কালের যাত্রা by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়
আজকাল 'খাওয়া' শব্দটি শিল্প-সংস্কৃতি-রাজনীতির ভুবনে বেশ পরিচিত হয়েছে। পরিচিত না বলে বলা যায় জনপ্রিয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। রাজনীতির মঞ্চে পার্টির সমর্থকরা অনেক নেতার বক্তৃতা খায় না। আবার কারো কারো বক্তৃতা নাকি ভীষণ খায়। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তাই। সবার লেখা পাঠক খায় না।
তবে 'খাওয়া' শব্দটি অধিক পরিচিত এখন প্যাকেজ নাটকের ক্ষেত্রে। নাট্যকার নাটক লেখেন খেটেখুটে। নির্দেশক বলেন, এ দৃশ্যগুলো পাল্টে দেন, সংলাপগুলো ফেলে দেন। কারণ? দর্শক খাবে না। নির্দেশক নাটকের জন্য শিল্পীতালিকা চূড়ান্ত করেন। চ্যানেল কর্তৃপক্ষ অথবা প্রযোজক বলেন, শিল্পী পাল্টান, দর্শক খাবে না। চ্যানেল কর্তৃপক্ষ অথবা প্রযোজকদের আবার স্পনসররা বলেন, অমুক শিল্পীকে ছেঁটে ফেলে দেন, পাবলিক খাবে না। অদ্ভুত সব কথাবার্তা। বর্ষীয়ান অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান সেদিন রেগে গিয়ে বললেন, দর্শক কি চিবিয়ে চিবিয়ে নাটক খান? দর্শক কি তেল-নুন-মরিচ মেখে শিল্পীদের ভর্তা করে খান? কী আশ্চর্য এবং অদ্ভুত প্রকাশভঙ্গি! তবে হ্যাঁ দর্শকরা নাটক কিংবা শিল্পী কিছুই খান না। তাঁরা নাটক দেখেন। তবে সব নাটক দেখেন না, ভালো নাটক দেখেন। ভালো বলতে যে নাটক তাঁদের কাছে সহজবোধ্য এবং চিত্তে আনন্দদায়ী, তাঁরা সেই নাটক দেখেন। এসব ক্ষেত্রে আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে বেশির ভাগ দর্শক নাটকে সুন্দর গল্প পছন্দ করেন এবং মনে ধরার মতো অভিনয় দেখতে চান। সাধারণ দর্শক কিন্তু ক্যামেরার দুর্দান্ত শট, ক্রেন-ট্রলিতে ক্যামেরার জারিজুরি, জুম চার্জ কিংবা ইনফোকাস আউট ফোকাস-জাতীয় ব্যাপারগুলো বোঝেন না। বুঝতে চানও না। এডিটিংয়ের কেরামতি কিংবা কম্পিউটারের চালাকি সম্পর্কে তাঁরা জানতে আগ্রহী নন। এ বিষয়গুলো কিন্তু আমাদের প্যাকেজ শিল্পের মালিক, নির্দেশক কেন জানি বুঝতে চান না অথবা বুঝেও না বোঝার ভান করেন। অবশ্য এ সবই আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতা। কেউ দ্বিমত করতে চাইলে করতে পারেন। কিন্তু শার্টের কলার উল্টে ঘাড় বাঁকা করে আঁতেলগিরি দেখাবেন না প্লিজ। হাম কেয়া হনুরে ভাব করে পূর্বসূরিদের অবজ্ঞা এবং তাচ্ছিল্য করবেন না। যাঁদের হাতে টেলিভিশন নাটকের পথচলা এবং জনপ্রিয়তা, তাঁদের অসম্মান তো নিজেকেই অসম্মান করা। পূর্বসূরিদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে কার্পণ্য করা শোভনও নয়। দেড় যুগের বেশি সময় হতে চলল, বেসরকারি খাতে টেলিভিশন নাটক নির্মিত ও প্রচারিত হচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে অসংখ্য একক এবং ধারাবাহিক নাটক নির্মাণ করা হয়েছে এবং তার বেশির ভাগ বিটিভি ও অন্যান্য চ্যানেলে প্রচারিতও হয়েছে। মাছের ঝাঁকের মতো অথবা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো নাটক আসছে, আবার হারিয়েও যাচ্ছে। কয়টি নাটকের নাম দর্শক একবাক্যে মনে করে বলতে পারেন? সংখ্যা খুব একটা বেশি হবে না। অসংখ্য নাটকের ভিড়ে মনে থাকারও কথা নয়। সাংগঠনিক এবং ব্যক্তিগত নেশায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘোরাঘুরি করি। সেসব জায়গায় যে সাধারণ টেলিভিশন দর্শক থাকেন, তাঁদের সঙ্গে কথা হয়। নাটক সম্পর্কে তাঁদের মতামত শুনি এবং বিশেষভাবে গুরুত্বও দিই। কারণ তাঁরা অনেক বেশি সৎ, অনেক বেশি আন্তরিক। দায়সারা টিআরপি তাঁদের নিয়ে জরিপ চালায় না। দর্শক হিসেবে আমার বিবেচনায় তাঁরা অনেক বেশি মনোযোগী এবং নিবিষ্টচিত্র। একসময় তাঁদের কাছে প্রিয় বিনোদন মাধ্যম ছিল যাত্রা। অর্থাৎ অভিনয়ের ভুলত্রুটি ধরা এবং বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা তাঁদের মজ্জাগত। রাজধানী ঢাকার নির্মাতা এবং