ভূমি ব্যবস্থা-মহামান্য সরকার, খাজনা কবুল করুন by পাভেল পার্থ
দ্রুত টাঙ্গাইলের সখীপুরসহ মধুপুর গড়ের জনগণের দাবি মেনে নিয়ে তাদের চিরায়ত ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা হোক। রাষ্ট্রের আইন মোতাবেক ভূমি মালিকদের কাছ থেকে ভূমি খাজনা নেওয়া হোক। আটিয়া বন অধ্যাদেশ বাতিল করে বনভূমিসহ স্থানীয় অঞ্চলের আদিবাসী জনগণের প্রথাগত অধিকার নিশ্চিত করা হোক।
খাজনার অধিকার বাতিল হলে রাষ্ট্রের সঙ্গে গ্রামীণ নাগরিকের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বলে মনে করে গ্রামীণ জনগণ। রাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের উচিত আন্দোলনকারীদের আহাজারি ও দাবি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা
ভূমিকে কেন্দ্র করে সামন্ত ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভিন্ন ধরন ও সংঘাতকে বিস্তারিত আলোচনা করে কার্ল মার্কস ভূসম্পত্তি বিস্তৃতির ভেতর পুঁজিবাদের বিজয়কে আন্দাজ করেছিলেন। সামন্ত প্রভু ও বুর্জোয়ার ভেতর পার্থক্য হলো, একজন সামন্ত প্রভু তার জমি থেকে সর্বোচ্চ আয় তুলে আনার চেষ্টা করেন না। বরং তিনি তা ভোগ করার জন্য উৎপাদনের যাবতীয় উদ্বেগকে দাস ও চাষির ওপর ছেড়ে দেন। ভূমি মালিক ও ভূমি প্রজার ভেতর এক ধরনের পিতৃতান্ত্রিক সম্পর্ক বিরাজ করে; কিন্তু ভূসম্পত্তি বাজারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ভেতর দিয়ে এ সম্পর্ক এক জটিল পরিবর্তনশীলতায় রূপ নেয়। ভূসম্পত্তিকে যখন পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয় তখন তথাকথিত পিতৃতান্ত্রিক সম্পর্ক বদলে গিয়ে তা ব্যক্তিমালিক ও শ্রমিকের ভেতর এক নির্যাতক এবং নির্যাতনকারীর সম্পর্ক তৈরি করে। ব্রিটিশ উপনিবেশের আগে এ দেশের ভূমির ওপর রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের প্রতিনিধির কোনো একক মালিকানা ও কর্তৃত্ব ছিল না। ব্রিটিশ শাসকরা 'ইংরেজ উপনিবেশ' পদ্ধতিতে তৎকালীন বাংলার কৃষি রূপান্তরের জন্য প্রথম রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেয় এবং তৈরি করে ÔPermanent Settlement Act-1793’. ওই আইনের মাধ্যমে জমিদাররা ভূমির 'মালিক' এবং কৃষকরা 'ভাগচাষি প্রজা'য় পরিণত হন। শের শাহর আমলে (১৫৪০-১৫৪৫) ভূমি খাজনা ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে জমির নিয়মিত মূল্যায়ন ও খাজনা সংগ্রহের রীতি চালু হয়। পরে তৎকালীন মন্ত্রী তদার মল (১৫৭১-১৫৮২) সুবা বাংলার ভূমি খাজনার লক্ষ্যে বাংলা অঞ্চলকে সরকার/জেলা, পরগনায় ভাগ করেন। ১৬৫৮ সালে মোগল গভর্নর শাহ সুজা বাংলার খাজনা ১০৬.৯৩ লাখ রুপি থেকে বাড়িয়ে ১৩১.১৩ লাখ রুপি করেন। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় তার ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব স্থাপন করার ভেতর দিয়ে ভূমি শাসনের ক্ষেত্রে নতুন আইন প্রচলন করে। ১৭৮৬ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস খাজনা আদায় এবং ভূমির ওপর স্থায়ী বন্দোবস্তির রূপরেখা প্রণয়নের দিকনির্দেশিকাসহ গভর্নর জেনারেল হিসেবে ভারতে আসেন। ১৭৯২ সালের আইনের মাধ্যমে বাংলার মাটির ওপর জমিদারদের মালিকানার অধিকার দেওয়া হয়।
