দারিদ্র্য বিমোচন-ক্ষুদ্রঋণ: সমস্যা আছে, বিকল্প কী by মহিউদ্দিন আহমদ
শান্তিতে নোবেল পাওয়া অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে নিয়ে সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় বেশ লেখালেখি হয়েছে এবং হচ্ছে। বিষয়টি এখানেই থেমে থাকেনি। ‘ক্ষুদ্রঋণ’ নিয়েও আলোচনা হচ্ছে অনেক। বিতর্ক ও কুতর্ক হচ্ছে বিস্তর; কেউ পক্ষে, কেউ বা বিপক্ষে। দুঃখজনক হলেও বলতে দ্বিধা নেই, একাডেমিক আলোচনা হচ্ছে না মোটেও।
এই অনার্য জনপদে চাটুকারের অভাব নেই; তারা তিলকে তাল বানাতে পারে। আবার দুষ্ট লোকের প্রাচুর্যও লক্ষণীয়; তারা সামান্য ছুতায় চামড়া তুলে নিতে দ্বিধা করে না। ফলে সত্যটা যে কী, তা জানা কষ্টকর হয়ে পড়ে। পরস্পরবিরোধী সংবাদ ও আলোচনা শুনে ও পড়ে আমরা বিভ্রান্ত হই। তথ্য বাদ দিয়ে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ আর অনুমাননির্ভর মন্তব্যের চোরাবালিতে সত্য উদ্ঘাটন করা দুরূহ হয়ে পড়ে।
১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল পেলেন, তখন অনেকেই বলেছিলেন, ওটা তো ইয়েটস লিখে দিয়েছে! ১৯৩৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘যেটা যথার্থ ক্ষোভের বিষয় সেটা এই যে, আমার দেশে আমার নিন্দার ব্যবসায়ে জীবিকা ভালো চলে, বুঝতে পারি আমার সম্বন্ধে তীব্র বিদ্বেষ কত দূর পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে আমার দেশে। আমার প্রতি আঘাত, আমাকে অবমাননা দেশের লোককে কতই কম বেদনা দেয়। তা যদি না হোত তাহলে আমার বিরুদ্ধে নিন্দার পণ্য এত লাভজনক হোত না’ (সূত্র: নীরদচন্দ্র চৌধুরী, আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ)।
ইউনূসের বন্দনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি ‘ক্ষুদ্রঋণ’, যা মাইক্রোক্রেডিট নামে পৃথিবীর মানুষের কাছে সুপরিচিত, তার ব্যাপারে দু-চারটি কথা বলব। আমার মনে হয়, কিছু মৌলিক তথ্য আমাদের জানা দরকার এবং অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করেই নীতিনির্ধারকদের উচিত সিদ্ধান্ত নেওয়া।
বাংলাদেশে বেসরকারি উদ্যোগে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম শুরু করে ব্র্যাক, ১৯৭৪ সালে সিলেট জেলার শাল্লা প্রকল্পে। ১৯৭৬ থেকে এটা ব্র্যাকের নিয়মিত কর্মসূচিতে পরিণত হয়। মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্যোগে বাংলাদেশ সরকার একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে ১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে। তার আগে অবশ্য তিনি জোবরা গ্রামে পরীক্ষামূলক এ কর্মসূচি চালু করেছিলেন। এ ছাড়া ইউএসএইড ও বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে জামানতবিহীন ক্ষুদ্রঋণের একটি পরীক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল। ১৯৮১-৮২ সালে পরিচালিত এই কার্যক্রমের নাম ছিল ‘রুরাল ফাইন্যান্স এক্সপেরিমেন্টাল প্রজেক্ট’। ১৯৮২ সালে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, ১৮ শতাংশ সুদে যাঁরা ঋণ নিয়েছিলেন, তাঁরাই অপেক্ষাকৃত বেশি সফল ছিলেন।
