রাষ্ট্রপতি জিয়া ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম by সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন
১৯৮০ সালে এক সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধায় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে এক ইফতার অনুষ্ঠানে ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। তাঁরই আমন্ত্রণে ৩০ জনের একটি সাংবাদিক দল সেদিন ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। রাষ্ট্রপতি জিয়া তখন তাঁর রাজনৈতিক ভিত মজবুত করার কাজে হাত দিয়েছেন।
বিভিন্ন সেক্টরের লোকজনের সঙ্গে কথা বলছেন, দলকে সুসংগঠিত করছেন। এরই অংশ হিসেবে সেদিনের সে বৈঠক। দলের তৎকালীন মহাসচিব অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং যুগ্ম মহাসচিব ফেরদৌস আহমদ কোরেশী এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ইফতারের ঠিক ১৫ মিনিট আগে জিয়াউর রহমান আমাদের মাঝে এসে উপস্থিত হলেন। কক্ষে প্রবেশ করেই সবাইকে সালাম দিয়ে উচ্চকণ্ঠে বললেন, 'সারা বাংলাদেশ দেখছি এখানে।' এক এক করে সবার সঙ্গে কুশলবিনিময় করলেন এবং পরিচিত হলেন।
অতিথি ভবনে ইফতার শেষে পাশের কক্ষে মাগরিবের নামাজ আদায় করি রাষ্ট্রপতি জিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে। নামাজ শেষে বৈঠকের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করলেন তিনি। তার মূল প্রতিপাদ্য ছিল, 'আমি দেশের মানুষের জন্য কাজ করছি, আপনারাও আমার পাশে থাকবেন। দেশ ও জনগণের জন্য আমার সঙ্গে কাজ করবেন।' তিনি তাঁর কর্মসূচির প্রতি আমাদের সমর্থন চাইলেন। পরবর্তী সময়ে অবশ্য তাঁর এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা অনেকেই তাঁর কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত হই। এরপর অবশ্য সাংবাদিক হিসেবে আমার নিজ জেলা মানিকগঞ্জে রাষ্ট্রপতি জিয়ার সফরসঙ্গী হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় ১৬ বারের মতো তিনি মানিকগঞ্জ সফর করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কাশাদহ খাল খনন কর্মসূচির উদ্বোধন, ঝিটকা স্কুলে রাতযাপন ও মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠান এবং মানিকগঞ্জের নবগ্রামকে আদর্শ গ্রাম হিসেবে ঘোষণা। এসব কর্মসূচির কারণে রাষ্ট্রপতি জিয়ার এত সফর। তাঁর রাজনীতি ছিল গ্রামমুখী। স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খননে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে বছরে দুই-তিন ফসলের আবাদ, হাজামজা পুকুর সংস্কার করে মাছচাষ করা, রাস্তার পাশে ফলের গাছ লাগানো, নিরক্ষরতা দূরীকরণের বিশেষ কর্মসূচি নিয়ে দ্রুত গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে বেড়িয়েছেন রাষ্ট্রপতি জিয়া। কৃষকদের সঙ্গে গিয়ে কোদাল হাতে খাল খনন করে গ্রামের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে দেশের বিজ্ঞজনের স্মৃতিচারণ, লেখালেখি এবং বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ। সে সময়ের কিছু উল্লেখযোগ্য পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের অংশবিশেষ অনুবাদ করে নিচে পত্রস্থ করা হলো :
ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন, লন্ডন (জুন-৩, ১৯৮১)
ঢাকা : লাখ লাখ স্বদেশবাসীর আবেগমথিত হৃদয়ের শেষ বিদায় জানানোর পর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে মঙ্গলবার জাতীয় সংসদ ভবনের কাছে দাফন করা হয়। জিয়া ছিলেন গণতন্ত্রের প্রতীক এবং পার্লামেন্ট ভবন হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। এ কারণেই জেনারেল জিয়াকে এখানে দাফনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জিয়া ছিলেন ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের বীর নায়ক। এর চার বছর পর এক সফল সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ১৯৭৬ সালের নির্বাচনে জনসাধারণের ভোটে নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং তিনিই বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেন।
নিউ ইয়র্ক টাইমস, ৭ জুন, ১৯৮১ সংখ্যার এক প্রতিবেদনে বলা হয় : ক্ষমতা গ্রহণের পর রাষ্ট্রপতি জিয়া খুব অল্প সময়ের মধ্যে দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কার্যকরী প্রকল্প গ্রহণ করেন। তাঁর সময়ে যথেষ্ট রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পরিলক্ষিত হয়। তিনি এশিয়ার মধ্যে একজন অনন্য নেতায় পরিণত হন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সব আশা-আকাঙ্ক্ষারও মৃত্যু ঘটে। জিয়া নিরক্ষরতা দূরীকরণ এবং পাঁচ বছরের মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্য ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেন। উচ্চ ফলনশীল ফসল চাষের জন্য কৃষকদের উৎসাহী করেন। ঢাকা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে এক গ্রামের কৃষক জানালেন, 'জিয়া এসে বললেন, এখানে খাল কেটে সেচের ব্যবস্থা করা হবে। দেখা গেল, এক মাসের মধ্যে খাল কাটা হয়ে গেল। সেচকাজ শুরু হলো, আমরা এখন গ্রীষ্ম মৌসুমে আর একটা ফসল ফলিয়ে অনেক লাভবান হচ্ছি। আমরা তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত।'
ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর, ১ জুন, ১৯৮১ সংখ্যায় 'বাংলাদেশের ক্ষতি' শিরোনামে ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই বাংলাদেশ প্রধানত হেনরি কিসিঞ্জারের ভাষায় 'তলাবিহীন ঝুড়ি'র দেশ বলে পরিগণিত হয়ে আসছিল। বাইরের কেউ বাংলাদেশের কথা চিন্তা করলে প্রায়ই তাঁর মনে ভেসে উঠত বন্যা, দুর্ভিক্ষ, দুঃখ-দুর্দশা, জনসংখ্যার আধিক্য ও বিশৃঙ্খলার ছবি। তবুও রাষ্ট্রপতি জিয়া নীরবে, এমনকি সবার অজ্ঞাতে বাংলাদেশের চেহারা ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করেছিলেন। ৯ কোটি লোকের দেশকে তিনি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার কাজ শুরু করেছিলেন। এটা করতে গিয়ে তিনি দূরদূরান্তের গ্রামে ব্যাপকভাবে ঘুরে বেড়ান, কৃষকদের উৎসাহী করেন এবং তাদের মধ্যে স্বনির্ভরতার বাণী প্রচার করেন।
ওয়াশিংটন পোস্ট, ৩১ মে, ১৯৮১ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয় : বাংলাদেশের নিহত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মাসের ২০ দিনই হেলিকপ্টারে চড়ে ঢাকার বাইরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতেন। দেশকে সম্ভব খুব অল্প সময়ের মধ্যে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিনি প্রায়ই জনগণের কাছে যেতেন। খাল খনন, কূপ খনন, সেচ কার্যক্রম ইত্যাদি কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতেন। তিনি যখন গ্রামে গ্রামে হেঁটে যেতেন, স্থানীয় প্রশাসনের লোকজনও তাঁর সফরসঙ্গী হতেন। প্রশাসনের সহযোগিতা সম্পর্কে জনগণের মতামত জানতে গিয়ে প্রশাসনকে অনেক বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিতেন। ৪৬ বছর বয়স্ক সৈনিক জিয়া দেশকে 'তলাবিহীন ঝুড়ি'র অপবাদ থেকে মুক্ত করার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন।
দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ১ জুন, ১৯৮১ সংখ্যায় বলা হয় : অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়া বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র এবং সর্বাধিক খাদ্য সাহায্যপ্রাপ্ত দেশের শাসনভার গ্রহণ করে সে দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন।
দ্য সান, ৩ জুন, ১৯৮১ সংখ্যায় বলা হয় : গরম অথচ মেঘলা আবহাওয়ায় সে দেশের লাখ লাখ লোক বিলাপ করতে করতে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে নিহত তাঁদের প্রাণপ্রিয় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
কানাডা থেকে প্রকাশিত সিটিজেন, ২ জুন, ১৯৮১ সংখ্যায় বলা হয় : ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তিনিই স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে তিনি একজন সফল সমর নায়ক ছিলেন। জিয়া সৎ হিসেবে সম্মানিত ছিলেন। তাঁর সততা, ত্যাগ ও সুখ্যাতি উল্লেখযোগ্য।
টেলিগ্রাফ, লন্ডন, ১ জুন, ১৯৮১ সংখ্যায় বলা হয় : বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে জেনারেল জিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তিনি চট্টগ্রাম থেকে রেডিওর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সেনা অফিসারদের মধ্যে তিনিই প্রথম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি একজন বিনয়ী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং মানবাধিকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। তিনি পাকিস্তানের পক্ষেও নয় এবং ভারতবিরোধীও নয়_এমন নীতি মেনে চলতেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে 'জেড ফোর্সের' অধিনায়ক হিসেবে তাঁর অধীন সৈনিকদের কাছে খুব প্রিয় ছিলেন। শেখ মুজিব হত্যার সময় তিনি নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। তিনি অত্যন্ত সৎ ও চরিত্রবান হিসেবে সম্মানিত ছিলেন।
লেখক : সাংবাদিক
অতিথি ভবনে ইফতার শেষে পাশের কক্ষে মাগরিবের নামাজ আদায় করি রাষ্ট্রপতি জিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে। নামাজ শেষে বৈঠকের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করলেন তিনি। তার মূল প্রতিপাদ্য ছিল, 'আমি দেশের মানুষের জন্য কাজ করছি, আপনারাও আমার পাশে থাকবেন। দেশ ও জনগণের জন্য আমার সঙ্গে কাজ করবেন।' তিনি তাঁর কর্মসূচির প্রতি আমাদের সমর্থন চাইলেন। পরবর্তী সময়ে অবশ্য তাঁর এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা অনেকেই তাঁর কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত হই। এরপর অবশ্য সাংবাদিক হিসেবে আমার নিজ জেলা মানিকগঞ্জে রাষ্ট্রপতি জিয়ার সফরসঙ্গী হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় ১৬ বারের মতো তিনি মানিকগঞ্জ সফর করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কাশাদহ খাল খনন কর্মসূচির উদ্বোধন, ঝিটকা স্কুলে রাতযাপন ও মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠান এবং মানিকগঞ্জের নবগ্রামকে আদর্শ গ্রাম হিসেবে ঘোষণা। এসব কর্মসূচির কারণে রাষ্ট্রপতি জিয়ার এত সফর। তাঁর রাজনীতি ছিল গ্রামমুখী। স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খননে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে বছরে দুই-তিন ফসলের আবাদ, হাজামজা পুকুর সংস্কার করে মাছচাষ করা, রাস্তার পাশে ফলের গাছ লাগানো, নিরক্ষরতা দূরীকরণের বিশেষ কর্মসূচি নিয়ে দ্রুত গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে বেড়িয়েছেন রাষ্ট্রপতি জিয়া। কৃষকদের সঙ্গে গিয়ে কোদাল হাতে খাল খনন করে গ্রামের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে দেশের বিজ্ঞজনের স্মৃতিচারণ, লেখালেখি এবং বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ। সে সময়ের কিছু উল্লেখযোগ্য পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের অংশবিশেষ অনুবাদ করে নিচে পত্রস্থ করা হলো :
ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন, লন্ডন (জুন-৩, ১৯৮১)
ঢাকা : লাখ লাখ স্বদেশবাসীর আবেগমথিত হৃদয়ের শেষ বিদায় জানানোর পর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে মঙ্গলবার জাতীয় সংসদ ভবনের কাছে দাফন করা হয়। জিয়া ছিলেন গণতন্ত্রের প্রতীক এবং পার্লামেন্ট ভবন হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। এ কারণেই জেনারেল জিয়াকে এখানে দাফনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জিয়া ছিলেন ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের বীর নায়ক। এর চার বছর পর এক সফল সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ১৯৭৬ সালের নির্বাচনে জনসাধারণের ভোটে নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং তিনিই বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেন।
নিউ ইয়র্ক টাইমস, ৭ জুন, ১৯৮১ সংখ্যার এক প্রতিবেদনে বলা হয় : ক্ষমতা গ্রহণের পর রাষ্ট্রপতি জিয়া খুব অল্প সময়ের মধ্যে দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কার্যকরী প্রকল্প গ্রহণ করেন। তাঁর সময়ে যথেষ্ট রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পরিলক্ষিত হয়। তিনি এশিয়ার মধ্যে একজন অনন্য নেতায় পরিণত হন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সব আশা-আকাঙ্ক্ষারও মৃত্যু ঘটে। জিয়া নিরক্ষরতা দূরীকরণ এবং পাঁচ বছরের মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্য ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেন। উচ্চ ফলনশীল ফসল চাষের জন্য কৃষকদের উৎসাহী করেন। ঢাকা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে এক গ্রামের কৃষক জানালেন, 'জিয়া এসে বললেন, এখানে খাল কেটে সেচের ব্যবস্থা করা হবে। দেখা গেল, এক মাসের মধ্যে খাল কাটা হয়ে গেল। সেচকাজ শুরু হলো, আমরা এখন গ্রীষ্ম মৌসুমে আর একটা ফসল ফলিয়ে অনেক লাভবান হচ্ছি। আমরা তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত।'
ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর, ১ জুন, ১৯৮১ সংখ্যায় 'বাংলাদেশের ক্ষতি' শিরোনামে ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই বাংলাদেশ প্রধানত হেনরি কিসিঞ্জারের ভাষায় 'তলাবিহীন ঝুড়ি'র দেশ বলে পরিগণিত হয়ে আসছিল। বাইরের কেউ বাংলাদেশের কথা চিন্তা করলে প্রায়ই তাঁর মনে ভেসে উঠত বন্যা, দুর্ভিক্ষ, দুঃখ-দুর্দশা, জনসংখ্যার আধিক্য ও বিশৃঙ্খলার ছবি। তবুও রাষ্ট্রপতি জিয়া নীরবে, এমনকি সবার অজ্ঞাতে বাংলাদেশের চেহারা ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করেছিলেন। ৯ কোটি লোকের দেশকে তিনি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার কাজ শুরু করেছিলেন। এটা করতে গিয়ে তিনি দূরদূরান্তের গ্রামে ব্যাপকভাবে ঘুরে বেড়ান, কৃষকদের উৎসাহী করেন এবং তাদের মধ্যে স্বনির্ভরতার বাণী প্রচার করেন।
ওয়াশিংটন পোস্ট, ৩১ মে, ১৯৮১ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয় : বাংলাদেশের নিহত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মাসের ২০ দিনই হেলিকপ্টারে চড়ে ঢাকার বাইরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতেন। দেশকে সম্ভব খুব অল্প সময়ের মধ্যে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিনি প্রায়ই জনগণের কাছে যেতেন। খাল খনন, কূপ খনন, সেচ কার্যক্রম ইত্যাদি কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতেন। তিনি যখন গ্রামে গ্রামে হেঁটে যেতেন, স্থানীয় প্রশাসনের লোকজনও তাঁর সফরসঙ্গী হতেন। প্রশাসনের সহযোগিতা সম্পর্কে জনগণের মতামত জানতে গিয়ে প্রশাসনকে অনেক বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিতেন। ৪৬ বছর বয়স্ক সৈনিক জিয়া দেশকে 'তলাবিহীন ঝুড়ি'র অপবাদ থেকে মুক্ত করার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন।
দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ১ জুন, ১৯৮১ সংখ্যায় বলা হয় : অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়া বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র এবং সর্বাধিক খাদ্য সাহায্যপ্রাপ্ত দেশের শাসনভার গ্রহণ করে সে দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন।
দ্য সান, ৩ জুন, ১৯৮১ সংখ্যায় বলা হয় : গরম অথচ মেঘলা আবহাওয়ায় সে দেশের লাখ লাখ লোক বিলাপ করতে করতে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে নিহত তাঁদের প্রাণপ্রিয় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
কানাডা থেকে প্রকাশিত সিটিজেন, ২ জুন, ১৯৮১ সংখ্যায় বলা হয় : ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তিনিই স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে তিনি একজন সফল সমর নায়ক ছিলেন। জিয়া সৎ হিসেবে সম্মানিত ছিলেন। তাঁর সততা, ত্যাগ ও সুখ্যাতি উল্লেখযোগ্য।
টেলিগ্রাফ, লন্ডন, ১ জুন, ১৯৮১ সংখ্যায় বলা হয় : বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে জেনারেল জিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তিনি চট্টগ্রাম থেকে রেডিওর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সেনা অফিসারদের মধ্যে তিনিই প্রথম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি একজন বিনয়ী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং মানবাধিকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। তিনি পাকিস্তানের পক্ষেও নয় এবং ভারতবিরোধীও নয়_এমন নীতি মেনে চলতেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে 'জেড ফোর্সের' অধিনায়ক হিসেবে তাঁর অধীন সৈনিকদের কাছে খুব প্রিয় ছিলেন। শেখ মুজিব হত্যার সময় তিনি নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। তিনি অত্যন্ত সৎ ও চরিত্রবান হিসেবে সম্মানিত ছিলেন।
লেখক : সাংবাদিক
No comments