স্মরণ-বাবার জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রয়াত বাবাকে নিয়ে লেখা পৃথিবীর সব সন্তানের জন্য কষ্টকর ব্যাপার। আমি অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ কন্যা এবং এই লেখা তাঁর ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণার প্রয়াস। তিনি সন্তানদের স্বাধীনতা উপভোগ করতে দিতেন দায়িত্ববোধ নিয়ে। জানি না, আমরা সেটাতে কতটুকু সার্থক,


তবে তাঁর এবং মায়ের দোয়ায় আজ আমার ভাই ইনামুল আজিজ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকিং পেশায় নিয়োজিত, দ্বিতীয় বোন জাকিয়া চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে হাইস্কুল টিচার এবং কনিষ্ঠ বোন ইলোরা চৌধুরী বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছে। বাবা হিসেবে কেবল সাধারণ ডিগ্রি অর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে আন্তর্জাতিক মানের উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে সমাজে নিজের অবস্থান তৈরি করার ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত করতেন; বিশেষ করে আমি যখন এমএস বা পিএইচডি করার জন্য কানাডায় কমনওয়েলথ বৃত্তি পেলাম, তখন আমার পুত্রসন্তানকে বুকের মাঝে নিয়ে আমাকে প্লেনে উঠিয়ে দিয়েছিলেন। আজ আমার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে বাবার অবদান এবং মায়ের নাতি লালন করার বহু ক্লান্তি ও আনন্দ জড়িত। বাবার জীবনটা শিক্ষা পরিমণ্ডলে আবর্তিত ছিল। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫১ সালে রসায়ন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, তাঁর স্নাতকোত্তর থিসিসের বিষয় জুটের বিভিন্ন অংশের রাসায়নিক বিশ্লেষণ এবং তার ব্যবহার। বাংলাদেশের কৃতী বিজ্ঞানী আবুল হুস্সাম আমাকে বলেছিলেন, তিনি ঢাবির রসায়ন বিভাগের ছাত্র থাকাকালে পুনরায় ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখেছিলেন যে এই গবেষণাটি জুটের ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। ১৯৫৩ সালে রয়্যাল কমিশন ফর এক্সবিশন স্কলারশিপ নিয়ে ১৯৫৬ সালে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Patuch Prize লাভ করেন ভারতীয় ও পাকিস্তানি ছাত্রদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ থিসিস প্রদান করার জন্য। কিন্তু ১৯৫৮ সালে তাঁর চেয়ে কম যোগ্যতার একজন শিক্ষককে রিডার মনোনীত করায় তিনি ঢাবির রসায়ন বিভাগ থেকে পদত্যাগ করেন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে যোগ দেন। কিন্তু লক্ষণীয় যে পরবর্তী সময়ে উপাচার্য হয়ে ঢাবির রসায়ন বিভাগের তাঁর শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক মোকারম হোসেন খোন্দকারের নামে মোকারম বিজ্ঞান ভবন (১৯৮২-৮৩) নির্মাণ করেন। হয়তো বুকের মাঝে অভিমান ছিল, কিন্তু শিক্ষককে প্রকৃত মর্যাদা দেখাতে তিনি কার্পণ্য করেননি। ১৯৬৭ সালে রাবিতে ফলিত রসায়ন বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নবাব আবদুল লতিফ হলের প্রথম প্রভোস্ট এবং ১৯৭২ সালে রাবিতে ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছাত্র-শিক্ষকদের সার্বিক কল্যাণে সব সময় সক্রিয় ছিলেন। ১৯৫৭-৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯৫৮-৫৯ সালে রাবির শিক্ষক ক্লাবের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০-৭২ সালে রাবির শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। বাবা কোনো দিনই প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করতেন। বাবার ঘরের দেয়ালে টানানো ছিল: ‘যতদিন রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরী, যমুনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’। তিনি বলতেন, বঙ্গবন্ধু না থাকলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পেত না। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বাবা আগে ইউকে কমনওয়েলথ একাডেমিক স্টাফ ফেলোশিপ নিয়ে যাবেন, নাকি ঢাকায় কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবেন। বাবা ১৯৭৩ সালে ইউকে চলে যান। ১৯৭৪-এ বঙ্গবন্ধু তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে বিজ্ঞানবিষয়ক সদস্য নির্বাচিত করেন। ১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেটে জয়ী হয়ে উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৬-৮৩ সালে সামরিক স্বৈরাচারী সরকারের উত্থানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে থাকে, কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা যা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে বিঘ্নিত করতে পারে, তা সমর্থন করেননি। তাঁর সময় সামরিক স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলন, বিক্ষোভ, হরতাল, পে-কমিশন প্রদত্ত বেতন স্কেল প্রান্তিক সুবিধাদি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন চলেছে। এর পরও তিনি ধৈর্য হারাননি এক মুহূর্তের জন্য। কিন্তু ১৯৮৩ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে যখন মজিদ খান শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন উত্তাল হয়, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিরুদ্ধে তৎকালীন স্বৈরাচারী শাসনে এক চরম নজিরবিহীন পুলিশি অ্যাকশনের প্রতিবাদে ১৯৮৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেন। তিনি স্বায়ত্তশাসিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বৈরাচারী হস্তক্ষেপ বরদাশত করেননি। এরপর তিনি বিজ্ঞান উপদেষ্টা হিসেবে ১৯৮৫-৯১ সালে ইউনেসকো দিল্লিতে কর্মরত ছিলেন। জীবনসায়াহ্নে ১৯৯৬ সালের প্রথমার্ধে বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বাবা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা প্রসারে বক্তব্য দেন। এই অনুষ্ঠানটি ছিল মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ প্রাতিষ্ঠানিক অংশগ্রহণ। তাঁর গভীর বন্ধুত্ব ছিল সালাউদ্দিন আহমেদ, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, মোশারফ হোসেন, হাবিবুর রহমান শেলী, প্রয়াত আবু ইমাম ও খলিলুর রহমান চাচার সঙ্গে। প্রগতিশীল ছাত্রদের অনেকের প্রতি গভীর স্নেহ ছিল, যাঁরা আজ অনেকেই বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। বাবা অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণায় উজ্জীবিত ছিলেন। মানুষ হিসেবে অবশ্যই সীমাবদ্ধতা ছিল। তা মূল্যায়ন করবেন তাঁর ছাত্র, বন্ধুরা এবং তাঁর কর্মজীবনের সঙ্গীরা। তিনি হয়তো নিজেকে দেশের জন্য আরও উৎসর্গ করতে পারতেন, তবে তিনি অকালে আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছেন।
অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাবি
তথ্য কমিশনার (প্রেষণে)

No comments

Powered by Blogger.