দিল্লির চিঠি-দ্বিতীয় মেয়াদে হেরে গেলেন মনমোহন? by কুলদীপ নায়ার

ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের দ্বিতীয় মেয়াদ তাঁর জন্য অনেক বদনাম বয়ে এনেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দিল্লি সফর করে যাওয়ার পর মনমোহনের অবস্থান ছিল উঁচুতে। মনমোহনের মুখনিঃসৃত বাণী তখন বিবেচিত হতো গভীর জ্ঞানসমৃদ্ধ মুক্তা হিসেবে।


কিন্তু যেই একের পর এক কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হতে থাকল, তাঁর সেই ভান্ডার ধসে পড়তে শুরু করল।
মনমোহনের এই দুর্ভাগ্যের সূচনা ঘটে কমনওয়েলথ গেমসের প্রস্তুতির সময়, আর তা চূড়ায় পৌঁছে টু-জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারির সময়। টু-জি কেলেঙ্কারির ফলে সরকারি কোষাগারকে গুনতে হয় এক লাখ ৬৮ হাজার কোটি রুপি। অন্যায় পথে আহরিত সম্পদ মনমোহনের মন্ত্রীদের পকেটে গেছে বলে সন্দেহ করা হয়। সন্দেহের তালিকার শীর্ষে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী এ রাজা ও তাঁর দল ডিএমকে।
একই সময়ে ফাঁস হলো সুইস ব্যাংকে ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার কালো টাকা জমা রেখেছেন কয়েকজন ভারতীয়। আমানতকারী ২৬ জনের নাম সরকারের কাছে গেলেও সরকার তা প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এসব নাম পেতে যে চুক্তি করতে হয়েছিল, তার দোহাই দেওয়া হচ্ছে।
মনমোহন সিংয়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ কেউ তোলেনি। কিন্তু এসব কেলেঙ্কারির কথা তিনি জানতেন না—এ কথা কেউ বিশ্বাস করেনি। সাধারণের ভাবনা হলো, তিনি সবই জানতেন, তবে কিছুই করেননি পাছে তাঁর সরকার বিপদে পড়ে। তাঁর সরকারকে সমর্থন দিয়েছে ডিএমকে এবং মন্ত্রিপরিষদে জায়গা করে নিয়েছিলেন রাজা। মনমোহন সিংয়ের জন্য সময়টা সুখকর হয়নি। যদিও বিদেশে তাঁর নামে কালিমা পড়েনি।
মনমোহন তাঁর মর্যাদা কিছুটা ফেরাতে পেরেছেন প্রথমত, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছে, আর দ্বিতীয়ত, মোহালিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রিকেট বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলা উপভোগের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকে আমন্ত্রণ জানানোর মধ্য দিয়ে। তাঁকে আবারও সহায়তা করেছে ভারতে ও সীমান্তের ওপারের আন্তরিক পরিবেশ। লোকে তাঁর দূরদৃষ্টির কথা বলেছে—পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে নানা বাধাবিপত্তি থাকা সত্ত্বেও জনগণের সেই চাওয়া পূরণে তিনি সচেষ্ট বলে মনে করেছেন। দেখেশুনে মনে হচ্ছিল, তাঁর খারাপ দিনের বুঝি অবসান হলো। এখন আবার মনমোহন আবর্জনায় পতিত হয়েছেন। আন্না হাজারের ঘটনা তাঁকে ও তাঁর সরকারকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়েছে। গান্ধীবাদী আন্না অনশনের মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাতির ঘৃণাকে উসকে দিয়েছেন। ভারত-শরীরের সব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে তা ব্যাপৃত হচ্ছে। আন্দোলনের জন্য উর্বর জমি প্রস্তুতই ছিল। দুর্নীতির ক্যানসার দূর করতে আন্নার আহ্বান সিভিল সমাজকে জাগিয়ে তুলেছে। লক্ষ্যবস্তু হয়েছে মনমোহন সিংয়ের সরকার।
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে বড় ধরনের সাফল্যের সম্ভাবনা জাগানোর মাধ্যমে মনমোহন যে সুনামই অর্জন করে থাকুন না কেন, সেটা এখন খরচের খাতায়। ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতে সারা ভারতে যে বিজয় অনুভব করেছিল, তা কিছু সময়ের জন্য সবকিছুকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল।
নতুন যোগাযোগমন্ত্রী কপিল সিবাল ‘প্রমাণ’ করেছিলেন, টু-জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারিতে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ক্ষতির পরিমাণ শূন্য—তাঁর এই মহান আবিষ্কার মনমোহনকে কোনোভাবেই সহায়তা করেনি। আন্না আরেকটা মওকা পেলেন সরকারের অসৎ উদ্দেশ্য জনগণের সামনে স্পষ্ট করে দেওয়ার জন্য—যখন সংবাদ প্রকাশিত হলো, সরকার ও সিভিল সমাজ যৌথভাবে লোকপাল প্রতিষ্ঠার বিল তৈরি করবে, এটা মেনে নিতে ইচ্ছুক কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধী। লোকপাল প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতির শেকড় উপড়ে ফেলতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা। গ্রুপ অব মিনস্টার থেকে শারদ পাওয়ারের বিদায় ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন আন্না।
যখন কাজ করে দেখানোর সময়, তখন কিছু না করা যতটা না মনমোহনের দুর্ভাগ্য, তার চেয়ে হয়তো তাঁর ব্যর্থতাই সেখানে প্রধান। কমনওয়েলথ গেমস ভালোয় ভালোয় শেষ হলো। মনমোহন যদি আয়োজক কমিটির প্রধান সুরেশ কালমাডিকে সোজাসুজি পদচ্যুত করতেন, তাহলে তাঁর মর্যাদা বাড়ত। তিনি যদি কালমাডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাইতেন, তাহলে কালমাডির গলদ কোথায়, তা তো তিনি দেখতে পারতেন। এ-সংক্রান্ত সব তথ্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ছিল।
একইভাবে মনমোহন যেদিন মহা হিসাব নিরীক্ষকের কাছ থেকে টু-জি স্পেকট্রাম মামলা ভণ্ডুল করার চেষ্টাসংক্রান্ত প্রতিবেদন পেলেন, সেদিনই তাঁর উচিত ছিল রাজাকে মন্ত্রিপরিষদ থেকে বের করে দেওয়া। নতুন লোকপাল বিলের খসড়া প্রণয়নে যৌথ কমিটি নিয়োগ করার বিষয়ে আন্নার দাবির ব্যাপারে আবারও মনমোহন সময়োচিত পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে দাবি মেনে নিতে হলো। কিন্তু এ ঘটনা থেকে ধারণা পাওয়া গেল, চাপে পড়লেই সরকার নড়ে।
দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কেন হেরে গেলেন আর কীভাবে ঘটল সেই পরাজয়, তা নিয়ে মনমোহনের গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার। জনগণ একসময় ভালো মানুষ হিসেবে তাদের প্রধানমন্ত্রীর সুখ্যাতি নিয়ে পুলকিত ছিল। আজ লোকে বলে, তিনি তো শুধু তাঁর পদ আঁকড়ে পড়ে আছেন। এর জন্য তাঁর উপদেষ্টাদের কিছুটা দায়ী করা যায়। কিন্তু চূড়ান্ত দায় তাঁর ওপরই পড়ে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.