ভিন্নমত-এসইসির (SEC) কখন হুঁশ হবে! by আবু আহমেদ
২০১০ সালের শেষ দুই মাসে আমাদের শেয়ারবাজারের ইতিহাসের ভয়াবহ দুর্যোগ সংঘটিত হয়ে গেছে। কেলেঙ্কারির ভার পুরো শেয়ারবাজারকে বিধ্বস্ত করে গেল। সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পর ক্ষোভ-বিক্ষোভের মুখে সরকারও বলতে শুরু করল হায়, কি হলো, কারা করল, কিভাবে করল ইত্যাদি।
সেই কি হলো, কারা করল, কিভাবে করল ইত্যাদি বোঝার জন্য প্রবীণ ব্যাংকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধানী কমিটি করল। যদিও অনেকেই বিষয়টি জানত যে কারা করছে, কিভাবে করছে। তবুও সেই কমিটির রিপোর্টের মাধ্যমে অন্তত শেয়ারবাজারের বাইরের লোকেরা বুঝতে পারল যে এইখানে অতি চালাক এবং প্রভাবশালী খেলোয়াড়রা কিভাবে লাখ লাখ ভোলা-বালা বিনিয়োগকারীকে ঠকাতে পারে। তারা আরো আশ্চর্য হলো এই শুনে যে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে খুদে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য রেগুলেটর হিসেবে গঠন করা হয়েছে সেই সংস্থা নাকি শুধুই বড় এবং দুষ্ট খেলোয়াড়দের সহযোগী হয়ে কাজ করেছে। তারাই বলতে লাগল আর্থিক কেলেঙ্কারির জন্য কারো বিরুদ্ধে যদি মামলা করতে হয় তাহলে প্রথম মামলাটা করা উচিত রেগুলেটর এসইসি তথা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের বিরুদ্ধে।
ইব্রাহিম খালেদের কমিটি অতি অল্প সময়ে একটি ভালো কাজ করেছে; কিন্তু সেই ভালো কাজটিও সরকারের কাছে সেইভাবে মূল্য পায়নি। সেই রিপোর্টের ধারাবাহিকতায় এবং পরবর্তীকালে বিনিয়োগকারীদের ভূমিধস বিক্ষোভের কারণে সরকারের উচ্চপর্যায়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দিয়ে শেয়ারবাজারের ইস্যুগুলোতে আলাপ করেছে এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনাও দিয়েছে। অন্য ভালো দিক হলো কিছু প্রজ্ঞাবান সংসদ সদস্যও বিষয়টিকে সংসদে তুলেছেন এবং কি হলো, কারা করল, কিভাবে করল ইত্যাদি নিয়ে মোটামুটি বস্তুনিষ্ঠ বক্তব্য দিয়েছেন। এরপর আশা করেছিলাম ভবিষ্যৎ শেয়ারবাজার ঠিকমতো চলবে, অন্তত রেগুলেটর সাহেব তথা এসইসি আর ভুল করবেন না। কিন্তু অতীব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, রেগুলেটর সাহেব যেন অতীতের ভুল থেকে কিছুই শিক্ষা নেননি, সেই একই ভুল বর্তমান এসইসিও করে চলেছেন। আমি শঙ্কিত বর্তমানে যেভাবে এসইসি বিভিন্ন IPO (Initial Public Offering)-এর অনুমোদন দিচ্ছে তাতে আগের অনাবিষ্কৃত (Undiscovered) পথে আবার এই বাজারে কেলেঙ্কারি সংঘটিত হবে। সেই কেলেঙ্কারি ভূমিধস টাইপের কিছু হবে না, তবে অনেক মিনি কেলেঙ্কারির সমষ্টি হবে।
IPO প্রাইসিংয়ের ফর্মুলা কি? দুটি পদ্ধতি আছে। এক. কথিত বাজারনির্ভরBook Building পদ্ধতি, যেটি কেলেঙ্কারির ধাক্কায় আপাতত পরিত্যক্ত। দুই. কম্পানির আর্থিক অর্জনের এবং সম্পদের ভিত্তিতে রেগুলেটর এসইসি কর্তৃক IPOকে প্রাইসিং করে দেওয়া। এটার নাম Fixed Price Method|। বর্তমান SEC Book Building পদ্ধতি বাদ দিয়ে ইস্যুয়ারদের ইচ্ছায় পরবর্তী পদ্ধতিতে IPOকে প্রাইসিং করে অনুমোদন দিচ্ছে। কিন্তু হতাশ হতে হয় এসইসির উদারতা দেখে। ইস্যুয়ার বা IPO বিক্রেতা গিয়ে এসইসির কাছে হাজির হয় অতি সুন্দর এক অডিট রিপোর্ট নিয়ে যে তার IPO বা শেয়ার বেচার গণপ্রস্তাবের মূল্য হওয়া উচিত ১০ টাকার বিপরীতে এত এত গুণ প্রিমিয়ামে। আর এসইসি সামান্য কাটছাঁট করে সেই আবদার এবং আবেদনকৃত মূল্যের কখনো ৫০%-এ, কখনো ৭৫%-এ অনুমোদন দিয়ে দিচ্ছে। এসব অনুমোদনের ভিত্তি কী? অডিটরদের কিছু ফিগার এবং ভবিষ্যদ্বাণী।
এসইসির প্রাইসিং যদি এতই সঠিক হবে তাহলে একটি পাওয়ার কম্পানির IPO আন্ডার সাবসক্রাইবড (Under Subscribed) হলো কেন? এসইসি তো একটি শিপিং কম্পানির রাইট ইস্যুকে বহুগুণ প্রিমিয়ামে বেচার অনুমোদন দিয়েছিল, কিন্তু ওই রাইট অফার থেকে ক্রেতারা কি কিছু লাভ করতে পেরেছে? তাই বলছি, ইস্যুয়ার কী চায় সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো ইস্যুয়ার ও অডিটর সত্য বলছে কি না। দুই নম্বরী অডিট ফার্মের অডিট রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেও এসইসি সমানে IPO এবং রাইট ইস্যু করার অনুমোদন দিয়ে দিচ্ছে। একটি সাবান কম্পানি গত দুই বছরে দফায় দফায় টাকা নিয়েছে। সর্বশেষ এসইসি এই কম্পানিকে অনুমোদন দিয়েছে প্রিমিয়ামসহ রাইট ইস্যু করার জন্য। আগের অর্থগুলো ওই কম্পানি কোথায় কিভাবে ব্যয় করেছে এসইসি কি জানতে চেষ্টা করেছে?
এসইসি স্পন্সরদের যে ৩০ শতাংশ শেয়ারহোল্ডিং বাধ্যতামূলক করেছে, সেই ৩০ শতাংশ তো তারা জোগান দিতে পারছে বিভিন্ন বক্রপথে। কম্পানি বলবে, অমুক পরিচালক সাহেব তো ওই কম্পানিরই প্রতিনিধি! এসইসি কি ডকুমেন্টারি ডিভিডেন্ড গ্রহণ করে যে IPO ও রাইট ইস্যুয়ার ঠিকমতো VAT ও ইনকাম ট্যাক্স দিয়েছে কি না? এসইসি কি এটার খোঁজ রাখে যে রাইট ইস্যুয়ার ক্ষেত্রে স্পন্সরদের আগে অর্থ জমা দিতে হবে? আমি শঙ্কিত, বর্তমান এসইসি ও তাঁর কর্তব্যসাধনে অতি উদারতার মাধ্যমে পুরনো সংস্কৃতি টেনে কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছে, লালন করে যাচ্ছে। সাবধান হওয়া আবশ্যক।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইব্রাহিম খালেদের কমিটি অতি অল্প সময়ে একটি ভালো কাজ করেছে; কিন্তু সেই ভালো কাজটিও সরকারের কাছে সেইভাবে মূল্য পায়নি। সেই রিপোর্টের ধারাবাহিকতায় এবং পরবর্তীকালে বিনিয়োগকারীদের ভূমিধস বিক্ষোভের কারণে সরকারের উচ্চপর্যায়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দিয়ে শেয়ারবাজারের ইস্যুগুলোতে আলাপ করেছে এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনাও দিয়েছে। অন্য ভালো দিক হলো কিছু প্রজ্ঞাবান সংসদ সদস্যও বিষয়টিকে সংসদে তুলেছেন এবং কি হলো, কারা করল, কিভাবে করল ইত্যাদি নিয়ে মোটামুটি বস্তুনিষ্ঠ বক্তব্য দিয়েছেন। এরপর আশা করেছিলাম ভবিষ্যৎ শেয়ারবাজার ঠিকমতো চলবে, অন্তত রেগুলেটর সাহেব তথা এসইসি আর ভুল করবেন না। কিন্তু অতীব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, রেগুলেটর সাহেব যেন অতীতের ভুল থেকে কিছুই শিক্ষা নেননি, সেই একই ভুল বর্তমান এসইসিও করে চলেছেন। আমি শঙ্কিত বর্তমানে যেভাবে এসইসি বিভিন্ন IPO (Initial Public Offering)-এর অনুমোদন দিচ্ছে তাতে আগের অনাবিষ্কৃত (Undiscovered) পথে আবার এই বাজারে কেলেঙ্কারি সংঘটিত হবে। সেই কেলেঙ্কারি ভূমিধস টাইপের কিছু হবে না, তবে অনেক মিনি কেলেঙ্কারির সমষ্টি হবে।
IPO প্রাইসিংয়ের ফর্মুলা কি? দুটি পদ্ধতি আছে। এক. কথিত বাজারনির্ভরBook Building পদ্ধতি, যেটি কেলেঙ্কারির ধাক্কায় আপাতত পরিত্যক্ত। দুই. কম্পানির আর্থিক অর্জনের এবং সম্পদের ভিত্তিতে রেগুলেটর এসইসি কর্তৃক IPOকে প্রাইসিং করে দেওয়া। এটার নাম Fixed Price Method|। বর্তমান SEC Book Building পদ্ধতি বাদ দিয়ে ইস্যুয়ারদের ইচ্ছায় পরবর্তী পদ্ধতিতে IPOকে প্রাইসিং করে অনুমোদন দিচ্ছে। কিন্তু হতাশ হতে হয় এসইসির উদারতা দেখে। ইস্যুয়ার বা IPO বিক্রেতা গিয়ে এসইসির কাছে হাজির হয় অতি সুন্দর এক অডিট রিপোর্ট নিয়ে যে তার IPO বা শেয়ার বেচার গণপ্রস্তাবের মূল্য হওয়া উচিত ১০ টাকার বিপরীতে এত এত গুণ প্রিমিয়ামে। আর এসইসি সামান্য কাটছাঁট করে সেই আবদার এবং আবেদনকৃত মূল্যের কখনো ৫০%-এ, কখনো ৭৫%-এ অনুমোদন দিয়ে দিচ্ছে। এসব অনুমোদনের ভিত্তি কী? অডিটরদের কিছু ফিগার এবং ভবিষ্যদ্বাণী।
এসইসির প্রাইসিং যদি এতই সঠিক হবে তাহলে একটি পাওয়ার কম্পানির IPO আন্ডার সাবসক্রাইবড (Under Subscribed) হলো কেন? এসইসি তো একটি শিপিং কম্পানির রাইট ইস্যুকে বহুগুণ প্রিমিয়ামে বেচার অনুমোদন দিয়েছিল, কিন্তু ওই রাইট অফার থেকে ক্রেতারা কি কিছু লাভ করতে পেরেছে? তাই বলছি, ইস্যুয়ার কী চায় সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো ইস্যুয়ার ও অডিটর সত্য বলছে কি না। দুই নম্বরী অডিট ফার্মের অডিট রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেও এসইসি সমানে IPO এবং রাইট ইস্যু করার অনুমোদন দিয়ে দিচ্ছে। একটি সাবান কম্পানি গত দুই বছরে দফায় দফায় টাকা নিয়েছে। সর্বশেষ এসইসি এই কম্পানিকে অনুমোদন দিয়েছে প্রিমিয়ামসহ রাইট ইস্যু করার জন্য। আগের অর্থগুলো ওই কম্পানি কোথায় কিভাবে ব্যয় করেছে এসইসি কি জানতে চেষ্টা করেছে?
এসইসি স্পন্সরদের যে ৩০ শতাংশ শেয়ারহোল্ডিং বাধ্যতামূলক করেছে, সেই ৩০ শতাংশ তো তারা জোগান দিতে পারছে বিভিন্ন বক্রপথে। কম্পানি বলবে, অমুক পরিচালক সাহেব তো ওই কম্পানিরই প্রতিনিধি! এসইসি কি ডকুমেন্টারি ডিভিডেন্ড গ্রহণ করে যে IPO ও রাইট ইস্যুয়ার ঠিকমতো VAT ও ইনকাম ট্যাক্স দিয়েছে কি না? এসইসি কি এটার খোঁজ রাখে যে রাইট ইস্যুয়ার ক্ষেত্রে স্পন্সরদের আগে অর্থ জমা দিতে হবে? আমি শঙ্কিত, বর্তমান এসইসি ও তাঁর কর্তব্যসাধনে অতি উদারতার মাধ্যমে পুরনো সংস্কৃতি টেনে কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছে, লালন করে যাচ্ছে। সাবধান হওয়া আবশ্যক।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments