বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৩৬৪ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। নূরুল হক, বীর বিক্রম গুলিবিদ্ধ হয়েও দমে যাননি তিনি শেষ রাতে মুক্তিযোদ্ধারা নিঃশব্দে অবস্থান নিতে থাকলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান ঘিরে। মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি দলে বিভক্ত। একটি দলে আছেন নূরুল হক।
কিছুক্ষণ পর সকাল হলো। চারদিক আলোয় ক্রমে উজ্জ্বল হচ্ছে। পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের দেখেও বুঝতে পারল না, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা। একটু পর সেখানে শুরু হলো প্রচণ্ড যুদ্ধ। এ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে। ১৫ ডিসেম্বর। সিলেট এমসি কলেজে।
এই যুদ্ধের বিবরণ আছে মেজর (অব.) এম এ কাইয়ুম চৌধুরীর (১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন) বর্ণনায়। ওই যুদ্ধে তিনি অংশ নেন। তিনি বলেন: ‘...ভোর চারটায় এমসি কলেজের টিলার ওপরে এসে আমরা শত্রুর গতিবিধি লক্ষ করছিলাম। শত্রু কিন্তু আমাদের উপস্থিতি সম্বন্ধে একটুও সজাগ ছিল না। তারা তাদের ডিফেন্সের ভেতর দিয়ে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছিল। আমরা এর ফাঁক দিয়ে পজিশন নিচ্ছিলাম।
‘কিন্তু যথেষ্ট পাঞ্জাবি সেনা একসঙ্গে দেখতে পেয়ে আমরা নিজেদের দাবিয়ে রাখতে পারছিলাম না। তাই পজিশন না নিয়েই ছয়টা মেশিনগান দিয়ে তিন দিক থেকে ফায়ার শুরু করলাম। শত্রুর মাথায় যেন বজ্র ভেঙে পড়ল। তারা পাগলের মতো এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিল। এর ভেতরেই বেশ কিছু পাঞ্জাবি সেনা নিহত হয়। কিছু সেনা হাত তুলে সারেন্ডার করে।
‘শত্রুপক্ষে বেশ কিছু হতাহতের পর তারা আমাদের থেকে আরও উঁচু টিলায় অবস্থান নেয় এবং তাদের সব শক্তি টিলার ওপর নিয়োগ করে। এরপর আমাদের ‘ডি’ ও ‘বি’ কোম্পানির ওপর কয়েকটা মেশিনগান দিয়ে ফায়ার শুরু করে। আর্টিলারি ফায়ারও চলতে থাকে। এতে ডি ও বি কোম্পানির যথেষ্ট ক্ষতিসাধিত হয়। প্লাটুন কমান্ডার সুবেদার ফয়েজসহ বেশ কয়েকজন নিহত হন। যাঁরা আহত হয়েছিলেন, তাঁদের আমরা পেছনে নিয়ে যাই।
‘১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর ১১টা পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধ চলতে থাকে। আর্টিলারির সমর্থনে আমরা কিছুদূর এগোতে সমর্থ হই। তার পরেই আসে আত্মসমর্পণের পালা।’
এমসি কলেজের যুদ্ধে নূরুল হক যথেষ্ট বীরত্ব ও সাহস প্রদর্শন করেন। যুদ্ধের একপর্যায়ে তিনি আহত হন। তাঁর পায়ে গুলি লাগে। এতে তিনি দমে যাননি। গুলিবিদ্ধ হয়েও অনেকক্ষণ যুদ্ধ করেন। পরে সহযোদ্ধারা তাঁকে উদ্ধার করে পাঠিয়ে দেন ফিল্ড হাসপাতালে। এর আগে কামালপুর যুদ্ধেও শেলের স্প্লিন্টারের আঘাতে তিনি আহত হয়েছিলেন। ৩১ জুলাই ওই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। গুয়াহাটিতে চিকিৎসা নিয়ে পুনরায় যুদ্ধে যোগ দেন।
নূরুল হক চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। তখন তাঁর পদবি ছিল হাবিলদার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। যশোরের বেনাপোলে যুদ্ধ করার পর ভারতে যান। পুনর্গঠিত হওয়ার পর যুদ্ধ করেন নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীনে।
মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষত এমসি কলেজের যুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য নূরুল হককে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৪৩।
নূরুল হক ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। তখন তাঁর পদবি ছিল নায়েব সুবেদার। তাঁর পৈতৃক বাড়ি যশোর জেলার সদর উপজেলার ইছালী ইউনিয়নের ইছালী গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মো. শমসের আলী মোল্লা। মা রাহেলা বেগম। স্ত্রী শাহানারা বেগম। তাঁদের এক ছেলে ও দুই মেয়ে।
সূত্র: জাহিদ রহমান, প্রধান নির্বাহী, মুক্তিযুদ্ধে মাগুরা গবেষণা কেন্দ্র এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
এই যুদ্ধের বিবরণ আছে মেজর (অব.) এম এ কাইয়ুম চৌধুরীর (১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন) বর্ণনায়। ওই যুদ্ধে তিনি অংশ নেন। তিনি বলেন: ‘...ভোর চারটায় এমসি কলেজের টিলার ওপরে এসে আমরা শত্রুর গতিবিধি লক্ষ করছিলাম। শত্রু কিন্তু আমাদের উপস্থিতি সম্বন্ধে একটুও সজাগ ছিল না। তারা তাদের ডিফেন্সের ভেতর দিয়ে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছিল। আমরা এর ফাঁক দিয়ে পজিশন নিচ্ছিলাম।
‘কিন্তু যথেষ্ট পাঞ্জাবি সেনা একসঙ্গে দেখতে পেয়ে আমরা নিজেদের দাবিয়ে রাখতে পারছিলাম না। তাই পজিশন না নিয়েই ছয়টা মেশিনগান দিয়ে তিন দিক থেকে ফায়ার শুরু করলাম। শত্রুর মাথায় যেন বজ্র ভেঙে পড়ল। তারা পাগলের মতো এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিল। এর ভেতরেই বেশ কিছু পাঞ্জাবি সেনা নিহত হয়। কিছু সেনা হাত তুলে সারেন্ডার করে।
‘শত্রুপক্ষে বেশ কিছু হতাহতের পর তারা আমাদের থেকে আরও উঁচু টিলায় অবস্থান নেয় এবং তাদের সব শক্তি টিলার ওপর নিয়োগ করে। এরপর আমাদের ‘ডি’ ও ‘বি’ কোম্পানির ওপর কয়েকটা মেশিনগান দিয়ে ফায়ার শুরু করে। আর্টিলারি ফায়ারও চলতে থাকে। এতে ডি ও বি কোম্পানির যথেষ্ট ক্ষতিসাধিত হয়। প্লাটুন কমান্ডার সুবেদার ফয়েজসহ বেশ কয়েকজন নিহত হন। যাঁরা আহত হয়েছিলেন, তাঁদের আমরা পেছনে নিয়ে যাই।
‘১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর ১১টা পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধ চলতে থাকে। আর্টিলারির সমর্থনে আমরা কিছুদূর এগোতে সমর্থ হই। তার পরেই আসে আত্মসমর্পণের পালা।’
এমসি কলেজের যুদ্ধে নূরুল হক যথেষ্ট বীরত্ব ও সাহস প্রদর্শন করেন। যুদ্ধের একপর্যায়ে তিনি আহত হন। তাঁর পায়ে গুলি লাগে। এতে তিনি দমে যাননি। গুলিবিদ্ধ হয়েও অনেকক্ষণ যুদ্ধ করেন। পরে সহযোদ্ধারা তাঁকে উদ্ধার করে পাঠিয়ে দেন ফিল্ড হাসপাতালে। এর আগে কামালপুর যুদ্ধেও শেলের স্প্লিন্টারের আঘাতে তিনি আহত হয়েছিলেন। ৩১ জুলাই ওই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। গুয়াহাটিতে চিকিৎসা নিয়ে পুনরায় যুদ্ধে যোগ দেন।
নূরুল হক চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। তখন তাঁর পদবি ছিল হাবিলদার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। যশোরের বেনাপোলে যুদ্ধ করার পর ভারতে যান। পুনর্গঠিত হওয়ার পর যুদ্ধ করেন নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীনে।
মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষত এমসি কলেজের যুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য নূরুল হককে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৪৩।
নূরুল হক ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। তখন তাঁর পদবি ছিল নায়েব সুবেদার। তাঁর পৈতৃক বাড়ি যশোর জেলার সদর উপজেলার ইছালী ইউনিয়নের ইছালী গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মো. শমসের আলী মোল্লা। মা রাহেলা বেগম। স্ত্রী শাহানারা বেগম। তাঁদের এক ছেলে ও দুই মেয়ে।
সূত্র: জাহিদ রহমান, প্রধান নির্বাহী, মুক্তিযুদ্ধে মাগুরা গবেষণা কেন্দ্র এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments