কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-আমার দেশের আলো, আমার দেশের কালো by রণজিৎ বিশ্বাস

দেশের আলো ও কালোর কথা বলুন। : বিশেষ সময়ে বিশেষ কথা, দেশের কালোর কথা আমি বলতে চাই না। শুধু আলোর কথা বলেই শেষ করি! : তেমন করলে করতে পারেন, কিন্তু তেমন শোনায় আজ মনের সায় নেই। দুর্ভোগের ছবিতে ভয় পেয়ে তাকে বাড়ির সবচেয়ে ভয়ের ঘরে, আঁধার ঘরেও কোনো এক ভূতের ঘরে আটকে রাখলে চলবে না।


অনেক দিন আমরা তেমন করেছি। গৌরবের দিনে শুধু আনন্দগান গেয়ে অনুষ্ঠান সাঙ্গ করেছি। কিটেদের সামনে আনিনি।
তা ছাড়া এটিও তো সত্য, আলোর পাশে অন্ধকারকে এবং গৌরবের পাশে গ্লানিকে বিশ্লেষণ করে পথ কাটার জন্য পথের মাঝে দাঁড়াতে হবে মাঝে মাঝে। রবীন্দ্রবীক্ষণ এখানেও রিক্ত নয় : 'যে চলা পদে পদে থামার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, সে চলা চলা নয়।'
: তাহলে আমি কালোর কথা আগে বলব।
: বলুন। তাকে পেছনে রেখেই তার 'পরেই আলোর কথা সাজিয়ে দিন।
: আমার দেশের একটি কালোয় একটি কালোয় মনের আলো নিভে যায়। আমার দেশের সব মানুষ এখনো হতে পারেনি আলোর পাখি। তারা আঁধারডোবা ঘরের কোণে স্যাঁতসেঁতে জমিনে কিটের মতো বসবাস করে।
: চিনিয়ে দিন না!
: এরা কখনো স্বাধীনতার জন্য গৌরব করেনি। এরা কখনো মুক্তির জন্য কৃতজ্ঞ নয়। পৃথিবীর আর কোন কোণে আপনি মানবায় এমন কিটের সন্ধান পাবেন না- যারা দেশের স্বাধীনতার চলি্লশ বছর পরও নিজের দেশের স্বাধীনতাকে স্বাধীনতা, গৌরবকে গৌরব, বিজয়কে বিজয়, সৌরভকে সৌরভ ও শোককে শোক মানে না।
এদের মধ্যে যারা এখন যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বিলম্বে হলেও যথাপ্রাপ্য বুঝে পাওয়ার অপেক্ষায় যোগ্য স্থানে দিন গুনছে, তারা বা তাদের চ্যালাসাঙ্গাত কিংবা ধৌতমস্তিষ্ক অনুসারীরা বাইরে আছে, তাদের কেউ ভুলেও কখনো স্বাধীনতার পক্ষে, মানবতার পক্ষে কিংবা বিজয়ের পক্ষে এক 'লব্জ্' কোথাও উচ্চারণ করেছে?! কখনো শুনেছে? কোথাও পড়েছেন?! মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে, দেশের মানুষের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে বিপরীতে দাঁড়িয়ে শুধু নয় অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে, মুক্তিযোদ্ধার বুকে গুলি করে, নিজের ও প্রতিবেশীর ভাই, বন্ধু, পিতা ও শিক্ষককে হত্যা করে, বন্ধুর বোনের শুচিতা নষ্ট করে এবং তাদের লাঞ্ছনার জন্য অন্যের হাতে তুলে দিয়ে অপরাধ করেছি। অন্যের অনৈতিক সম্পর্কের সন্তানের মতো রাজাকারি আলবদরি ও আলশামসি করে দেশের পবিত্র মাটির সঙ্গে বেইমানি করেছি- এমন কথা তারা কখনো পরোক্ষভাবেও বলেনি। বরং, সরাসরি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছে- ১৯৭১ সালে যা করেছি (মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি ওদের অপবিত্র মুখে যে তোলেনি, এক দিক থেকে সেটিই রক্ষ।), তা ছিল আমাদের রাজনৈতিক কৌশল, আমাদের আদর্শিক অবস্থান। বলেছে- সেটি ছিল গৃহযুদ্ধ; বলেছে- মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বাধীনতার যুদ্ধ সেটি হবে কেন! সেটি তো ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মটির ওপর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ।
যত দিন এ আস্ফালনকারী ও তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের আমরা প্রাপ্য বুঝিয়ে দিত পারব না, তত দিন আমাদের আকাশের মেঘ সরবে না, আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের কালো ঘুচবে না।
এত কিছুর পরও আমার দেশের সবচেয়ে আলোর দিক হচ্ছে, যাদের কাঁধে ভর দিয়ে আমার দেশের ভবিষ্যৎ দাঁড়াবে, স্বপ্নের শেকড় নামবে ও ডালপালা ছড়াবে- সেই তরুণ সমাজ তাদের দুই নয়নের আঁধি কেটে নিচ্ছে ও তাদের বোধেবোধিতে স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার হচ্ছে- কে আসলে কে, কারা আসলে কারা, কী আসলে কী।
আমার দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনার দিক, এই দেশটির পবিত্র মাটি এখনো সংসারের সবচেয়ে সুবাসিত ও স্বপ্নসম্ভব মৃত্তিকা।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.