গতকাল সমকাল-বিহঙ্গদৃষ্টিতে মধ্যপ্রাচ্যের বিবর্তন by ফারুক চৌধুরী
তিউনিসিয়ার একজন শিক্ষিত বেকার যুবকের পেট্রলে সিক্ত হয়ে আত্মাহুতির হতাশার আগুন যে সারা আরব বিশ্বে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়বে, তা কারও ভাবনাতেই ছিল না। তবে সাময়িক সময়ের তথ্যবিপ্লবের প্রভাব এমনই যে তা-ই ঘটল এবং ২০১১ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া গণজাগরণের ধারা এখনো আরব বিশ্বে অব্যাহত আছে।
আমাদের সময়ে আরব বিশ্বে নাটকীয় ঘটনা যে ইতিপূর্বে ঘটেনি, তা তো নয়। ১৯৫৬ সালে প্রেসিডেন্ট নাসেরের সুয়েজ খাল জাতীয়করণে উদ্ভূত সমস্যার নাটকীয়তা সে সময় একজন শিক্ষানবিশ কূটনীতিক হিসেবে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল—একজন পাকিস্তানি কূটনীতিক হিসেবে জাতিসংঘে বসেই সুযোগ হয়েছিল সুয়েজ খাল জাতীয়করণের ওপর বিতর্কের একাংশ শোনার। কূটনীতিক-জীবনের শুরুতেই অনুধাবন করেছিলাম যে আরব জাতীয়তাবাদ আর পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের স্বার্থান্বেষিতা আরব বিশ্বের ইতিবাচক কোনো সমীকরণকে সহজ হতে দেবে না।
১৯৫৬ সালের দ্বিমেরুর পৃথিবীতে যা ঘটেছিল, এখনো তা-ই ঘটছে। আবার সেই যুক্তরাষ্ট্র, আবার সেই ব্রিটেন আর ফ্রান্স, আবার সেই গণতন্ত্রের ফাঁকা বুলি, আবার মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা স্বার্থরক্ষার আপ্রাণ প্রচেষ্টা। নতুন বিশ্ব আঙ্গিকেও পুরোনো সেই খেলা, যেখানে ন্যায়নীতি অনুপস্থিত এবং যেখানে রয়েছে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপুঞ্জের জাতিসংঘকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করার অমার্জনীয় প্রবণতা। ১৯৫৬ সালের পর নানা ঘটনা আর দুর্ঘটনার পথ ধরে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ মধ্যপ্রাচ্যে ভালোভাবেই তো তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে ফেলল। মধ্যপ্রাচ্যে পাশ্চাত্যের এই বিপুল আগ্রহের কারণ প্রধানত তিনটি। প্রথমত, মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক অবস্থান, দ্বিতীয়ত, সেই অঞ্চলের অঢেল জ্বালানি সম্পদ এবং তৃতীয়ত, আরব-ইসরায়েল সম্পর্কের বিবর্তনে ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও স্বার্থরক্ষা। তাই বিগত শতাব্দীতে থেকে থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে তাদের মনের মতো করে ঢেলে সাজাতে অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে পাশ্চাত্যের শক্তিধর রাষ্ট্রপুঞ্জ।
২০১১ সালের আরব গণজাগরণ আমাদের সমসাময়িক ইতিহাসের তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা। তা হলো এই যে, সেই অঞ্চলের মানুষ পাশ্চাত্যের স্বৈরাচারী তাঁবেদারদের ভীতি কাটিয়ে উঠছে। তারা তাদের নিজ নিজ দেশে নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে গণতান্ত্রিক সম্পৃক্ততা কামনা করে। পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ অবাক বিস্ময়েই প্রত্যক্ষ করল তিউনিসিয়া আর মিসরের অপ্রতিরোধ্য গণজাগরণ। তাদের মনের মানুষ যেন আলী আর হোসনি মোবারক তাই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হলেন। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘If you cannot beat them, join them’। অর্থাৎ তাদের পরাস্ত করতে না পারলে, তাদের দলেই যোগ দাও। তাই সেই দুই দেশে গণতন্ত্রের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিল যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপ। তাই কায়রোর প্রেসিডেন্টের দপ্তরে মোবারকের পদচিহ্ন মুছে যেতে না যেতেই সেখানে হাজির হলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন—প্রধানত বণিকের বেশে! আগামীর মিসর আর তিউনিসিয়ায় পাশ্চাত্য স্বার্থ যাতে অক্ষুণ্ন থাকে, প্রয়োজনবোধে তার নগ্ন প্রচেষ্টাই করবে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ। প্রয়োজনবোধে ইসলামি সন্ত্রাসী জুজুর অজুহাত তুলে ধরতে তারা বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করবে না। আরব বিশ্ব অচিরেই আবিষ্কার করবে যে স্বৈরাচারীকে তাড়ানো কঠিন কাজ বটে, তবে সত্যিকার অর্থে নিজ নিজ দেশের স্বার্থ সমুন্নত রেখে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কঠিনতর।
১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপের মানুষ সমাজতান্ত্রিক একনায়কত্বের অবসান ঘটিয়েছিল। তার প্রভাব বিশ্ব রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। তবে ২০১১ সালে মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলি ১৯৮৯ সালের পূর্ব ইউরোপের গণজাগরণের সঙ্গে যে তুলনীয়, তা কিন্তু এককথায় বলা যাবে না। এ যাত্রায় সমস্যা বহুলাংশে ভিন্নতর ও জটিল এবং মধ্যপ্রাচ্যের ওপর পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের শ্যেনদৃষ্টি এবং সেই অঞ্চলে তাদের স্বার্থরক্ষার (উল্লিখিত তিনটি কারণে) আপ্রাণ প্রচেষ্টা তাকে অনেক পঙ্কিল করে তুলেছে। ঘোলা পানিতে মৎস্য শিকারের প্রবণতা পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের নতুন নয়, নতুন নয় একটি ঘটনার সুযোগ নিয়ে অন্য স্থানে তাদের স্বার্থ হাসিল করা। ৯/১১-এর বেদনাদায়ক ঘটনাটিকেই ধরা যাক। টুইন টাওয়ার আর পেন্টাগনে আঘাত হানায় যে ২০-২১ জন আরব তরুণ জড়িত ছিল, তাদের মধ্যে ১৮ জনই ছিল সৌদি আরবের বাসিন্দা। কিন্তু বুশ সাহেব সৌদি আরবের বিরুদ্ধে তাঁর উষ্মা প্রকাশ না করে আঘাত হানলেন সাদ্দামের ইরাকে। তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ইরাকের ভূগর্ভস্থ জ্বালানিশক্তির ওপর পাশ্চাত্যের কর্তৃত্ব স্থাপন এবং মধ্যপ্রাচ্য আর ফিলিস্তিনি আরব জনসাধারণের ন্যায্য দাবি উপেক্ষা করে ইসরায়েলের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। যুক্তরাষ্ট্র, তার মিত্র রাষ্ট্রগুলো আর ইসরায়েল আগলে ধরে থাকুক মধ্যপ্রাচ্যের ভূগর্ভস্থ যক্ষের ধন। বর্তমানের আরব বিশ্বের গণজাগরণে তাই পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ উদ্বেল। আরব বিশ্বে যা-ই ঘটুক, যুক্তরাষ্ট্র আর পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ তাদের চিরন্তন স্বার্থরক্ষায় এখনো সুস্থির। এবারকার সাদ্দাম হলেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি। দুজনের কেউই আমাদের অশ্রুবিসর্জনের দাবিদার নন। আমার প্রচেষ্টা হলো ঘটনাবলির বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা। এককথায় গণতন্ত্রের পথে আরব বিশ্বের যাত্রা দেশভেদে হবে ভিন্ন আর সব দেশেই হবে কণ্টকাকীর্ণ।
এখন মনে হচ্ছে, স্বৈরাচারী গাদ্দাফিকে তাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন আর ইতালি বদ্ধপরিকর। এ জন্য তারা নিরাপত্তা পরিষদের গৃহীত ১৯৭৩ নম্বর সিদ্ধান্তকে (যা বেসামরিক জনগণের ওপর আঘাত না হানার নিশ্চয়তা প্রদানের কথা বলেছে) গাদ্দাফি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালানোর অজুহাত হিসেবে তুলে ধরেছে এবং তারই জের ধরে লিবিয়ায় বোমাবর্ষণ করছে। অথচ এই গাদ্দাফিকে নিয়ে কী মাতামাতিই না করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স আর ইতালি। মাত্র সাত মাস আগে ইতালির প্রধানমন্ত্রী বেরলুসকোনি গাদ্দাফিকে আরব ‘জামহুরিয়ার’ মহান প্রতিনিধি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু মনে হচ্ছে, এখন পাশ্চাত্যের প্রধান শক্তিগুলো একমত যে, লিবিয়ায় গাদ্দাফিকে ধরে রাখার চেয়ে তাড়ানোই শ্রেয়। তাতে বর্তমান অবস্থায় পাশ্চাত্যের জ্বালানি স্বার্থরক্ষা সহজতর হবে। ন্যাটোর ২৬ সদস্যের মধ্যে ছয়টি রাষ্ট্র লিবিয়ার ওপর বোমাবাজিতে অংশ নিচ্ছে, আর কেউই সেই দেশে সেনা পাঠাতে রাজি হচ্ছে না (ইরাক আর আফগানিস্তান থেকে অন্তত এই শিক্ষাটা তারা পেয়েছে বলে মনে হয়!)।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, স্বৈরাচারী গাদ্দাফি যদি একজন ঘৃণ্য ব্যক্তি হন, তাহলে বাহরাইনের আমির, যিনি নিজের দেশের মানুষকে গাদ্দাফির মতোই হত্যা করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি, যিনি তাঁর মসনদ ধরে রাখতে সৌদি আরব ও আমিরাতের সেনাশক্তি ব্যবহার করেছেন, যিনি দেশের ৭০ শতাংশ শিয়া জনসাধারণের সঙ্গে বছর বছর ধরে বৈষম্যমূলক আচরণ করে আসছেন, তিনি পাশ্চাত্যের প্রিয়পাত্র রইলেন কী করে? কারণ হলো, বাহরাইনে যুক্তরাষ্ট্রের নৌঘাঁটি, পাশ্চাত্য স্বার্থরক্ষায় (অর্থাৎ তাঁর সিংহাসন রক্ষায়) বাহরাইনের আমিরের অসীম আগ্রহ এবং ইরান সম্বন্ধে পাশ্চাত্য জগতের সচেতনতা। গণতন্ত্রের যুক্তি তাই এখানে ধোপে টেকে না, যেমনি টেকে না ইয়েমেনের তাঁবেদার প্রেসিডেন্ট সালাহর বেলায়। যাঁর আসন পাশ্চাত্যের সমর্থন সত্ত্বেও জনরোষের মুখে নড়বড়েই মনে হচ্ছে। হয়তো বা তিনি অচিরেই যোগ দেবেন মোবারক, বেন আলীর দলে! সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ পাশ্চাত্যের পছন্দের মানুষ নন, কিন্তু জর্ডানের বাদশাহ তাদের পিয়ারা বান্দা। অতএব এই দুজনের বেলায় পাশ্চাত্যের মাপকাঠি ভিন্ন। এসব দেশে যে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিজয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। পাশ্চাত্যের স্বার্থরক্ষার নীতিহীনতাই তার প্রধান অন্তরায়। আর তাঁবেদার রাষ্ট্র সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কুয়েত, কাতার প্রভৃতি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ‘বিশ্বকাপে’র প্রথম রাউন্ডই এখনো শুরু হয়নি।
মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম শুরু হয়েছে, তা পশ্চিমা শক্তিবর্গ তাদের নিজের স্বার্থে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করবে। এসব দেশে নিরবচ্ছিন্ন গণতন্ত্র স্থাপন সহজ হবে বলে মনে হয় না।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়াদিতে ব্রিটিশদের অভিজ্ঞতা সর্বাধিক। গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফুর তাঁর প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জকে বলেছিলেন, ‘তেলের ওপর দখল কীভাবে রাখি, তা বড় কথা নয়, তবে তেল আমাদের চাই-ই চাই।’ বেলফুর আর বর্তমানের উইলিয়াম হেগ, লয়েড জর্জ আর বর্তমানের ক্যামেরনের মধ্যে তফাত শুধু নামের।
বিশ্ব রাজনীতিতে শত্রু মিত্র হয়, মিত্র হয় শত্রু—স্থায়ী থাকে শুধু স্বার্থ। মধ্যপ্রাচ্যে পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য গণতন্ত্র অর্জনের পথচলার শেষ হতে এখনো অনেক বাকি। বিশ্ব রাজনীতির রূঢ় বাস্তবতা তো তা-ই বলে!
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net
১৯৫৬ সালের দ্বিমেরুর পৃথিবীতে যা ঘটেছিল, এখনো তা-ই ঘটছে। আবার সেই যুক্তরাষ্ট্র, আবার সেই ব্রিটেন আর ফ্রান্স, আবার সেই গণতন্ত্রের ফাঁকা বুলি, আবার মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা স্বার্থরক্ষার আপ্রাণ প্রচেষ্টা। নতুন বিশ্ব আঙ্গিকেও পুরোনো সেই খেলা, যেখানে ন্যায়নীতি অনুপস্থিত এবং যেখানে রয়েছে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপুঞ্জের জাতিসংঘকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করার অমার্জনীয় প্রবণতা। ১৯৫৬ সালের পর নানা ঘটনা আর দুর্ঘটনার পথ ধরে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ মধ্যপ্রাচ্যে ভালোভাবেই তো তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে ফেলল। মধ্যপ্রাচ্যে পাশ্চাত্যের এই বিপুল আগ্রহের কারণ প্রধানত তিনটি। প্রথমত, মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক অবস্থান, দ্বিতীয়ত, সেই অঞ্চলের অঢেল জ্বালানি সম্পদ এবং তৃতীয়ত, আরব-ইসরায়েল সম্পর্কের বিবর্তনে ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও স্বার্থরক্ষা। তাই বিগত শতাব্দীতে থেকে থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে তাদের মনের মতো করে ঢেলে সাজাতে অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে পাশ্চাত্যের শক্তিধর রাষ্ট্রপুঞ্জ।
২০১১ সালের আরব গণজাগরণ আমাদের সমসাময়িক ইতিহাসের তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা। তা হলো এই যে, সেই অঞ্চলের মানুষ পাশ্চাত্যের স্বৈরাচারী তাঁবেদারদের ভীতি কাটিয়ে উঠছে। তারা তাদের নিজ নিজ দেশে নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে গণতান্ত্রিক সম্পৃক্ততা কামনা করে। পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ অবাক বিস্ময়েই প্রত্যক্ষ করল তিউনিসিয়া আর মিসরের অপ্রতিরোধ্য গণজাগরণ। তাদের মনের মানুষ যেন আলী আর হোসনি মোবারক তাই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হলেন। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘If you cannot beat them, join them’। অর্থাৎ তাদের পরাস্ত করতে না পারলে, তাদের দলেই যোগ দাও। তাই সেই দুই দেশে গণতন্ত্রের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিল যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপ। তাই কায়রোর প্রেসিডেন্টের দপ্তরে মোবারকের পদচিহ্ন মুছে যেতে না যেতেই সেখানে হাজির হলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন—প্রধানত বণিকের বেশে! আগামীর মিসর আর তিউনিসিয়ায় পাশ্চাত্য স্বার্থ যাতে অক্ষুণ্ন থাকে, প্রয়োজনবোধে তার নগ্ন প্রচেষ্টাই করবে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ। প্রয়োজনবোধে ইসলামি সন্ত্রাসী জুজুর অজুহাত তুলে ধরতে তারা বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করবে না। আরব বিশ্ব অচিরেই আবিষ্কার করবে যে স্বৈরাচারীকে তাড়ানো কঠিন কাজ বটে, তবে সত্যিকার অর্থে নিজ নিজ দেশের স্বার্থ সমুন্নত রেখে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কঠিনতর।