চ্যানেল যেসব নাটক নিয়ে জনপ্রিয়তার ঢেঁকুর তোলেন, সেসব নাটক উলি্লখিত দর্শকের কাছে খুব একটা প্রিয় নয় বলে দেখেছি। সহজ গল্প, সরল গদ্যের সংলাপ, ভালো অভিনয়ের নাটকগুলো দেখেছি তাঁরা খুবই পছন্দ করেন। নাটকের মাঝে বিজ্ঞাপন কম থাকলে তো তাঁরা আরো খুশি। আর একটি বিষয় আমাকে বেশ খুশি করে, সেটি হলো সাহিত্যের গন্ধমাখা নাটকের প্রতি তাঁদের আগ্রহ বেশি। অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠিত গল্পাশ্রয়ী নাটকগুলো তাঁদের তুলনামূলকভাবে বেশি টানে। এখনকার ভাষায় যাকে বলে বেশি মাত্রায় 'খাওয়া'। রবীন্দ্রনাথের গল্পভিত্তিক নাটক এসব সাধারণ দর্শক খুবই পছন্দ করেন। কিন্তু সেগুলো তো বছরান্তে দুবার। কবির জন্ম ও মৃত্যুদিনে। নজরুলের বেলায়ও তাই। এ ব্যাপারে বিটিভি ও বেসরকারি চ্যানেলগুলোকে সাধুবাদ জানাই। রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী চ্যানেলগুলোতে ঘটা করে পালিত হওয়া অবশ্যই শুভ ও মঙ্গলবার্তা বয়ে এনেছে। এ ক্ষেত্রে আমার প্রত্যাশা, শুধুই রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুল কেন, নাটকে উঠে আসুক শরৎ, বিভূতি-তারাশংকর-মানিক-ওয়ালীউল্লাহ-শওকত ওসমানের লেখা কাহিনী। এক তরুণ নির্দেশককে চিনি, যিনি সাহিত্যাশ্রয়ী কাহিনীর বাইরে সাধারণত নাটক নির্মাণ করেন না। তাঁর নির্দেশনায় নির্মিত হয়েছে শামসুর রাহমান, রশীদ করিম, শওকত আলী, মাহমুদুল হক, মোসলে উদ্দিনের গল্প-উপন্যাস অবলম্বনে সুন্দর কিছু নাটক। ইদানীং অবশ্য আরো কেউ এই পথে হাঁটা শুরু করেছেন। এটা মন্দের ভালো। তবে গল্প নির্বাচনে যদি তাঁরা নিজ দেশের সাহিত্যের দিকে আরো একটু বেশি মনোযোগ দেন, তবে তা সর্বার্থেই মঙ্গলের হবে। বিটিভি এককালে 'গল্প থেকে নাটক' নিয়মিত প্রচার করত এবং সাধারণ দর্শকের কাছে বহুল প্রশংসিতও হয়েছে। এ উদ্যোগটি বিটিভি এবং বেসরকারি চ্যানেলগুলো নিয়মিতভাবে নিলে ভালো হয়। দর্শকদের 'খাওয়া' সার্থকও হবে।
টেলিভিশন নাটকে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা কেমন যেন গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। কোথাও বদহজম হচ্ছে, কোথাও মন ভরছে না। অর্থাৎ দর্শক-রুচির চাহিদা সম্পূর্ণভাবে পূরণ হচ্ছে না। প্যাকেজ অনুষ্ঠান চালু হওয়ার পর এ ক্ষেত্রে শত-সহস্র কোটি টাকার আদান-প্রদান হচ্ছে। শিল্পী এবং অজস্র কর্মীর বাঁচামরা নির্ভর করছে এই মাধ্যমে। দেশে এক এক করে বেড়ে চলেছে বেসরকারি চ্যানেল। দৈনিকের পাতায় প্রতিদিন অনেক অংশজুড়ে ছাপা হচ্ছে প্যাকেজ অনুষ্ঠানের সংবাদ ও চিত্র। বর্তমানে এ ক্ষেত্রটি শিল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। আমি আগেও বলেছি, আজও বলি, ক্ষেত্রটি নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবা দরকার। কেমন যেন সমন্বয়হীনতার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সবখানে। সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার ব্যাপারটি সবার কাছে গৌণ হয়ে পড়ছে। আত্মকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণে অনেকেই বিত্তশালী হয়ে উঠছেন। নিজেদের এলিট ভাবছেন তাঁরা এবং পারিপার্শ্ব তার স্বীকৃতিও দিচ্ছে। তাতে নব্য ধনী হয়ে শিকড় বিচ্ছিন্ন হতে গিয়ে রুচিহীনতার পরিচয় দিতে কেউ কেউ সামাজিক অনাচারের জন্মও দিচ্ছেন। এটা শুভ লক্ষণ নয়। এর লাগাম টানা দরকার। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং সমন্বিত উদ্যোগ এখনই না নিলে সমাজ ও সাংস্কৃতিক ভুবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। জাতীয় দুর্যোগ এবং সামাজিক ধসের জন্য শুধু রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেই দুষলে চলবে না, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের নেতৃত্বকেও এগিয়ে আসতে হবে। গণমাধ্যমের বড় মাথাওয়ালাদেরও সঠিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। না হলে আড়তদার কিংবা মজুদদার অথবা ফটকাবাজ ব্যবসায়ীর সঙ্গে তাঁদের পার্থক্য থাকে কোথায়! পরিশেষে বলি, বিশাল সম্ভাবনাময় এ ক্ষেত্রটিকে ধর্মের ষাঁড় না বানিয়ে একটু সমতার সঙ্গে দেখভাল করলে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে দেশেরই লাভ হবে। তা ছাড়া বিশ্বজুড়ে দর্শকের কথা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করলে এই মাধ্যম থেকেই উল্লেখ করার মতো বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনা সম্ভব। একই সঙ্গে এ মাধ্যমটিকে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করে প্রবাসী বাঙালির মাঝে জাতীয় চেতনার শুভ দিকগুলো প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে জাতীয় ঐক্যের বন্ধনটি দৃঢ় হবে। খাওয়াদাওয়ার মতো রুচিহীন মানসিকতা নিয়ে কাজ করলে তা সম্ভব নয়। জয় বাংলা।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
টেলিভিশন নাটকে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা কেমন যেন গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। কোথাও বদহজম হচ্ছে, কোথাও মন ভরছে না। অর্থাৎ দর্শক-রুচির চাহিদা সম্পূর্ণভাবে পূরণ হচ্ছে না। প্যাকেজ অনুষ্ঠান চালু হওয়ার পর এ ক্ষেত্রে শত-সহস্র কোটি টাকার আদান-প্রদান হচ্ছে। শিল্পী এবং অজস্র কর্মীর বাঁচামরা নির্ভর করছে এই মাধ্যমে। দেশে এক এক করে বেড়ে চলেছে বেসরকারি চ্যানেল। দৈনিকের পাতায় প্রতিদিন অনেক অংশজুড়ে ছাপা হচ্ছে প্যাকেজ অনুষ্ঠানের সংবাদ ও চিত্র। বর্তমানে এ ক্ষেত্রটি শিল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। আমি আগেও বলেছি, আজও বলি, ক্ষেত্রটি নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবা দরকার। কেমন যেন সমন্বয়হীনতার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সবখানে। সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার ব্যাপারটি সবার কাছে গৌণ হয়ে পড়ছে। আত্মকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণে অনেকেই বিত্তশালী হয়ে উঠছেন। নিজেদের এলিট ভাবছেন তাঁরা এবং পারিপার্শ্ব তার স্বীকৃতিও দিচ্ছে। তাতে নব্য ধনী হয়ে শিকড় বিচ্ছিন্ন হতে গিয়ে রুচিহীনতার পরিচয় দিতে কেউ কেউ সামাজিক অনাচারের জন্মও দিচ্ছেন। এটা শুভ লক্ষণ নয়। এর লাগাম টানা দরকার। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং সমন্বিত উদ্যোগ এখনই না নিলে সমাজ ও সাংস্কৃতিক ভুবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। জাতীয় দুর্যোগ এবং সামাজিক ধসের জন্য শুধু রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেই দুষলে চলবে না, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের নেতৃত্বকেও এগিয়ে আসতে হবে। গণমাধ্যমের বড় মাথাওয়ালাদেরও সঠিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। না হলে আড়তদার কিংবা মজুদদার অথবা ফটকাবাজ ব্যবসায়ীর সঙ্গে তাঁদের পার্থক্য থাকে কোথায়! পরিশেষে বলি, বিশাল সম্ভাবনাময় এ ক্ষেত্রটিকে ধর্মের ষাঁড় না বানিয়ে একটু সমতার সঙ্গে দেখভাল করলে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে দেশেরই লাভ হবে। তা ছাড়া বিশ্বজুড়ে দর্শকের কথা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করলে এই মাধ্যম থেকেই উল্লেখ করার মতো বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনা সম্ভব। একই সঙ্গে এ মাধ্যমটিকে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করে প্রবাসী বাঙালির মাঝে জাতীয় চেতনার শুভ দিকগুলো প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে জাতীয় ঐক্যের বন্ধনটি দৃঢ় হবে। খাওয়াদাওয়ার মতো রুচিহীন মানসিকতা নিয়ে কাজ করলে তা সম্ভব নয়। জয় বাংলা।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments