বিদ্যুৎ উৎপাদন-বহুমাত্রিক জ্বালানি ব্যবহারের বিকল্প নেই by বদরূল ইমাম

বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত উৎপাদন জনজীবনে যে কঠিন যন্ত্রণা বয়ে এনেছে, তার স্বরূপ বর্ণনার কোনো প্রয়োজন নেই। সরকারি ভাষ্যমতে, বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছয় হাজার মেগাওয়াটের বিপরীতে সর্বোচ্চ উৎপাদন চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াট, অর্থাৎ লোডশেডিংয়ের পরিমাণ সর্বোচ্চ দেড় থেকে


দুই হাজার মেগাওয়াট। সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে, তা তার কার্যকলাপে দৃশ্যমান হলেও এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে আসেনি বা কবে নাগাদ আসবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
বিদ্যুতের চাহিদা বছরে ৭ থেকে ১০ শতাংশ হারে বেড়ে চলেছে। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে সর্বোচ্চ ১০ হাজার এবং ২০২০ সালে ১৪ হাজার মেগাওয়াটে। উদ্বেগের কথা হলো, এত বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিকট ভবিষ্যতে জ্বালানির জোগান কীভাবে হবে, তার কোনো গ্রহণযোগ্য চিত্র সরকারের হাতে আছে বলে মনে হয় না।
কিন্তু এ বিষয়ে সরকারি ভাষ্য জাদুকরিভাবে সহজ। সরকার বলছে, ২০১২ সালে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত হাজার মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সর্বোচ্চ উৎপাদন হবে সাত হাজার ২০০ মেগাওয়াট, অর্থাৎ লোডশেডিং কমে গিয়ে প্রায় ৩০০ মেগাওয়াট হবে। আর ২০১৩ সাল হবে সেই সুবর্ণ বছর, যখন দেশে কোনো লোডশেডিং থাকবে না। সে বছর বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা আট হাজার ৩০০ মেগাওয়াটের বিপরীতে সর্বোচ্চ উৎপাদন হবে আট হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। আর তার পরবর্তী সব বছরে, সরকারি ভাষ্যমতে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্রা চাহিদার ওপরে অবস্থান করতে থাকবে (বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ক্রোড়পত্র, ১০ ডিসেম্বর ২০১০)। এক অস্থির যন্ত্রণাপীড়িত জনগোষ্ঠীকে এমন সান্ত্বনাবাণী শোনালেও বাস্তব যে বহুগুণে কঠিন, তা বলাই বাহুল্য; বিদ্যমান একটি দুর্বল বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার সমাধান-প্রক্রিয়া যেখানে ১০ বছর আগে শুরু করা উচিত ছিল, তা শুরু হয়েছে অনেক দেরি করে।
কয়েক দশক ধরে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনকে মূলত গ্যাসভিত্তিক (৮০ থেকে ৯০ শতাংশ) একক জ্বালানিনির্ভর করে রাখা সরকারি মহলের অদূরদর্শিতার সাক্ষ্য বহন করে। কেবল তা-ই নয়, এটিকে বর্তমান বিদ্যুৎ-সংকটের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। আর এর সমাধান হবে একক জ্বালানি-নির্ভরতা থেকে বের হয়ে বহুমাত্রিক জ্বালানি পন্থা অবলম্বন করা। নিচে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশের গ্যাস, কয়লা ও পারমাণবিক জ্বালানির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দৃশ্যপটের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
প্রাকৃতিক গ্যাস: বর্তমানে দেশে প্রাকৃতিক গ্যাস ঘাটতি দিনে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট, যার কারণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কম বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় চলমান বাধাসমূহ দূর করতে পারলে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। দেশের সমুদ্র অঞ্চলে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম পুনরায় শুরু করতে না পারার ব্যর্থতা সরকারি দুর্বলতার প্রতিফলন। প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সমুদ্র গ্যাস কার্যক্রম তৎপরতা ও সাম্প্রতিক সাফল্য বাংলাদেশের জন্য অর্থবহ হলেও এ দেশের সমুদ্র গ্যাস কার্যক্রমের বর্তমান স্থবিরতা দেশের জ্বালানি-সংকটকে কেবল দীর্ঘায়িত করতে সাহায্য করবে।
