দুর্যোগ-ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে ঢাকা মহানগর
গত এক শতকে ঢাকা মহানগরের জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১২০ গুণ আর আয়তনে বেড়েছে প্রায় ২০ গুণ। ঢাকামুখী এই জনস্রোতের চাপের কারণে ঢাকা ও এর চারপাশে অনেক আবাসন প্রকল্প হয়েছে। শহর-বৃদ্ধির এই মহোৎসবে অনেক ক্ষেত্রেই নির্মাণকাজের মানের চেয়ে এর দ্রুততা এবং মাটির গুণগত মানের চেয়ে জমির অবস্থান আর দামের
গুরুত্ব অনেক বেশি। স্বাভাবিকভাবেই যখন ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা তৈরি হয়, তখন আতঙ্কিত না হয়ে আমাদের কোনো উপায় থাকে না।
ঢাকার যোগাযোগব্যবস্থা বর্তমানে বেশ বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ২০ বছর মেয়াদি যোগাযোগ পরিকল্পনা (STP) এবং বেশ কয়েকটি নতুন রাস্তা ও ফ্লাইওভারের নির্মাণ যাতায়াতের পাশাপাশি আবাসন-শিল্পেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। বর্তমানেই ঢাকার পাশের জলাশয় আর নিচু জমিতে যে-সংখ্যক আবাসন প্রকল্প আছে, যোগাযোগব্যবস্থা ভালো হলে এর সংখ্যা অবশ্যই অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে।
ভূমিকম্পে ঢাকার অবস্থার ব্যাপারে আলোচনার আগে মেক্সিকোর রাজধানী মেক্সিকো সিটির ব্যাপারে কয়েকটি বিষয় দেখে নেওয়া দরকার। প্রায় ৭০০ বছর আগে অ্যাজটেকরা লেক টেক্সকোকোর অগভীর অংশে তাদের টেনোকটিটলান নগরের সূচনা করে। বহুযুদ্ধের পর ১৫ শতকে তা হুয়ান কর্টেজের হাত ধরে স্প্যানিশ আয়ত্তে আসে; নাম হয় মেক্সিকো। রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক কারণে শহর বহুগুণ বৃদ্ধি পায়, কিন্তু তা হয় একই জায়গায় ১৫০ থেকে ২৫০ ফুট গভীর লেক ভরাট করে। ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮৫ সালের সকাল সাতটা ১৯ মিনিটে এই শহরে ৮ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত করে। এর কেন্দ্র ছিল প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দূরে। কমপক্ষে ১০ হাজার লোকের প্রাণহানি আর চার বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়। সেই সঙ্গে ৪১২টি ভবন ধসে পড়ে আর তিন হাজারের ওপর ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেক্সিকো সিটির এই দুরবস্থার সব পূর্বসংকেত ঢাকাতেও বিদ্যমান—অর্থাৎ জলাশয় ভরাট করা মাটি এবং তার ওপর দুর্বল স্থাপনা। ঢাকা কি তাহলে একই পথে যাচ্ছে?
কোনো বাড়ির ভূমিকম্প-ঝুঁকি মূলত দুদিক থেকে বিবেচনা করা হয়। প্রথমত, গাঠনিক (স্ট্রাকচার) প্রকৃতি তথা এর বিভিন্ন অংশের শক্তি আর ভূমিকম্পের ঝাঁকুনিতে এর আচরণ ও অটুট থাকার ক্ষমতা; দ্বিতীয়ত, মাটির অবস্থা। আমাদের দেশের স্থাপনার নির্মাণ তদারকের গাফিলতি খুবই সাধারণ ঘটনা। এমনকি প্রকৌশলীর পরামর্শ ছাড়াই বাড়ি তৈরির (এবং ভেঙে পড়ার) ঘটনাও বিরল নয়। আবার যত্নের সঙ্গে তৈরি ভবনও বিরল নয়, যেখানে একাধিক দক্ষ প্রকৌশলী নির্মাণের তদারক করেছেন। নির্মাণকাজের এই অনির্ধারিত ধরনের জন্য এর বিশ্লেষণ করা বেশ কষ্টসাধ্য এবং মোটা দাগে কোনো মন্তব্য করা সম্ভব নয়।
কিন্তু মাটির প্রকৃতির ক্ষেত্রে তুলনামূলক আলোচনা করা যায়। কেননা এর বৈশিষ্ট্য অঞ্চলভেদে মোটা দাগে মোটামুটি স্থির থাকে। ঢাকার মাটি প্রধানত দুই রকম। ঢাকা নগরের প্রায় ৬০ শতাংশ মাটি হলো শক্ত লাল মাটি (মধুপুর ক্লে) আর বাকি ৪০ শতাংশ হলো ভরাট মাটি (ফিল)। অবশ্য নগরায়ণের ফলে এই ভরাট মাটির পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে। ভরাট মাটির এলাকাগুলো স্থানভেদে ৪০ থেকে ১০০ ফুট গভীরতা পর্যন্ত নরম মাটি বা লুস বালু দিয়ে ভরাট করা। ১৮৯৭ সালে সংঘটিত রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পটির মতো কোনো ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তি ঘটলে, শক্ত মাটির এলাকায় ক্ষতির তীব্রতা সর্বোচ্চ ৮ এবং ভরাট মাটির এলাকায় স্থানভেদে ৯ থেকে ১০ পর্যন্ত হতে পারে। সংযুক্ত মানচিত্রে ঢাকার ক্ষেত্রে এলাকাভেদে এই ক্ষতির তীব্রতা কোথায় কত হতে পারে, তার ধারণা পাওয়া যাবে।
ক্যান্টনমেন্ট এলাকা বাদে মোটামুটিভাবে ঢাকা মহানগরের সব থানার জন্যই এই মানচিত্র প্রযোজ্য। এখানে দেখা যাবে, সব ভরাট করা অঞ্চলই ৯-১০ তীব্রতার অংশে আছে।
ভরাট করা মাটিকে ভূমিকম্প-ঝুঁকির দিক দিয়ে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণগুলোর একটি বলে গণ্য করা হয়। এর তিনটি কারণ রয়েছে—মাটির লিক্যুইফেকশন (তরল-আচরণ), ভূমিধস (গ্রাউন্ড সাবসিডেন্স) এবং মাটি ও স্থাপনার মধ্যে অনুরণন ও কম্পনবৃদ্ধি। লিক্যুইফেকশন আক্ষরিকভাবেই মাটির তরলের মতো আচরণ করাকে বোঝায়। শুধু বালুমাটিতে অর্থাৎ যে মাটির দানাগুলো একে অন্যের সঙ্গে লেগে থাকতে পারে না, তাতে এ রকম হতে পারে। সবচেয়ে সহজবোধ্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে রাস্তার নিচের পানির পাইপ ফেটে গেলে পানির চাপে তার ওপরের বালুর উথলে ওঠা দিয়ে। ভূমিকম্পের সময় যে ধাক্কা আসে তার কারণে বালু ও এর সংলগ্ন পানির ওপর চাপ তৈরি হয়, যা বালুকে অনেকটা ভাসিয়ে তোলে। এতে ওই মাটির কোনো রকম ভার বহনের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে এর ওপরের স্থাপনা আক্ষরিকভাবেই মাটির ভেতরে ডুবে যায়। লিক্যুইফেকশন হওয়ার জন্য বালুর পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো বালুতে যথেষ্ট পানি থাকতে হবে। এই শর্তটি ঢাকার জন্য কিছুটা হলেও শাপে বর হয়েছে, কেননা মূল ঢাকাতে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্তর অনেক নিচে চলে গেছে। ফলে ঢাকার মূল অংশে লিক্যুইফেকশনের সম্ভাবনা কিছুটা হলেও কম। তবে বর্ষার সময় বা যেসব এলাকা কোনো জলাধার বা নদীর কাছে অবস্থিত, সে ক্ষেত্রে এ রকম ঘটার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
আবার পানির স্তরের নেমে যাওয়া আরেক দিক দিয়ে ভূমিধসের আশঙ্কা তৈরি করে। মাটির পানিবাহী স্তরটিকে অনেকটা পানিভর্তি স্পঞ্জের মতো ভাবা যায়। পানি বের হয়ে গেলে ওপরের ওজনের চাপে এই স্তর বসে যেতে পারে।
তৃতীয় যে ঘটনাটি ভয়াবহতা তৈরি করতে পারে, তা হলো মাটি আর স্থাপনার মধ্যে অনুরণন। অনুরণন হয় তখনই, যখন দুটি জিনিসের কম্পনের হার এক হবে। প্রকৃতপক্ষে, প্রতিটি জিনিসেরই নিজ নিজ স্বাভাবিক কম্পনকাল রয়েছে। মাটির কম্পনকাল এর গঠন, উপাদান আর ঘনত্বের ওপর নির্ভর করে। একইভাবে, কোনো স্থাপনার ক্ষেত্রে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি প্রধানত এর উচ্চতা কম্পনকাল নির্ধারণ করে দেয়। ছয়ের কম ও ১৫-এর বেশি তলাবিশিষ্ট ভবনের কম্পনকাল যথাক্রমে এক সেকেন্ডের কম ও দুই সেকেন্ডের বেশি এবং এ কারণে এদের ক্ষতি অনেক কম হয়েছিল। আবার নরম মাটি তথা ভরাট করা মাটি যেকোনো কম্পনকেই বাড়িয়ে তোলে। বাংলাদেশের ভরাট মাটির ক্ষেত্রে এ কথাগুলো একইভাবে প্রযোজ্য। বিশেষ করে, দুর্বল স্থাপনাগুলো অনুরণনের জন্য সৃষ্ট বড় মাপের কম্পনকে প্রতিহত করতে পারবে না। দুর্বল মাটিকে (নরম কাদা বা লুস বালু) ভূমিকম্প-সহনীয় করার অনেক পদ্ধতি আছে। সাধারণভাবে ভরাট মাটিতে পাইলিং ছাড়া কোনো স্থাপনা করা উচিত নয়।
সবশেষে কিছু আশার কথা। প্রথমত, ঢাকার অধিকাংশ ভবনই শক্ত লাল মাটিতে রয়েছে, দ্বিতীয়ত, ঢাকার ভরাট করা অংশে এখনো তুলনামূলকভাবে অনেক কমসংখ্যক উঁচু ভবন রয়েছে। এ জন্য বর্তমানে ঝুঁকির পরিমাণ কিছুটা হলেও কম। কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদে ভরাট করা এলাকা যেমন বাড়বে, তেমন ভরাট করা মাটিতে উঁচু ভবনও তৈরি হবে। তাই এসব অংশে জনবসতি আরও বাড়ার আগেই সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি হওয়া দরকার, যেন তাঁরা ভরাট করা মাটিতে বাড়ি তৈরির আগে যথাযথ ব্যবস্থা নেন।
রাজউকসহ অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থারও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসা উচিত। আমরা সময়ের কাজ সময়ে করি না, এ জন্য আমাদের অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়। কিন্তু এই বিষয়ে কাজ করার সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। তাই সময় থাকতে সবারই ভূমিকম্পের প্রতিরোধ বা ক্ষয়ক্ষতি কমানোর বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
নাজমুস সাকিব: প্রভাষক, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি), গাজীপুর।
ড. মেহেদী আনসারী ও ড. এ এম এম সফিউল্লাহ: অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা।
ঢাকার যোগাযোগব্যবস্থা বর্তমানে বেশ বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ২০ বছর মেয়াদি যোগাযোগ পরিকল্পনা (STP) এবং বেশ কয়েকটি নতুন রাস্তা ও ফ্লাইওভারের নির্মাণ যাতায়াতের পাশাপাশি আবাসন-শিল্পেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। বর্তমানেই ঢাকার পাশের জলাশয় আর নিচু জমিতে যে-সংখ্যক আবাসন প্রকল্প আছে, যোগাযোগব্যবস্থা ভালো হলে এর সংখ্যা অবশ্যই অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে।
ভূমিকম্পে ঢাকার অবস্থার ব্যাপারে আলোচনার আগে মেক্সিকোর রাজধানী মেক্সিকো সিটির ব্যাপারে কয়েকটি বিষয় দেখে নেওয়া দরকার। প্রায় ৭০০ বছর আগে অ্যাজটেকরা লেক টেক্সকোকোর অগভীর অংশে তাদের টেনোকটিটলান নগরের সূচনা করে। বহুযুদ্ধের পর ১৫ শতকে তা হুয়ান কর্টেজের হাত ধরে স্প্যানিশ আয়ত্তে আসে; নাম হয় মেক্সিকো। রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক কারণে শহর বহুগুণ বৃদ্ধি পায়, কিন্তু তা হয় একই জায়গায় ১৫০ থেকে ২৫০ ফুট গভীর লেক ভরাট করে। ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮৫ সালের সকাল সাতটা ১৯ মিনিটে এই শহরে ৮ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত করে। এর কেন্দ্র ছিল প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দূরে। কমপক্ষে ১০ হাজার লোকের প্রাণহানি আর চার বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়। সেই সঙ্গে ৪১২টি ভবন ধসে পড়ে আর তিন হাজারের ওপর ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেক্সিকো সিটির এই দুরবস্থার সব পূর্বসংকেত ঢাকাতেও বিদ্যমান—অর্থাৎ জলাশয় ভরাট করা মাটি এবং তার ওপর দুর্বল স্থাপনা। ঢাকা কি তাহলে একই পথে যাচ্ছে?
কোনো বাড়ির ভূমিকম্প-ঝুঁকি মূলত দুদিক থেকে বিবেচনা করা হয়। প্রথমত, গাঠনিক (স্ট্রাকচার) প্রকৃতি তথা এর বিভিন্ন অংশের শক্তি আর ভূমিকম্পের ঝাঁকুনিতে এর আচরণ ও অটুট থাকার ক্ষমতা; দ্বিতীয়ত, মাটির অবস্থা। আমাদের দেশের স্থাপনার নির্মাণ তদারকের গাফিলতি খুবই সাধারণ ঘটনা। এমনকি প্রকৌশলীর পরামর্শ ছাড়াই বাড়ি তৈরির (এবং ভেঙে পড়ার) ঘটনাও বিরল নয়। আবার যত্নের সঙ্গে তৈরি ভবনও বিরল নয়, যেখানে একাধিক দক্ষ প্রকৌশলী নির্মাণের তদারক করেছেন। নির্মাণকাজের এই অনির্ধারিত ধরনের জন্য এর বিশ্লেষণ করা বেশ কষ্টসাধ্য এবং মোটা দাগে কোনো মন্তব্য করা সম্ভব নয়।
কিন্তু মাটির প্রকৃতির ক্ষেত্রে তুলনামূলক আলোচনা করা যায়। কেননা এর বৈশিষ্ট্য অঞ্চলভেদে মোটা দাগে মোটামুটি স্থির থাকে। ঢাকার মাটি প্রধানত দুই রকম। ঢাকা নগরের প্রায় ৬০ শতাংশ মাটি হলো শক্ত লাল মাটি (মধুপুর ক্লে) আর বাকি ৪০ শতাংশ হলো ভরাট মাটি (ফিল)। অবশ্য নগরায়ণের ফলে এই ভরাট মাটির পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে। ভরাট মাটির এলাকাগুলো স্থানভেদে ৪০ থেকে ১০০ ফুট গভীরতা পর্যন্ত নরম মাটি বা লুস বালু দিয়ে ভরাট করা। ১৮৯৭ সালে সংঘটিত রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পটির মতো কোনো ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তি ঘটলে, শক্ত মাটির এলাকায় ক্ষতির তীব্রতা সর্বোচ্চ ৮ এবং ভরাট মাটির এলাকায় স্থানভেদে ৯ থেকে ১০ পর্যন্ত হতে পারে। সংযুক্ত মানচিত্রে ঢাকার ক্ষেত্রে এলাকাভেদে এই ক্ষতির তীব্রতা কোথায় কত হতে পারে, তার ধারণা পাওয়া যাবে।
ক্যান্টনমেন্ট এলাকা বাদে মোটামুটিভাবে ঢাকা মহানগরের সব থানার জন্যই এই মানচিত্র প্রযোজ্য। এখানে দেখা যাবে, সব ভরাট করা অঞ্চলই ৯-১০ তীব্রতার অংশে আছে।
ভরাট করা মাটিকে ভূমিকম্প-ঝুঁকির দিক দিয়ে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণগুলোর একটি বলে গণ্য করা হয়। এর তিনটি কারণ রয়েছে—মাটির লিক্যুইফেকশন (তরল-আচরণ), ভূমিধস (গ্রাউন্ড সাবসিডেন্স) এবং মাটি ও স্থাপনার মধ্যে অনুরণন ও কম্পনবৃদ্ধি। লিক্যুইফেকশন আক্ষরিকভাবেই মাটির তরলের মতো আচরণ করাকে বোঝায়। শুধু বালুমাটিতে অর্থাৎ যে মাটির দানাগুলো একে অন্যের সঙ্গে লেগে থাকতে পারে না, তাতে এ রকম হতে পারে। সবচেয়ে সহজবোধ্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে রাস্তার নিচের পানির পাইপ ফেটে গেলে পানির চাপে তার ওপরের বালুর উথলে ওঠা দিয়ে। ভূমিকম্পের সময় যে ধাক্কা আসে তার কারণে বালু ও এর সংলগ্ন পানির ওপর চাপ তৈরি হয়, যা বালুকে অনেকটা ভাসিয়ে তোলে। এতে ওই মাটির কোনো রকম ভার বহনের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে এর ওপরের স্থাপনা আক্ষরিকভাবেই মাটির ভেতরে ডুবে যায়। লিক্যুইফেকশন হওয়ার জন্য বালুর পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো বালুতে যথেষ্ট পানি থাকতে হবে। এই শর্তটি ঢাকার জন্য কিছুটা হলেও শাপে বর হয়েছে, কেননা মূল ঢাকাতে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্তর অনেক নিচে চলে গেছে। ফলে ঢাকার মূল অংশে লিক্যুইফেকশনের সম্ভাবনা কিছুটা হলেও কম। তবে বর্ষার সময় বা যেসব এলাকা কোনো জলাধার বা নদীর কাছে অবস্থিত, সে ক্ষেত্রে এ রকম ঘটার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
আবার পানির স্তরের নেমে যাওয়া আরেক দিক দিয়ে ভূমিধসের আশঙ্কা তৈরি করে। মাটির পানিবাহী স্তরটিকে অনেকটা পানিভর্তি স্পঞ্জের মতো ভাবা যায়। পানি বের হয়ে গেলে ওপরের ওজনের চাপে এই স্তর বসে যেতে পারে।
তৃতীয় যে ঘটনাটি ভয়াবহতা তৈরি করতে পারে, তা হলো মাটি আর স্থাপনার মধ্যে অনুরণন। অনুরণন হয় তখনই, যখন দুটি জিনিসের কম্পনের হার এক হবে। প্রকৃতপক্ষে, প্রতিটি জিনিসেরই নিজ নিজ স্বাভাবিক কম্পনকাল রয়েছে। মাটির কম্পনকাল এর গঠন, উপাদান আর ঘনত্বের ওপর নির্ভর করে। একইভাবে, কোনো স্থাপনার ক্ষেত্রে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি প্রধানত এর উচ্চতা কম্পনকাল নির্ধারণ করে দেয়। ছয়ের কম ও ১৫-এর বেশি তলাবিশিষ্ট ভবনের কম্পনকাল যথাক্রমে এক সেকেন্ডের কম ও দুই সেকেন্ডের বেশি এবং এ কারণে এদের ক্ষতি অনেক কম হয়েছিল। আবার নরম মাটি তথা ভরাট করা মাটি যেকোনো কম্পনকেই বাড়িয়ে তোলে। বাংলাদেশের ভরাট মাটির ক্ষেত্রে এ কথাগুলো একইভাবে প্রযোজ্য। বিশেষ করে, দুর্বল স্থাপনাগুলো অনুরণনের জন্য সৃষ্ট বড় মাপের কম্পনকে প্রতিহত করতে পারবে না। দুর্বল মাটিকে (নরম কাদা বা লুস বালু) ভূমিকম্প-সহনীয় করার অনেক পদ্ধতি আছে। সাধারণভাবে ভরাট মাটিতে পাইলিং ছাড়া কোনো স্থাপনা করা উচিত নয়।
সবশেষে কিছু আশার কথা। প্রথমত, ঢাকার অধিকাংশ ভবনই শক্ত লাল মাটিতে রয়েছে, দ্বিতীয়ত, ঢাকার ভরাট করা অংশে এখনো তুলনামূলকভাবে অনেক কমসংখ্যক উঁচু ভবন রয়েছে। এ জন্য বর্তমানে ঝুঁকির পরিমাণ কিছুটা হলেও কম। কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদে ভরাট করা এলাকা যেমন বাড়বে, তেমন ভরাট করা মাটিতে উঁচু ভবনও তৈরি হবে। তাই এসব অংশে জনবসতি আরও বাড়ার আগেই সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি হওয়া দরকার, যেন তাঁরা ভরাট করা মাটিতে বাড়ি তৈরির আগে যথাযথ ব্যবস্থা নেন।
রাজউকসহ অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থারও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসা উচিত। আমরা সময়ের কাজ সময়ে করি না, এ জন্য আমাদের অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়। কিন্তু এই বিষয়ে কাজ করার সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। তাই সময় থাকতে সবারই ভূমিকম্পের প্রতিরোধ বা ক্ষয়ক্ষতি কমানোর বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
নাজমুস সাকিব: প্রভাষক, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি), গাজীপুর।
ড. মেহেদী আনসারী ও ড. এ এম এম সফিউল্লাহ: অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা।
No comments