নিত্যজাতম্‌-চার ঘণ্টার মহাখালী দখল by মহসীন হাবিব

'বুধবার রাতে রাজধানীর মহাখালীর কড়াইলে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কম্পানির (বিটিসিএল) বস্তি উচ্ছেদ করা হয়। এর প্রতিবাদে মহাখালী ওয়ারলেস গেটের টিঅ্যান্ডটি বস্তি, এরশাদনগর, বেলতলা ও কড়াইলের কয়েক হাজার বস্তিবাসী নারী-পুরুষ ফার্মগেট-বিমানবন্দর সড়কের মহাখালী ফ্লাইওভার থেকে চেয়ারম্যান বাড়ি পর্যন্ত দখল করে


নেয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি অংশের প্রতিবাদের মুখে এই গুরুত্বপূর্ণ সড়ক বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে প্রায় গোটা ঢাকা স্থবির হয়ে পড়ে। ঘণ্টাচারেক রাস্তা অবরোধ করে রাখার পর সরকারের পরবর্তী আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত আর বস্তি উচ্ছেদ করা হবে না- এমন আশ্বাসের পর তারা রাস্তা থেকে অবরোধ তুলে নেয়।'
ওপরের অংশটুকু হলো খবর। পরদিন শুক্রবার কোনো কোনো পত্রিকায় ছোট করে বের হয়েছে এ সংবাদ। সড়ক থেকে অবরোধ তুলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ঘটনার আর কোনো মূল্য কারো কাছে থাকেনি। কিন্তু আমার কাছে এ ঘটনাকে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে। বিপ্লবের যুগ এখন নেই; বিপ্লবের রিমোট কন্ট্রোল যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। যে সড়কটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কয়েক শ' প্রতিনিধি সেদিন দখল করে নিয়েছিল, সেই সড়কের নির্মাণসামগ্রী থেকে শুরু করে দরিদ্র মানুষটির কানের কাছে ধরে রাখা মোবাইল ফোনের সিম- সর্বত্রই তারা বিরাজমান। বর্তমান আদর্শবিহীন অর্থনীতিনির্ভর রাজনীতিতে এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীও অদৃশ্যভাবে একটি বিশেষ শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে, যা এই মানুষগুলো জানে না। এদের ছলেবলে যারা নিয়ন্ত্রণ করছে, সেই এলিট শ্রেণীর অদৃশ্য সুতার বাঁধন আবার ওয়াশিংটনে। সে কারণেই আমরা দেখতে পাই, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় একজন সাধারণ কর্মচারী এখানে প্রভুর ভক্তি উপভোগ করে যান। এর পরও মনে রাখতে হবে, পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে মানুষ সব যুক্তি ভুলে যায়, সব সান্ত্বনা ক্রোধে রূপ নেয়। যতই পৃথিবীর রাজনৈতিক চেহারা বদলে যাক না কেন, যত দিন মানুষের পেটে ক্ষুধা থাকবে, যত দিন মানুষে মানুষে আকাশ-পাতাল বৈষম্য থাকবে, তত দিন মানুষের জেগে ওঠার সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করা যাবে না। প্রাসঙ্গিক একটি আন্দোলনের কথা মনে পড়ছে। ভারত স্বাধীনের পর ১৯৪৩ সালে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েছিল বাংলা। যাকে আমরা এখনো পঞ্চাশের মন্বন্তর বলে থাকি। দুর্ভিক্ষ আগের বছরগুলোতেও ছোট আকারে দেখা দিয়েছে, কিন্তু ১৯৪৩ সালেই ক্ষুধা এবং পুষ্টিহীনতায় সাড়ে ছয় কোটি মানুষের মধ্যে ৮০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল। তখন বাংলার ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। এর পরের বছরগুলোয় মাত্রা কমলেও অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। প্রতিবছরই লেগে থাকত ক্ষুধা। যত ক্ষুধা আসে, তত মানুষ কলকাতামুখী হয়ে পড়ে। ১৯৫৯ সালে আবার খাদ্য ঘাটতি তীব্র আকার ধারণ করে। কাহাতক আর সহ্য হয়! এবার শুরু হলো খাদ্য আন্দোলন, যাকে ইংরেজিতে ফুড মুভমেন্ট বলা হয়। রাস্তায় রাস্তায় মানুষের ঢল নেমেছিল। গ্রামবাংলার কৃষক, নারী-পুরুষ ও শিশু দখল করে নিয়েছিল কলকাতা। শুয়ে পড়েছিল তারা কলকাতার রাস্তায়। তিন লাখ মানুষ জড়ো হয়েছিল কলকাতার ময়দানসংলগ্ন শহীদ মিনারে। ক্ষুধার্ত মানুষ দুর্বল শরীর নিয়ে রাস্তায় আন্দোলনরত অবস্থায় মৃত্যুরকোলে ঢলে পড়েছিল। পুলিশের ব্যাটনে কোনো কাজ হয়নি। মৃত্যুই যদি, তাহলে কলকাতার রাস্তায়! তখন গ্রামবাংলা থেকে উঠে আসা ক্ষুধার্ত নারী-পুরুষের সাহায্য করতে অথবা একসঙ্গে আন্দোলন করতে রাস্তায় নেমেছিল ছাত্র-পেশাজীবী থেকে শুরু করে পতিতারাও। এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি। তখনো পার্টি ভাগ হয়নি। এ আন্দোলনের হাত ধরেই পরবর্তী সময়ে পশ্চিম বাংলার ক্ষমতায় এসেছিল কমিউনিস্ট পার্টি। সুতরাং আন্দোলনের নাম যাই হোক, চরিত্র একই থাকবে। যত দিন মানুষের মৌলিক অধিকার মিটবে না, তত দিন আন্দোলন থাকবে। (দয়া করে কেউ রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনের নামে নোংরামির সঙ্গে এই মহান আন্দোলনকে গুলিয়ে ফেলবেন না। এ ধরনের আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক দলগুলো সুযোগ নেয় শুধু।) আর এ আন্দোলনের প্রথম শর্ত কিন্তু দখল।
যে ধারণার ওপর ভিত্তি করে অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট (ওয়ালস্ট্রিট দখল) আন্দোলন সম্প্রতি শুরু হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে, অনানুষ্ঠানিকভাবে এই চার ঘণ্টার মহাখালী দখল ছিল তারই রূপান্তর। বরং বলা যায়, এটাই ছিল সংক্ষেপে আন্দোলনের প্রকৃত রূপ। অকুপাই লন্ডন ও প্যারিস আন্দোলনের পেছনে একটি রাজনৈতিক আনুষ্ঠানিকতা আছে। কিন্তু মহাখালীতে অবরোধ করা মানুষগুলোর পেছনে সবচেয়ে বড় কাজ করেছে টিকে থাকার তাগিদ। সরকারে যে দলই থাক, শাসকশ্রেণীকে এখনই সতর্ক হতে হবে।
একটি সময় আমার মনেও প্রশ্ন ছিল, কেন দেশ-গাঁও ছেড়ে এ মানুষগুলো উপচে পড়া ভিড়ের মধ্যে ঢাকা শহরে এসে আরো ভারী করে তুলছে এ শহরকে? এ যে কত বড় অন্যায় ধারণা, তা আমাকে বুঝতে শিখিয়েছেন তেজদীপ্ত মহীয়সী অরুন্ধতি রায়। আমি তাঁর লেখা পড়ে পড়ে বুঝতে শিখেছি, যে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে না, বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করতে পারে না, সে রাষ্ট্রের শহর সাজানোর কোনো অধিকার নেই। জীবনকে ধারণ করার মহান প্রয়োজনে দখল করে টিকে থাকা ওদের প্রাকৃতিক দায়িত্ব। এ দায়িত্বকে যে শাসকগোষ্ঠী অস্বীকার করবে, তারা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শত্রুতে পরিণত হবে।
শাসকগোষ্ঠী তাকিয়ে থাকে পল্টনে বিরোধী দল কার নামে কী কুৎসা গাইল তার দিকে। সেই কুৎসার একটি মোক্ষম জবাব দিয়ে আবার আত্মতৃপ্তি লাভ করে। দুর্ভাগ্যজনক হলো এসব বাংলাদেশের হাস্যকর ছেলেমানুষির রাজনীতির অংশ। চিরন্তন সত্য ভুলে গেলে চলবে না : মানুষের চাহিদা পূরণই ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার একমাত্র উপায়। জনগণের প্রয়োজনের দিকে চোখ রাখাই একটি ভালো সরকারের উদাহরণ।
সাম্প্রতিক সময়ের উদাহরণ দিই? চীনের সরকার লক্ষ করল, অস্বাভাবিক হারে মানুষ শহরমুখী হয়ে পড়েছে। সরকার বেইজিংয়ের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়িত্ব দিল, ঘটনা কী তা ক্ষতিয়ে দেখতে। বেইজিং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি কৃষি গবেষণা হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার দীর্ঘ প্রতিবেদন সরকারকে দেওয়া হলো, যার মোদ্দা কথা হলো, গ্রামে পর্যাপ্ত কৃষি অবকাঠামো নেই, অধিক শ্রমে স্বল্প আয় হচ্ছে শহরের শিল্প আয়ের তুলনায়। তাই মানুষ শহরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সচিবের-অতিরিক্ত সচিবদের টেবিলে ফাইল ফেলে না রেখে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে চীনের সরকার। সম্প্রতি চীনে বৃদ্ধ লোকের পরিমাণ বেশি হয়ে গেছে। আয় রোজগার না থাকায় তাঁদের ভরণপোষণ নিয়েও দেখা দিয়েছে জটিলতা। সরকারের চোখ এড়ায়নি। প্রতিটি গ্রামে একজন গ্রামপ্রধান নিয়োগ করা হয়েছে, যিনি শুধু পারিবারিক অসঙ্গতিগুলো দূর করবেন। সন্তানরা খাবার না দিলে তিনি চাপ প্রয়োগ করে খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন এবং যাতে সন্তান দুর্ব্যবহার না করে, সেদিকে লক্ষ রাখবেন। আর যদি সন্তানের খাবার দেওয়ার সঙ্গতি না থাকে তাহলে ওই প্রধান স্থানীয় সরকারের কাছে রিপোর্ট করবেন এবং সরকার তাঁর ভরণপোষণের ব্যবস্থা করবে। সরকারের এ দূরদৃষ্টি সৃষ্টি হওয়ার কারণেই চীনে এখন আর তিয়েনআনমেন স্কয়ারের দুঃখজনক ঘটনা দেখা যায় না। মানবাধিকার পরিস্থিতিও (পশ্চিমারা যাই বলুক) অনেক উন্নত হয়েছে। তাই শেষ কথা কিন্তু জনগণের ভাষা বুঝতে পারা।
মহাখালীর ছোট্ট ঘটনায় কেন জানি বাস্তিল দুর্গ পতনের কথা মনে পড়ল। ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে মানুষের কান্নায় চার্চের প্রার্থনা বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। প্রাসাদ থেকে নাকি সম্রাট জানতে চেয়েছিলেন ওরা কী চায়? উত্তরে রাজ কর্মচারী জানিয়েছিল, ওরা রুটি খেতে চায়। সম্রাট উত্তরে বলেছিলেন, কেন কেক খেতে পারে না? আমাদের সরকারের ইন্দ্রিয় যেন এমন স্তরে না পৌঁছে।
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.