অন্যায় খাজনা প্রথার বিরুদ্ধে ও ভূমি অধিকারের দাবিতে এ অঞ্চলে বারবার সংগঠিত হয়েছে কৃষক-মজুর-আদিবাসী গণসংগ্রাম। তেভাগা-নানকার-টংক-হুল-উলগুলানের মতো প্রতিটি ঐতিহাসিক গণবিদ্রোহই রাষ্ট্রের খাজনার বিরুদ্ধে জনগণের জানবাজি রাখা উত্তর। কিন্তু কালের ধারাবাহিকতায় অন্যায় খাজনা প্রথাবিরোধী জনগণের উত্তরাধিকাররা আবার খাজনা দেওয়ার দাবিতে শুরু করেছেন আন্দোলন। টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার বঞ্চিত ভূমি মালিক ও কৃষকরা সরকারকে খাজনা গ্রহণের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। উপজেলার আরএস খতিয়ানভুক্ত জমির খাজনা গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়ে 'খাজনা বাস্তবায়ন কমিটি' শুরু করেছে আন্দোলন।
রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ এবং ১৯৫৫ সালের ভূমি জরিপ আইনের ১৪৪ ধারার বিধানমতে, ১৯৭৬ সালের এক স্মারক বিজ্ঞপ্তি অনুসারে ১৯৭৬-৮৫ সালে দেশের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে টাঙ্গাইল জেলার সখীপুর উপজেলার সখীপুর, গড়গোবিন্দপুর, রতনপুর, লাঙ্গুলিয়া, হতেয়া, বাজাইল, দেওয়ানপুর কালমেঘা, তালেবাবাদ কালমেঘা, প্রতিমাবংকী, হাতিবান্ধা, বেড়বাড়ি, বহুড়িয়া চতলবাইদ, আটিয়া কালমেঘা ও চতলবাইদ এই চৌদ্দটি মৌজার প্রায় এক লাখ গ্রামীণ জনগণের ভোগদখলীয় প্রায় ৩৫ হাজার একর জমির আরএস জরিপ সম্পন্ন হয়। এরপর ১৯৮৫ সাল থেকে ভূমি মালিকদের জমির নকশা ও পরচা দেওয়া হয়। বিধি মোতাবেক সংশিল্গষ্ট দফতর ১৯৮৭ সালে ৮টি, ১৯৯৮ সালে একটি ও বিভিন্ন সময়ে অন্য পাঁচটি মৌজার গেজেট প্রকাশ করে। ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ সালে সখীপুরের উলি্লখিত চৌদ্দটি মৌজা থেকে প্রথমে গেজেটভুক্ত আটটি মৌজার ভলিউম ও খাজনা আদায়ের নির্দেশ স্থানীয় ভূমি কার্যালয়ে আসে। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৯৮ সালে বন বিভাগের কিছু জমি আরএস রেকর্ডে ব্যক্তিমালিকানায় চলে গেছে দাবি করে বন বিভাগ আপত্তি দিলে স্থানীয় ভূমি কার্যালয় খাজনা (ভূমি উন্নয়ন কর) নেওয়া বন্ধ করে দেয়। পরবর্তী সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে উলি্লখিত মৌজার খাজনা না নেওয়ার ফলে এসব জমির বৈধ ভোগদখলীয় মালিকরা তাদের জমি আইনগত কেনাবেচা করতে পারছেন না। সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বড় রকমের ভূমি রাজস্ব থেকে।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ এবং ঢাকা (বর্তমানে এ অংশ গাজীপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত) জেলার আটিয়া পরগনার বন সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে আটিয়া অধ্যাদেশ ১৯৮২ জারি করেন। সে মোতাবেক টাঙ্গাইল জেলায় ৫৫,৪৭৬.৩৮ একর, ময়মনসিংহ জেলায় ৩৪৪৫.১৮ একর ও গাজীপুর জেলায় ৭২৬.৬৪ একর_ মোট ৫৯,৬৪৮.২০ একর ভূমি Attia Reserved Forest এলাকা হিসেবে ঘোষিত হয়। যদিও ওই বন এলাকাকে তৎকালীন 'গভর্নর-ইন-কাউন্সিল' ১৮৭৮ সালে ভারতীয় বন আইনের সেকশন-৪ অনুসারে ২৩.৯.১৯২৫ তারিখে নোটিফিকেশনের মাধ্যমে 'সংরক্ষিত বন' হিসেবে গঠনের প্রস্তাব করেন। পরে ১৯২৭ সালের ঔপনিবেশিক বন আইনের ২০ ধারা মোতাবেক একটি চূড়ান্ত নোটিফিকেশন জারি করা হয়। ১৯২৭ সালের বন আইন কার্যকর হওয়ার পর স্থানীয় জমিদারদের অনুরোধে ৩.৪.১৯৩৪ তারিখে জারিকৃত প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিভিন্ন মৌজার প্রায় ১৩,৭৯২.৯৭ একর বনভূমি একই বন আইনের বিধান অনুযায়ী সরকার জমিদারদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা শর্তে De-Reserve করে। এখানে উল্লেখ্য, De-Reserve--কৃত ভূমি জমিদাররা প্রজাদের মাধ্যমেই সৃজন/সংরক্ষণ করবেন বলে প্রতীয়মান হয় কিন্তু E.P. Private forest ordinance ১৯৪৯-এর ৭ ধারার বিধানমতে জমিদারদের সম্মতির ভিত্তিতেই আবার বন বিভাগের কাছে ন্যস্ত করা হয়। মূলত আটিয়া অধ্যাদেশ ও এর বিধানগুলোর জটিলতার মধ্যে সাধারণ জনগণ জীবন-জীবিকা পরিচালনা করছে। এত কিছু সত্ত্বেও বন বিভাগ কর্তৃক বন সংরক্ষণ সম্ভব হচ্ছে না।
'মধুপুর গড়' নামটি শুনলেই অনেকে মনে করেন এটি হয়তো টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার কেবল মধুপুর শালবন এলাকা। কিন্তু আদতে বাংলাদেশের কেন্দ্রভাগের বৃহৎ উত্থিত এলাকার দক্ষিণাংশ ভাওয়াল গড় এবং উত্তরাংশ মধুপুর গড় নামে পরিচিত। ভূপ্রকৃতি, মাটি, ভূমির উচ্চতা এবং কৃষি-জলবায়ুর ওপর ভিত্তি করে সমগ্র বাংলাদেশকে মোট ৩০টি প্রধান কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চল, ৮৮টি কৃষি প্রতিবেশ উপ-অঞ্চল এবং ৫৩৫টি কৃষি প্রতিবেশ এককে ভাগ করা হয়েছে। মোট ৪,২৪৪ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই 'মধুপুর গড়' দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চল। টাঙ্গাইল, জামালপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, শেরপুর, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী জেলার নানা অংশে এ গড়াঞ্চল বিস্তৃত। আর এ মধুপুর গড়ের ভূমি নিয়ে রাষ্ট্রীয় জটিলতা ও মশকরা এখনও থামেনি। নানা আইন, নানা নীতি, নানা উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বারবার মধুপুর গড়ের বনভূমিসহ স্থানীয় ভূবৈশিষ্ট্য নিশ্চিহ্ন করে আদিবাসীসহ স্থানীয় জনগণের ভূমি অধিকার কেড়ে নিয়েছে রাষ্ট্র। দ্রুত টাঙ্গাইলের সখীপুরসহ মধুপুর গড়ের জনগণের দাবি মেনে নিয়ে তাদের চিয়ায়ত ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা হোক। রাষ্ট্রের আইন মোতাবেক ভূমি মালিকদের কাছ থেকে ভূমি খাজনা নেওয়া হোক। আটিয়া বন অধ্যাদেশ বাতিল করে বনভূমিসহ স্থানীয় অঞ্চলের আদিবাসী জনগণের প্রথাগত অধিকার নিশ্চিত করা হোক। খাজনার অধিকার বাতিল হলে রাষ্ট্রের সঙ্গে গ্রামীণ নাগরিকের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বলে মনে করে গ্রামীণ জনগণ। রাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের উচিত আন্দোলনকারীদের আহাজারি ও দাবি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা। সখীপুরসহ দেশের সব প্রান্তের খাজনাবিহীন সব ভূমির ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই, এখনই।
পাভেল পার্থ :গবেষক
animistbangla@gmail.com
ভূমিকে কেন্দ্র করে সামন্ত ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভিন্ন ধরন ও সংঘাতকে বিস্তারিত আলোচনা করে কার্ল মার্কস ভূসম্পত্তি বিস্তৃতির ভেতর পুঁজিবাদের বিজয়কে আন্দাজ করেছিলেন। সামন্ত প্রভু ও বুর্জোয়ার ভেতর পার্থক্য হলো, একজন সামন্ত প্রভু তার জমি থেকে সর্বোচ্চ আয় তুলে আনার চেষ্টা করেন না। বরং তিনি তা ভোগ করার জন্য উৎপাদনের যাবতীয় উদ্বেগকে দাস ও চাষির ওপর ছেড়ে দেন। ভূমি মালিক ও ভূমি প্রজার ভেতর এক ধরনের পিতৃতান্ত্রিক সম্পর্ক বিরাজ করে; কিন্তু ভূসম্পত্তি বাজারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ভেতর দিয়ে এ সম্পর্ক এক জটিল পরিবর্তনশীলতায় রূপ নেয়। ভূসম্পত্তিকে যখন পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয় তখন তথাকথিত পিতৃতান্ত্রিক সম্পর্ক বদলে গিয়ে তা ব্যক্তিমালিক ও শ্রমিকের ভেতর এক নির্যাতক এবং নির্যাতনকারীর সম্পর্ক তৈরি করে। ব্রিটিশ উপনিবেশের আগে এ দেশের ভূমির ওপর রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের প্রতিনিধির কোনো একক মালিকানা ও কর্তৃত্ব ছিল না। ব্রিটিশ শাসকরা 'ইংরেজ উপনিবেশ' পদ্ধতিতে তৎকালীন বাংলার কৃষি রূপান্তরের জন্য প্রথম রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেয় এবং তৈরি করে ÔPermanent Settlement Act-1793’. ওই আইনের মাধ্যমে জমিদাররা ভূমির 'মালিক' এবং কৃষকরা 'ভাগচাষি প্রজা'য় পরিণত হন। শের শাহর আমলে (১৫৪০-১৫৪৫) ভূমি খাজনা ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে জমির নিয়মিত মূল্যায়ন ও খাজনা সংগ্রহের রীতি চালু হয়। পরে তৎকালীন মন্ত্রী তদার মল (১৫৭১-১৫৮২) সুবা বাংলার ভূমি খাজনার লক্ষ্যে বাংলা অঞ্চলকে সরকার/জেলা, পরগনায় ভাগ করেন। ১৬৫৮ সালে মোগল গভর্নর শাহ সুজা বাংলার খাজনা ১০৬.৯৩ লাখ রুপি থেকে বাড়িয়ে ১৩১.১৩ লাখ রুপি করেন। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় তার ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব স্থাপন করার ভেতর দিয়ে ভূমি শাসনের ক্ষেত্রে নতুন আইন প্রচলন করে। ১৭৮৬ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস খাজনা আদায় এবং ভূমির ওপর স্থায়ী বন্দোবস্তির রূপরেখা প্রণয়নের দিকনির্দেশিকাসহ গভর্নর জেনারেল হিসেবে ভারতে আসেন। ১৭৯২ সালের আইনের মাধ্যমে বাংলার মাটির ওপর জমিদারদের মালিকানার অধিকার দেওয়া হয়।
অন্যায় খাজনা প্রথার বিরুদ্ধে ও ভূমি অধিকারের দাবিতে এ অঞ্চলে বারবার সংগঠিত হয়েছে কৃষক-মজুর-আদিবাসী গণসংগ্রাম। তেভাগা-নানকার-টংক-হুল-উলগুলানের মতো প্রতিটি ঐতিহাসিক গণবিদ্রোহই রাষ্ট্রের খাজনার বিরুদ্ধে জনগণের জানবাজি রাখা উত্তর। কিন্তু কালের ধারাবাহিকতায় অন্যায় খাজনা প্রথাবিরোধী জনগণের উত্তরাধিকাররা আবার খাজনা দেওয়ার দাবিতে শুরু করেছেন আন্দোলন। টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার বঞ্চিত ভূমি মালিক ও কৃষকরা সরকারকে খাজনা গ্রহণের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। উপজেলার আরএস খতিয়ানভুক্ত জমির খাজনা গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়ে 'খাজনা বাস্তবায়ন কমিটি' শুরু করেছে আন্দোলন।
রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ এবং ১৯৫৫ সালের ভূমি জরিপ আইনের ১৪৪ ধারার বিধানমতে, ১৯৭৬ সালের এক স্মারক বিজ্ঞপ্তি অনুসারে ১৯৭৬-৮৫ সালে দেশের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে টাঙ্গাইল জেলার সখীপুর উপজেলার সখীপুর, গড়গোবিন্দপুর, রতনপুর, লাঙ্গুলিয়া, হতেয়া, বাজাইল, দেওয়ানপুর কালমেঘা, তালেবাবাদ কালমেঘা, প্রতিমাবংকী, হাতিবান্ধা, বেড়বাড়ি, বহুড়িয়া চতলবাইদ, আটিয়া কালমেঘা ও চতলবাইদ এই চৌদ্দটি মৌজার প্রায় এক লাখ গ্রামীণ জনগণের ভোগদখলীয় প্রায় ৩৫ হাজার একর জমির আরএস জরিপ সম্পন্ন হয়। এরপর ১৯৮৫ সাল থেকে ভূমি মালিকদের জমির নকশা ও পরচা দেওয়া হয়। বিধি মোতাবেক সংশিল্গষ্ট দফতর ১৯৮৭ সালে ৮টি, ১৯৯৮ সালে একটি ও বিভিন্ন সময়ে অন্য পাঁচটি মৌজার গেজেট প্রকাশ করে। ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ সালে সখীপুরের উলি্লখিত চৌদ্দটি মৌজা থেকে প্রথমে গেজেটভুক্ত আটটি মৌজার ভলিউম ও খাজনা আদায়ের নির্দেশ স্থানীয় ভূমি কার্যালয়ে আসে। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৯৮ সালে বন বিভাগের কিছু জমি আরএস রেকর্ডে ব্যক্তিমালিকানায় চলে গেছে দাবি করে বন বিভাগ আপত্তি দিলে স্থানীয় ভূমি কার্যালয় খাজনা (ভূমি উন্নয়ন কর) নেওয়া বন্ধ করে দেয়। পরবর্তী সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে উলি্লখিত মৌজার খাজনা না নেওয়ার ফলে এসব জমির বৈধ ভোগদখলীয় মালিকরা তাদের জমি আইনগত কেনাবেচা করতে পারছেন না। সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বড় রকমের ভূমি রাজস্ব থেকে।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ এবং ঢাকা (বর্তমানে এ অংশ গাজীপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত) জেলার আটিয়া পরগনার বন সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে আটিয়া অধ্যাদেশ ১৯৮২ জারি করেন। সে মোতাবেক টাঙ্গাইল জেলায় ৫৫,৪৭৬.৩৮ একর, ময়মনসিংহ জেলায় ৩৪৪৫.১৮ একর ও গাজীপুর জেলায় ৭২৬.৬৪ একর_ মোট ৫৯,৬৪৮.২০ একর ভূমি Attia Reserved Forest এলাকা হিসেবে ঘোষিত হয়। যদিও ওই বন এলাকাকে তৎকালীন 'গভর্নর-ইন-কাউন্সিল' ১৮৭৮ সালে ভারতীয় বন আইনের সেকশন-৪ অনুসারে ২৩.৯.১৯২৫ তারিখে নোটিফিকেশনের মাধ্যমে 'সংরক্ষিত বন' হিসেবে গঠনের প্রস্তাব করেন। পরে ১৯২৭ সালের ঔপনিবেশিক বন আইনের ২০ ধারা মোতাবেক একটি চূড়ান্ত নোটিফিকেশন জারি করা হয়। ১৯২৭ সালের বন আইন কার্যকর হওয়ার পর স্থানীয় জমিদারদের অনুরোধে ৩.৪.১৯৩৪ তারিখে জারিকৃত প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিভিন্ন মৌজার প্রায় ১৩,৭৯২.৯৭ একর বনভূমি একই বন আইনের বিধান অনুযায়ী সরকার জমিদারদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা শর্তে De-Reserve করে। এখানে উল্লেখ্য, De-Reserve--কৃত ভূমি জমিদাররা প্রজাদের মাধ্যমেই সৃজন/সংরক্ষণ করবেন বলে প্রতীয়মান হয় কিন্তু E.P. Private forest ordinance ১৯৪৯-এর ৭ ধারার বিধানমতে জমিদারদের সম্মতির ভিত্তিতেই আবার বন বিভাগের কাছে ন্যস্ত করা হয়। মূলত আটিয়া অধ্যাদেশ ও এর বিধানগুলোর জটিলতার মধ্যে সাধারণ জনগণ জীবন-জীবিকা পরিচালনা করছে। এত কিছু সত্ত্বেও বন বিভাগ কর্তৃক বন সংরক্ষণ সম্ভব হচ্ছে না।
'মধুপুর গড়' নামটি শুনলেই অনেকে মনে করেন এটি হয়তো টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার কেবল মধুপুর শালবন এলাকা। কিন্তু আদতে বাংলাদেশের কেন্দ্রভাগের বৃহৎ উত্থিত এলাকার দক্ষিণাংশ ভাওয়াল গড় এবং উত্তরাংশ মধুপুর গড় নামে পরিচিত। ভূপ্রকৃতি, মাটি, ভূমির উচ্চতা এবং কৃষি-জলবায়ুর ওপর ভিত্তি করে সমগ্র বাংলাদেশকে মোট ৩০টি প্রধান কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চল, ৮৮টি কৃষি প্রতিবেশ উপ-অঞ্চল এবং ৫৩৫টি কৃষি প্রতিবেশ এককে ভাগ করা হয়েছে। মোট ৪,২৪৪ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই 'মধুপুর গড়' দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চল। টাঙ্গাইল, জামালপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, শেরপুর, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী জেলার নানা অংশে এ গড়াঞ্চল বিস্তৃত। আর এ মধুপুর গড়ের ভূমি নিয়ে রাষ্ট্রীয় জটিলতা ও মশকরা এখনও থামেনি। নানা আইন, নানা নীতি, নানা উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বারবার মধুপুর গড়ের বনভূমিসহ স্থানীয় ভূবৈশিষ্ট্য নিশ্চিহ্ন করে আদিবাসীসহ স্থানীয় জনগণের ভূমি অধিকার কেড়ে নিয়েছে রাষ্ট্র। দ্রুত টাঙ্গাইলের সখীপুরসহ মধুপুর গড়ের জনগণের দাবি মেনে নিয়ে তাদের চিয়ায়ত ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা হোক। রাষ্ট্রের আইন মোতাবেক ভূমি মালিকদের কাছ থেকে ভূমি খাজনা নেওয়া হোক। আটিয়া বন অধ্যাদেশ বাতিল করে বনভূমিসহ স্থানীয় অঞ্চলের আদিবাসী জনগণের প্রথাগত অধিকার নিশ্চিত করা হোক। খাজনার অধিকার বাতিল হলে রাষ্ট্রের সঙ্গে গ্রামীণ নাগরিকের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বলে মনে করে গ্রামীণ জনগণ। রাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের উচিত আন্দোলনকারীদের আহাজারি ও দাবি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা। সখীপুরসহ দেশের সব প্রান্তের খাজনাবিহীন সব ভূমির ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই, এখনই।
পাভেল পার্থ :গবেষক
animistbangla@gmail.com
No comments