বহে কাল নিরবধি-জীবনে-মরণে বিতর্কিতই থাকলেন প্রথাবিরুদ্ধ মোল্লা by এম আবদুল হাফিজ
সৌদি আরবে জন্মগ্রহণকারী ওসামা বিন লাদেন যেমন মৃত্যুর আশা পোষণ করতেন, সেভাবেই তাঁর সে আশা পূর্ণ হয়েছে। তবে তিনি জীবনে এবং মরণে তাঁকে ঘিরে যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন, তা সহজেই শেষ হবে না। স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনে অভ্যস্ত অনেকেই এখনো ভেবে কূলকিনারা করতে পারেন না যে তাঁর মতো ধনাঢ্য ব্যক্তি কী করে একটি
বিলাসী জীবন পরিহার করে আফগানিস্তানের মতো একটি দুর্গম দেশে থাকতে এবং যুদ্ধ করতে গেলেন শুধু 'জিহাদের' প্রতি তাঁর কমিটমেন্টের কারণে? এই একই কারণে তিনি, এমনকি তাঁর পরিবার কর্তৃক পরিত্যক্ত হন এবং তাঁর সৌদি নাগরিকত্ব বাতিল হয়।
তাঁর কার্যক্রম, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর আল-কায়েদা দ্বারা নয়-এগারোর সংঘটন কার্যত বিশ্ব মুসলিমকে বিভক্ত করে ফেলে, আফগানিস্তানে আমেরিকার প্রলয়ঙ্করী আক্রমণ হয় এবং সেখানকার আল-কায়েদা প্রণোদিত তালেবান সরকারের পতন ঘটে। অবশ্য ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের নিঃশর্ত সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য, যা ফিলিস্তিনিদের দখলে রাখতে সাহায্য করে এমন মার্কিন আচরণেরও তিনি যৌক্তিক ও কড়া সমালোচনা করতে দ্বিধান্বিত হননি। শক্ত বিরোধিতা করেছেন তাঁর স্বদেশ সৌদি আরবে মার্কিন সেনা উপস্থিতির। এতে অবশ্যই তাঁর স্বদেশপ্রেম এবং বিজাতীয়দের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবাদী মনোভাব ফুটে উঠেছে।
কিন্তু উদ্দেশ্য সাধন ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাঁর অনুসৃত যে সহিংস কৌশল এবং আল-কায়েদার সন্ত্রাসী হামলা, যাতে অনেক নিরীহ মানুষ নিহত হয়, সেসবের বিবেচনায় তাঁর দর্শন অনেক আগেই কালিমালিপ্ত হয়েছে এবং সে কারণেই আল-কায়েদার কার্যক্রম ক্রমেই সমর্থন হারিয়ে ফেলেছে। শেষের দিকে তাঁর ভক্ত দলের ক্রম সংকোচন তাঁর সমর্থন হারানোর প্রমাণ। ফলে একপর্যায়ে রাজনৈতিকভাবে বিন লাদেন একজন নন-এলটিটিতে পরিণত হন। তার প্রমাণ আরব বিশ্বে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানে আল-কায়েদার প্রায় শূন্য প্রভাব। কারণ আরবরা করে দেখিয়েছে গণ-অভ্যুত্থান, পরিবর্তন বা গণতন্ত্রায়ণ_এ সব কিছুই অহিংস পথেও সম্ভব। তাই আরব বিশ্বের সাড়া জাগানো পরিবর্তনের ধারায় আল-কায়েদাকে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে।
তবে এটা অসম্ভব নয় যে আল-কায়েদা একটি বিরাষ্ট্রীয় সত্তা হিসেবে তার অস্তিত্ব কোনোমতে টিকিয়ে রাখতে পারবে সম্ভবত মিসরীয় আল-কায়েদা নেতা ডা. আইমান আল জাওয়াহিরির নেতৃত্বে, যদিও এর আবেদন তার তীব্রতা হারাবে। আরব এবং বিশ্বের অন্য মুসলমানরা আরব অভ্যুত্থানের ধারায় বুঝতে পেরেছে, তারা শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাদের আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারেও বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়াই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম।
ইতিমধ্যেই দুর্বল এবং অস্তিত্ব রক্ষায় সংগ্রামরত আল-কায়েদার জন্য বিন লাদেনের মৃত্যুর চেয়ে কঠিন আঘাত কদাচিৎ হতে পারে_তাও আবার মার্কিন স্পেশাল ফোর্সের নাটকীয় হামলায় তারই অ্যাবোটাবাদের (পাকিস্তান) গোপন আস্তানায়। আল-কায়েদার ৫৪ বছর বয়স্ক প্রতিষ্ঠাতা সেই মানুষটি, যিনি বিশ্বব্যাপী মুসলিম যুবসমাজকে ইসলামের নামে অস্ত্র হাতে নিতে প্রেরণা জুুগিয়েছিলেন, তিনি আর নেই। আল-কায়েদার অভ্যন্তরে এ মুহূর্তে এমনই এক বিশৃঙ্খল অবস্থা যে পহেলা মের ভোরে ওসামার মৃত্যু হলেও এর সদস্যরা অনেক সময় নিয়েছেন বিন লাদেনের মৃত্যুসংবাদ নিশ্চিত করতে।
এখন সবাই তাকিয়ে আছে সহযোগী আল-কায়েদা নেতা জাওয়াহিরির দিকে। মিসরের একজন চিকিৎসক, যিনি ওসামার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগে মিসরের ইসলামিক জিহাদ সংগঠনটির প্রধান ছিলেন এবং তাঁর জিহাদি তৎপরতার জন্য নিজ দেশে কারাবরণও করেছেন। মিসরে তাঁর সাংগঠনিক কার্যক্রম ক্রমান্বয়ে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হলে তিনি আফগান উদ্বাস্তু শিবিরে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে পাকিস্তানে পাড়ি জমান। পাকিস্তানেই তিনি প্রথমে আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে জিহাদে জড়িয়ে পড়েন। অতঃপর এখানেই লাদেনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয় এবং তিনি আল-কায়েদার সহনেতা ও তাত্তি্বকের দায়িত্ব পালন করেন।
আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযানের পর সংগত কারণেই যুদ্ধের ঘনঘটায়ই সম্ভবত জাওয়াহিরি ওসামার সঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন হন। এ কথা এখন পরিষ্কার, এই বিচ্ছিন্নতার কারণেই জীবিত আছেন বলে সবার বিশ্বাস। কিন্তু এই মর্মে তাঁর একটি বিবৃতি, যা আল-কায়েদার জন্য প্রত্যাশিত ছিল, তা এখনো আসেনি। ধারণা করা হয়, তাঁরা উভয়ে উভয়ের সংস্পর্শে থাকলেও একত্রিত থাকেননি, যাতে তাঁদের অন্তত একজন মার্কিন গোয়েন্দার ও অ্যাবোটাবাদের মতো হামলা থেকে বেঁচে যান এবং আল-কায়েদার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জাওয়াহিরি এখন পর্যন্ত কোথাও থেকে আত্মপ্রকাশ না করলেও এ কথা নিশ্চিত, ওসামার সঙ্গে যাঁরা ১ মে-তে মৃত্যুবরণ করেছেন, সেই তালিকায় জাওয়াহিরি নেই। এমনো কোনো তথ্য নেই যে তিনি এই নেভিসিলসের হামলায় আহত হয়েছেন বা ধরা পড়েছেন।
এর ফলে আল-কায়েদা এবং সমমনা সংগঠনগুলো এখন পর্যন্ত উৎকণ্ঠার সঙ্গে জাওয়াহিরির ভাগ্য বা বর্তমান অবস্থান জানার অপেক্ষায় আছে। ইতিমধ্যে সাইফ আল আদেল নামে এক সৌদি আল-কায়েদার ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। তবে জাওয়াহিরি বেঁচে থাকলেও এখন তাঁর পক্ষে আর বেশি দিন আত্মগোপন করে থাকা সম্ভব হবে না। কেননা বিন লাদেনের অ্যাবোটাবাদ আস্তানা থেকে নেভিসিলস লাদেনের কম্পিউটারসহ এখন পর্যন্ত অনেক অজ্ঞাত তথ্য সংগ্রহের যেসব মাধ্যম উদ্ধার করেছে, তা জাওয়াহিরির ওপর আলোকপাত করার জন্য যথেষ্ট। এ সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত আল-কায়েদার অনুমান, জাওয়াহিরিই হয়তো তাঁর অজ্ঞাতবাস থেকে বেরিয়ে এসে সংগঠনের হাল ধরবেন। কিন্তু তাঁর নেতৃত্ব হবে আল-কায়েদার বর্তমান দুর্বল অবস্থায় কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ।
এ কথা অনস্বীকার্য, আল-কায়েদা এ মুহূর্তে আফগানিস্তানে কোয়ালিশন ফোর্সের যুদ্ধের পরিণতিতে দুর্বল ও কোণঠাসা এবং উপজাতীয় অঞ্চলে পাকিস্তানের উপর্যুপরি সামরিক অভিযানে বেকায়দায় রয়েছে। তা ছাড়া পাকিস্তানই তো আল-কায়েদার শীর্ষ কুশলীদের ধরে ধরে মার্কিনিদের হাতে তুলে দিয়েছে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে মার্কিনিদের ওসামা বধের মতো অগ্রগতি সত্ত্বেও তারাও খুব ভালো অবস্থানে নেই। আফগানিস্তানে উভয়পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষিত রেখে একটি নিষ্পত্তিতে এখনো মার্কিনিদের পাকিস্তানের মধ্যস্থতার প্রয়োজন আছে। নতুবা তাদের যুদ্ধে আফগান তালেবানকে পরাজিত করেই তারা সেনা প্রত্যাহারের চিন্তা করতে পারে, যার প্রতিশ্রুতি বারাক ওবামা দিয়ে রেখেছেন। দৃশ্যপট থেকে ওসামার অন্তর্হিত হওয়ার পর অনুসারীদের মনোবল ভেঙে পড়ায় সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধসংশ্লিষ্ট সমীকরণগুলোও বদলাবে।
আরো বদলে যাবে বিন লাদেন সম্পর্কে এ পর্যন্ত প্রচলিত জনমত ও বিভিন্ন মহলের ধ্যানধারণা। যে মানুষটি অন্তত গত দেড় দশকের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তিত্ব এবং সর্বাধিক মানুষ যাঁর ভাগ্য ও অবস্থান নিয়ে আন্দাজ-অনুমানে লিপ্ত থাকত, যাঁকে ঘিরে অনেক নতুন সংবাদমাধ্যমের উৎপত্তি হয়েছে, যাঁকে নিয়ে রূপকথা রচিত হয়েছে বা বাস্তববাদী বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা খ্যাতি অর্জন করেছেন, সেই ওসামা বিন লাদেন এখন এ সব কিছুর ঊধর্ে্ব। তবু তাঁকে ঘিরে আলোচনার রেশ এখনো শেষ হতে চায় না। সম্ভবত তা হবেও না। ওসামার হত্যাকারীরা একসময় তাঁকে হাজার দুর্ঘটনার মতো ভুলে যাবে। কিন্তু তাঁর ভক্ত-সমর্থকদের অন্তরে তিনি জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকবেন।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট
তাঁর কার্যক্রম, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর আল-কায়েদা দ্বারা নয়-এগারোর সংঘটন কার্যত বিশ্ব মুসলিমকে বিভক্ত করে ফেলে, আফগানিস্তানে আমেরিকার প্রলয়ঙ্করী আক্রমণ হয় এবং সেখানকার আল-কায়েদা প্রণোদিত তালেবান সরকারের পতন ঘটে। অবশ্য ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের নিঃশর্ত সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য, যা ফিলিস্তিনিদের দখলে রাখতে সাহায্য করে এমন মার্কিন আচরণেরও তিনি যৌক্তিক ও কড়া সমালোচনা করতে দ্বিধান্বিত হননি। শক্ত বিরোধিতা করেছেন তাঁর স্বদেশ সৌদি আরবে মার্কিন সেনা উপস্থিতির। এতে অবশ্যই তাঁর স্বদেশপ্রেম এবং বিজাতীয়দের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবাদী মনোভাব ফুটে উঠেছে।
কিন্তু উদ্দেশ্য সাধন ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাঁর অনুসৃত যে সহিংস কৌশল এবং আল-কায়েদার সন্ত্রাসী হামলা, যাতে অনেক নিরীহ মানুষ নিহত হয়, সেসবের বিবেচনায় তাঁর দর্শন অনেক আগেই কালিমালিপ্ত হয়েছে এবং সে কারণেই আল-কায়েদার কার্যক্রম ক্রমেই সমর্থন হারিয়ে ফেলেছে। শেষের দিকে তাঁর ভক্ত দলের ক্রম সংকোচন তাঁর সমর্থন হারানোর প্রমাণ। ফলে একপর্যায়ে রাজনৈতিকভাবে বিন লাদেন একজন নন-এলটিটিতে পরিণত হন। তার প্রমাণ আরব বিশ্বে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানে আল-কায়েদার প্রায় শূন্য প্রভাব। কারণ আরবরা করে দেখিয়েছে গণ-অভ্যুত্থান, পরিবর্তন বা গণতন্ত্রায়ণ_এ সব কিছুই অহিংস পথেও সম্ভব। তাই আরব বিশ্বের সাড়া জাগানো পরিবর্তনের ধারায় আল-কায়েদাকে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে।
তবে এটা অসম্ভব নয় যে আল-কায়েদা একটি বিরাষ্ট্রীয় সত্তা হিসেবে তার অস্তিত্ব কোনোমতে টিকিয়ে রাখতে পারবে সম্ভবত মিসরীয় আল-কায়েদা নেতা ডা. আইমান আল জাওয়াহিরির নেতৃত্বে, যদিও এর আবেদন তার তীব্রতা হারাবে। আরব এবং বিশ্বের অন্য মুসলমানরা আরব অভ্যুত্থানের ধারায় বুঝতে পেরেছে, তারা শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাদের আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারেও বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়াই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম।
ইতিমধ্যেই দুর্বল এবং অস্তিত্ব রক্ষায় সংগ্রামরত আল-কায়েদার জন্য বিন লাদেনের মৃত্যুর চেয়ে কঠিন আঘাত কদাচিৎ হতে পারে_তাও আবার মার্কিন স্পেশাল ফোর্সের নাটকীয় হামলায় তারই অ্যাবোটাবাদের (পাকিস্তান) গোপন আস্তানায়। আল-কায়েদার ৫৪ বছর বয়স্ক প্রতিষ্ঠাতা সেই মানুষটি, যিনি বিশ্বব্যাপী মুসলিম যুবসমাজকে ইসলামের নামে অস্ত্র হাতে নিতে প্রেরণা জুুগিয়েছিলেন, তিনি আর নেই। আল-কায়েদার অভ্যন্তরে এ মুহূর্তে এমনই এক বিশৃঙ্খল অবস্থা যে পহেলা মের ভোরে ওসামার মৃত্যু হলেও এর সদস্যরা অনেক সময় নিয়েছেন বিন লাদেনের মৃত্যুসংবাদ নিশ্চিত করতে।
এখন সবাই তাকিয়ে আছে সহযোগী আল-কায়েদা নেতা জাওয়াহিরির দিকে। মিসরের একজন চিকিৎসক, যিনি ওসামার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগে মিসরের ইসলামিক জিহাদ সংগঠনটির প্রধান ছিলেন এবং তাঁর জিহাদি তৎপরতার জন্য নিজ দেশে কারাবরণও করেছেন। মিসরে তাঁর সাংগঠনিক কার্যক্রম ক্রমান্বয়ে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হলে তিনি আফগান উদ্বাস্তু শিবিরে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে পাকিস্তানে পাড়ি জমান। পাকিস্তানেই তিনি প্রথমে আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে জিহাদে জড়িয়ে পড়েন। অতঃপর এখানেই লাদেনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয় এবং তিনি আল-কায়েদার সহনেতা ও তাত্তি্বকের দায়িত্ব পালন করেন।
আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযানের পর সংগত কারণেই যুদ্ধের ঘনঘটায়ই সম্ভবত জাওয়াহিরি ওসামার সঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন হন। এ কথা এখন পরিষ্কার, এই বিচ্ছিন্নতার কারণেই জীবিত আছেন বলে সবার বিশ্বাস। কিন্তু এই মর্মে তাঁর একটি বিবৃতি, যা আল-কায়েদার জন্য প্রত্যাশিত ছিল, তা এখনো আসেনি। ধারণা করা হয়, তাঁরা উভয়ে উভয়ের সংস্পর্শে থাকলেও একত্রিত থাকেননি, যাতে তাঁদের অন্তত একজন মার্কিন গোয়েন্দার ও অ্যাবোটাবাদের মতো হামলা থেকে বেঁচে যান এবং আল-কায়েদার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জাওয়াহিরি এখন পর্যন্ত কোথাও থেকে আত্মপ্রকাশ না করলেও এ কথা নিশ্চিত, ওসামার সঙ্গে যাঁরা ১ মে-তে মৃত্যুবরণ করেছেন, সেই তালিকায় জাওয়াহিরি নেই। এমনো কোনো তথ্য নেই যে তিনি এই নেভিসিলসের হামলায় আহত হয়েছেন বা ধরা পড়েছেন।
এর ফলে আল-কায়েদা এবং সমমনা সংগঠনগুলো এখন পর্যন্ত উৎকণ্ঠার সঙ্গে জাওয়াহিরির ভাগ্য বা বর্তমান অবস্থান জানার অপেক্ষায় আছে। ইতিমধ্যে সাইফ আল আদেল নামে এক সৌদি আল-কায়েদার ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। তবে জাওয়াহিরি বেঁচে থাকলেও এখন তাঁর পক্ষে আর বেশি দিন আত্মগোপন করে থাকা সম্ভব হবে না। কেননা বিন লাদেনের অ্যাবোটাবাদ আস্তানা থেকে নেভিসিলস লাদেনের কম্পিউটারসহ এখন পর্যন্ত অনেক অজ্ঞাত তথ্য সংগ্রহের যেসব মাধ্যম উদ্ধার করেছে, তা জাওয়াহিরির ওপর আলোকপাত করার জন্য যথেষ্ট। এ সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত আল-কায়েদার অনুমান, জাওয়াহিরিই হয়তো তাঁর অজ্ঞাতবাস থেকে বেরিয়ে এসে সংগঠনের হাল ধরবেন। কিন্তু তাঁর নেতৃত্ব হবে আল-কায়েদার বর্তমান দুর্বল অবস্থায় কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ।
এ কথা অনস্বীকার্য, আল-কায়েদা এ মুহূর্তে আফগানিস্তানে কোয়ালিশন ফোর্সের যুদ্ধের পরিণতিতে দুর্বল ও কোণঠাসা এবং উপজাতীয় অঞ্চলে পাকিস্তানের উপর্যুপরি সামরিক অভিযানে বেকায়দায় রয়েছে। তা ছাড়া পাকিস্তানই তো আল-কায়েদার শীর্ষ কুশলীদের ধরে ধরে মার্কিনিদের হাতে তুলে দিয়েছে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে মার্কিনিদের ওসামা বধের মতো অগ্রগতি সত্ত্বেও তারাও খুব ভালো অবস্থানে নেই। আফগানিস্তানে উভয়পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষিত রেখে একটি নিষ্পত্তিতে এখনো মার্কিনিদের পাকিস্তানের মধ্যস্থতার প্রয়োজন আছে। নতুবা তাদের যুদ্ধে আফগান তালেবানকে পরাজিত করেই তারা সেনা প্রত্যাহারের চিন্তা করতে পারে, যার প্রতিশ্রুতি বারাক ওবামা দিয়ে রেখেছেন। দৃশ্যপট থেকে ওসামার অন্তর্হিত হওয়ার পর অনুসারীদের মনোবল ভেঙে পড়ায় সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধসংশ্লিষ্ট সমীকরণগুলোও বদলাবে।
আরো বদলে যাবে বিন লাদেন সম্পর্কে এ পর্যন্ত প্রচলিত জনমত ও বিভিন্ন মহলের ধ্যানধারণা। যে মানুষটি অন্তত গত দেড় দশকের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তিত্ব এবং সর্বাধিক মানুষ যাঁর ভাগ্য ও অবস্থান নিয়ে আন্দাজ-অনুমানে লিপ্ত থাকত, যাঁকে ঘিরে অনেক নতুন সংবাদমাধ্যমের উৎপত্তি হয়েছে, যাঁকে নিয়ে রূপকথা রচিত হয়েছে বা বাস্তববাদী বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা খ্যাতি অর্জন করেছেন, সেই ওসামা বিন লাদেন এখন এ সব কিছুর ঊধর্ে্ব। তবু তাঁকে ঘিরে আলোচনার রেশ এখনো শেষ হতে চায় না। সম্ভবত তা হবেও না। ওসামার হত্যাকারীরা একসময় তাঁকে হাজার দুর্ঘটনার মতো ভুলে যাবে। কিন্তু তাঁর ভক্ত-সমর্থকদের অন্তরে তিনি জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকবেন।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট
No comments