ঢাকার নিম্নবর্গ-এই রাষ্ট্রের নৈ-নাগরিকেরা by ফারুক ওয়াসিফ
ঢাকায় গাঁট হয়ে বসতে পারা নিম্ন ও মধ্যবিত্তের চকচকে স্বপ্ন। রাজধানীতে একটা চাকরি-ব্যবসা-জমি-ফ্ল্যাট অর্জনের খোয়াব তাদের মনের তলায় উসখুস করে। আবাসন কোম্পানির বিজ্ঞাপনগুলো সেই স্বপ্নকে আরও উসকায়। স্বপ্নটা তখন ডালপালা মেলে, পারলে উড়ে চলে। আরও ওপরে যারা,
তারা ইউরোপ-আমেরিকা মহাদেশের কোনো ধনী দেশে সেই স্বপ্ন পূরণ করার বাসনা রাখে। শিক্ষা-চাকরি-ব্যবসার সুবাদে তাদের ছেলেমেয়েরা সেসব দেশে ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে অথবা যাই যাই করছে। বাকিরা ‘মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করে গমন’ বলতে বলতে তাদের অনুসরণ করছে। মধ্য থেকে উচ্চবিত্তের এসব মানুষ আরও গতি চায়, চায় আরও বেশি স্থানে বসবাসের অধিকার। গ্রামের বাড়ি, ঢাকার বাড়ি, বিদেশের বাড়ির মধ্যে তাদের চলাচল অনেক মসৃণ ও সহজ। দেশে বা বিদেশে যেখানেই তাদের প্রতিষ্ঠার খুঁটি ফিট করা থাকুক না কেন, স্থানের সীমা ডিঙিয়ে তারা উড়তে চায় সীমান্ত পেরিয়ে। তারা দেশেও নাগরিকসুবিধা ভোগ করে, ‘বিদেশি’ রাষ্ট্রের দেওয়া অধিকারটুকুও তাদের আরও সুখী করে।
অন্যদিকে সামাজিক পিরামিডের যত তলার দিকে যাওয়া যাবে, সেখানে তত দেখা যাবে ভাসমানতা। আইন-অর্থনীতি তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায় আর তারা কৃষির জন্য জমি, বসবাসের জন্য ভিটা, জীবিকার জন্য স্থানের দাবিতে প্রতিদিন লড়াই করে। সেই লড়াই সমুদ্রের তলার স্রোতের মতো চাপা থাকে, রাষ্ট্রের সামনাসামনি কমই দাঁড়াতে পারে। ক্রমশই স্থান বা জমি থেকে তারা উচ্ছেদ হলেও ঢাকার বেশির ভাগ ভাসমান শ্রমজীবীর প্রধান চাওয়া হলো কোনো না কোনো পেশায় বা স্থানে স্থায়ী হওয়া। যে বস্তিতে থাকে তার ভয় বস্তি উচ্ছেদ হওয়ার। যে রিকশা চালায়, তার ভয় আজ যে পথে রিকশা চালাচ্ছে, কাল সেই পথে রিকশা নিষিদ্ধ হওয়ার। যে ফুটপাতে সস্তা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে, তার ভয় ওইটুকু স্থানের বরাতে যে রোজগারটা হচ্ছে, সেই স্থানটুকু হারানোর। যে রাস্তার মোড়ে বা ভ্রাম্যমাণ হয়ে টুকিটাকি জিনিস বিক্রি করে পেট চালায়, তার ভয় পুলিশের তাড়া খেয়ে ভ্রাম্যমাণ উপার্জনের অধিকার হারানোর। বস্তিই হোক বা রাজপথই হোক বা হোক ফুটপাত, তাদের দাবি স্থানের ওপর অধিকার, মালিকানা অর্জনের স্বপ্ন তারা ভুলে গেছে।
পাঁচ তারকা হোটেল সোনারগাঁওয়ের সামনে ঝালমুড়ি বিক্রেতা আজিজুল। অনেক খুঁচিয়েও তাঁর মুখ থেকে কোনো স্বপ্নের কথা বের করা গেল না। ২০ বছর ধরে মুড়ি বিক্রি করে চলেছেন। ২০ বছর আগে সাত টাকা দিয়ে এক বেলা খাওয়া যেত, এখন ৪০ থেকে ৫০ টাকা দিয়েও হয় না। তাঁর জীবনে বদলেছে কেবল অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের দাম। তবে আগে এত তাড়া খেতে হতো না। এখন পুলিশ কোথাও বসতে দেয় না, তাড়িয়ে বেড়ায়। মাস্তানেরা উপরি দাবি করে। তাঁর হাড়সর্বস্ব দেহের হাড়ে হাড়ে একটাই শিক্ষা বাজে, জীবন মানেই দৌড়ের ওপর থাকা, তাড়া খেয়ে চলা। ঢাকায় এখন এ ধরনের তাড়া খাওয়া লোকের সংখ্যা লাখ লাখ। রাষ্ট্রের একমাত্র যে সেবাটি তারা পায়, তা হলো পুলিশের লাঠি কিংবা ধাওয়া খাওয়া। অথচ সংবিধান মানলে তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও কাজের অধিকার রয়েছে। রয়েছে রাষ্ট্রের কাছ থেকে নাগরিকের সব অধিকার ও সম্মান পাওয়ার, সেবা পাওয়ার। সেসব ছাড়া এ জীবন ভূতের জীবন, এদের বেগার ভূতের বেগার। ভদ্রলোকেরা তাদের আরেকটা নাম দিয়েছে ‘মফিজ’।
গত ক্রিকেট বিশ্বকাপ উপলক্ষে এই ভূতসমাজের ‘মফিজদের’ উচ্ছেদ করেছিল পুলিশ। এখন আবার তারা যখন যার যার জীবিকার জায়গায়বসতে শুরু করেছে, তখন আবার শুরু হয়েছে তাড়িয়েবেড়ানো। সে সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ক্রিকেট বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই ঢাকার প্রধান প্রধান রাজপথ হকার, ভিখারি ও ফুটপাতবাসীমুক্ত করা হবে। কেন? বিদেশি দর্শকদের চোখে ঢাকাকে যাতে সুন্দর দেখায়, তিলোত্তমা লাগে। গরিব মানুষ ময়লার মতো, ভূতের মতো—তাদের পরিষ্কার করতে হয়, ভূত ঝাড়ানোর মতো তাদেরও দাবড়ানির ওপর রাখতে হয়। সরকারি চোখে এরা ‘বদ স্বভাবের’ উটকো লোকজন, যারা ঠিক ‘আমাদের’ মতো নয়। মানবাধিকার ও সুবিচারের খাটো হাত এসব তলানির মানুুষ পর্যন্ত পৌঁছে না। উল্টো তাদের বিরুদ্ধে আইন বানানো হয়। গত ৯ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ ‘ভবঘুরে ও আশ্রয়হীন ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন, ২০১০’-এর খসড়া পাস করে। এ বিষয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ব্লাস্ট, ব্র্যাক ও এডিডি আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাবনায় বলা হয়, ‘...এই খসড়া দরিদ্র ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক এবং স্বেচ্ছাচারী দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন। এই আইন ‘ভবঘুরে এবং আশ্রয়হীন ব্যক্তি’র আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক স্বেচ্ছাচারী ও বৈষম্যমূলক আটককে বৈধতা দান করে এবং বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিকের মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন সমর্থন করে।’ মৌলিক অধিকারবিরোধী হয়রানিমূলক গণগ্রেপ্তারের অস্ত্রও এ ধরনের আইন। রাজনৈতিক সহিংসতার সময় গরিব লোক দেখে দেখে ধাওয়া করে ধরা হয়। তারপর মামলা-জামিনের সুড়ঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে তারা আরও গরিব হয়ে যায়, কেউ কেউ ভিখারিও হয়। গরিববিরোধী আইন এভাবে গরিবীই বাড়ায়। আর কোনো শ্রেণী বা পেশার বিরুদ্ধে এ রকম আইন নেই। রাষ্ট্র এখানে সরাসরি গরিবদের নাগরিক অধিকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে।
কথায় কথায় আমরা বলি, ১৬ কোটি লোকের সরকার। কিন্তু কোনো সরকারই সব মানুষের সরকার হয়নি। ভাসমান শ্রমজীবীদের প্রতি কোনো দায়িত্ব রাষ্ট্র বোধ করে, তেমন প্রমাণ নেই। তারা রাজপথের অধিকার থেকে বঞ্চিত। তারা স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জনের অধিকার থেকেও বিতাড়িত। এতসব বঞ্চনার একটাই অর্থ, রাষ্ট্র তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। হয় এই রাষ্ট্র তাদের নয়, কিংবা তারা এই রাষ্ট্রের নৈ-নাগরিক।
প্রথমে বলা ওইসব ভদ্র-সভ্য-সুখী নাগরিকদের সঙ্গে তুলনা করলে এদের ‘নৈ-নাগরিকত্ব’ আরও প্রমাণিত হয়। বস্তির জায়গায় বড়লোকি দালান ওঠে, ফুটপাত আর সড়কের দখলও থাকে তাদের গাড়ির। যে স্থানটুকুতে ভাসমান শ্রমজীবীরা থাকার জন্য বা জীবিকা অর্জনের জন্য ব্যবহার করতে পারত, সেটুকু ব্যবহূত হয় অবস্থাপন্নদের স্বার্থে। কিন্তু এই ‘মফিজ’দের মানুষের মতো জীবন না দিতে পারলে কিসের গণতন্ত্র, কিসের মানবতা আর কিসের আইনের শাসন? অবস্থাটা ঢাকার নদীর মতো, তাড়া খাওয়া কিন্তু গতিহীন। অনেকটা স্বপ্নের দৌড়ের মতো: স্বপ্নে আমরা ছুটি কিন্তু এগোতে পারি না।
কী করতে হবে সবাই জানে। বিকল্প বন্দোবস্ত ছাড়া বস্তি এবং হকার ও রিকশা উচ্ছেদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের রায় আছে। তা না মেনে, সরকার তৈরি করছে গরিব উচ্ছেদের কালো আইন। সরকারি জায়গা ও খাসজমি দরিদ্রদের বন্দোবস্ত না দিয়ে দেওয়া হচ্ছে ব্যবসায়ী ও ধনীদের। সরকারকে এবং মধ্য ও উচ্চবিত্তদের মানতে হবে, ঢাকা শহর এসব তাড়া খাওয়া মানুষেরও শহর। এদের দাবিয়ে রেখে এই শহর চলতে পারবে না।
দেশের লাখো-কোটি মানুষকে নৈ-নাগরিক বানিয়ে রাখলে তারাও রাষ্ট্রকে নৈ-রাষ্ট্র মনে করবে। আর নৈ-রাষ্ট্র থেকে নৈ-রাজ্যের ফারাক কিন্তু খুব সামান্য। বাংলাদেশে চলমান সীমিত মাত্রার নৈরাজ্য তখন মিসর বা তিউনিসিয়ার মতো দাবানল হয়ে ছড়াতে দ্বিধা করবে না।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
অন্যদিকে সামাজিক পিরামিডের যত তলার দিকে যাওয়া যাবে, সেখানে তত দেখা যাবে ভাসমানতা। আইন-অর্থনীতি তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায় আর তারা কৃষির জন্য জমি, বসবাসের জন্য ভিটা, জীবিকার জন্য স্থানের দাবিতে প্রতিদিন লড়াই করে। সেই লড়াই সমুদ্রের তলার স্রোতের মতো চাপা থাকে, রাষ্ট্রের সামনাসামনি কমই দাঁড়াতে পারে। ক্রমশই স্থান বা জমি থেকে তারা উচ্ছেদ হলেও ঢাকার বেশির ভাগ ভাসমান শ্রমজীবীর প্রধান চাওয়া হলো কোনো না কোনো পেশায় বা স্থানে স্থায়ী হওয়া। যে বস্তিতে থাকে তার ভয় বস্তি উচ্ছেদ হওয়ার। যে রিকশা চালায়, তার ভয় আজ যে পথে রিকশা চালাচ্ছে, কাল সেই পথে রিকশা নিষিদ্ধ হওয়ার। যে ফুটপাতে সস্তা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে, তার ভয় ওইটুকু স্থানের বরাতে যে রোজগারটা হচ্ছে, সেই স্থানটুকু হারানোর। যে রাস্তার মোড়ে বা ভ্রাম্যমাণ হয়ে টুকিটাকি জিনিস বিক্রি করে পেট চালায়, তার ভয় পুলিশের তাড়া খেয়ে ভ্রাম্যমাণ উপার্জনের অধিকার হারানোর। বস্তিই হোক বা রাজপথই হোক বা হোক ফুটপাত, তাদের দাবি স্থানের ওপর অধিকার, মালিকানা অর্জনের স্বপ্ন তারা ভুলে গেছে।
পাঁচ তারকা হোটেল সোনারগাঁওয়ের সামনে ঝালমুড়ি বিক্রেতা আজিজুল। অনেক খুঁচিয়েও তাঁর মুখ থেকে কোনো স্বপ্নের কথা বের করা গেল না। ২০ বছর ধরে মুড়ি বিক্রি করে চলেছেন। ২০ বছর আগে সাত টাকা দিয়ে এক বেলা খাওয়া যেত, এখন ৪০ থেকে ৫০ টাকা দিয়েও হয় না। তাঁর জীবনে বদলেছে কেবল অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের দাম। তবে আগে এত তাড়া খেতে হতো না। এখন পুলিশ কোথাও বসতে দেয় না, তাড়িয়ে বেড়ায়। মাস্তানেরা উপরি দাবি করে। তাঁর হাড়সর্বস্ব দেহের হাড়ে হাড়ে একটাই শিক্ষা বাজে, জীবন মানেই দৌড়ের ওপর থাকা, তাড়া খেয়ে চলা। ঢাকায় এখন এ ধরনের তাড়া খাওয়া লোকের সংখ্যা লাখ লাখ। রাষ্ট্রের একমাত্র যে সেবাটি তারা পায়, তা হলো পুলিশের লাঠি কিংবা ধাওয়া খাওয়া। অথচ সংবিধান মানলে তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও কাজের অধিকার রয়েছে। রয়েছে রাষ্ট্রের কাছ থেকে নাগরিকের সব অধিকার ও সম্মান পাওয়ার, সেবা পাওয়ার। সেসব ছাড়া এ জীবন ভূতের জীবন, এদের বেগার ভূতের বেগার। ভদ্রলোকেরা তাদের আরেকটা নাম দিয়েছে ‘মফিজ’।
গত ক্রিকেট বিশ্বকাপ উপলক্ষে এই ভূতসমাজের ‘মফিজদের’ উচ্ছেদ করেছিল পুলিশ। এখন আবার তারা যখন যার যার জীবিকার জায়গায়বসতে শুরু করেছে, তখন আবার শুরু হয়েছে তাড়িয়েবেড়ানো। সে সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ক্রিকেট বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই ঢাকার প্রধান প্রধান রাজপথ হকার, ভিখারি ও ফুটপাতবাসীমুক্ত করা হবে। কেন? বিদেশি দর্শকদের চোখে ঢাকাকে যাতে সুন্দর দেখায়, তিলোত্তমা লাগে। গরিব মানুষ ময়লার মতো, ভূতের মতো—তাদের পরিষ্কার করতে হয়, ভূত ঝাড়ানোর মতো তাদেরও দাবড়ানির ওপর রাখতে হয়। সরকারি চোখে এরা ‘বদ স্বভাবের’ উটকো লোকজন, যারা ঠিক ‘আমাদের’ মতো নয়। মানবাধিকার ও সুবিচারের খাটো হাত এসব তলানির মানুুষ পর্যন্ত পৌঁছে না। উল্টো তাদের বিরুদ্ধে আইন বানানো হয়। গত ৯ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ ‘ভবঘুরে ও আশ্রয়হীন ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন, ২০১০’-এর খসড়া পাস করে। এ বিষয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ব্লাস্ট, ব্র্যাক ও এডিডি আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাবনায় বলা হয়, ‘...এই খসড়া দরিদ্র ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক এবং স্বেচ্ছাচারী দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন। এই আইন ‘ভবঘুরে এবং আশ্রয়হীন ব্যক্তি’র আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক স্বেচ্ছাচারী ও বৈষম্যমূলক আটককে বৈধতা দান করে এবং বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিকের মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন সমর্থন করে।’ মৌলিক অধিকারবিরোধী হয়রানিমূলক গণগ্রেপ্তারের অস্ত্রও এ ধরনের আইন। রাজনৈতিক সহিংসতার সময় গরিব লোক দেখে দেখে ধাওয়া করে ধরা হয়। তারপর মামলা-জামিনের সুড়ঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে তারা আরও গরিব হয়ে যায়, কেউ কেউ ভিখারিও হয়। গরিববিরোধী আইন এভাবে গরিবীই বাড়ায়। আর কোনো শ্রেণী বা পেশার বিরুদ্ধে এ রকম আইন নেই। রাষ্ট্র এখানে সরাসরি গরিবদের নাগরিক অধিকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে।
কথায় কথায় আমরা বলি, ১৬ কোটি লোকের সরকার। কিন্তু কোনো সরকারই সব মানুষের সরকার হয়নি। ভাসমান শ্রমজীবীদের প্রতি কোনো দায়িত্ব রাষ্ট্র বোধ করে, তেমন প্রমাণ নেই। তারা রাজপথের অধিকার থেকে বঞ্চিত। তারা স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জনের অধিকার থেকেও বিতাড়িত। এতসব বঞ্চনার একটাই অর্থ, রাষ্ট্র তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। হয় এই রাষ্ট্র তাদের নয়, কিংবা তারা এই রাষ্ট্রের নৈ-নাগরিক।
প্রথমে বলা ওইসব ভদ্র-সভ্য-সুখী নাগরিকদের সঙ্গে তুলনা করলে এদের ‘নৈ-নাগরিকত্ব’ আরও প্রমাণিত হয়। বস্তির জায়গায় বড়লোকি দালান ওঠে, ফুটপাত আর সড়কের দখলও থাকে তাদের গাড়ির। যে স্থানটুকুতে ভাসমান শ্রমজীবীরা থাকার জন্য বা জীবিকা অর্জনের জন্য ব্যবহার করতে পারত, সেটুকু ব্যবহূত হয় অবস্থাপন্নদের স্বার্থে। কিন্তু এই ‘মফিজ’দের মানুষের মতো জীবন না দিতে পারলে কিসের গণতন্ত্র, কিসের মানবতা আর কিসের আইনের শাসন? অবস্থাটা ঢাকার নদীর মতো, তাড়া খাওয়া কিন্তু গতিহীন। অনেকটা স্বপ্নের দৌড়ের মতো: স্বপ্নে আমরা ছুটি কিন্তু এগোতে পারি না।
কী করতে হবে সবাই জানে। বিকল্প বন্দোবস্ত ছাড়া বস্তি এবং হকার ও রিকশা উচ্ছেদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের রায় আছে। তা না মেনে, সরকার তৈরি করছে গরিব উচ্ছেদের কালো আইন। সরকারি জায়গা ও খাসজমি দরিদ্রদের বন্দোবস্ত না দিয়ে দেওয়া হচ্ছে ব্যবসায়ী ও ধনীদের। সরকারকে এবং মধ্য ও উচ্চবিত্তদের মানতে হবে, ঢাকা শহর এসব তাড়া খাওয়া মানুষেরও শহর। এদের দাবিয়ে রেখে এই শহর চলতে পারবে না।
দেশের লাখো-কোটি মানুষকে নৈ-নাগরিক বানিয়ে রাখলে তারাও রাষ্ট্রকে নৈ-রাষ্ট্র মনে করবে। আর নৈ-রাষ্ট্র থেকে নৈ-রাজ্যের ফারাক কিন্তু খুব সামান্য। বাংলাদেশে চলমান সীমিত মাত্রার নৈরাজ্য তখন মিসর বা তিউনিসিয়ার মতো দাবানল হয়ে ছড়াতে দ্বিধা করবে না।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments