জীবনের সাইকেল-মলয় ভৌমিকের পদত্যাগ by মামুনুর রশীদ
কয়েক দিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে আমার এক উৎকণ্ঠিত স্বজনের টেলিফোন পাই। টেলিফোনে তাঁর কণ্ঠস্বর কাঁপা কাঁপা। বলছে, ‘আপনি কি রাজশাহী আসছেন?’ আমি বললাম, কেন? উৎকণ্ঠিত স্বজন জানাল, ‘এখানে মলয় ভৌমিকবিরোধী আন্দোলন চলছে। যারাই তাঁর পক্ষ হয়ে আসবে, তাদের অপমানিত হতে হবে।’
আমি অবাক বিস্ময়ে কথাগুলো শুনলাম। মাত্র কিছুদিন আগেই নাট্যকলা বিভাগের কাজেই রাজশাহী গিয়েছিলাম। সেখানে শিক্ষকদের সঙ্গে বেশ হূদ্যতাপূর্ণ সময়ই কেটেছে আমার। হঠাৎ কিসে কী হয়ে গেল? এরপর খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করি।
চেয়ারম্যান মলয় ভৌমিকের কক্ষে তালা দেওয়া, শিক্ষক-ছাত্ররা মিলে ভিসির অফিসের সামনে বিক্ষোভ ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত মলয় ভৌমিকের পদত্যাগ এবং পদত্যাগপত্র গ্রহণ। ধারাবাহিকতা একটু দেখার চেষ্টা করি। ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক মলয় ভৌমিক কেন নাট্যকলা বিভাগে গেলেন? তিনি কি স্বেচ্ছায়, নাকি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে পাঠিয়েছে? কেনই বা পাঠাল? সেখানেও তো শিক্ষকের অভাব নেই। নিশ্চয়ই কারণ আছে। বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে কোন্দল। নানা অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দুটি তদন্ত কমিটিও গঠন করে। সেখানে কিছু অভিযোগ প্রমাণিতও হয়েছে।
যেমন, ছাত্রদের অভিযোগ, অধিক মূল্যে শিক্ষকেরা পরীক্ষার আগে ফরম পূরণ করিয়ে থাকেন। বিষয়টির সত্যতাও প্রমাণিত হয়েছে। এক অধ্যাপক তাঁর বিএসসির ফলাফল গোপন রেখেছিলেন। জানা গেল, সেটি তৃতীয় শ্রেণী। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য বহু প্রার্থী একটি তৃতীয় শ্রেণীর জন্য চাকরি পায়নি। তেমন উদাহরণ আমরা জানি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এসব বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, ওই বিভাগে যোগ্য ব্যক্তি না থাকায় চেয়ারম্যান অন্য বিভাগ থেকেই পাঠানো হবে। মলয় ভৌমিকের ওই বিভাগে পাঠানোর কারণই হচ্ছে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। সে জন্য স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কঠোর হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সেই কঠোরতা যদি অশিক্ষকসুলভ হয়, তাহলে তা তো অনুমোদনযোগ্য নয়। কিন্তু সে রকম কিছু কী প্রমাণ করতে পেরেছেন তাঁরা? এসব বিষয় নিয়ে আমি আর কিছু বলব না। ছাত্রদের কোনো অভিযোগ তো মলয় ভৌমিকের বিরুদ্ধে ছিল না। তারা কেন যুক্ত হলো এ ঘটনায়? শিক্ষকদের স্বার্থ রক্ষায় ছাত্রদের নামতে হয়েছে কি? নম্বরের ভয়ে। অন্য জায়গায়ও তো কিন্তু তা হচ্ছে। অধ্যাপক মলয় ভৌমিকের পথ তিনি বেছে নেবেন। নাট্যকলা-সংগীত বিভাগের শিক্ষকেরাও তাঁদের পথ জানেন। কিন্তু আমি উদ্বিগ্ন অন্য কারণে।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়-গুলোতে নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগ খোলা কিন্তু বাংলাদেশের নাট্যকর্মী, বিশেষ করে, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের আন্দোলনের ফল। বহু দফায় আমরা বিভিন্ন সময়ে উপাচার্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, দেনদরবার করেছি। তার সুফলও মিলেছে, যদিও পাস করায় নাট্যমঞ্চে তাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ঘটছে না। তার পরও অন্য বিভাগের কায়দায় এই বিভাগ চলে না। শিল্প কোনো মুখস্থ বিদ্যার বিষয় নয়, নম্বরের জাদু নয়। গুরু-শিষ্যপরম্পরায় এক শৈল্পিক পরিবেশে এর চর্চা করতে হয়। যাঁরা গুরু হবেন, তাঁরা শুধু চাকরি করবেন না। জীবনচর্চার অংশ হিসেবেই বেছে নেবেন এই পেশাকে। তার যদি ব্যত্যয় ঘটে, শৃঙ্খলা যদি ভঙ্গ হতে থাকে, তাহলে পরিবেশটাই নষ্ট হবে। তার একটা দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়ে গেল।
দু-চারজন শিক্ষক দেখলেন, তাঁদের স্বার্থ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ক্ষুব্ধ হলেন কিন্তু তাঁরা সুদূর কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ কি না, তা ভাবলেন না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো তাৎক্ষণিক সমস্যা সমাধানেই মগ্ন থাকে, সুদূরপ্রসারী কোনো চিন্তা করার সময় পায় না।
আশা করব, মলয় ভৌমিকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো এসেছে তার তদন্ত হবে, শিক্ষকদের বিষয়ে তদন্ত হয়ে পাওয়া বিষয়গুলোর ব্যাপারেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ছাত্ররা ভবিষ্যতে আমাদের সহকর্মীই হবেন, তাই তাঁদের শিক্ষা কার্যক্রম যেন মুষ্টিমেয়র স্বার্থ রক্ষায় বিঘ্নিত না হয়, তাও আমরা দেখতে চাই। বেশি দিন আগে নয়, এই কলামেই কারারুদ্ধ মলয় ভৌমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুক্তির জন্য লিখেছিলাম। মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও শাহ্দীন মালিকও সেই দুঃসময়ে সাহস দেখিয়েছিলেন। তাঁরা মুক্ত হয়েছিলেন। সেই সময়ে রাজশাহী গিয়েছি, তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে। ভয় ছিল, ভয়কে অতিক্রম করেছি এর আগেও। জামায়াত-শিবির-আক্রান্ত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা বহু বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের পতাকাকে সমুন্নত রেখেছেন, তাঁদের একজন মলয় ভৌমিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাজনীতি পছন্দ-অপছন্দের বাইরে তিনি দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতা। সুদীর্ঘ দিনে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অনিয়মের অভিযোগ কেউ করতে পারেননি। তবে তিনি নিয়ম ও নৈতিকতা নিয়ে একটু কঠোর অবস্থানই নেন। সে জন্য তাঁর কি কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ আছে কি না, তা-ও কি ছাত্র-শিক্ষকেরা দেখবেন না?
যে স্বজন উদ্বিগ্ন হয়ে আমাকে ফোন করেছিল, সে বোধ হয় এক ধরনের পেশিশক্তির উচ্ছৃঙ্খল আচরণের শঙ্কা করছিল। বাংলাদেশে গত ৪০ বছরের মধ্যে সামান্য সময়ই আমাদের জন্য নিরাপদ ছিল। বহু হিংস্রতা আমরা দেখেছি, বহু দখল দেখেছি, কিন্তু পিছিয়ে আসিনি। এই পথেই যদি ওরাও বিজয়ী হতে চায়, তাহলে সত্যিই এক বোকার স্বর্গে ওদের বসবাস। ওই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই অনেক মহড়ার মুখে আমাদের কাজটুকু করে এসেছি। তাই আমাদের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।
চেয়ারম্যান মলয় ভৌমিকের কক্ষে তালা দেওয়া, শিক্ষক-ছাত্ররা মিলে ভিসির অফিসের সামনে বিক্ষোভ ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত মলয় ভৌমিকের পদত্যাগ এবং পদত্যাগপত্র গ্রহণ। ধারাবাহিকতা একটু দেখার চেষ্টা করি। ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক মলয় ভৌমিক কেন নাট্যকলা বিভাগে গেলেন? তিনি কি স্বেচ্ছায়, নাকি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে পাঠিয়েছে? কেনই বা পাঠাল? সেখানেও তো শিক্ষকের অভাব নেই। নিশ্চয়ই কারণ আছে। বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে কোন্দল। নানা অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দুটি তদন্ত কমিটিও গঠন করে। সেখানে কিছু অভিযোগ প্রমাণিতও হয়েছে।
যেমন, ছাত্রদের অভিযোগ, অধিক মূল্যে শিক্ষকেরা পরীক্ষার আগে ফরম পূরণ করিয়ে থাকেন। বিষয়টির সত্যতাও প্রমাণিত হয়েছে। এক অধ্যাপক তাঁর বিএসসির ফলাফল গোপন রেখেছিলেন। জানা গেল, সেটি তৃতীয় শ্রেণী। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য বহু প্রার্থী একটি তৃতীয় শ্রেণীর জন্য চাকরি পায়নি। তেমন উদাহরণ আমরা জানি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এসব বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, ওই বিভাগে যোগ্য ব্যক্তি না থাকায় চেয়ারম্যান অন্য বিভাগ থেকেই পাঠানো হবে। মলয় ভৌমিকের ওই বিভাগে পাঠানোর কারণই হচ্ছে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। সে জন্য স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কঠোর হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সেই কঠোরতা যদি অশিক্ষকসুলভ হয়, তাহলে তা তো অনুমোদনযোগ্য নয়। কিন্তু সে রকম কিছু কী প্রমাণ করতে পেরেছেন তাঁরা? এসব বিষয় নিয়ে আমি আর কিছু বলব না। ছাত্রদের কোনো অভিযোগ তো মলয় ভৌমিকের বিরুদ্ধে ছিল না। তারা কেন যুক্ত হলো এ ঘটনায়? শিক্ষকদের স্বার্থ রক্ষায় ছাত্রদের নামতে হয়েছে কি? নম্বরের ভয়ে। অন্য জায়গায়ও তো কিন্তু তা হচ্ছে। অধ্যাপক মলয় ভৌমিকের পথ তিনি বেছে নেবেন। নাট্যকলা-সংগীত বিভাগের শিক্ষকেরাও তাঁদের পথ জানেন। কিন্তু আমি উদ্বিগ্ন অন্য কারণে।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়-গুলোতে নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগ খোলা কিন্তু বাংলাদেশের নাট্যকর্মী, বিশেষ করে, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের আন্দোলনের ফল। বহু দফায় আমরা বিভিন্ন সময়ে উপাচার্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, দেনদরবার করেছি। তার সুফলও মিলেছে, যদিও পাস করায় নাট্যমঞ্চে তাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ঘটছে না। তার পরও অন্য বিভাগের কায়দায় এই বিভাগ চলে না। শিল্প কোনো মুখস্থ বিদ্যার বিষয় নয়, নম্বরের জাদু নয়। গুরু-শিষ্যপরম্পরায় এক শৈল্পিক পরিবেশে এর চর্চা করতে হয়। যাঁরা গুরু হবেন, তাঁরা শুধু চাকরি করবেন না। জীবনচর্চার অংশ হিসেবেই বেছে নেবেন এই পেশাকে। তার যদি ব্যত্যয় ঘটে, শৃঙ্খলা যদি ভঙ্গ হতে থাকে, তাহলে পরিবেশটাই নষ্ট হবে। তার একটা দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়ে গেল।
দু-চারজন শিক্ষক দেখলেন, তাঁদের স্বার্থ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ক্ষুব্ধ হলেন কিন্তু তাঁরা সুদূর কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ কি না, তা ভাবলেন না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো তাৎক্ষণিক সমস্যা সমাধানেই মগ্ন থাকে, সুদূরপ্রসারী কোনো চিন্তা করার সময় পায় না।
আশা করব, মলয় ভৌমিকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো এসেছে তার তদন্ত হবে, শিক্ষকদের বিষয়ে তদন্ত হয়ে পাওয়া বিষয়গুলোর ব্যাপারেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ছাত্ররা ভবিষ্যতে আমাদের সহকর্মীই হবেন, তাই তাঁদের শিক্ষা কার্যক্রম যেন মুষ্টিমেয়র স্বার্থ রক্ষায় বিঘ্নিত না হয়, তাও আমরা দেখতে চাই। বেশি দিন আগে নয়, এই কলামেই কারারুদ্ধ মলয় ভৌমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুক্তির জন্য লিখেছিলাম। মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও শাহ্দীন মালিকও সেই দুঃসময়ে সাহস দেখিয়েছিলেন। তাঁরা মুক্ত হয়েছিলেন। সেই সময়ে রাজশাহী গিয়েছি, তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে। ভয় ছিল, ভয়কে অতিক্রম করেছি এর আগেও। জামায়াত-শিবির-আক্রান্ত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা বহু বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের পতাকাকে সমুন্নত রেখেছেন, তাঁদের একজন মলয় ভৌমিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাজনীতি পছন্দ-অপছন্দের বাইরে তিনি দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতা। সুদীর্ঘ দিনে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অনিয়মের অভিযোগ কেউ করতে পারেননি। তবে তিনি নিয়ম ও নৈতিকতা নিয়ে একটু কঠোর অবস্থানই নেন। সে জন্য তাঁর কি কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ আছে কি না, তা-ও কি ছাত্র-শিক্ষকেরা দেখবেন না?
যে স্বজন উদ্বিগ্ন হয়ে আমাকে ফোন করেছিল, সে বোধ হয় এক ধরনের পেশিশক্তির উচ্ছৃঙ্খল আচরণের শঙ্কা করছিল। বাংলাদেশে গত ৪০ বছরের মধ্যে সামান্য সময়ই আমাদের জন্য নিরাপদ ছিল। বহু হিংস্রতা আমরা দেখেছি, বহু দখল দেখেছি, কিন্তু পিছিয়ে আসিনি। এই পথেই যদি ওরাও বিজয়ী হতে চায়, তাহলে সত্যিই এক বোকার স্বর্গে ওদের বসবাস। ওই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই অনেক মহড়ার মুখে আমাদের কাজটুকু করে এসেছি। তাই আমাদের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।
No comments