সরল গরল-বিচারিক জবাবদিহি ধরাছোঁয়ার বাইরেই? by মিজানুর রহমান খান
সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের জবাবদিহির জন্য সংসদে বিশেষ কমিটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিলুপ্ত করে সংসদীয় অভিশংসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে চাইছে। জ্যেষ্ঠ আইনবিদেরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁরা বলেছেন, যদি সংসদীয় অভিশংসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়, তাহলে তা হবে বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতার জন্য হুমকি।
কিন্তু পরিহাস হলো, বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের বিচারকদের জবাবদিহির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হলে সংসদীয় অভিশংসন কিংবা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল উপযুক্ত মহৌষধ নয়।
আমার অবস্থান সংসদীয় অভিশংসনের পক্ষে। বিশ্বের যেসব দেশে সংসদীয় অভিশংসনের ব্যবস্থা রয়েছে, সেসব দেশে উচ্চ আদালতের বিচারকদের জবাবদিহির প্রশ্নে বিচার প্রশাসনে স্বচ্ছতা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, গতিশীলতা ও আইনের চোখে সমতার নীতি কতটা কীভাবে নিরূপিত হচ্ছে সেটাই সর্বাগ্রে যাচাই করা হয়।
সংসদীয় বিশেষ কমিটি ও আইনবিদেরা যেন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নাকি সংসদীয় অভিশংসন এই বিতর্কের মধ্যে নিবিষ্ট ও নিমগ্ন না থাকেন। বিশ্ব গত ৪০ বছরে অনেক বদলে গেছে। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে সংসদীয় অভিশংসন সম্পর্কে ৭২-এর সংবিধানে একটি আইনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সেই আইনটি কখনোই সংসদ পাস করেনি। সেই অবস্থায় চতুর্থ সংশোধনীতে সংসদীয় অভিশংসনের বিলোপ ঘটে।
আমাদের গণতান্ত্রিক ভারতের দিকে তাকাতে হবে। গত ডিসেম্বরে ভারতীয় সংসদে জুডিশিয়াল স্ট্যান্ডার্ডাস অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিবিলিটি বিল তোলা হয়েছে। এর প্রয়োজনীয়তা যে কতটা বাস্তবসম্মত তার প্রমাণ ইতিমধ্যেই আমাদের সুপ্রিম কোর্ট রেখেছেন। প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক সম্প্রতি বিচারকদের বিরুদ্ধে যাতে সাধারণ মানুষ বা ভুক্তভোগীরা অভিযোগ দায়ের করতে পারেন, সে জন্য একটি কমিটি গঠন করেছেন। আমরা মনে করি, ভারত যে পথে গিয়েছে সেই একই পথে এই কমিটি গঠনের পদক্ষেপটি একটি নিউক্লিয়াস। এখন একে একটা বাস্তবসম্মত পূর্ণ রূপ দিতে হবে।
ভারতে বর্তমানে জাজেজ ইনকোয়ারি অ্যাক্ট রয়েছে। বর্তমানে প্রস্তাব করা হয়েছে, ভারতের একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি ন্যাশনাল ওভারসাইট কমিটি থাকবে। এর কাছে ভারতের প্রধান বিচারপতি ও হাইকোর্টগুলোর প্রধান বিচারপতিদের বিরুদ্ধেও যদি কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে তা পেশ করা যাবে। কেউ যুক্তি দিতে পারেন বর্তমানে যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল রয়েছে, সেখানে অভিযোগ দায়েরের অবারিত সুযোগ রয়েছে। তা ঠিক নয়।
৯৬(৫) অনুচ্ছেদ বলেছে ‘যেক্ষেত্রে কাউন্সিল অথবা অন্য কোনো সূত্র হইতে প্রাপ্ত তথ্যে রাষ্ট্রপতির এরূপ বুঝিবার কারণ থাকে যে, কোনো বিচারক-ক. শারীরিক বা মানসিক অসামর্থের কারণে তাহার পদে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করিতে অযোগ্য হইয়া পরিতে পারেন, অথবা খ. গুরুতর অসদাচরনের জন্য দোষী হইতে পারেন, সেই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করিতে ও উহার তদন্তফল জ্ঞাপন করিবার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন।’ এ থেকে স্পষ্ট যে বিষয়টি কোনোভাবেই বিচার বিভাগীয় গণ্ডির মধ্যে নেই। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার একটি বড় মন্ত্র হলো শৃঙ্খলাজনিত প্রাথমিক কর্মকাণ্ড বিচার বিভাগের দ্বারাই সাধিত হতে হবে।
বিদ্যমান সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিরুদ্ধে আমরা বরাবরই সোচ্চার। সেটা শুধু আইয়ুব খানের অনুকরণে জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান দ্বারা এনেছিলেন বলে নয়। ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার সরকারদলীয় স্লোগানের হুজুগে তো নয়ই। প্রকৃতপক্ষে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের গঠনশৈলী একান্তভাবেই ত্রুটিপূর্ণ। আমরা ৭২-এর সংবিধানে বর্ণিত সংসদীয় অভিশংসন প্রথার প্রত্যাবর্তন চাই। কিন্তু সেটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিচার বিভাগের যে ধরনের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা এখন প্রয়োজন, সেটা তাতে মিটবে না।
মনে রাখতে হবে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এবং সংসদীয় অভিশংসন দুটিরই রয়েছে চরম ব্যবস্থা। একমাত্র অপসারণ ছাড়া অন্য বিকল্প নেই। আমাদের নানাবিধ লঘু বিকল্প দরকার। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তো একান্তভাবেই প্রধানমন্ত্রীর অধীন। তারা প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া বৈঠকে বসতেই অক্ষম। ঠিক যেভাবে দুদক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা অসদাচরণের অভিযোগ স্বাধীনভাবে তদন্ত শুরু করতেই অক্ষম। এ ক্ষেত্রে দুদক চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির ক্ষমতার মধ্যে কোনো তফাত নেই।
সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের আওতায় উচ্চ আদালতের বিচারকদের জন্য পালনীয় একটি লিখিত আচরণবিধি রয়েছে। ভারতেও সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা কোনো ধরনের সংবিধিবদ্ধ শাস্তিমূলক ব্যবস্থার উল্লেখ ছাড়াই নিজেদের জন্য পালনীয় একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন। এটি হলো ‘রিস্টেটমেন্ট অব ভেল্যুজ অব জুডিশিয়াল লাইফ’। এটিও দীর্ঘদিন ভারতে দারুণভাবে উপেক্ষিত থেকেছে। যেমন এর বিধান ছিল উচ্চ আদালতের বিচারকেরা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে তাঁদের সম্পদের বিবরণী জমা দেবেন। কিন্তু তাঁরা তা দিচ্ছিলেন না। সুশীল সমাজের চাপের মুখে সেটা দিতে তাঁরা প্রায় বাধ্য হয়েছেন। এখন সংসদে যখন বিল এসেছে তখন কিন্তু সেই বিলের আওতায় সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের সম্পদ ও দায়দেনার ঘোষণার বিধান আনা হয়েছে। এমনকি তাঁদের স্ত্রী-সন্তান ও পোষ্যদের সম্পদের বিবরণীও প্রকাশ করতে হবে। এই বিল পাস হলে তাঁদের প্রত্যেকের সম্পদের বিবরণী সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে দিতে হবে। বর্তমানে উচ্চ আদালতে বিচারকদের আচরণবিধি অগ্রাহ্য করা হলে কারও বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই।
