শিবের গীত-দারিদা ফুঁকা by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

আমাদের মন্টু মামা গেল বছর আশিতে পা রেখেছেন। এই বয়সেও হাসিখুশি, মাথাটা সচল, পড়াশোনা করেন প্রচুর। আর জগৎ ও জীবন নিয়ে ভাবেন, বাস্তবের আর কল্পনার নানা হিসাব মেলাতে চেষ্টা করেন। না মিললে আমাকে ফোন করেন। স্ত্রী থাকলে, ছেলেমেয়ে থাকলে হয়তো তাদের সাহায্য নিতেন—কিন্তু মন্টু মামা অকৃতদার।


অকৃতদার থাকার ব্যাপারে আজন্ম তিনি প্রকৃত উদার।
সেদিন মামার ফোন পেয়ে মনে হলো, কোথাও নিশ্চয় হিসাবে জট লেগেছে। ভজকট কোনো সমস্যা হয়েছে। মামা শুরুতেই জিজ্ঞেস করলেন, আমার দারিদা ফুঁকা কেমন চলছে। বছর কুড়ি-পঁচিশ আগে, জাক দারিদা আর মিশেল ফুকো যখন আমাদের আঁতেলপাড়ায় নিঃশ্বাস আর প্রশ্বাসের সঙ্গে নেওয়ার মতোই দুই নাম, এই মনীষীদ্বয়কে আমার ঘন ঘন উদ্ধৃত করার বাতিকে বিরক্ত হয়ে মামা বলেছিলেন, ‘মুরব্বির সামনে এভাবে দারিদা ফুঁকা ঠিক না। কথায় কথায় ফুকো-দারিদা দারিদা-ফুকো করাটা, বিড়ি ফুঁকার মতোই বিরক্তিকর।’ সেই থেকে দারিদা ফুঁকায় আমার ব্রেক কষা।
মামাকে ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘অনেক দিনই তো ফুঁকি না। হঠাৎ জিজ্ঞেস করা কেন?’
‘কারণ আছে।’ মামা বললেন, ‘আজকাল দেখছি অনেকেই অনেক বিপ্লবী কাজ করছেন, যেগুলোকে তাঁরা বলছেন প্রচলিত ডিসকোর্সের বিকল পাঠ।’
‘বিকল নয় মামা, বিকল্প।’ মামার খটকাটা বুঝতে পেরে বললাম। ‘বিকল্প পাঠ নির্মাণের অধিকার সবারই আছে। কেন থাকবে না? প্রচলিত, জাতীয়তাবাদী ইতিহাসচর্চা থেকে বেরিয়ে কি নিম্নবর্গীয় ইতিহাস নির্মাণ করা হয়নি? নরকণ্ঠের নরটলজি—মানে ন্যারেটলজি— থেকে বেরিয়ে কি নারীকণ্ঠের নারীটলজি তৈরি হয়নি? প্রচলকে চপেটাঘাত না করলে প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতাকেন্দ্রগুলোর আঁচল গলে কীভাবে বেরোব? অচল হয়ে পড়ব না?’
আমাকে থামিয়ে দিয়ে মামা বললেন, ‘আরে, আমিও তো সে রাস্তাতেই যাচ্ছি। একটা উপন্যাস লিখছি। প্রচলবিরোধী সচল উপন্যাস। তোমাকে ইংরেজি তর্জমাটা করতে হবে। নামটাও ঠিক করে ফেলেছি—তোমাদের ওই জাদুবাস্তবতার ঠাকুর গার্সিয়া মার্কেজের কেতাব অনুসারে— কলেরাইন টাইম অব ওয়ার।’
মামা অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আসাম সীমান্ত ঘেঁষে এক দুর্দান্ত অসম যুদ্ধ করে শত্রু ঘায়েল করেছেন। অথচ তখন কলেরায় তাঁর বিষম অবস্থা।
‘বাংলায় কী নাম দিয়েছেন?’ নিজের লিখনশক্তির ওপর মামার ভক্তিতে প্রীত হয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে।’
বুঝলাম, মামা একই সঙ্গে দুই বিকল্প পাঠের সন্ধানে আছেন।
‘কিছুকাল আরও দারিদা ফুঁকো, আর বিনির্মাণের শ্রমিক হিসেবে কাজ করে যাও। আমার কাজে লাগবে।’ মামা বললেন। তারপর, ফোনটা রাখার আগে মূল কথায় গেলেন। ‘আচ্ছা, শোনো,’ মামার কণ্ঠে হিসাব না মেলার উদ্বেগ, ‘আমাকে বলো তো, ভাষার মাসে ত্রিদেশীয় নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকারা বঙ্গবন্ধুতে কোন বিকল্প পাঠ দিয়ে গেল? উর্দু-হিন্দিতে গান গেয়ে, মাস্তি করে? চিৎকার-চেঁচামেচি করে?’
‘ব্যাপারটা একুশের চেতনা দিয়েই দেখো, মামা,’ আমি বললাম। ‘এই যে এতগুলো মাতৃভাষার সঙ্গে ভাষার মাসে আমাদের নতুন করে পরিচয় হলো, এই সুযোগ কি ওনারা না এলে হতো?’
‘কিন্তু এসব ধুমধাড়াক্কা নাচ?’
‘নাচ হচ্ছে শরীরের ভাষা, যে শরীরের পত্তন হয় মার্তৃজঠরে। সে হিসেবে নাচের সঙ্গে শরীরের মাতৃভাষা জড়িত। ত্রিদেশীয় মহান নর্তক-নর্তকীরা সেই আদি মাতৃভাষার চর্চা করে আমাদের ভাষাচেতনা সমৃদ্ধ করেছেন। এতে দোষ কী?’
‘আর যে অসভ্য শিসটিস দিল?’ মামার অধৈর্য প্রশ্ন।
‘শিস তো, মামা, কথার মতোই জিহ্বার ভাষা। তাতে কী সমস্যা?’
মামা হাল ছেড়ে দিলেন। ‘তাহলে বিজয়ের মাসে তোমাদের শাহ রক খানের খাট্টা-তামাশা, সঙ্গে স্বল্পবসনা মেয়েদের খ্যামটা নাচ—এসবের মানে কী?’
‘স্বল্পবসনাদের নাচ থেকে যে ডিসকোর্সটি আমরা পাই,’ আমি মামাকে দারিদার প্রজ্ঞা নিয়ে বোঝাতে শুরু করলাম, ‘সেটি হচ্ছে, আদিম সমাজ থেকে মানবজাতির উত্তরণের চেষ্টার একটি রেখাচিত্র, এবং খান দেখাতে চেয়েছেন, অন্যরা যখন কাপড়ের অভাবে আধখানা শরীরও ঢাকতে পারছে না, সেখানে বাংলাদেশ সারা পৃথিবীকে পোশাক পরাতে প্রস্তুত। পোশাকহীনতার বিরুদ্ধে আমাদের পোশাকশিল্পের বিজয়ের এক বিকল্প পাঠই তো বিজয়ের মাসে আমাদের উপহার দিলেন খান সাহেব।’
মামার হিসাবটা নিশ্চয় মিলল। তিনি মৃদুস্বরে বললেন, ‘তোমাদের বিকল্প পাঠগুলো সত্যিই মেহেরবান। কী সুন্দর আমার ধন্দগুলো মিটিয়ে দিল!’
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.