জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী-তাঁর অর্জন অনেক by মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞা

আজ ৩০ মে। ১৯৮১ সালের এই তারিখের দিবাগত রাতে কিছুসংখ্যক বিপথগামী সেনা সদস্যের চক্রান্তে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে অবস্থানকালীন নিহত হন। এ লেখাটি তাঁকেই স্মরণ করে, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। কে ছিলেন জিয়াউর রহমান, কেমন করে তিনি রাজনীতিতে এলেন, রাষ্ট্রক্ষমতায় অবস্থানকালে কী ছিল তাঁর অর্জন_সংক্ষিপ্ত আকারে এ সবই ছোট এই নিবন্ধটির উপজীব্য।


জিয়াউর রহমান ও তাঁর কর্মকাণ্ড জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে। ইতিপূর্বে তৎকালীন পাকিস্তানের উভয় অংশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে। কথা ছিল, নির্বাচনের পর সংসদে আলোচনার মাধ্যমে দেশের সংবিধান রচিত হবে, যার ভিত্তিতে সে সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সেনাবাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তর করবে জনপ্রতিনিধিদের কাছে। এ নিয়ে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে টানাপড়েন শুরু হয়। ১৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সংবিধান কী হবে, তা নিয়ে আলোচনা আরম্ভ হয়; কিন্তু পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে সমঝোতায় পেঁৗছানোর কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না, প্রকৃতপক্ষে তা সম্ভবও ছিল না। এ অবস্থায় ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে_আক্রান্ত হয় বিডিআরের প্রধান আস্তানা, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিভিন্ন আবাসিক হল ও শিক্ষকদের বাসস্থান, ঢাকা শহরের কোনো কোনো বস্তি ইত্যাদি। মধ্যরাতের মধ্যে এ খবর দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় জিয়াউর রহমান ছিলেন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের একজন মেজর। ওই রাতেই তিনি একটি ড্রামের ওপর উঠে তাঁর কয়েকজন সহকর্মীর সামনে 'ডব ৎবাড়ষঃ' বা আমরা বিদ্রোহ করলাম_এই কথা বলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। পরদিন ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাঁর এই একটি কাজই তাঁকে দিয়েছে অমরত্ব। এ ছাড়া তিনি একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে নিজে সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি প্রথমে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান এবং পরবর্তী সময়ে সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এদিকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অত্যন্ত এক মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ড ঘটে, ফলে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি তাঁর পরিবারের কয়েকজন সদস্যসহ নিহত হন এবং আওয়ামী লীগেরই একজন প্রবীণ সদস্য ও সামনের কাতারের রাজনীতিবিদ খোন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রক্ষমতায় সমাসীন হন; কিন্তু ওই সরকার বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ওই বছরেরই ৩ নভেম্বর আওয়ামী ঘরানার সেনাবাহিনীর এক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করেন, খোন্দকার মোশতাককে সরিয়ে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সায়েমকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন। জিয়াউর রহমানকে বন্দি করে তাঁর কাছ থেকে সেনাপ্রধান হিসেবে পদত্যাগপত্র লিখিয়ে নেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। এ সময়ের ঘটনাবলির প্রত্যক্ষদর্শী লে. কর্নেল হামিদের বই থেকে জানা যায়, জিয়াউর রহমানকে বন্দি করা হয়েছে_এ কথা যখন ক্যান্টনমেন্টের সেনা সদস্যরা জানলেন তখন সবাই একত্র হয়ে জিয়াউর রহমানের বাসায় গিয়ে তাঁর অনিচ্ছা সত্ত্বেও '....মহিউদ্দীন, আনিস ও অন্য সিপাহিরা তাঁকে একেবারে চ্যাংদোলা করে কাঁধে উঠিয়ে অপেক্ষমাণ জিপে তুলে ফেলেন। চতুর্দিকে স্লোগান উঠল...জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ, সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই' (লে. কর্নেল হামিদ : তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না-বলা কথা)।
জিয়াউর রহমান মুক্ত হলেন। তখন সেনাবাহিনীর মধ্যে ভীষণ বিশৃঙ্খলা। সাধারণ সিপাহিরা কোনো কোনো অফিসার এবং তাঁদের স্ত্রীদের হত্যা করেছে। মনে হচ্ছিল সেনাবাহিনী বোধ হয় আর শৃঙ্খলায় ফিরে আসবে না। কিন্তু জিয়াউর রহমান নিজের নিরাপত্তার কথা আমলে না নিয়ে প্রচণ্ড সাহস নিয়ে এগিয়ে গেলেন বিশৃঙ্খল অবস্থার অবসান ঘটাতে। কর্নেল হামিদের বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, 'জিয়া পাগলের মতো এখানে-ওখানে ঘুরে সিপাহিদের বিশৃঙ্খল কার্যক্রম বন্ধ করতে বললেন ও অসম সাহস নিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলেন।' জিয়াউর রহমানের অসম সাহস, তাঁর ব্যক্তিত্ব ও ধৈর্য_সব কিছুর সাহায্যে তিনি প্রশাসনে স্থিতি ফিরিয়ে আনলেন। এরপর গণভোট ও পরবর্তী সময়ে নির্বাচনের মাধ্যমে অবিসংবাদিতভাবে ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি পদে অভিষিক্ত হন।
রাষ্ট্রপতি জিয়ার চিন্তাচেতনা ও গৃহীত কার্যক্রম : ৯ মাসের যুদ্ধে প্রায়-বিধ্বস্ত ছোট্ট একটি দেশ, তাও আবার স্বাধীনতার পরবর্তী কয়েক বছরে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা, একশ্রেণীর মানুষের আকাশচুম্বী লোভ-লালসার চাপে দুর্নীতি আর কালোবাজারির প্রসার_সব কিছু মিলিয়ে তখনকার প্রয়োজন ছিল সমগ্র জাতিকে একক জাতীয় চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করা। এ প্রেক্ষাপটে জিয়াউর রহমান আনলেন 'বাংলাদেশি' জাতীয়তাবাদের ধারণা। এ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য এ রকম_আমাদের মাতৃভাষা বাংলা আর সে অর্থে আমরা বাঙালি; কিন্তু বাংলাদেশের বাইরে আরো কোটি কোটি বাঙালি আছে। তাদের সঙ্গে আমরা এক রাষ্ট্র কি গঠন করব? সে প্রশ্ন আসে না এবং তা অসম্ভব। পাশাপাশি অবস্থান করেও সব আরবি ভাষাভাষী জনগণ তো এক রাষ্ট্রের নাগরিক নয়। আবার ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র তাও অস্বাভাবিক। কারণ সারা পৃথিবীতে অসংখ্য মুসলমান ধর্মীয় গোষ্ঠীর বাস। তা ছাড়া ধর্মের ভিত্তিতে আমরা তো পাকিস্তানের সঙ্গে একসময় ছিলাম। কিন্তু তা কি পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানের শোষণ রোধ করা গিয়েছিল? সহজ-সরল উত্তর_না। আর তাই তাও আমাদের জাতীয়তাবাদের মূল উপাদান হতে পারে না। আমাদের জাতীয়তাবাদের সর্বজনগ্রাহ্য ও গৃহীত সংজ্ঞা হবে ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি সব কিছুর ঊধর্ে্ব উঠে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি তার সীমারেখার মধ্যে সব মানুষ আমরা এক জাতি, যে জাতির নাম 'বাংলাদেশি' জাতি। এই হচ্ছে 'বাংলাদেশি' জাতীয়তাবাদের পরিচয়। দেশের ধর্ম-বর্ণ-নৃতাত্তি্বক পরিচয়ে কিছু আলাদা উপাদান থাকলেও আমরা সবাই মিলে এক জাতি। দেশের কোটি কোটি মানুষকে একটি অভিন্ন জাতীয় পরিচয়ে এক সুতোয় বেঁধে একটি অভিন্ন ও ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনে এর থেকে আর বিকল্প পথ ছিল বলে আমরা মনে করি না।
কিন্তু ওই যে বলে 'শুধু মুখে চিঁড়ে ভেজে না'। জিয়াউর রহমান স্পষ্টই উপলব্ধি করেছিলেন, বিরাটসংখ্যক দরিদ্র জনগণের জন্য যদি প্রয়োজনীয় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যবস্থা না করা যায় তাহলে কোনো তত্ত্বই, যা যতই মধুর হোক, শেষ বিচারে টিকবে না। তাই সমগ্র জাতির আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রণয়ন করলেন তাঁর বিখ্যাত ১৯ দফা কর্মসূচি। আমরা এ কর্মসূচির সব এখানে উল্লেখ করছি না। তবে এর মধ্যে ছিল দেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, নিজেদের একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে গড়ে তোলা, অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কৃষি উন্নয়ন, যেন কোনো মানুষ ভুখা না থাকে তার ব্যবস্থা করা, দেশকে নিরক্ষতার অভিশাপ মুক্ত করা, সব মানুষের নূ্যনতম চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, নারীর যথাযোগ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করাসহ সর্বমোট ১৯টি কর্মসূচি।
জিয়াউর রহমান অসংখ্য খাল খনন করলেন, ভারতের সঙ্গে পাঁচ বছর মেয়াদি ফারাক্কা চুক্তি করলেন, কৃষি উপকরণের ব্যবস্থা করলেন, সর্বোপরি গ্রাম-গ্রামাঞ্চলের কৃষক-শ্রমিককে তাঁর নেতৃত্বের গুণে বিমোহিত করলেন। ফল হলো এই, ১৯৭৫ সালে যেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল ৭৫ শতাংশ, বর্ধিত কৃষি উৎপাদনের ফলে তা নেমে আসতে থাকল। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৭-৭৮ সালে জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ শতাংশ, যা এ দেশে উচ্চতম প্রবৃদ্ধির হারের অন্যতম। এ-ও সবাই জানেন, ১৯৭৪ সালের পর এ দেশে দুর্ভিক্ষ বা চরম খাদ্যাভাব আর হয়নি। এর মূল কারণ ছিল কৃষির উন্নতি, যার পেছনের কারণ দুর্নীতিমুক্ত, কর্মোদ্যোগী প্রশাসন।
পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রেও জিয়াউর রহমানের অর্জন ছিল অনেক। তাঁর সময় প্রতিবেশীসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তিনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সখ্য গড়ে তোলেন। ফল হয়েছিল এই যে বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ বেড়েছিল। তাঁর শাসনামলে বাংলাদেশ প্রথম জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয় অত্যন্ত শক্তিশালী দেশ জাপানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। ওই সময় ওআইসির সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কমিটি 'আলকুদস কমিটি'রও সদস্য নির্বাচিত হয় বাংলাদেশ। আর ব্যক্তিগতভাবে জিয়াউর রহমানকে দায়িত্ব দেওয়া হয় 'ইরান-ইরাক' যুদ্ধ নিরসনে মধ্যস্থতা করার জন্য। আমি যেহেতু সেনেগালসহ পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছিলাম কয়েক বছর, সেহেতু সেসব দেশে গিয়ে জানতে পারি, তিনি ওই সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানসহ উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সখ্য গড়ে তুলেছিলেন। বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে তাঁর সর্বাপেক্ষা বড় কীর্তি সার্কের রূপকার হিসেবে। প্রকৃতপক্ষে স্বল্পকালীন শাসনামলে জিয়াউর রহমান কী কৃষি, কী শিল্প, কী নারীর ক্ষমতায়ন, কী শিশুদের সুষম উন্নয়ন, কী সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কী পররাষ্ট্রনীতি_এমন কোনো দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নেই, যেখানে তিনি তাঁর সফলতার স্বাক্ষর রেখে যাননি। আর তা সম্ভব হয়েছে এ কারণে যে তিনি ছিলেন নির্লোভ, নির্মোহ জীবনাচারের সাধক, আর ছিল তাঁর অগাধ দেশপ্রেম, যার প্রকাশ হতো ব্যক্তিগত পর্যায়ে।
লেখক : সাবেক অধ্যাপক ও উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত, সেনেগাল

No comments

Powered by Blogger.