এখন যদি শুধু সংসদীয় অভিশংসন প্রথাসংবলিত বাহাত্তরের বিধানটি পুনরুজ্জীবিত করা হয়, তাহলে কিন্তু বিচারিক জবাবদিহি ধরাও যাবে না, ছোঁয়াও যাবে না। বাহাত্তরের ৯৬ অনুচ্ছেদের সংশ্লিষ্ট বিধান এ রকম: ‘২. প্রমাণিত অসদাচারণ বা অসামর্থের কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অনূন্য দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনো বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না। ৩. এই অনুচ্ছেদের ২ দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচারণ বা অসামর্থ সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবেন।’
সুতরাং এখন যখন সংসদীয় জবাবদিহির কথা বলা হচ্ছে, তখন আমরা এই আইনের খসড়ার মুখ দেখতে চাই। আমরা মনে রাখব, ভারতের প্রস্তাবিত ন্যাশনাল ওভারসাইট কমিটি নামে যে ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটতে চলেছে, সে দেশের সংবিধানে কিন্তু উল্লিখিত বাহাত্তরের ৯৬ অনুচ্ছেদ অর্থাৎ সংসদীয় অভিশংসন অবিকল বহাল রয়েছে। সুতরাং সংসদীয় অভিশংসন প্রথা বহাল থাকা সত্ত্বেও ভারতে উচ্চ আদালতে বিচারকদের জবাবদিহির জন্য কেন একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে কমিটি গঠনে সংসদে বিল আনা হয়েছে, সেটা আমাদের বিচারক, আইনবিদ, সাংসদসহ সংশ্লিষ্ট সচেতন মহলকে বিবেচনায় নিতে হবে। গতকাল সংসদের বিশেষ কমিটির সংশ্লিষ্ট একজন বিজ্ঞ ব্যক্তির ফোন পেয়ে হতাশ হলাম। কয়েক দিন আগে কমিটির বিবেচনার জন্য বিচারক নিয়োগে বিচার বিভাগীয় কমিশন কীভাবে গঠিত হতে পারে, সে বিষয়ে দুটি খসড়া ভারত ও পাকিস্তানের অভিজ্ঞতার আলোকে পেশ করেছিলাম। কিন্তু সে নিয়ে কারও কোনো শিরপীড়া নেই। কেউ আবার বিচারক নিয়োগে বাহাত্তরের ৯৫(১)-এ বর্ণিত ‘প্রধান বিচারপতির পরামর্শ’ ফিরে পেলেই ধন্য হবেন বলে ইঙ্গিত দিচ্ছেন। ওই সদস্য জানালেন, কমিটিতে যাঁদের নামের আগে অ্যাডভোকেট শব্দটি রয়েছে তাঁরাই স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে অধিকতর সংকল্পবদ্ধ।
সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে নীরবতা ও গা বাঁচানোর প্রতিযোগিতা চলছে। বার নির্বাচনে বিএনপি-সমর্থিত প্যানেল বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে। তাদের এই জয় লাভের নেপথ্যে পেশাদারি কোটারি স্বার্থ সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে।
ভারতের প্রস্তাবিত কমিটির সদস্যসংখ্যা পাঁচ। রাষ্ট্রপতি তাঁদের নিয়োগ দেবেন। এঁদের মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের কর্মরত বিচারক আছেন। তাঁদের মনোনয়ন দেবেন ভারতের প্রধান বিচারপতি। থাকবেন অ্যাটর্নি জেনারেল এবং রাষ্ট্রপতির মনোনয়নে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। কোনো অভিযোগ পেলে কমিটি একটি বাছাই প্যানেলের কাছে পাঠাবে। অভিযোগ যদি সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে হয় তাহলে বাছাই প্যানেল গঠিত হবে ভারতের একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের দুজন কর্মরত বিচারক দিয়ে। হাইকোর্টের কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে সেই প্যানেলে থাকবেন হাইকোর্টের একজন সাবেক বিচারপতি এবং হাইকোর্টের দুজন কর্মরত বিচারক। সুপ্রিম কোর্ট প্যানেল সদস্যদের মনোনীত করবেন ভারতের প্রধান বিচারপতি।
বাছাই প্যানেলের ক্ষমতা থাকবে একটি সিভিল কোর্টের মতো। উদাহরণস্বরূপ তাঁরা সাক্ষী এবং দলিলপত্রাদি তলব করতে পারবেন। ওভারসাইট কমিটির কাছে তিন মাসের মধ্যে তাঁরা রিপোর্ট দেবেন। যে ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকবে সে ক্ষেত্রে ওভারসাইট কমিটি নিজেরাই বাছাই করবে। সাধারণত বাছাই প্যানেলের কাছ থেকে প্রতিবেদন পাওয়ার পর থেকে ওভারসাইট কমিটি অধিকতর তদন্তের জন্য একটি কমিটি করবে। বাছাই প্যানেলের মতো সেই তদন্ত কমিটিরও ক্ষমতা থাকবে সিভিল কোর্টের মতো। তারা নির্দিষ্ট অভিযোগ গঠন করতে পারবে। অভিযোগ যদি প্রমাণিত না হয় তদন্ত কমিটি নিজেরাই মামলা খারিজ করতে পারবে। অন্যথায় তারা ওভারসাইট কমিটির কাছে একটি রিপোর্ট দেবে। অভিযোগ যদি গুরুতর না হয়, তাহলে তারা উপদেষ্টামূলক কিংবা হুঁশিয়ারি কিংবা লঘু শাস্তির সুপারিশ করতে পারবে। অভিযোগ যদি গুরুতর হয়, তাহলে কমিটি অভিযুক্ত বিচারককে পদত্যাগের জন্য অনুরোধ করতে পারবে। যদি বিচারক তা না করেন, তাহলে ওভারসাইট কমিটি তাঁর অপসারণের জন্য সুপারিশ করে রাষ্ট্রপতির কাছে বিষয়টি পাঠাবে।
ভারতের প্রস্তাবিত ওই বিলে আরও যেসব বিধিনিষেধ আনা হয়েছে তার কয়েকটি আমাদের দেশের জন্য বহুকাল আগে থেকেই অতীব অপরিহার্য। যেমন—বারের কোনো বিশেষ সদস্যের সঙ্গে বিচারকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক না থাকা, বিচারকদের পরিবারের কাছে কোনো সদস্য তাঁর আদালতে ওকালতি করতে না পারা, আইন-আদালতসংক্রান্ত ব্যতিরেকে কোনো ক্লাব, সংগঠন বা সমিতির কোনো নির্বাচনে বিচারকের অংশ না নেওয়া ইত্যাদি। বিদ্যমান আচরণবিধি আরও সম্প্রসারিত করে এখানে সংসদীয় সিল চাই। সংসদ এ রকম আইন করে দিলে আমরা সংসদের কাছে বিচারিক জবাবদিহির মানে খুঁজে পাব। অন্যথায় বিচারিক জবাবদিহিতা দূর থেকে ভেসে আসা বাদ্যযন্ত্রের শব্দ হয়েই কানে বাজতে পারে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
আমার অবস্থান সংসদীয় অভিশংসনের পক্ষে। বিশ্বের যেসব দেশে সংসদীয় অভিশংসনের ব্যবস্থা রয়েছে, সেসব দেশে উচ্চ আদালতের বিচারকদের জবাবদিহির প্রশ্নে বিচার প্রশাসনে স্বচ্ছতা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, গতিশীলতা ও আইনের চোখে সমতার নীতি কতটা কীভাবে নিরূপিত হচ্ছে সেটাই সর্বাগ্রে যাচাই করা হয়।
সংসদীয় বিশেষ কমিটি ও আইনবিদেরা যেন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নাকি সংসদীয় অভিশংসন এই বিতর্কের মধ্যে নিবিষ্ট ও নিমগ্ন না থাকেন। বিশ্ব গত ৪০ বছরে অনেক বদলে গেছে। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে সংসদীয় অভিশংসন সম্পর্কে ৭২-এর সংবিধানে একটি আইনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সেই আইনটি কখনোই সংসদ পাস করেনি। সেই অবস্থায় চতুর্থ সংশোধনীতে সংসদীয় অভিশংসনের বিলোপ ঘটে।
আমাদের গণতান্ত্রিক ভারতের দিকে তাকাতে হবে। গত ডিসেম্বরে ভারতীয় সংসদে জুডিশিয়াল স্ট্যান্ডার্ডাস অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিবিলিটি বিল তোলা হয়েছে। এর প্রয়োজনীয়তা যে কতটা বাস্তবসম্মত তার প্রমাণ ইতিমধ্যেই আমাদের সুপ্রিম কোর্ট রেখেছেন। প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক সম্প্রতি বিচারকদের বিরুদ্ধে যাতে সাধারণ মানুষ বা ভুক্তভোগীরা অভিযোগ দায়ের করতে পারেন, সে জন্য একটি কমিটি গঠন করেছেন। আমরা মনে করি, ভারত যে পথে গিয়েছে সেই একই পথে এই কমিটি গঠনের পদক্ষেপটি একটি নিউক্লিয়াস। এখন একে একটা বাস্তবসম্মত পূর্ণ রূপ দিতে হবে।
ভারতে বর্তমানে জাজেজ ইনকোয়ারি অ্যাক্ট রয়েছে। বর্তমানে প্রস্তাব করা হয়েছে, ভারতের একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি ন্যাশনাল ওভারসাইট কমিটি থাকবে। এর কাছে ভারতের প্রধান বিচারপতি ও হাইকোর্টগুলোর প্রধান বিচারপতিদের বিরুদ্ধেও যদি কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে তা পেশ করা যাবে। কেউ যুক্তি দিতে পারেন বর্তমানে যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল রয়েছে, সেখানে অভিযোগ দায়েরের অবারিত সুযোগ রয়েছে। তা ঠিক নয়।
৯৬(৫) অনুচ্ছেদ বলেছে ‘যেক্ষেত্রে কাউন্সিল অথবা অন্য কোনো সূত্র হইতে প্রাপ্ত তথ্যে রাষ্ট্রপতির এরূপ বুঝিবার কারণ থাকে যে, কোনো বিচারক-ক. শারীরিক বা মানসিক অসামর্থের কারণে তাহার পদে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করিতে অযোগ্য হইয়া পরিতে পারেন, অথবা খ. গুরুতর অসদাচরনের জন্য দোষী হইতে পারেন, সেই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করিতে ও উহার তদন্তফল জ্ঞাপন করিবার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন।’ এ থেকে স্পষ্ট যে বিষয়টি কোনোভাবেই বিচার বিভাগীয় গণ্ডির মধ্যে নেই। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার একটি বড় মন্ত্র হলো শৃঙ্খলাজনিত প্রাথমিক কর্মকাণ্ড বিচার বিভাগের দ্বারাই সাধিত হতে হবে।
বিদ্যমান সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিরুদ্ধে আমরা বরাবরই সোচ্চার। সেটা শুধু আইয়ুব খানের অনুকরণে জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান দ্বারা এনেছিলেন বলে নয়। ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার সরকারদলীয় স্লোগানের হুজুগে তো নয়ই। প্রকৃতপক্ষে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের গঠনশৈলী একান্তভাবেই ত্রুটিপূর্ণ। আমরা ৭২-এর সংবিধানে বর্ণিত সংসদীয় অভিশংসন প্রথার প্রত্যাবর্তন চাই। কিন্তু সেটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিচার বিভাগের যে ধরনের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা এখন প্রয়োজন, সেটা তাতে মিটবে না।
মনে রাখতে হবে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এবং সংসদীয় অভিশংসন দুটিরই রয়েছে চরম ব্যবস্থা। একমাত্র অপসারণ ছাড়া অন্য বিকল্প নেই। আমাদের নানাবিধ লঘু বিকল্প দরকার। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তো একান্তভাবেই প্রধানমন্ত্রীর অধীন। তারা প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া বৈঠকে বসতেই অক্ষম। ঠিক যেভাবে দুদক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা অসদাচরণের অভিযোগ স্বাধীনভাবে তদন্ত শুরু করতেই অক্ষম। এ ক্ষেত্রে দুদক চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির ক্ষমতার মধ্যে কোনো তফাত নেই।
সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের আওতায় উচ্চ আদালতের বিচারকদের জন্য পালনীয় একটি লিখিত আচরণবিধি রয়েছে। ভারতেও সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা কোনো ধরনের সংবিধিবদ্ধ শাস্তিমূলক ব্যবস্থার উল্লেখ ছাড়াই নিজেদের জন্য পালনীয় একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন। এটি হলো ‘রিস্টেটমেন্ট অব ভেল্যুজ অব জুডিশিয়াল লাইফ’। এটিও দীর্ঘদিন ভারতে দারুণভাবে উপেক্ষিত থেকেছে। যেমন এর বিধান ছিল উচ্চ আদালতের বিচারকেরা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে তাঁদের সম্পদের বিবরণী জমা দেবেন। কিন্তু তাঁরা তা দিচ্ছিলেন না। সুশীল সমাজের চাপের মুখে সেটা দিতে তাঁরা প্রায় বাধ্য হয়েছেন। এখন সংসদে যখন বিল এসেছে তখন কিন্তু সেই বিলের আওতায় সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের সম্পদ ও দায়দেনার ঘোষণার বিধান আনা হয়েছে। এমনকি তাঁদের স্ত্রী-সন্তান ও পোষ্যদের সম্পদের বিবরণীও প্রকাশ করতে হবে। এই বিল পাস হলে তাঁদের প্রত্যেকের সম্পদের বিবরণী সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে দিতে হবে। বর্তমানে উচ্চ আদালতে বিচারকদের আচরণবিধি অগ্রাহ্য করা হলে কারও বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই।
এখন যদি শুধু সংসদীয় অভিশংসন প্রথাসংবলিত বাহাত্তরের বিধানটি পুনরুজ্জীবিত করা হয়, তাহলে কিন্তু বিচারিক জবাবদিহি ধরাও যাবে না, ছোঁয়াও যাবে না। বাহাত্তরের ৯৬ অনুচ্ছেদের সংশ্লিষ্ট বিধান এ রকম: ‘২. প্রমাণিত অসদাচারণ বা অসামর্থের কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অনূন্য দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনো বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না। ৩. এই অনুচ্ছেদের ২ দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচারণ বা অসামর্থ সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবেন।’
সুতরাং এখন যখন সংসদীয় জবাবদিহির কথা বলা হচ্ছে, তখন আমরা এই আইনের খসড়ার মুখ দেখতে চাই। আমরা মনে রাখব, ভারতের প্রস্তাবিত ন্যাশনাল ওভারসাইট কমিটি নামে যে ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটতে চলেছে, সে দেশের সংবিধানে কিন্তু উল্লিখিত বাহাত্তরের ৯৬ অনুচ্ছেদ অর্থাৎ সংসদীয় অভিশংসন অবিকল বহাল রয়েছে। সুতরাং সংসদীয় অভিশংসন প্রথা বহাল থাকা সত্ত্বেও ভারতে উচ্চ আদালতে বিচারকদের জবাবদিহির জন্য কেন একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে কমিটি গঠনে সংসদে বিল আনা হয়েছে, সেটা আমাদের বিচারক, আইনবিদ, সাংসদসহ সংশ্লিষ্ট সচেতন মহলকে বিবেচনায় নিতে হবে। গতকাল সংসদের বিশেষ কমিটির সংশ্লিষ্ট একজন বিজ্ঞ ব্যক্তির ফোন পেয়ে হতাশ হলাম। কয়েক দিন আগে কমিটির বিবেচনার জন্য বিচারক নিয়োগে বিচার বিভাগীয় কমিশন কীভাবে গঠিত হতে পারে, সে বিষয়ে দুটি খসড়া ভারত ও পাকিস্তানের অভিজ্ঞতার আলোকে পেশ করেছিলাম। কিন্তু সে নিয়ে কারও কোনো শিরপীড়া নেই। কেউ আবার বিচারক নিয়োগে বাহাত্তরের ৯৫(১)-এ বর্ণিত ‘প্রধান বিচারপতির পরামর্শ’ ফিরে পেলেই ধন্য হবেন বলে ইঙ্গিত দিচ্ছেন। ওই সদস্য জানালেন, কমিটিতে যাঁদের নামের আগে অ্যাডভোকেট শব্দটি রয়েছে তাঁরাই স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে অধিকতর সংকল্পবদ্ধ।
সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে নীরবতা ও গা বাঁচানোর প্রতিযোগিতা চলছে। বার নির্বাচনে বিএনপি-সমর্থিত প্যানেল বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে। তাদের এই জয় লাভের নেপথ্যে পেশাদারি কোটারি স্বার্থ সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে।
ভারতের প্রস্তাবিত কমিটির সদস্যসংখ্যা পাঁচ। রাষ্ট্রপতি তাঁদের নিয়োগ দেবেন। এঁদের মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের কর্মরত বিচারক আছেন। তাঁদের মনোনয়ন দেবেন ভারতের প্রধান বিচারপতি। থাকবেন অ্যাটর্নি জেনারেল এবং রাষ্ট্রপতির মনোনয়নে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। কোনো অভিযোগ পেলে কমিটি একটি বাছাই প্যানেলের কাছে পাঠাবে। অভিযোগ যদি সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে হয় তাহলে বাছাই প্যানেল গঠিত হবে ভারতের একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের দুজন কর্মরত বিচারক দিয়ে। হাইকোর্টের কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে সেই প্যানেলে থাকবেন হাইকোর্টের একজন সাবেক বিচারপতি এবং হাইকোর্টের দুজন কর্মরত বিচারক। সুপ্রিম কোর্ট প্যানেল সদস্যদের মনোনীত করবেন ভারতের প্রধান বিচারপতি।
বাছাই প্যানেলের ক্ষমতা থাকবে একটি সিভিল কোর্টের মতো। উদাহরণস্বরূপ তাঁরা সাক্ষী এবং দলিলপত্রাদি তলব করতে পারবেন। ওভারসাইট কমিটির কাছে তিন মাসের মধ্যে তাঁরা রিপোর্ট দেবেন। যে ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকবে সে ক্ষেত্রে ওভারসাইট কমিটি নিজেরাই বাছাই করবে। সাধারণত বাছাই প্যানেলের কাছ থেকে প্রতিবেদন পাওয়ার পর থেকে ওভারসাইট কমিটি অধিকতর তদন্তের জন্য একটি কমিটি করবে। বাছাই প্যানেলের মতো সেই তদন্ত কমিটিরও ক্ষমতা থাকবে সিভিল কোর্টের মতো। তারা নির্দিষ্ট অভিযোগ গঠন করতে পারবে। অভিযোগ যদি প্রমাণিত না হয় তদন্ত কমিটি নিজেরাই মামলা খারিজ করতে পারবে। অন্যথায় তারা ওভারসাইট কমিটির কাছে একটি রিপোর্ট দেবে। অভিযোগ যদি গুরুতর না হয়, তাহলে তারা উপদেষ্টামূলক কিংবা হুঁশিয়ারি কিংবা লঘু শাস্তির সুপারিশ করতে পারবে। অভিযোগ যদি গুরুতর হয়, তাহলে কমিটি অভিযুক্ত বিচারককে পদত্যাগের জন্য অনুরোধ করতে পারবে। যদি বিচারক তা না করেন, তাহলে ওভারসাইট কমিটি তাঁর অপসারণের জন্য সুপারিশ করে রাষ্ট্রপতির কাছে বিষয়টি পাঠাবে।
ভারতের প্রস্তাবিত ওই বিলে আরও যেসব বিধিনিষেধ আনা হয়েছে তার কয়েকটি আমাদের দেশের জন্য বহুকাল আগে থেকেই অতীব অপরিহার্য। যেমন—বারের কোনো বিশেষ সদস্যের সঙ্গে বিচারকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক না থাকা, বিচারকদের পরিবারের কাছে কোনো সদস্য তাঁর আদালতে ওকালতি করতে না পারা, আইন-আদালতসংক্রান্ত ব্যতিরেকে কোনো ক্লাব, সংগঠন বা সমিতির কোনো নির্বাচনে বিচারকের অংশ না নেওয়া ইত্যাদি। বিদ্যমান আচরণবিধি আরও সম্প্রসারিত করে এখানে সংসদীয় সিল চাই। সংসদ এ রকম আইন করে দিলে আমরা সংসদের কাছে বিচারিক জবাবদিহির মানে খুঁজে পাব। অন্যথায় বিচারিক জবাবদিহিতা দূর থেকে ভেসে আসা বাদ্যযন্ত্রের শব্দ হয়েই কানে বাজতে পারে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments