরিবারে হত্যার পর আমাদের বাড়িও সকাল হতে ঘেরাও করে রাখে আর্মির লোকেরা। এ সময় তাজউদ্দীন জানান, সেদিন তিনি গোপনে মুজিব ভাইয়ের ৩২ নম্বর বাড়িতে গিয়েছিলেন সাবধান করতে যে, মুজিবকে হত্যাসহ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটি গভীর চক্রান্ত চূড়ান্ত হয়ে গেছে। নির্দিষ্ট সূত্রের উল্লেখ করে তিনি মুজিব ভাইকে অনুরোধ জানিয়ে এসেছিলেন এক-দু'দিনের মধ্যেই অরক্ষিত ৩২নং ছেড়ে গণভবনে চলে যাওয়ার জন্য। এর কয়েক দিন পরেই তো ঐ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল।'
পাশের বাড়িটি নিরাপদ দূরত্ব বজায় না রেখে পুনর্নির্মাণ করতে শুরু করলে তাজউদ্দীন আহমদের ধানমণ্ডির বাড়িটি ২০০৬ সালের ৪ এপ্রিল হেলে পড়তে থাকে। তখন পত্রিকায় এর সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়। তড়িঘড়ি করে বহু মালপত্র রেখেই তার পরিবারের সদস্যরা বনানীর পুরাতন ডিওএইচএসের একটি ভাড়া বাড়িতে চলে যান। পরে ধানমণ্ডির বাড়িটি পুনর্নির্মিত হয়ে বহুতলবিশিষ্ট তাজ-লিলি গ্রিন নামে শোভা পাচ্ছে। স্বভাবতই মুজিব-তাজউদ্দীনের স্মৃতিধন্য; বহু ক্রান্তিকালীন মিটিংয়ের সাক্ষী এই বাড়িটি অক্ষত থাকল না। শুনেছি, বহুতলবিশিষ্ট ভবনটির টপ ফ্লোরে তাজউদ্দীন আহমদ মিউজিয়াম করা হবে।
সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের বনানীর বাসাতেও বেশ কয়েকবার গিয়েছি। এর মধ্যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ইতিহাসের অজানা কোনো উপাদান বা তথ্য যদি পাই, সেই আশা নিয়ে মাঝে মধ্যেই ছুটে যাই। তিনি যতক্ষণ কথা বলেন, তার মধ্যে দেশপ্রেম, দেশের মঙ্গল, দেশের ভবিষ্যৎ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, নির্মমভাবে মুক্তিযুদ্ধের নেতাদের হত্যা, রাজাকার, জঙ্গিবাদ প্রভৃতি প্রসঙ্গ থাকে। সর্বশেষ তার সঙ্গে আমার দেখা ২০০৮ সালে। তখন জরুরি অবস্থা চলছে। তার একই কথা_ দেশের কী হবে? এই বাসাতেই একদিন তাজউদ্দীন আহমদের উচ্চাদর্শ সম্পর্কে বললেন, 'আতাউর রহমান সাহেব তখন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি পেশায় ছিলেন আইনজীবী। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে তার চলমান মামলাগুলোর নথিপত্র প্রস্তুত করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। আর বলেছিলেন, তুমি তো ব্যস্ত মানুষ। ফেরার সময় আমার গাড়ি ব্যবহার করো। হঠাৎ একদিন তিনি খেয়াল করলেন, তাজউদ্দীন চলে গেলেন, কিন্তু গাড়ি বারান্দাতেই রয়েছে। ড্রাইভারের কাছ থেকে জানতে পারেন তাজউদ্দীন গাড়ি নেন না কোনোদিনই। পরদিন তার কাছে এর কারণ জানতে চাইলে তাজউদ্দীন বলেন, এটা তো আপনার সরকারি গাড়ি। সেটি কেবল আপনিই ব্যবহার করতে পারেন। আর আমার তেমন সমস্যাও হয় না।_ এই হলো তাজউদ্দীন।' দাম্পত্য জীবনের শুরু থেকেই জোহরা তাজউদ্দীন আওয়ামী লীগের সক্রিয় সংগঠক। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনের কারণে যখন পর্যায়ক্রমে সব নেতাকর্মীকে বন্দি করা হয়, তখন এক পর্যায়ে তিনি ও তার মতো অনেকেই দলকে চাঙ্গা রাখার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আর দশজনের মতো তিনিও প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে নাবালক ছেলেমেয়েদের নিয়ে কলকাতায় যান। ১৯৭৫ সালের মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগ হয়ে পড়ে নেতৃত্বহীন। অনেকেই ছিলেন কারাবন্দি। কেউবা মোশতাক, সায়েম ও জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারের সঙ্গে হাত মেলান। আওয়ামী লীগ যাতে কোনো কর্মসূচি পালন না করতে পারে, সে বিষয়ে ছিল শ্যেনদৃষ্টি। এই দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে মহীয়সী জোহরা তাজউদ্দীন আওয়ামী লীগকে উঠে দাঁড়াতে ১৯৭৭ সাল থেকে দেশের সুদূর প্রান্ত পর্যন্ত কষ্ট করে ছুটে গেছেন। নেতাকর্মীদের মনে শক্তি জুগিয়েছেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত সাংগঠনিক এই সফরের কথা আজও অনেকের মনে ভাস্বর হয়ে আছে। দলের জন্য তার এই দুঃসাহসিক অবদান অবিস্মরণীয়। দেশ ও তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে তার একটি অনুভব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৭৫ সালে জেলহত্যার পর যখন তাজউদ্দীন আহমদের মরদেহ সাত মসজিদ রোডের বাড়ির আঙিনায় আনা হয়, তখন কিছু সময়ের জন্য সম্বিৎ হারান। তারপরই তিনি চেতনার গভীরে উচ্চারণ করেন_ আমি হারালাম স্বামীকে, ছেলেমেয়েরা হারাল তাদের বাবাকে; কিন্তু দেশ হারাল কাকে! সত্যিই তো তাই। তাজউদ্দীন আহমদ ৪১ বছর বয়সে দলের সাধারণ সম্পাদক হন। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন ৪৬ বছর বয়সে। আর মাত্র ৫০ বছর বয়সে উন্মত্ত ঘাতকের বুলেট তার প্রাণ ছিনিয়ে নেয় অন্যান্য রাজনৈতিক সহকর্মীর সঙ্গে। যে গতিতে রাজনীতিতে তার উত্থান এবং অর্জন, তাতে স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল পেলে জাতিকে তিনি অদ্যাবধি অনেক কিছুই দিতে পারতেন। এই ক্ষতি স্বাধীন বাংলাদেশের; এই দেশের মানুষের।
আজ ২৩ জুলাই ৮৭তম জন্মবার্ষিকীতে তার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
ড. মো. কামাল হোসেন :তাজউদ্দীন আহমদ এবং বাংলাদেশের
অভ্যুদয় বিষয়ক গবেষক
গবেষণা কাজের সূত্র ধরে তাজউদ্দীন আহমদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আমার প্রথম সরাসরি পরিচয় ঘটে ২০০০ সালের এপ্রিলে। ধানমণ্ডির সাত মসজিদ রোডে ৭৫১ নং বাড়ি। বাড়ির সামনে_ প্রায় রাস্তার মাঝখানে মাথা উঁচু করে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে একটি আমগাছ। পরে জেনেছিলাম, গাছটি তাজউদ্দীন আহমদ নিজ হাতে লাগিয়েছিলেন ১৯৬৯ সালে। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। প্রথমে তানজিম আহমদ সোহেল তাজের সঙ্গে কথা। বছর দুয়েক আগে তিনি আমেরিকা থেকে বিজনেস স্টাডিজে মাস্টার্স করে এসেছেন। কথা বলছিলেন বাংলাদেশের আর্সেনিক সমস্যা নিয়ে। দেশের বেশ কিছু স্থানের আর্সেনিক সমস্যার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরলেন। তার উদ্বেগ_ যদি এখনই সতর্ক না হওয়া যায়, তাহলে আর্সেনিক মহামারী হিসেবে দেখা দিতে পারে। কিছুক্ষণ পরে এলেন সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন এবং সিমিন হোসেন রিমি। আমি তাদের আমার উদ্দেশ্যের কথা বললাম। ততক্ষণে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন মুক্তিযুদ্ধ, তার পরের ঘটনাবলি, বর্তমান অবস্থা প্রভৃতি নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন। রিমি আপা তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে এর প্রায় এক যুগ আগে কাজ শুরু করেছেন। এরপর বহুবার এই বাড়িতে গিয়েছি। এই বাড়িতে বসে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। আর আলাপচারিতা হয়েছে দেখা হলেই। এ ছাড়াও সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছি ডা. করিম (যিনি তাজউদ্দীন আহমদের প্রাথমিক রাজনৈতিক জীবনের বহু ঘটনার সাক্ষী), দলিলউদ্দীন (তাজউদ্দীন আহমদের ভাইপো), জনৈক বুলবুল (যিনি ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের মর্মন্তুদ ঘটনার পূর্বাপর বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করেন কারাবন্দি হিসেবে) প্রমুখের। তাজউদ্দীন আহমদ জেলখানাতে বসেই বিভিন্নভাবে দলের নেতাকর্মীদের কাছে সংবাদ পাঠানোর চেষ্টা করেন, যাতে মোশতাক আহমদ কোনোভাবেই সংসদ বসাতে না পারেন। তিনি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছিলেন, মোশতাক ৯০ দিনের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। বস্তুত মোশতাক আহমদ মাত্র ৮১ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। ১৯৭৩ সালের দিক থেকেই তাজউদ্দীন আহমদ বুঝতে পারেন, ভবিষ্যৎ খারাপ কিছুর দিকে মোড় নিচ্ছে। জোহরা তাজউদ্দীন স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে বলেন, 'তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার তুলনা হয় না। তিনি আগেই সবকিছু দেখতে, বুঝতে পারতেন। আমাকে তিনি বলতেন, তোমরা শিগগিরই বিধবা হচ্ছো। বেগম মুজিবসহ অন্যান্য ভাবীকেও একই কথা বলতেন।' তিনি আরও বলেন_ '১৯৭৫ সন। তাজউদ্দীন আহমদ তখন মন্ত্রিপরিষদে নেই। ২৭ কিংবা ২৮ জুলাই একদিন মধ্যরাতে খেয়াল করলাম খুব সাধারণ পোশাকে আমাকে কিছু না বলে বাইরে চলে গেলেন। ঘণ্টাখানেক পরে ফিরে এলেন। কোথায় কেন গিয়েছিলেন প্রশ্ন করেও জানতে পারিনি। ১৫ আগস্ট মুজিব ভাইকে সপরিবারে হত্যার পর আমাদের বাড়িও সকাল হতে ঘেরাও করে রাখে আর্মির লোকেরা। এ সময় তাজউদ্দীন জানান, সেদিন তিনি গোপনে মুজিব ভাইয়ের ৩২ নম্বর বাড়িতে গিয়েছিলেন সাবধান করতে যে, মুজিবকে হত্যাসহ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটি গভীর চক্রান্ত চূড়ান্ত হয়ে গেছে। নির্দিষ্ট সূত্রের উল্লেখ করে তিনি মুজিব ভাইকে অনুরোধ জানিয়ে এসেছিলেন এক-দু'দিনের মধ্যেই অরক্ষিত ৩২নং ছেড়ে গণভবনে চলে যাওয়ার জন্য। এর কয়েক দিন পরেই তো ঐ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল।'
পাশের বাড়িটি নিরাপদ দূরত্ব বজায় না রেখে পুনর্নির্মাণ করতে শুরু করলে তাজউদ্দীন আহমদের ধানমণ্ডির বাড়িটি ২০০৬ সালের ৪ এপ্রিল হেলে পড়তে থাকে। তখন পত্রিকায় এর সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়। তড়িঘড়ি করে বহু মালপত্র রেখেই তার পরিবারের সদস্যরা বনানীর পুরাতন ডিওএইচএসের একটি ভাড়া বাড়িতে চলে যান। পরে ধানমণ্ডির বাড়িটি পুনর্নির্মিত হয়ে বহুতলবিশিষ্ট তাজ-লিলি গ্রিন নামে শোভা পাচ্ছে। স্বভাবতই মুজিব-তাজউদ্দীনের স্মৃতিধন্য; বহু ক্রান্তিকালীন মিটিংয়ের সাক্ষী এই বাড়িটি অক্ষত থাকল না। শুনেছি, বহুতলবিশিষ্ট ভবনটির টপ ফ্লোরে তাজউদ্দীন আহমদ মিউজিয়াম করা হবে।
সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের বনানীর বাসাতেও বেশ কয়েকবার গিয়েছি। এর মধ্যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ইতিহাসের অজানা কোনো উপাদান বা তথ্য যদি পাই, সেই আশা নিয়ে মাঝে মধ্যেই ছুটে যাই। তিনি যতক্ষণ কথা বলেন, তার মধ্যে দেশপ্রেম, দেশের মঙ্গল, দেশের ভবিষ্যৎ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, নির্মমভাবে মুক্তিযুদ্ধের নেতাদের হত্যা, রাজাকার, জঙ্গিবাদ প্রভৃতি প্রসঙ্গ থাকে। সর্বশেষ তার সঙ্গে আমার দেখা ২০০৮ সালে। তখন জরুরি অবস্থা চলছে। তার একই কথা_ দেশের কী হবে? এই বাসাতেই একদিন তাজউদ্দীন আহমদের উচ্চাদর্শ সম্পর্কে বললেন, 'আতাউর রহমান সাহেব তখন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি পেশায় ছিলেন আইনজীবী। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে তার চলমান মামলাগুলোর নথিপত্র প্রস্তুত করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। আর বলেছিলেন, তুমি তো ব্যস্ত মানুষ। ফেরার সময় আমার গাড়ি ব্যবহার করো। হঠাৎ একদিন তিনি খেয়াল করলেন, তাজউদ্দীন চলে গেলেন, কিন্তু গাড়ি বারান্দাতেই রয়েছে। ড্রাইভারের কাছ থেকে জানতে পারেন তাজউদ্দীন গাড়ি নেন না কোনোদিনই। পরদিন তার কাছে এর কারণ জানতে চাইলে তাজউদ্দীন বলেন, এটা তো আপনার সরকারি গাড়ি। সেটি কেবল আপনিই ব্যবহার করতে পারেন। আর আমার তেমন সমস্যাও হয় না।_ এই হলো তাজউদ্দীন।' দাম্পত্য জীবনের শুরু থেকেই জোহরা তাজউদ্দীন আওয়ামী লীগের সক্রিয় সংগঠক। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনের কারণে যখন পর্যায়ক্রমে সব নেতাকর্মীকে বন্দি করা হয়, তখন এক পর্যায়ে তিনি ও তার মতো অনেকেই দলকে চাঙ্গা রাখার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আর দশজনের মতো তিনিও প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে নাবালক ছেলেমেয়েদের নিয়ে কলকাতায় যান। ১৯৭৫ সালের মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগ হয়ে পড়ে নেতৃত্বহীন। অনেকেই ছিলেন কারাবন্দি। কেউবা মোশতাক, সায়েম ও জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারের সঙ্গে হাত মেলান। আওয়ামী লীগ যাতে কোনো কর্মসূচি পালন না করতে পারে, সে বিষয়ে ছিল শ্যেনদৃষ্টি। এই দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে মহীয়সী জোহরা তাজউদ্দীন আওয়ামী লীগকে উঠে দাঁড়াতে ১৯৭৭ সাল থেকে দেশের সুদূর প্রান্ত পর্যন্ত কষ্ট করে ছুটে গেছেন। নেতাকর্মীদের মনে শক্তি জুগিয়েছেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত সাংগঠনিক এই সফরের কথা আজও অনেকের মনে ভাস্বর হয়ে আছে। দলের জন্য তার এই দুঃসাহসিক অবদান অবিস্মরণীয়। দেশ ও তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে তার একটি অনুভব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৭৫ সালে জেলহত্যার পর যখন তাজউদ্দীন আহমদের মরদেহ সাত মসজিদ রোডের বাড়ির আঙিনায় আনা হয়, তখন কিছু সময়ের জন্য সম্বিৎ হারান। তারপরই তিনি চেতনার গভীরে উচ্চারণ করেন_ আমি হারালাম স্বামীকে, ছেলেমেয়েরা হারাল তাদের বাবাকে; কিন্তু দেশ হারাল কাকে! সত্যিই তো তাই। তাজউদ্দীন আহমদ ৪১ বছর বয়সে দলের সাধারণ সম্পাদক হন। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন ৪৬ বছর বয়সে। আর মাত্র ৫০ বছর বয়সে উন্মত্ত ঘাতকের বুলেট তার প্রাণ ছিনিয়ে নেয় অন্যান্য রাজনৈতিক সহকর্মীর সঙ্গে। যে গতিতে রাজনীতিতে তার উত্থান এবং অর্জন, তাতে স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল পেলে জাতিকে তিনি অদ্যাবধি অনেক কিছুই দিতে পারতেন। এই ক্ষতি স্বাধীন বাংলাদেশের; এই দেশের মানুষের।
আজ ২৩ জুলাই ৮৭তম জন্মবার্ষিকীতে তার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
ড. মো. কামাল হোসেন :তাজউদ্দীন আহমদ এবং বাংলাদেশের
অভ্যুদয় বিষয়ক গবেষক
No comments