১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপের মানুষ সমাজতান্ত্রিক একনায়কত্বের অবসান ঘটিয়েছিল। তার প্রভাব বিশ্ব রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। তবে ২০১১ সালে মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলি ১৯৮৯ সালের পূর্ব ইউরোপের গণজাগরণের সঙ্গে যে তুলনীয়, তা কিন্তু এককথায় বলা যাবে না। এ যাত্রায় সমস্যা বহুলাংশে ভিন্নতর ও জটিল এবং মধ্যপ্রাচ্যের ওপর পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের শ্যেনদৃষ্টি এবং সেই অঞ্চলে তাদের স্বার্থরক্ষার (উল্লিখিত তিনটি কারণে) আপ্রাণ প্রচেষ্টা তাকে অনেক পঙ্কিল করে তুলেছে। ঘোলা পানিতে মৎস্য শিকারের প্রবণতা পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের নতুন নয়, নতুন নয় একটি ঘটনার সুযোগ নিয়ে অন্য স্থানে তাদের স্বার্থ হাসিল করা। ৯/১১-এর বেদনাদায়ক ঘটনাটিকেই ধরা যাক। টুইন টাওয়ার আর পেন্টাগনে আঘাত হানায় যে ২০-২১ জন আরব তরুণ জড়িত ছিল, তাদের মধ্যে ১৮ জনই ছিল সৌদি আরবের বাসিন্দা। কিন্তু বুশ সাহেব সৌদি আরবের বিরুদ্ধে তাঁর উষ্মা প্রকাশ না করে আঘাত হানলেন সাদ্দামের ইরাকে। তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ইরাকের ভূগর্ভস্থ জ্বালানিশক্তির ওপর পাশ্চাত্যের কর্তৃত্ব স্থাপন এবং মধ্যপ্রাচ্য আর ফিলিস্তিনি আরব জনসাধারণের ন্যায্য দাবি উপেক্ষা করে ইসরায়েলের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। যুক্তরাষ্ট্র, তার মিত্র রাষ্ট্রগুলো আর ইসরায়েল আগলে ধরে থাকুক মধ্যপ্রাচ্যের ভূগর্ভস্থ যক্ষের ধন। বর্তমানের আরব বিশ্বের গণজাগরণে তাই পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ উদ্বেল। আরব বিশ্বে যা-ই ঘটুক, যুক্তরাষ্ট্র আর পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ তাদের চিরন্তন স্বার্থরক্ষায় এখনো সুস্থির। এবারকার সাদ্দাম হলেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি। দুজনের কেউই আমাদের অশ্রুবিসর্জনের দাবিদার নন। আমার প্রচেষ্টা হলো ঘটনাবলির বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা। এককথায় গণতন্ত্রের পথে আরব বিশ্বের যাত্রা দেশভেদে হবে ভিন্ন আর সব দেশেই হবে কণ্টকাকীর্ণ।
এখন মনে হচ্ছে, স্বৈরাচারী গাদ্দাফিকে তাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন আর ইতালি বদ্ধপরিকর। এ জন্য তারা নিরাপত্তা পরিষদের গৃহীত ১৯৭৩ নম্বর সিদ্ধান্তকে (যা বেসামরিক জনগণের ওপর আঘাত না হানার নিশ্চয়তা প্রদানের কথা বলেছে) গাদ্দাফি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালানোর অজুহাত হিসেবে তুলে ধরেছে এবং তারই জের ধরে লিবিয়ায় বোমাবর্ষণ করছে। অথচ এই গাদ্দাফিকে নিয়ে কী মাতামাতিই না করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স আর ইতালি। মাত্র সাত মাস আগে ইতালির প্রধানমন্ত্রী বেরলুসকোনি গাদ্দাফিকে আরব ‘জামহুরিয়ার’ মহান প্রতিনিধি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু মনে হচ্ছে, এখন পাশ্চাত্যের প্রধান শক্তিগুলো একমত যে, লিবিয়ায় গাদ্দাফিকে ধরে রাখার চেয়ে তাড়ানোই শ্রেয়। তাতে বর্তমান অবস্থায় পাশ্চাত্যের জ্বালানি স্বার্থরক্ষা সহজতর হবে। ন্যাটোর ২৬ সদস্যের মধ্যে ছয়টি রাষ্ট্র লিবিয়ার ওপর বোমাবাজিতে অংশ নিচ্ছে, আর কেউই সেই দেশে সেনা পাঠাতে রাজি হচ্ছে না (ইরাক আর আফগানিস্তান থেকে অন্তত এই শিক্ষাটা তারা পেয়েছে বলে মনে হয়!)।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, স্বৈরাচারী গাদ্দাফি যদি একজন ঘৃণ্য ব্যক্তি হন, তাহলে বাহরাইনের আমির, যিনি নিজের দেশের মানুষকে গাদ্দাফির মতোই হত্যা করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি, যিনি তাঁর মসনদ ধরে রাখতে সৌদি আরব ও আমিরাতের সেনাশক্তি ব্যবহার করেছেন, যিনি দেশের ৭০ শতাংশ শিয়া জনসাধারণের সঙ্গে বছর বছর ধরে বৈষম্যমূলক আচরণ করে আসছেন, তিনি পাশ্চাত্যের প্রিয়পাত্র রইলেন কী করে? কারণ হলো, বাহরাইনে যুক্তরাষ্ট্রের নৌঘাঁটি, পাশ্চাত্য স্বার্থরক্ষায় (অর্থাৎ তাঁর সিংহাসন রক্ষায়) বাহরাইনের আমিরের অসীম আগ্রহ এবং ইরান সম্বন্ধে পাশ্চাত্য জগতের সচেতনতা। গণতন্ত্রের যুক্তি তাই এখানে ধোপে টেকে না, যেমনি টেকে না ইয়েমেনের তাঁবেদার প্রেসিডেন্ট সালাহর বেলায়। যাঁর আসন পাশ্চাত্যের সমর্থন সত্ত্বেও জনরোষের মুখে নড়বড়েই মনে হচ্ছে। হয়তো বা তিনি অচিরেই যোগ দেবেন মোবারক, বেন আলীর দলে! সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ পাশ্চাত্যের পছন্দের মানুষ নন, কিন্তু জর্ডানের বাদশাহ তাদের পিয়ারা বান্দা। অতএব এই দুজনের বেলায় পাশ্চাত্যের মাপকাঠি ভিন্ন। এসব দেশে যে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিজয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। পাশ্চাত্যের স্বার্থরক্ষার নীতিহীনতাই তার প্রধান অন্তরায়। আর তাঁবেদার রাষ্ট্র সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কুয়েত, কাতার প্রভৃতি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ‘বিশ্বকাপে’র প্রথম রাউন্ডই এখনো শুরু হয়নি।
মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম শুরু হয়েছে, তা পশ্চিমা শক্তিবর্গ তাদের নিজের স্বার্থে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করবে। এসব দেশে নিরবচ্ছিন্ন গণতন্ত্র স্থাপন সহজ হবে বলে মনে হয় না।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়াদিতে ব্রিটিশদের অভিজ্ঞতা সর্বাধিক। গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফুর তাঁর প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জকে বলেছিলেন, ‘তেলের ওপর দখল কীভাবে রাখি, তা বড় কথা নয়, তবে তেল আমাদের চাই-ই চাই।’ বেলফুর আর বর্তমানের উইলিয়াম হেগ, লয়েড জর্জ আর বর্তমানের ক্যামেরনের মধ্যে তফাত শুধু নামের।
বিশ্ব রাজনীতিতে শত্রু মিত্র হয়, মিত্র হয় শত্রু—স্থায়ী থাকে শুধু স্বার্থ। মধ্যপ্রাচ্যে পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য গণতন্ত্র অর্জনের পথচলার শেষ হতে এখনো অনেক বাকি। বিশ্ব রাজনীতির রূঢ় বাস্তবতা তো তা-ই বলে!
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net
No comments