বর্তমান গ্যাস-সংকট মেটাতে যে ত্বরিত ব্যবস্থা সরকার নিতে যাচ্ছে, তার মধ্যে চালু গ্যাসক্ষেত্রসমূহে উৎপাদন-কূপের সংখ্যা বাড়ানো সঠিক পন্থা। তবে দেশীয় গ্যাস ব্যবস্থাপনার একটি বিষয় বিস্ময়কর। আজ প্রায় ছয় বছর হয়ে গেল, দেশের সর্ববৃহৎ তিতাস গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাস লিক হয়ে মাটি ফেটে বের হয়ে চলেছে। নিজস্ব বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত এটি সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে বের হয়ে যাওয়া বিপুল পরিমাণ গ্যাসের ক্ষতি তো রয়েছেই, তার সঙ্গে দেখা দিয়েছে তিতাস গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নে জটিলতা। তিতাস গ্যাসক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে চারটি কূপ খননের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত বিদেশি একটি কোম্পানি গ্যাস লিকেজের কারণে এ কাজ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। পরে রাশিয়ার সরকারি গ্যাস কোম্পানিকে এ কাজে নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, কিন্তু বিশেষজ্ঞ মহলে অনেকে মনে করেন, তিতাস গ্যাসক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের গ্যাস লিক সমস্যা এটি উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করবে। বিশ্বের কোনো দেশে নিজস্ব গ্যাসসম্পদ বিনষ্টে এ রকম দায়িত্বহীন ব্যবস্থাপনার উদাহরণ নেই। এদিকে বাংলাদেশের বাজারে গ্যাসের দাম যেখানে ইউনিটপ্রতি দুই থেকে তিন ডলার, সেখানে ইউনিটপ্রতি ১০ থেকে ১২ ডলার মূল্যে এলএনজি আমদানির সরকারি পরিকল্পনা কোনো অর্থে যৌক্তিক নয়।
কয়লা: বর্তমানে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (বড়পুকুরিয়া ২৫০ মেগাওয়াট) থেকে দেশে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের মাত্র ৪ শতাংশ সরবরাহ হয়। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কম হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করার ব্যাপারে সবাই একমত পোষণ করে। খুলনা ও চট্টগ্রামে দুটি বৃহৎ (প্রতিটি ১৩২০ মেগাওয়াট) কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়াও বর্তমানে আরও বেশ কটি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। সরকারি ভাষ্যমতে, ২০১৫ সালের মধ্যে দেশে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে মোট সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে, যা কিনা দেশের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রায় ৪৫ শতাংশ।
দেশে বর্তমানে প্রতিদিন তিন হাজার টন কয়লা উৎপাদিত হয়। ওপরের পরিকল্পনামাফিক বিদ্যুৎ পেতে হলে ২০১৫ সাল নাগাদ কয়লার প্রয়োজন হবে প্রতিদিন প্রায় ৩০ হাজার টন। প্রশ্ন হলো, এই কয়লা আসবে কোথা থেকে? তা কি দেশের নিজস্ব মজুদ থেকে, নাকি বাইরে থেকে আমদানির মাধ্যমে? আমদানি করা কয়লার দাম পড়বে বেশি এবং তার জন্য অবকাঠামোগত প্রস্তুতি নিতে হবে। অনেকের মতে, দেশের মাটির নিচে পর্যাপ্ত কয়লা রেখে দীর্ঘ মেয়াদে বিদেশ থেকে কয়লা কেনার সিদ্ধান্ত ভুল বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু বাংলাদেশে কয়লা খনন ও উত্তোলনের বিষয়টি জটিলতার পাকে পড়ে আটকে রয়েছে।
বড়পুকুরিয়া খনি প্রমাণ করেছে, ভূগর্ভস্থ খনির (২০ শতাংশ কয়লা উত্তোলনযোগ্য) মাধ্যমে দেশে কয়লার চাহিদা মেটানো যাবে না এবং এ পদ্ধতির খনি বিদ্যমান ভূ-কাঠামোতে পরিচালনা করা কঠিন। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে বাংলাদেশের মতো পানিবাহী ভূতাত্ত্বিক পরিবেশে উন্মুক্ত পদ্ধতির কয়লাখনি (৯০ শতাংশ কয়লা উত্তোলনযোগ্য) চালানোর জটিলতাও সমপরিমাণ। বিজ্ঞান ও কারিগরি উৎকর্ষের এই যুগে খনি নির্মাণ-জটিলতাকে কাটিয়ে ওঠা যাবে, তা অনেকেই বিশ্বাস করেন। কিন্তু মূল সমস্যা যতটা না কারিগরি, তার চেয়ে বেশি সামাজিক। উর্বর মাটিতে শস্য ফলানো এক বিরাট জনগোষ্ঠীকে জমি থেকে সরিয়ে দিতে হলে জনগণের সম্মতি অর্জন করা অত্যাবশ্যক।
এ দেশের উন্মুক্ত কয়লাখনি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ঘটেছে ঠিক উল্টোটা। ফুলবাড়ীতে জনগণকে উত্তেজিত করে মারমুখী বাহিনী দিয়ে তাড়া করে গুলি করে মারা হলো প্রতিবাদী মানুষকে। পরে ঘটনার সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলেন রাজনীতিবিদ, বিরোধী দলের প্রধানসহ অনেকে। পুরো ব্যাপারটি রাজনৈতিক মোড়কে মুড়িয়ে ওই অঞ্চলের জনগণকে একটি খনিবিরোধী সংগ্রামী শক্তি উপহার দিয়ে আসা হলো। এখন কারিগরি জ্ঞানে সর্বাভিজ্ঞ ব্যক্তি যদি সেখানে উন্মুক্ত খনি পদ্ধতির কারিগরি যৌক্তিকতা বোঝাতে আসেন, তবে তা অর্থহীন নয় কি? বাংলাদেশ সরকার উন্মুক্ত খনি স্থাপনে সত্যিকারভাবে আগ্রহী হলে তাকে প্রথমে জনগণের সঙ্গে সমঝোতা করে কয়লাখনির বিষয়ে তাদের আস্থা ও সম্মতি অর্জনে সচেষ্ট হতে হবে। প্রস্তাবিত খনি এলাকায় বসবাসরত জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব বিষয়ের সন্তোষজনক সমাধান উপস্থিত করে তাদের রাজি করাতে না পারলে সেখানে খনন নকশা নিয়ে যাওয়া অর্থবহ হবে না।
পারমাণবিক জ্বালানি: পারমাণবিক বিদ্যুৎ পরিকল্পনা দীর্ঘ চার দশক সুপ্ত অবস্থায় থাকার পর সম্প্রতি বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে এক চুক্তি স্বাক্ষর করে, যাতে রূপপুরে দুটি (প্রতিটি এক হাজার মেগাওয়াট) পারমাণবিক রিয়্যাক্টর স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করা হবে। চুক্তি অনুযায়ী, রাশিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, পারমাণবিক জ্বালানি সরবরাহ ও ব্যবহূত জ্বালানি ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থা করবে। বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করা যাবে বলে জানানো হয়। তবে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করে, নতুন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে সাত থেকে ১০ বছর সময় লেগে থাকে, আর বাংলাদেশে এই প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য কোনো ধরনের অবকাঠামো নেই, তাই তা চালু হতে ন্যূনতম ১০ বছর লাগবে। অর্থাৎ ২০১২ সালে নির্মাণকাজ শুরু হলে ২০২২ সালে বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ পেতে পারে।
সম্প্রতি জাপানে ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে সংঘটিত ভয়াবহ দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে বাংলাদেশে পারমাণবিক কেন্দ্র স্থাপন না করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। উল্লেখ্য, অতি শক্তিশালী ভূমিকম্পেও কেন্দ্রটি দুর্ঘটনাকবলিত হয়নি, বরং এরপর সংঘটিত সুনামির পানির জোয়ারে কেন্দ্রটির শীতাতপ ব্যবস্থাপনা ভেসে গেলে তাতেই তা দুর্ঘটনাকবলিত হয়। বাংলাদেশের রূপপুর ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত নয়, আর সেখানে সুনামি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। সেই অর্থে ফুকুশিমার সঙ্গে রূপপুরের তুলনা করা ঠিক নয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনা হওয়া বিরল ঘটনা, যদিও তা হলে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পর বিশ্বব্যাপী চালু ৪৪০টিরও বেশি কেন্দ্রের মধ্যে আজ পর্যন্ত কেবল তিনটি বড় দুর্ঘটনা ঘটে। প্রতিটি দুর্ঘটনার পরবর্তী সময়ে নির্মিত কেন্দ্রসমূহ আরও সতর্ক নকশা ও ব্যবস্থাপনাসহ তৈরি করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে পারমাণবিক কেন্দ্রের সংখ্যা ১০৪টি, জাপানে ৫৫, ফ্রান্সে ৫৮, রাশিয়ায় ৩২, দক্ষিণ কোরিয়ায় ২১ ও ভারতে ২০টি। ভারতে বর্তমানে আরও চারটি পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে এবং আরও ২০টি নির্মাণ পরিকল্পনার অধীনে আছে। বিশ্বব্যাপী চালু, নির্মাণাধীন ও নির্মাণ পরিকল্পনাধীন পারমাণবিক কেন্দ্রসমূহের পূর্ণ তালিকা বিবেচনায় আনলে বাংলাদেশে একটি পারমাণবিক কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা খুব ঝুঁকিপূর্ণ বা অযৌক্তিক বলে মনে হয় না।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.