চারদিক-ছয়ছিরির চড়ক মেলা by আকমল হোসেন

পয়লা বৈশাখের (চড়ক মেলার আয়োজকদের কাছে শেষ চৈত্র) সূর্যটা পশ্চিমে গা এলাতেই নারী, পুরুষ ও শিশুর স্রোত মেলামুখী। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ছয়ছিরির দিঘির পাড়ে চৈত্রসংক্রান্তিতে সেই কবে থেকে চলছে চড়ক মেলা বা চড়কপূজা। এটি হিন্দু বাঙালির ধর্মীয় পার্বণের একটি।


চৈত্রসংক্রান্তিতে ধুমধামের সঙ্গে উদ্যাপিত হয় এই চড়ক মেলা। এবারও জমে উঠেছিল ছয়ছিরির দিঘির পাড়।
শিথিল দাস জানালেন, আগের রাতে কালীকাজ, কালীপূজা ও কালীনাচ হয়েছে। চড়কপূজার দিন সকালে দিঘি থেকে তোলা হয় চড়কগাছ। চড়কগাছের বয়স ৫০-৬০ বছর বা আরও বেশি। এই চড়কগাছ হরীতকী, কাউ, পাহাড়ি ফুলুডি নামের একধরনের গাছ থেকে তৈরি। পূজা শেষে গাছগুলো আবার দিঘির জলে ভাসানো হয়। চড়কগাছ দিঘির পাড়ে পোঁতার পর গাছে তৈরি হয় ঘূর্ণমান মঞ্চ। দিঘির দক্ষিণ, পূর্ব ও উত্তর পাড়ে এ রকম চারটি চড়কগাছ থাকে। শৈলেন রায় জানালেন, আগে পশ্চিম পাড়েও চড়কগাছ থাকত।
চড়কগাছ স্থাপনের পর চলে পূজার কাজ। দিঘির পাড়গুলো তখন মানুষে মানুষে সয়লাব। পুরোহিত মলয় চন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, ‘এটাকে লিঙ্গপূজা বা হরগৌরীর পূজা বলা হয়। হর হচ্ছে লিঙ্গ বা মহাদেব এবং গৌরী হচ্ছে দুর্গার আরেক নাম। চড়কগাছটা হচ্ছে হর, আর মাথার অংশটা হচ্ছে গৌরী। অনেকে অন্য দিন চড়কপূজা করে থাকলেও এটা মূলত চৈত্রসংক্রান্তিতেই হয়ে থাকে।’ অনেকের অনেক রকমের মানত থাকে। কেউ গাছের কলা বা অন্য ফলও মানত দেয়। ব্রিটিশ আমল থেকেই ছয়ছিরির জমিদারবাড়ির দিঘির পাড়ে এই চড়কপূজা হয়ে আসছে। মোহন দাস বলেন, ‘মনে করেন, এটা বাপ-দাদার আমল থেকে হয়ে আসছে। এটা সর্বজনীন। এটা এখন ত্রিশা চৈত্রে পালন করতে হবে। মৌরসী হয়ে গেছে।’ পঞ্চাশোর্ধ্ব সুরেন্দ্র কর বললেন, ‘ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি।’ তিনিও একসময় বড়শি গেঁথে চড়কগাছে শূন্যে ঝুলেছেন। চক্কর দেওয়ার কথাটি নিশ্চিত করতেই সুরেন্দ্র কর তাঁর পিঠে প্রায় ১০-১২ বছর আগের বড়শিতে গাঁথার চিহ্ন দেখালেন। এখনো সে দাগ স্পষ্ট হয়ে আছে। মোহন দাস বলেন, ‘শূন্যে বাতাস কাটতে কাটতে ঘুরলে একরকম ভালোই লাগে।’
দুপুর গড়ানোর পর শুরু হয়ে যায় হরগৌরীর পূজা। ভক্তরা এসে পূজাঘরে মানতের কলা, নগদ টাকা দান করে ভক্তি দেন। বিনিময়ে পূজারীর হাত থেকে ফুল, নকুলদানা ও চরণামৃত গ্রহণ করেন। তবে বেশি উন্মাদনা থাকে লালসালু পরা ভক্তদের মাঝে। তাঁরা ঢোল ও করতাল বাজিয়ে নেচেই চলেন। বেলা যখন পড়তির দিকে, পুরোহিত চড়কগাছকে সিঁদুর আর ফুল ও বেলপাতা দিয়ে পূজা দেন। এরপর কলাগাছের বেড় দেওয়া গোলচত্বরে চলে ভক্তনাচ। ভক্তনাচ শেষ হলে শুরু হয় দা বান নাচ। একজন ভক্ত লম্বা দা নিয়ে অনেকক্ষণ নানা ভঙ্গিতে নাচের পর একপর্যায়ে জিভের ওপর দা রেখে নৃত্য করেন। জিভের ওপর দা রেখে নানা কসরত দেখান। জিভ অক্ষত দেখে ভক্তরা জয়ধ্বনি দিয়ে ওঠেন।
ততক্ষণে মানুষে মানুষে দিঘির পাড় একাকার। তখন গ্রামের দিক থেকে চড়ক মেলার দিকে এগিয়ে আসেন শিব ও কালী। অস্থায়ী পূজাঘরে পূজার কাজ শেষে কলাগাছের সেই গোলচত্বরে ত্রিশূল হাতে প্রথমে নাচেন শিব। নেচে নেচে শিব ক্লান্ত হলে নাচতে শুরু করেন কালী। অনেকক্ষণ ত্রিশূলধারী কালীর রণমূর্তি নৃত্য চলে। নাচপর্ব শেষে দিঘির জলে স্নান শেষ করার পর শুরু হলো ভিন্ন এক দৃশ্য।
ভক্তদের দেওয়া হলো চন্দ্রবাণ, জিববাণ, ফাঁসবাণ ও কণ্ঠবাণ। প্রায় দেড় ফুট লম্বা লোহার শিকের সুচালো অংশ অবশ করা ছাড়াই ভুরুর মাংসে গেঁথে চন্দ্রবাণ, কণ্ঠার নিচে কণ্ঠবাণ, জিভে জিববাণ ও পাঁজরের নিচে গেঁথে ফাঁসবাণ দিলেন ওস্তাদ। শেষ পর্বে ছিল প্রতিটি চড়কগাছে চারজন ভক্তের লোহার তৈরি বড়শি পিঠে গেঁথে শূন্যে ওড়া। চড়কগাছের দড়ির সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হলো বড়শি। অনেকে নানা মানসে সেই বড়শিগাঁথা ভক্তদের কাছে তুলে দিলেন কলা। ভক্তরা চড়কগাছে কলা ছুঁইয়ে শূন্যে ছুড়ে দিলেন কলার হরিলুট। সবশেষে শুরু হলো শূন্যে চক্কর। ধীরে ধীরে গাছের সঙ্গে তৈরি মঞ্চ ঘোরানো হলে পাখির মতো শূন্যে ওড়ে চারজন। শূন্যে উড়তে উড়তেই তাঁরা হাততালি দেন। যখন ঘুরতে ঘুরতে চড়কগাছের চক্কর থেমে আসতে থাকে, তখন ভক্তদের মুখে ধ্বনি ওঠে, ‘হরগৌরী প্রাণনাথ/ মাথার ওপর জগন্নাথ/ এইবার উদ্ধার করো শিব বম মহাদেব।’...ঘূর্ণমান মঞ্চটি থামলে বড়শির দড়ির বাঁধন খুলে নেন ওস্তাদ।
চড়কপূজাকে ঘিরেই ছয়ছিরির দিঘির চড়ক মেলা। মেলায় কাঠের লাঙল, লোহার দা, খুন্তি, কুড়াল, কাঠ ও বাঁশের তৈরি সংসারের কত কিছু। আর খই, বেলুন, বাঁশি—এসব তো আছেই। ততক্ষণে বেলা যে আর নেই। সন্ধ্যা নামছে ঘন হয়ে। আর মেলার কুপিবাতিগুলো আঁধারের বুকে ভক্তদের চোখের মতো নতুন কোনো আশায় জ্বলে উঠতে থাকে।
আকমল হোসেন

No comments

Powered by Blogger.