টাঙ্গুয়ার হাওর-সমাজভিত্তিক টেকসই ব্যবস্থাপনা উদ্যোগ by মুশফিকুর রহমান
বেশ কয়েক বছর আগে একবার টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেবার সুনামগঞ্জ থেকে স্পিডবোটে গিয়ে একই দিনে ফিরে এসেছিলাম। তখন ছিল বর্ষা মৌসুম। এবার খরায় যাওয়া হলো, তবে সে জন্য সুনামগঞ্জে নৌকায় উঠে খানিক পথ পেরিয়ে লেগুনা বা টেম্পোতে চড়ে তাহিরপুর যেতে হলো।
সেখানে রাত কাটিয়ে আবার লেগুনায় চড়ে খানিক পথ পেরিয়ে আবার নৌকায় যাত্রা। মাঝে একবার নৌকা বদল করে হাওরের মাঝামাঝি ছোট্ট দ্বীপের মতো হাতিরগাতা নামের জায়গাটিতে পৌঁছা গেল। বেশ চ্যালেঞ্জিং ভ্রমণ।
টাঙ্গুয়ার হাওরের বিস্তার শুকনো মৌসুমে সুনামগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত উপজেলা তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার চারটি ইউনিয়নের অধীন প্রায় ১০ হাজার হেক্টর বা ১০০ বর্গকিলোমিটার। বর্ষায় টাঙ্গুয়ার হাওর ও এর মাছ চলাচলের পথসহ বিস্তৃত হয় প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর। টাঙ্গুয়ার হাওরের বিশাল জলাভূমি মেঘালয়ের পাহাড়শ্রেণীর পাদদেশে অবস্থিত হওয়ায় এখানে মিঠা পানির অভাব হয় না। পরস্পর সংযুক্ত ১০৪টি বিলের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে টাঙ্গুয়ার হাওর। এর মধ্যে ৫২টি বিল উল্লেখযোগ্য এবং ১০টি বিল বড় ও গভীর। হাওরের ভেতর দিয়ে বেশ কয়েকটি নদী প্রবাহিত হলেও জাদুকাটা, পাটলাই, বিশরপাশা ও ঘাসি নদী প্রধান।
টাঙ্গুয়ার হাওরে জলাভূমির প্রায় ২০০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৪১ প্রজাতির মাছ, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৩৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ৯৮ প্রজাতির পাখির আবাস। আমাদের দেশের মোট ২০০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৪১ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় এই হাওরে। অফুরান খাবার আর তুলনামূলক নিরাপদ পরিবেশের কারণে বছরে প্রায় দুই লাখ পরিযায়ী জলচর পাখি টাঙ্গুয়ার হাওরে আসে। এই বিপুল জীববৈচিত্র্য ও হাওরসংলগ্ন ৮৮ গ্রাম এবং প্রায় ৬০ হাজার মানুষ নিয়ে রচিত হয়েছে টাঙ্গুয়ার হাওরের পরিবেশ।
টাঙ্গুয়ার হাওর সন্নিহিত গ্রামগুলোতে বসবাসকারী মানুষের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। টাঙ্গুয়ার হাওরের বিপুল মৎস্যভান্ডার, কৃষিজমি, চারণভূমি ও জলজ সম্পদ একই সঙ্গে মানুষের জীবিকার অবলম্বন। এই হাওরে জাল বা বড়শি দিয়ে মাছ ধরে, মাছ ধরার উপকরণ তৈরি করে, কৃষিকাজ করে, পশুপালন বা হাঁস-মুরগি পালন করে হাওর ও সংলগ্ন জনপদের অধিকাংশ মানুষ জীবন যাপন করে।
পরিবেশ ও প্রতিবেশগত গুরুত্বের বিবেচনায় টাঙ্গুয়ার হাওর আমাদের দেশ ও অঞ্চলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাছ, পাখি ও প্রাণিজগতের যেসব সদস্যের টাঙ্গুয়ার হাওরে দেখা মেলে, সেগুলোর অনেকগুলোই বিপন্ন বা সংকটাপন্ন। স্পর্শকাতর ও প্রতিবেশ গুরুত্বের বিবেচনায় টাঙ্গুয়ার হাওরের সংরক্ষণ তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দীর্ঘদিন ধরে টাঙ্গুয়ার হাওরের সম্পদ, বিশেষ করে মৎস্য সম্পদের অতি আহরণ এখানকার পরিবেশ ও প্রতিবেশব্যবস্থাকে নাজুক করেছে।
টাঙ্গুয়ার হাওর সংরক্ষণ প্রসঙ্গে কথা হলো সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি জানালেন, দীর্ঘদিন এলাকার প্রভাবশালী মানুষ ইজারা নিয়ে নিজেদের মতো মাছ ধরত। হাওরের জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা এবং হাওরের সম্পদ সংরক্ষণের লক্ষ্যে টাঙ্গুয়ার হাওরের নয় হাজার ৭২৭ হেক্টর এলাকা ১৯৯৯ সালে সরকার ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করে। ২০০১ সালের পর থেকে টাঙ্গুয়ার হাওর ইজারা দেওয়া বন্ধ হয়েছে। ২০০৩ সালের নভেম্বর থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পিত হয় সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের ওপর। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর টাঙ্গুয়ার হাওরের সংরক্ষণ, প্রতিবেশব্যবস্থার উন্নয়ন ও এর সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০০৭ সাল থেকে ‘টাঙ্গুয়ার হাওরের সমাজভিত্তিক টেকসই ব্যবস্থাপনা’ প্রকল্প চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় আইইউসিএন- বাংলাদেশের কারিগরি সহায়তায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
এ প্রসঙ্গে আইইউসিএন-বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ ইশতিয়াক আহমেদ জানালেন, সমাজভিত্তিক সহ-ব্যবস্থাপনার মডেলে টাঙ্গুয়ার হাওরের টেকসই ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে স্থানীয় কমিউনিটির মানুষদের সংগঠিত করে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে হাওরের অন্তর্গত ৮৮ গ্রামের ১০ হাজার পরিবার থেকে প্রায় ছয় হাজার সদস্যকে সংগঠিত করা হয়েছে। ৭৬টি গ্রামে গড়া হয়েছে ৭৩টি গ্রাম ‘সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি’।
এখন টাঙ্গুয়ার হাওরের অধীন পাঁচটি বিলের গভীরতম অংশে সীমানা নির্ধারণ করে ৬০ শতাংশ এলাকা ঘিরে দিয়ে ‘মাছ ধরা নিষিদ্ধ এলাকা’ চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ‘সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি’ সবাইকে তা মেনে চলা নিশ্চিত করছে। তা ছাড়া দুটি বিলকে পাখির অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়েছে। ৬৫ হাজার হিজল ও করচগাছের চারা লাগানো হয়েছে এবং ৩৫ হাজার নলজাতীয় জলজ উদ্ভিদ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। হাওরবাসী মানুষদের সচেতনতার বিভিন্ন উদ্যোগসহ বছরের নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত বিলে পরিমিত মাত্রায় অবাণিজ্যিক ভিত্তিতে সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের জন্য মাছ ধরার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। হাওরে নিয়ন্ত্রিতভাবে আহরিত মাছের বাজার বসে হাওরের মাঝখানের উঁচু জায়গা বা হাতিরগাতা নামের কান্দায়। জেলেরা একক বা দলবদ্ধ হয়ে রুই, বোয়াল, শোল, আইড়, ঘনিয়া, টাটকিনি, বাইন, চিংড়ি, গাঙমাগুর, মেনি, কাকিলা, পুঁটি, টেংরাসহ বিভিন্ন মাছ ধরেন নির্দিষ্ট অনুমতির অধীনে। মাছ ধরে নিয়ে যেতে হয় হাতিরগাতায়। সেখানে মাছ বিক্রয় থেকে লব্ধ আয়ের ৪০ শতাংশ জেলে, ৩৬ শতাংশ সংগঠন এবং ২৪ শতাংশ সরকার পায়।
টাঙ্গুয়ার হাওরের বিস্তৃত জনপদের বিভিন্ন পেশা ও বৈশিষ্ট্যের মানুষের পরিবেশ রক্ষা করে কীভাবে হাওর ও এর সম্পদ টেকসইভাবে সংরক্ষণ করা যায়, তা বোঝানো ও উদ্বুদ্ধ করা সহজ কাজ নয়। এ জন্য দিনরাত হাওরের বিভিন্ন জনপদে ঘুরছেন সরকার, আইইউসিএন-বাংলাদেশ, সহযোগী এনজিও সিএনআরএস ও ইরার কর্মকর্তা ও কর্মীরা। টাঙ্গুয়ার হাওরের অনন্য সৌন্দর্য আর সম্পদ কেবল তার মাছ, পাখি আর জলজ উদ্ভিদের সংখ্যা এবং হাওরের বিস্তার দেখে বোঝা সম্ভব নয়। প্রকৃতির এই অসাধারণ রূপের দেখা পেতে যেতে হবে হাওরের গভীরে। টাঙ্গুয়ার হাওরের গহিনে অজস্র জলচর পাখির নিশ্চিন্ত চলাচল, বিচিত্র শব্দ করে গাওয়া পাখিদের গান, নলবনে শিরশিরে হাওয়ার দুলুনি এবং বড়-ছোট মাছের স্বচ্ছ জলে চরে বেড়ানো দেখার আনন্দ কোনো পার্থিব প্রাপ্তির সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে?
ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী, জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।
টাঙ্গুয়ার হাওরের বিস্তার শুকনো মৌসুমে সুনামগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত উপজেলা তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার চারটি ইউনিয়নের অধীন প্রায় ১০ হাজার হেক্টর বা ১০০ বর্গকিলোমিটার। বর্ষায় টাঙ্গুয়ার হাওর ও এর মাছ চলাচলের পথসহ বিস্তৃত হয় প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর। টাঙ্গুয়ার হাওরের বিশাল জলাভূমি মেঘালয়ের পাহাড়শ্রেণীর পাদদেশে অবস্থিত হওয়ায় এখানে মিঠা পানির অভাব হয় না। পরস্পর সংযুক্ত ১০৪টি বিলের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে টাঙ্গুয়ার হাওর। এর মধ্যে ৫২টি বিল উল্লেখযোগ্য এবং ১০টি বিল বড় ও গভীর। হাওরের ভেতর দিয়ে বেশ কয়েকটি নদী প্রবাহিত হলেও জাদুকাটা, পাটলাই, বিশরপাশা ও ঘাসি নদী প্রধান।
টাঙ্গুয়ার হাওরে জলাভূমির প্রায় ২০০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৪১ প্রজাতির মাছ, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৩৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ৯৮ প্রজাতির পাখির আবাস। আমাদের দেশের মোট ২০০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৪১ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় এই হাওরে। অফুরান খাবার আর তুলনামূলক নিরাপদ পরিবেশের কারণে বছরে প্রায় দুই লাখ পরিযায়ী জলচর পাখি টাঙ্গুয়ার হাওরে আসে। এই বিপুল জীববৈচিত্র্য ও হাওরসংলগ্ন ৮৮ গ্রাম এবং প্রায় ৬০ হাজার মানুষ নিয়ে রচিত হয়েছে টাঙ্গুয়ার হাওরের পরিবেশ।
টাঙ্গুয়ার হাওর সন্নিহিত গ্রামগুলোতে বসবাসকারী মানুষের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। টাঙ্গুয়ার হাওরের বিপুল মৎস্যভান্ডার, কৃষিজমি, চারণভূমি ও জলজ সম্পদ একই সঙ্গে মানুষের জীবিকার অবলম্বন। এই হাওরে জাল বা বড়শি দিয়ে মাছ ধরে, মাছ ধরার উপকরণ তৈরি করে, কৃষিকাজ করে, পশুপালন বা হাঁস-মুরগি পালন করে হাওর ও সংলগ্ন জনপদের অধিকাংশ মানুষ জীবন যাপন করে।
পরিবেশ ও প্রতিবেশগত গুরুত্বের বিবেচনায় টাঙ্গুয়ার হাওর আমাদের দেশ ও অঞ্চলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাছ, পাখি ও প্রাণিজগতের যেসব সদস্যের টাঙ্গুয়ার হাওরে দেখা মেলে, সেগুলোর অনেকগুলোই বিপন্ন বা সংকটাপন্ন। স্পর্শকাতর ও প্রতিবেশ গুরুত্বের বিবেচনায় টাঙ্গুয়ার হাওরের সংরক্ষণ তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দীর্ঘদিন ধরে টাঙ্গুয়ার হাওরের সম্পদ, বিশেষ করে মৎস্য সম্পদের অতি আহরণ এখানকার পরিবেশ ও প্রতিবেশব্যবস্থাকে নাজুক করেছে।
টাঙ্গুয়ার হাওর সংরক্ষণ প্রসঙ্গে কথা হলো সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি জানালেন, দীর্ঘদিন এলাকার প্রভাবশালী মানুষ ইজারা নিয়ে নিজেদের মতো মাছ ধরত। হাওরের জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা এবং হাওরের সম্পদ সংরক্ষণের লক্ষ্যে টাঙ্গুয়ার হাওরের নয় হাজার ৭২৭ হেক্টর এলাকা ১৯৯৯ সালে সরকার ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করে। ২০০১ সালের পর থেকে টাঙ্গুয়ার হাওর ইজারা দেওয়া বন্ধ হয়েছে। ২০০৩ সালের নভেম্বর থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পিত হয় সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের ওপর। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর টাঙ্গুয়ার হাওরের সংরক্ষণ, প্রতিবেশব্যবস্থার উন্নয়ন ও এর সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০০৭ সাল থেকে ‘টাঙ্গুয়ার হাওরের সমাজভিত্তিক টেকসই ব্যবস্থাপনা’ প্রকল্প চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় আইইউসিএন- বাংলাদেশের কারিগরি সহায়তায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
