অবিশ্বাস্য! ‘তোরা আঁরে হড়ে নদ্দে?’ by মাহাবুবুর রহমান
বাংলানিউজের নিয়মিত পাঠক চট্টগ্রাম আদালতের মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট মাহাবুবুর রহমান। সাহিত্যপ্রেমী মাহাবুবুর রহমান পেশাগত দায়িত্ব বিচারকার্য পরিচালনার পাশাপাশি লেখালেখি করেন, তবে অনিয়মিত। লাশ বহনকারী গাড়ির এক চালকের কাছ থেকে শোনা বিচিত্র কিছু অভিজ্ঞতা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জবানিতে ধারাবাহিকভাবে তিনি উপস্থাপন করছেন বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য ‘অবিশ্বাস্য’ শিরোনামে।
এখানে রয়েছে এর দ্বিতীয় কিস্তি
‘সকাল দশটার দিকে অফিসে আসি। পুলের লোকজন আমাকে জানায়- প্রকৌশল বিভাগে কর্মরত এক অফিসারের আত্মীয় মারা গেছে হাসপাতালে। তার লাশ নিয়ে যেতে হবে কক্সবাজার। আমি গাড়ী নিয়ে ওই হাসপাতালে গেলাম। এবার আমার সাথে হেল্পার ছিল। দু’জনে মিলে গাড়ি থেকে স্ট্রেচার নামালাম। লাশটি রাখা ছিল মেডিকেলের স্ট্রেচারে। ডেথ সার্টিফিকেট রেডি হচ্ছিল। লাশ ঘিরে ছিল অনেক আত্মীয়-স্বজন। কয়েকজন নার্স ও ওয়ার্ডবয়কেও দেখলাম লাশের আশপাশে।
ডেথ সার্টিফিকেট রেডি হলো। আত্মীয়-স্বজন ও আমার হেলপার মেডিকেলের স্ট্রেচার থেকে আমাদের স্ট্রেচারে লাশটি তোলার জন্য এগিয়ে যায়। কয়েকজন যেই না লাশটি একটু আলগা করেছে, ঠিক তখনই একটি কথা কানে বেজে উঠল, ‘তোরা আঁরে হড়ে নদ্দে (তোমরা আমাকে কোথায় নিচ্ছ)?’ উপস্থিত সবারর মত ভড়কে যাই আমিও। প্রথমে বুঝতে পারলাম না- কথাগুলো কোত্থেকে আসছে।
হঠাৎ আমার হেলপার আতংকে চিৎকার করে ওঠে- ‘মাগো! ওস্তাদ! লাশতো জীবিত। লাশ আমারে মারতে চায়!’
আমি একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলাম। গাড়ির পেছন দিকে লাশ রাখার ফ্রিজটি দেখে নিচ্ছিলাম। তার কথা শুনে তাকিয়ে দেখি- ‘লাশ’ স্ট্রেচারে বসে গেছে। কাউকে মারছে এরূপ ভঙ্গিতে হাত ছোঁড়াছুঁড়ি করছে। যে অফিসার আমাদেরকে পাঠিয়েছিলেন তাকে ফোন করে বললাম, ‘স্যার। আপনার আত্মীয়ের লাশ তো জীবিত হয়ে গেছে!’ উনি শোনার সাথে সাথে বললেন, ‘ওখানে থাকার দরকার নেই, তোমরা তাড়াতাড়ি চলে আস গাড়ি নিয়ে। জীবিত মানুষকে ফ্রিজে ঢোকানোর চেষ্টা করেছ- এটা সাংবাদিকরা জানলে সমস্যা হবে।’
তাঁর কথা শুনে আমি দ্রুত গাড়ি নিয়ে অফিসের পথ ধরলাম। মনে মনে ভাবছিলাম- মাত্র দুই-তিন মিনিটের ব্যবধান! একটু দেরিতে জ্ঞান ফিরলে তো কিছুই করা যেতো না। একবার ফ্রিজে ঢোকানোর পর গন্তব্যে পৌঁছার আগে লাশ নামানো হয় না। এই জীবিত মানুষটাকে ফ্রিজে ঢোকানো হলে সে তো ঠাণ্ডায় মরে যেত। আমি স্বল্প শিক্ষিত মানুষ। ডাক্তাররাই বা কিভাবে ডেথ সার্টিফিকেট দিলেন? হায়রে ডাক্তার! হায়রে মানুষ! হায়রে মানবতা!
মাস ছয়েক পরের কথা।
আমি অফিসের নিচে দাঁড়িয়েছিলাম। বেলা ১১টা বেজে গেছে। পুলের অন্যান্য ড্রাইভারদের সাথে গল্প করছিলাম। হঠাৎ দেখলাম- একটা রিক্সা আমাদের সামনে এসে থেমেছে। ধবধবে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক রিক্সা থেকে নামলেন। বয়স চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর হতে পারে। রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে খুব উদাসীন ভঙ্গিতে হেঁটে চললেন অফিসের দিকে।
লোকটির চেহারার দিকে চোখ পড়তেই বুকটা ধক করে উঠল। তবে কেন এমন হল, তাৎক্ষণিক বুঝতে পারিনি। মনে করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। এক অজানা কৌতুহল চেপে বসল আমার মনে। দোতলায় উঠে দেখলাম- লোকটি প্রকৌশল বিভাগের একটি কক্ষে ঢুকে পড়েছেন। আগপিছু না ভেবে আমি সেই কক্ষে ঢুকে পড়লাম কোনো প্রকার অনুমতি ছাড়াই। আমাকে দেখেই অফিসার বলে উঠলেন, ‘চিনে ফেলেছ তাহলে?’
আমার সেই দিনের সব কথা নিমিষেই মনে পড়ে গেল। ‘হাসপাতাল...মৃত ব্যক্তি...হঠাৎ জীবিত হয়ে ওঠা...’ আমার মাথা ঘুরছিল। অফিসার বললেন, ‘তুমি ঘেমে গেছ, অসুস্থ নাকি? কোণার চেয়ারে বস।’
তার কথা মত বসে পড়লাম। অফিসে রাখা জার থেকে এক গ্লাস পানি পান করলাম।
হাতের কাজ সেরে অফিসার আমাকে বললেন, উনাকে আনতেই সেদিন হাসপাতালে গিয়েছিলে। যেভাবেই হোক তিনি বেঁচে আছেন।’
লোকটি কিছুটা বিরক্তি নিয়ে প্রতিবাদের সুরে বললেন, ‘স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই আমাকে বাঁচিয়েছেন এবং সুস্থ করেছেন।’
আমি বললাম, ‘আপনি লোকজনকে মারতে উদ্যত হলে আমরা ভয় পেয়ে পালিয়ে আসি।’
তিনি বললেন, ‘আমি তো আপনারদেরকে মারতে চাইনি। আমি ওই লোকগুলোকে মারতে চেয়েছিলাম।’ চোখেমুখে কেমন যেন রহস্যময় ইঙ্গিত।
আমি প্রশ্ন করলাম, ‘ওই লোকগুলো মানে কারা?’
আমার কথার সরাসরি জবাব না দিয়ে তিনি বলতে শুরু করেন, ‘পনের বিশ দিন ধরে আমি হাসপাতালে ছিলাম। ওইদিন রাত তিনটা-চারটার দিকে আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। তলপেটের ব্যথা সহ্য করতে না পেরে আমি বেঁহুশ হয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ পর অনুভব করলাম- আমি যেন চেতনা ফিরে পেয়েছি। কেউ যেন আমাকে কোথাও যাবার জন্য ডাকছে। হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল- অসম্ভব রকম সাদা একটা জায়গা। যেদিকে তাকাই কেবল সাদা আর সাদা । সে এক অদ্ভূত জগৎ। বড়ই অদ্ভূত! বড়ই অদ্ভূত! বড়ই অদ্ভূত!’
এভাবে কয়েকবার আওড়ানোর পর তিনি চুপ হয়ে যান। চোখ বন্ধ করে কি যেন ভাবতে থাকেন। নীরবতা নেমে আসে কক্ষে। আমাদের মুখেও কোনো কথা নেই।
চার-পাঁচ মিনিট কেটে গেল এভাবে। নীরবতা ভেঙ্গে আবার বলতে শুরু করেন, ‘আমি হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় গিয়ে দেখি- অসংখ্য লোক গোল হয়ে বসে পরস্পর আলাপ করছে। সবার পরনে সাদা ধবধবে লম্বা জামা। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে তারা সবাই উঠে দাঁড়াল। আমি আরও নিকটে যেতেই বিশাল একটা দরজা খুলে গেল। দরজার ওপারে অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাঁদের চেহারায় উৎসুক ভাব। এত লোকের ভীড়ে আমি আমার দাদাকে দেখতে পেলাম। আমি অবাক হয়ে যাই।’
লোকটি বলতে লাগলেন, ‘আমার বয়স যখন ছয়-সাত বছর তখন দাদা মারা যান। একশত বছরেরও বেশি হয়েছিল তাঁর বয়স। খুবই ধার্মিক ছিলেন। খুব ভোরে ফজরের নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় মাঝে মাঝে আমাকে সংগে নিয়ে যেতেন। আমাকে ডাকতেন যাদুমণি বলে। হঠাৎ দাদা আমার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘যাদুমণি, তুমি ওদের সাথে এসো না। তোমার আসার সময় হয়নি।’
দাদার কথা শুনে আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। হঠাৎ করে আমার সাত বছর বয়সী ছেলে আসেমের ফুটফুটে চেহারা ভেসে উঠল চোখে। আমি ফেরার জন্য উদগ্রীব হলাম। সবাই মিলে আমাকে দরজার মধ্য দিয়ে ওপারে নিতে চায়। আমি অস্থির হয়ে হাত-পা ছুঁড়তে থাকি। একপর্যায়ে আমি তাদের লক্ষ্য করে আঞ্চলিক ভাষাতেই বলতে থাকি, ‘তোরা আঁরে হড়ে নদ্দে (তোমরা আমাকে কোথায় নিচ্ছ)?’
এটুকু বলেই তিনি থামলেন। তার চেহারা জুড়ে প্রশান্তির একটা ভাব।
মন্ত্রমুগ্ধের মত তার বয়ান শুনলাম। মনে মনে বললাম, ‘অবিশ্বাস্য!’
‘সকাল দশটার দিকে অফিসে আসি। পুলের লোকজন আমাকে জানায়- প্রকৌশল বিভাগে কর্মরত এক অফিসারের আত্মীয় মারা গেছে হাসপাতালে। তার লাশ নিয়ে যেতে হবে কক্সবাজার। আমি গাড়ী নিয়ে ওই হাসপাতালে গেলাম। এবার আমার সাথে হেল্পার ছিল। দু’জনে মিলে গাড়ি থেকে স্ট্রেচার নামালাম। লাশটি রাখা ছিল মেডিকেলের স্ট্রেচারে। ডেথ সার্টিফিকেট রেডি হচ্ছিল। লাশ ঘিরে ছিল অনেক আত্মীয়-স্বজন। কয়েকজন নার্স ও ওয়ার্ডবয়কেও দেখলাম লাশের আশপাশে।
ডেথ সার্টিফিকেট রেডি হলো। আত্মীয়-স্বজন ও আমার হেলপার মেডিকেলের স্ট্রেচার থেকে আমাদের স্ট্রেচারে লাশটি তোলার জন্য এগিয়ে যায়। কয়েকজন যেই না লাশটি একটু আলগা করেছে, ঠিক তখনই একটি কথা কানে বেজে উঠল, ‘তোরা আঁরে হড়ে নদ্দে (তোমরা আমাকে কোথায় নিচ্ছ)?’ উপস্থিত সবারর মত ভড়কে যাই আমিও। প্রথমে বুঝতে পারলাম না- কথাগুলো কোত্থেকে আসছে।
হঠাৎ আমার হেলপার আতংকে চিৎকার করে ওঠে- ‘মাগো! ওস্তাদ! লাশতো জীবিত। লাশ আমারে মারতে চায়!’
আমি একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলাম। গাড়ির পেছন দিকে লাশ রাখার ফ্রিজটি দেখে নিচ্ছিলাম। তার কথা শুনে তাকিয়ে দেখি- ‘লাশ’ স্ট্রেচারে বসে গেছে। কাউকে মারছে এরূপ ভঙ্গিতে হাত ছোঁড়াছুঁড়ি করছে। যে অফিসার আমাদেরকে পাঠিয়েছিলেন তাকে ফোন করে বললাম, ‘স্যার। আপনার আত্মীয়ের লাশ তো জীবিত হয়ে গেছে!’ উনি শোনার সাথে সাথে বললেন, ‘ওখানে থাকার দরকার নেই, তোমরা তাড়াতাড়ি চলে আস গাড়ি নিয়ে। জীবিত মানুষকে ফ্রিজে ঢোকানোর চেষ্টা করেছ- এটা সাংবাদিকরা জানলে সমস্যা হবে।’
তাঁর কথা শুনে আমি দ্রুত গাড়ি নিয়ে অফিসের পথ ধরলাম। মনে মনে ভাবছিলাম- মাত্র দুই-তিন মিনিটের ব্যবধান! একটু দেরিতে জ্ঞান ফিরলে তো কিছুই করা যেতো না। একবার ফ্রিজে ঢোকানোর পর গন্তব্যে পৌঁছার আগে লাশ নামানো হয় না। এই জীবিত মানুষটাকে ফ্রিজে ঢোকানো হলে সে তো ঠাণ্ডায় মরে যেত। আমি স্বল্প শিক্ষিত মানুষ। ডাক্তাররাই বা কিভাবে ডেথ সার্টিফিকেট দিলেন? হায়রে ডাক্তার! হায়রে মানুষ! হায়রে মানবতা!
মাস ছয়েক পরের কথা।
আমি অফিসের নিচে দাঁড়িয়েছিলাম। বেলা ১১টা বেজে গেছে। পুলের অন্যান্য ড্রাইভারদের সাথে গল্প করছিলাম। হঠাৎ দেখলাম- একটা রিক্সা আমাদের সামনে এসে থেমেছে। ধবধবে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক রিক্সা থেকে নামলেন। বয়স চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর হতে পারে। রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে খুব উদাসীন ভঙ্গিতে হেঁটে চললেন অফিসের দিকে।
লোকটির চেহারার দিকে চোখ পড়তেই বুকটা ধক করে উঠল। তবে কেন এমন হল, তাৎক্ষণিক বুঝতে পারিনি। মনে করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। এক অজানা কৌতুহল চেপে বসল আমার মনে। দোতলায় উঠে দেখলাম- লোকটি প্রকৌশল বিভাগের একটি কক্ষে ঢুকে পড়েছেন। আগপিছু না ভেবে আমি সেই কক্ষে ঢুকে পড়লাম কোনো প্রকার অনুমতি ছাড়াই। আমাকে দেখেই অফিসার বলে উঠলেন, ‘চিনে ফেলেছ তাহলে?’
আমার সেই দিনের সব কথা নিমিষেই মনে পড়ে গেল। ‘হাসপাতাল...মৃত ব্যক্তি...হঠাৎ জীবিত হয়ে ওঠা...’ আমার মাথা ঘুরছিল। অফিসার বললেন, ‘তুমি ঘেমে গেছ, অসুস্থ নাকি? কোণার চেয়ারে বস।’
তার কথা মত বসে পড়লাম। অফিসে রাখা জার থেকে এক গ্লাস পানি পান করলাম।
হাতের কাজ সেরে অফিসার আমাকে বললেন, উনাকে আনতেই সেদিন হাসপাতালে গিয়েছিলে। যেভাবেই হোক তিনি বেঁচে আছেন।’
লোকটি কিছুটা বিরক্তি নিয়ে প্রতিবাদের সুরে বললেন, ‘স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই আমাকে বাঁচিয়েছেন এবং সুস্থ করেছেন।’
আমি বললাম, ‘আপনি লোকজনকে মারতে উদ্যত হলে আমরা ভয় পেয়ে পালিয়ে আসি।’
তিনি বললেন, ‘আমি তো আপনারদেরকে মারতে চাইনি। আমি ওই লোকগুলোকে মারতে চেয়েছিলাম।’ চোখেমুখে কেমন যেন রহস্যময় ইঙ্গিত।
আমি প্রশ্ন করলাম, ‘ওই লোকগুলো মানে কারা?’
আমার কথার সরাসরি জবাব না দিয়ে তিনি বলতে শুরু করেন, ‘পনের বিশ দিন ধরে আমি হাসপাতালে ছিলাম। ওইদিন রাত তিনটা-চারটার দিকে আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। তলপেটের ব্যথা সহ্য করতে না পেরে আমি বেঁহুশ হয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ পর অনুভব করলাম- আমি যেন চেতনা ফিরে পেয়েছি। কেউ যেন আমাকে কোথাও যাবার জন্য ডাকছে। হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল- অসম্ভব রকম সাদা একটা জায়গা। যেদিকে তাকাই কেবল সাদা আর সাদা । সে এক অদ্ভূত জগৎ। বড়ই অদ্ভূত! বড়ই অদ্ভূত! বড়ই অদ্ভূত!’
এভাবে কয়েকবার আওড়ানোর পর তিনি চুপ হয়ে যান। চোখ বন্ধ করে কি যেন ভাবতে থাকেন। নীরবতা নেমে আসে কক্ষে। আমাদের মুখেও কোনো কথা নেই।
চার-পাঁচ মিনিট কেটে গেল এভাবে। নীরবতা ভেঙ্গে আবার বলতে শুরু করেন, ‘আমি হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় গিয়ে দেখি- অসংখ্য লোক গোল হয়ে বসে পরস্পর আলাপ করছে। সবার পরনে সাদা ধবধবে লম্বা জামা। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে তারা সবাই উঠে দাঁড়াল। আমি আরও নিকটে যেতেই বিশাল একটা দরজা খুলে গেল। দরজার ওপারে অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাঁদের চেহারায় উৎসুক ভাব। এত লোকের ভীড়ে আমি আমার দাদাকে দেখতে পেলাম। আমি অবাক হয়ে যাই।’
লোকটি বলতে লাগলেন, ‘আমার বয়স যখন ছয়-সাত বছর তখন দাদা মারা যান। একশত বছরেরও বেশি হয়েছিল তাঁর বয়স। খুবই ধার্মিক ছিলেন। খুব ভোরে ফজরের নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় মাঝে মাঝে আমাকে সংগে নিয়ে যেতেন। আমাকে ডাকতেন যাদুমণি বলে। হঠাৎ দাদা আমার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘যাদুমণি, তুমি ওদের সাথে এসো না। তোমার আসার সময় হয়নি।’
দাদার কথা শুনে আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। হঠাৎ করে আমার সাত বছর বয়সী ছেলে আসেমের ফুটফুটে চেহারা ভেসে উঠল চোখে। আমি ফেরার জন্য উদগ্রীব হলাম। সবাই মিলে আমাকে দরজার মধ্য দিয়ে ওপারে নিতে চায়। আমি অস্থির হয়ে হাত-পা ছুঁড়তে থাকি। একপর্যায়ে আমি তাদের লক্ষ্য করে আঞ্চলিক ভাষাতেই বলতে থাকি, ‘তোরা আঁরে হড়ে নদ্দে (তোমরা আমাকে কোথায় নিচ্ছ)?’
এটুকু বলেই তিনি থামলেন। তার চেহারা জুড়ে প্রশান্তির একটা ভাব।
মন্ত্রমুগ্ধের মত তার বয়ান শুনলাম। মনে মনে বললাম, ‘অবিশ্বাস্য!’
No comments