শিক্ষা-পরীক্ষায় ভালো ফল ও মূল্যবোধ by শেখ শাহবাজ রিয়াদ

আমরা নিশ্চিত নই যে, এসব উচ্চনম্বরধারী শিক্ষার্থী তাদের চেতনায় কী আদর্শ বা মূল্যবোধ লালন করছে। দেশের জন্য ভবিষ্যতে অবদান রাখতে তারা কতটুকু প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পারিবারিক-সামাজিক-ধর্মীয় এবং জাতীয় মূল্যবোধ ও আদর্শের প্রতি তারা কতটা শ্রদ্ধাশীল।


তবে অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ থেকে যা জানতে পারি, তা অনেকটা হতাশার


বাংলাদেশে মাধ্যমিক স্তরে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার ৫০০ প্রতিষ্ঠান, আড়াই লাখ শিক্ষক ও ৮০ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। সংখ্যাগত হিসাবে তা নিউজিল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার দ্বিগুণ। এত বড় ক্ষেত্রে ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জন করা সহজসাধ্য নয়। যার কারণে আমরা শিক্ষার কোনো লক্ষ্যই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অর্জন করতে পারিনি। তা ছাড়া অদক্ষতা, পেশাদারির অভাব, জবাবদিহির অভাব, সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতি, অপচয় ইত্যাদি তো আছেই। তবে এক দশক ধরে মাধ্যমিক শিক্ষার ওপর যেভাবে জোর দেওয়া হয়েছে, অতীতে তেমনটি হয়নি। শিক্ষার মোট বাজেটের প্রায় অর্ধাংশ বর্তমানে মাধ্যমিক শিক্ষা খাতে ব্যয় হচ্ছে, আগে যা করা হতো প্রাথমিক খাতে। বর্তমানে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার গুণগত ও পরিমাণগত উন্নয়নের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্প কাজ করছে। বিভিন্ন ধরনের শিক্ষক প্রশিক্ষণ, মনিটরিং, সেমিনার, কর্মশালা ও বিস্তরণ কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রত্যাশায়।
এসব কর্মকাণ্ডের ইতিবাচক ফলও জাতি পেতে শুরু করেছে। বিগত কয়েক বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলে শিক্ষার পরিমাণগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে গুণগত উন্নয়নও বেশ জোরালোভাবেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে জিপিএ-৫ পাওয়ার হার বৃদ্ধি নিয়ে শিক্ষক, অভিভাবক, প্রশিক্ষক, পরীক্ষকসহ অনেকেই সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাদের বক্তব্য, প্রতিবছর জিপিএ বৃদ্ধির হার যেভাবে বাড়ছে, শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক বিকাশ সেভাবে হচ্ছে না। বরং পরীক্ষক ও প্রধান পরীক্ষকদের উদার মূল্যায়ননীতির কারণে প্রকৃত জিপিএপ্রাপ্তদের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে কম মেধাবীদের বিশাল একটি অংশ জিপিএ পেয়ে যাচ্ছে। ১০-১৫ বছর আগে আমাদের শিক্ষকদের একটি বড় শ্রেণী শিক্ষার্থীদের ন্যায্য নম্বর দিতে কৃপণতা করতেন, যা ছিল অবিচারের শামিল। সামান্য ভুল হলেই পুরো নম্বর কেটে দিতেন। উল্টোটা ঘটছে বর্তমানে। খাতায় লেখা থাকলেই নম্বর দিতে হবে বলে অলিখিত নির্দেশনা থাকে। অপ্রাসঙ্গিক তথ্য বা বানান ভুল হলেও নম্বর দিতে বলা হয়। এ উদারতা মধ্যম ও নিম্নমেধার শিক্ষর্থীদের জন্য আশীর্বাদ হলেও উচ্চমেধার শিক্ষার্থীর জন্য ততটাই হতাশার। কারণ তাদের মেধা, পরিশ্রমের স্বীকৃতি যথার্থভাবে হচ্ছে না। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বর্তমান জিপিএ গ্রেডিং ব্যবস্থায় পরিবর্তন ও পরিমার্জন আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ ৭৬ হাজার ৭৪৯ শিক্ষার্থীকে আমরা একই মেধাস্তরে গণ্য করতে পারি না। সঙ্গে সঙ্গে উত্তরপত্র মূল্যায়নের আরও কার্যকর নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে এ নিয়ে বিতর্কের কোনো সুযোগ না থাকে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষার এসব সাফল্য ও উন্নয়ন শুধু শিক্ষার্থীদের জ্ঞানগত দিকের, যা শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক সার্বিক লক্ষ্যের খণ্ডিত অংশমাত্র। শিক্ষার প্রধান যে লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যগুলো তা পাসের হার বৃদ্ধি কিংবা জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধির দ্বারা অর্জিত হয় না বা প্রচলিত লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে পরিমাপ করা যায় না। সেগুলো হচ্ছে শিক্ষার্থীদের কর্মদক্ষতা, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক দায়বদ্ধতা, দেশপ্রেম। উল্লেখ্য, আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ শিক্ষার ৩০টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যার অন্যতম দুটি হচ্ছে 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে তোলা ও তাদের চিন্তাচেতনায় দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবোধ এবং তাদের চরিত্রে সুনাগরিকের গুণাবলির বিকাশ ঘটানো' (লক্ষ্য-৩) এবং 'মুখস্থ বিদ্যার পরিবর্তে বিকশিত চিন্তাশক্তি, কল্পনাশক্তি এবং অনুসন্ধিৎসু মননের অধিকারী হয়ে শিক্ষার্থীরা যাতে প্রতি স্তরে মানসম্পন্ন প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন করতে পারে তা নিশ্চিত করা' (লক্ষ্য-৬)। প্রচলিত মূল্যায়ন ব্যবস্থায় এ লক্ষ্য অর্জনমাত্রা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। কারণ আমাদের মাধ্যমিক পর্যায়ে এখনও প্রান্তিক যোগ্যতাগুলো নির্ধারণ করা হয়নি, যা করা আছে প্রাথমিক স্তরের জন্য। আবার আমরা নিশ্চিত নই যে, এসব উচ্চনম্বরধারী শিক্ষার্থী তাদের চেতনায় কী আদর্শ বা মূল্যবোধ লালন করছে। দেশের জন্য ভবিষ্যতে অবদান রাখতে তারা কতটুকু প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পারিবারিক-সামাজিক-ধর্মীয় ও জাতীয় মূল্যবোধ ও আদর্শের প্রতি তারা কতটা শ্রদ্ধাশীল। তবে অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ থেকে যা জানতে পারি, তা অনেকটা হতাশার। পেশার সুবাদে শত শত শিক্ষকের সঙ্গে আমাদের মতবিনিময় হয়। তারাও যা বলেন তাতেও আশাহত হতে হয়। শিক্ষার্থীদের শাস্তি বন্ধের নির্দেশ জারির পরের দিনই শিক্ষার্থী পত্রিকার কাটিং এনে শিক্ষকদের বলেছে, আপনারা এখন থেকে আমাদের আর কিছুই বলতে পারবেন না। মোবাইল ফোন বন্ধের নির্দেশে শিক্ষকরা যতটা সতর্ক হয়েছেন, শিক্ষার্থী ততটা হয়নি। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হাতেই শিক্ষকদের চেয়ে অনেক দামি, নামি মোবাইল ফোন। ক্লাসরুমের শিক্ষার চেয়ে কোচিংয়ের লেকচার তাদের ভালো লাগে। অন্যদিকে যে শিক্ষক বিভিন্ন যৌক্তিক ও অযৌক্তিক অজুহাতে ক্লাসে ভালো পড়ান না বা পড়াতে পারেন না, তিনিই তার কোচিং সেন্টারে নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছেন। প্রাইভেট না পড়ার কারণে কিংবা অন্য কোনো কারণে শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেওয়ার খবর আমরা পাই, অথচ কোনো কোচিং সেন্টারে তো কাউকে শিক্ষকরা তো শাস্তি দেন না। বরং শিক্ষার্থীদের অধিক নম্বর পাওয়ার জন্য যতভাবে মোটিভেট করা যায় তা-ই করেন। এসবই মূল্যবোধের প্রশ্ন। শিক্ষা যখন পরীক্ষা, নম্বর, গ্রেডিং, ভর্তির সুযোগ, সামাজিক প্রতিপত্তি, প্রতিযোগিতা, চাকরি ও অর্থসংস্থানের সঙ্গে সমার্থক হয়ে যায়, তখনই মূল্যবোধের শিক্ষা গুরুত্বহীন হয়ে যায়। অথচ আমাদের দুটিই দরকার। সে লক্ষ্য অর্জনে আমাদের দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে।

শেখ শাহবাজ রিয়াদ : সহকারী অধ্যাপক টিচার্স টেনিং কলেজ, ঢাকা
riadisrat1971@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.