এ প্রসঙ্গে আইইউসিএন-বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ ইশতিয়াক আহমেদ জানালেন, সমাজভিত্তিক সহ-ব্যবস্থাপনার মডেলে টাঙ্গুয়ার হাওরের টেকসই ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে স্থানীয় কমিউনিটির মানুষদের সংগঠিত করে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে হাওরের অন্তর্গত ৮৮ গ্রামের ১০ হাজার পরিবার থেকে প্রায় ছয় হাজার সদস্যকে সংগঠিত করা হয়েছে। ৭৬টি গ্রামে গড়া হয়েছে ৭৩টি গ্রাম ‘সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি’।
এখন টাঙ্গুয়ার হাওরের অধীন পাঁচটি বিলের গভীরতম অংশে সীমানা নির্ধারণ করে ৬০ শতাংশ এলাকা ঘিরে দিয়ে ‘মাছ ধরা নিষিদ্ধ এলাকা’ চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ‘সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি’ সবাইকে তা মেনে চলা নিশ্চিত করছে। তা ছাড়া দুটি বিলকে পাখির অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়েছে। ৬৫ হাজার হিজল ও করচগাছের চারা লাগানো হয়েছে এবং ৩৫ হাজার নলজাতীয় জলজ উদ্ভিদ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। হাওরবাসী মানুষদের সচেতনতার বিভিন্ন উদ্যোগসহ বছরের নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত বিলে পরিমিত মাত্রায় অবাণিজ্যিক ভিত্তিতে সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের জন্য মাছ ধরার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। হাওরে নিয়ন্ত্রিতভাবে আহরিত মাছের বাজার বসে হাওরের মাঝখানের উঁচু জায়গা বা হাতিরগাতা নামের কান্দায়। জেলেরা একক বা দলবদ্ধ হয়ে রুই, বোয়াল, শোল, আইড়, ঘনিয়া, টাটকিনি, বাইন, চিংড়ি, গাঙমাগুর, মেনি, কাকিলা, পুঁটি, টেংরাসহ বিভিন্ন মাছ ধরেন নির্দিষ্ট অনুমতির অধীনে। মাছ ধরে নিয়ে যেতে হয় হাতিরগাতায়। সেখানে মাছ বিক্রয় থেকে লব্ধ আয়ের ৪০ শতাংশ জেলে, ৩৬ শতাংশ সংগঠন এবং ২৪ শতাংশ সরকার পায়।
টাঙ্গুয়ার হাওরের বিস্তৃত জনপদের বিভিন্ন পেশা ও বৈশিষ্ট্যের মানুষের পরিবেশ রক্ষা করে কীভাবে হাওর ও এর সম্পদ টেকসইভাবে সংরক্ষণ করা যায়, তা বোঝানো ও উদ্বুদ্ধ করা সহজ কাজ নয়। এ জন্য দিনরাত হাওরের বিভিন্ন জনপদে ঘুরছেন সরকার, আইইউসিএন-বাংলাদেশ, সহযোগী এনজিও সিএনআরএস ও ইরার কর্মকর্তা ও কর্মীরা। টাঙ্গুয়ার হাওরের অনন্য সৌন্দর্য আর সম্পদ কেবল তার মাছ, পাখি আর জলজ উদ্ভিদের সংখ্যা এবং হাওরের বিস্তার দেখে বোঝা সম্ভব নয়। প্রকৃতির এই অসাধারণ রূপের দেখা পেতে যেতে হবে হাওরের গভীরে। টাঙ্গুয়ার হাওরের গহিনে অজস্র জলচর পাখির নিশ্চিন্ত চলাচল, বিচিত্র শব্দ করে গাওয়া পাখিদের গান, নলবনে শিরশিরে হাওয়ার দুলুনি এবং বড়-ছোট মাছের স্বচ্ছ জলে চরে বেড়ানো দেখার আনন্দ কোনো পার্থিব প্রাপ্তির সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে?
ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী, জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।
No comments