ক্ষুদ্রঋণের বিশেষত্ব হলো, ঋণগ্রহীতাকে প্রতিষ্ঠানের কাছে আসতে হয় না। প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই তাঁদের কাছে যান। ঋণের জন্য কোনো জামানত লাগে না। ঋণ শোধ করতে হয় সাপ্তাহিক কিস্তিতে এক বছরের মধ্যে (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া)। ক্ষুদ্রঋণ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ‘ক্রেডিট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরাম’-এর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানভেদে সুদের হার হচ্ছে ১০ থেকে ৪০ শতাংশ।
গ্রামীণ ব্যাংক ও মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছেন প্রধানত দুটো কারণে। প্রথমত, তাঁরা দেখিয়েছেন, গরিব মানুষেরা ঋণ নিলে তা ফেরত দেয়। দ্বিতীয়ত, ইউনূস এটা সবার কাছে তুলে ধরতে প্রয়াস পেয়েছেন যে ঋণ পাওয়ার অধিকার একটি মানবাধিকার।
এখানে একটি মিথ বিরাজ করছে, আর তা হলো ক্ষুদ্রঋণ মানেই গ্রামীণ ব্যাংক। আসলে তা নয়। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায়, সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এযাবৎ মোট ১৪৭০ বিলিয়ন টাকা ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংকের দেওয়া ঋণের পরিমাণ ২৯ শতাংশ। ৭ শতাংশ ঋণ এসেছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। অন্যান্য এনজিও দিয়েছে ৬৪ শতাংশ ঋণ। এর মধ্যে ব্র্যাকের দেওয়া ঋণের পরিমাণ ২৪ শতাংশ এবং আশার ১৬ শতাংশ। ক্রেডিট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণের সুদের হার ২০ শতাংশ, ব্র্যাকের ১৫ শতাংশ এবং আশার ১২ শতাংশ। তবে এ নিয়ে মতভেদ আছে। ঋণের কিস্তি যেভাবে ফেরত দেওয়া হয়, তাতে করে সুদের হার বাস্তবে আরও বেশি হয় বলে অভিযোগ আছে।
ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতারা দারিদ্র্যের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না, এ রকম একটা অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগটি পুরোপুরি অমূলক নয়। তবে কেন এমন হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
একজন ৫ থেকে ১০ হাজার টাকার মতো এককালীন ঋণ পেয়ে থাকেন। অবকাঠামোর অভাব, বাজারে সীমাবদ্ধতা এবং বিনিয়োগযোগ্য খাতের সংখ্যাস্বল্পতার কারণে গ্রামের মানুষ বড় আকারে বিনিয়োগ করতে পারেন না। তাঁরা মূলত নির্ভর করেন পারিবারিক শ্রমের ওপর, যা লাভ হয় তার অনেকটাই খরচ হয়ে যায় দৈনন্দিন অভাব মেটাতে। বছর শেষে বিনিয়োগযোগ্য সঞ্চয় প্রায় থাকে না বললেই চলে। তাই তাঁকে আবার ঋণ নিতে হয়। একবার ঋণ নেওয়া শুরু হলে এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। ক্ষুদ্রঋণের চরিত্রই হলো এমন যে একজন যতটা না স্বাবলম্বী হবেন, তার চেয়ে বেশি কার্যকর হবে তাঁর অবস্থান ধরে রাখার লড়াই। অর্থাৎ তিনি ‘দারিদ্র্যসীমা’ থেকে ‘দুর্ভিক্ষসীমা’য় পড়ে যাবেন না।
এ ছাড়া দারিদ্র্যের সংজ্ঞা এখন পাল্টে গেছে। শুধু দৈনিক মাথাপিছু ২২০০ ক্যালরি খাদ্যশক্তি গ্রহণ নয়, এখন দেখতে হয় ঋণগ্রহীতা তাঁর সন্তানকে স্কুলে পাঠাচ্ছেন কি না, তাঁর বাড়িতে নলকূপ আছে কি না, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা আছে কি না, অসুখ-বিসুখে চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন কি না ইত্যাদি। এসবের খরচ আছে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রাথমিক স্তরে স্কুলে ভর্তির হার ৯৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে, ৫৫ শতাংশ পঞ্চম শ্রেণী অবধি পড়ছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা বেড়েছে। এগুলো তো এমনি এমনি হয়নি। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয়েই এসব অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। যার বাড়িতে খড়ের চাল ছিল, সেখানে এখন টিন; ছেলেমেয়েদের পায়ে স্যান্ডেল, নারীদের গায়ে ব্লাউজ—এসব তো আলাদিনের চেরাগ দিয়ে হয়নি। গ্রামের মানুষের হাতে টাকা এসেছে, সে বাজারে যাচ্ছে, খরচ করছে। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে গ্রামের মানুষের কাছে যে বিপুল পরিমাণ চলতি মূলধন পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, তার ইতিবাচক প্রতিফলন চোখ মেলে তাকালেই দেখা যায়।
এযাবৎ সব প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে ১৪৭০ বিলিয়ন টাকা ক্ষুদ্রঋণ হিসেবে মানুষের হাতে পৌঁছে দিয়েছে, যাঁদের অধিকাংশ নারী। গ্রামীণ ব্যাংকসহ সব এনজিও (৬১৩টি) এযাবৎ তিন কোটি ৫৯ লাখ মানুষকে ঋণসুবিধা দিয়েছে। এর প্রয়োজন হতো না, যদি সরকারি ব্যাংকগুলো তাদের ভল্টে টাকা জমিয়ে না রেখে গরিব মানুষকে ঋণ দিত।
আর একটি বিষয় ভেবে দেখা দরকার। প্রায় এক লাখ ৩৭ হাজার নারী-পুরুষ ক্ষুদ্রঋণদানকারী সংগঠনগুলোতে চাকরি করছেন। এটা একটা বিশাল কর্মিবাহিনী। তাঁদের কথাও সমাজকে ভাবতে হবে। যেখানে সমস্যা আছে, সেখানে বিকল্প ধারণার উদ্ভাবন দরকার, তার সফল প্রয়োগ দরকার।
ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে বেশ কিছু মন্দ লোক ঢুকে পড়েছেন। তাঁরা বড় বড় গাড়ি হাঁকাচ্ছেন, ঘন ঘন বিদেশে যাচ্ছেন। তাঁদের চুরি-বাটপাড়ির কারণে পুরো খাতটিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই আবর্জনা সাফ করতে হবে সবাইকে নিয়ে। তবে নেতিবাচক দিকগুলো সামনে এনে ইতিবাচক দিকগুলো অস্বীকার করার প্রয়োজন নেই। অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এগোতে হবে সামনের দিকে, আরও ভালো কর্মসূচি নিয়ে।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক, গবেষক।
mohi2005@gmail.com
১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল পেলেন, তখন অনেকেই বলেছিলেন, ওটা তো ইয়েটস লিখে দিয়েছে! ১৯৩৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘যেটা যথার্থ ক্ষোভের বিষয় সেটা এই যে, আমার দেশে আমার নিন্দার ব্যবসায়ে জীবিকা ভালো চলে, বুঝতে পারি আমার সম্বন্ধে তীব্র বিদ্বেষ কত দূর পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে আমার দেশে। আমার প্রতি আঘাত, আমাকে অবমাননা দেশের লোককে কতই কম বেদনা দেয়। তা যদি না হোত তাহলে আমার বিরুদ্ধে নিন্দার পণ্য এত লাভজনক হোত না’ (সূত্র: নীরদচন্দ্র চৌধুরী, আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ)।
ইউনূসের বন্দনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি ‘ক্ষুদ্রঋণ’, যা মাইক্রোক্রেডিট নামে পৃথিবীর মানুষের কাছে সুপরিচিত, তার ব্যাপারে দু-চারটি কথা বলব। আমার মনে হয়, কিছু মৌলিক তথ্য আমাদের জানা দরকার এবং অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করেই নীতিনির্ধারকদের উচিত সিদ্ধান্ত নেওয়া।
বাংলাদেশে বেসরকারি উদ্যোগে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম শুরু করে ব্র্যাক, ১৯৭৪ সালে সিলেট জেলার শাল্লা প্রকল্পে। ১৯৭৬ থেকে এটা ব্র্যাকের নিয়মিত কর্মসূচিতে পরিণত হয়। মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্যোগে বাংলাদেশ সরকার একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে ১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে। তার আগে অবশ্য তিনি জোবরা গ্রামে পরীক্ষামূলক এ কর্মসূচি চালু করেছিলেন। এ ছাড়া ইউএসএইড ও বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে জামানতবিহীন ক্ষুদ্রঋণের একটি পরীক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল। ১৯৮১-৮২ সালে পরিচালিত এই কার্যক্রমের নাম ছিল ‘রুরাল ফাইন্যান্স এক্সপেরিমেন্টাল প্রজেক্ট’। ১৯৮২ সালে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, ১৮ শতাংশ সুদে যাঁরা ঋণ নিয়েছিলেন, তাঁরাই অপেক্ষাকৃত বেশি সফল ছিলেন।
ক্ষুদ্রঋণের বিশেষত্ব হলো, ঋণগ্রহীতাকে প্রতিষ্ঠানের কাছে আসতে হয় না। প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই তাঁদের কাছে যান। ঋণের জন্য কোনো জামানত লাগে না। ঋণ শোধ করতে হয় সাপ্তাহিক কিস্তিতে এক বছরের মধ্যে (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া)। ক্ষুদ্রঋণ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ‘ক্রেডিট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরাম’-এর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানভেদে সুদের হার হচ্ছে ১০ থেকে ৪০ শতাংশ।
গ্রামীণ ব্যাংক ও মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছেন প্রধানত দুটো কারণে। প্রথমত, তাঁরা দেখিয়েছেন, গরিব মানুষেরা ঋণ নিলে তা ফেরত দেয়। দ্বিতীয়ত, ইউনূস এটা সবার কাছে তুলে ধরতে প্রয়াস পেয়েছেন যে ঋণ পাওয়ার অধিকার একটি মানবাধিকার।
এখানে একটি মিথ বিরাজ করছে, আর তা হলো ক্ষুদ্রঋণ মানেই গ্রামীণ ব্যাংক। আসলে তা নয়। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায়, সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এযাবৎ মোট ১৪৭০ বিলিয়ন টাকা ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংকের দেওয়া ঋণের পরিমাণ ২৯ শতাংশ। ৭ শতাংশ ঋণ এসেছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। অন্যান্য এনজিও দিয়েছে ৬৪ শতাংশ ঋণ। এর মধ্যে ব্র্যাকের দেওয়া ঋণের পরিমাণ ২৪ শতাংশ এবং আশার ১৬ শতাংশ। ক্রেডিট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণের সুদের হার ২০ শতাংশ, ব্র্যাকের ১৫ শতাংশ এবং আশার ১২ শতাংশ। তবে এ নিয়ে মতভেদ আছে। ঋণের কিস্তি যেভাবে ফেরত দেওয়া হয়, তাতে করে সুদের হার বাস্তবে আরও বেশি হয় বলে অভিযোগ আছে।
ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতারা দারিদ্র্যের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না, এ রকম একটা অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগটি পুরোপুরি অমূলক নয়। তবে কেন এমন হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
একজন ৫ থেকে ১০ হাজার টাকার মতো এককালীন ঋণ পেয়ে থাকেন। অবকাঠামোর অভাব, বাজারে সীমাবদ্ধতা এবং বিনিয়োগযোগ্য খাতের সংখ্যাস্বল্পতার কারণে গ্রামের মানুষ বড় আকারে বিনিয়োগ করতে পারেন না। তাঁরা মূলত নির্ভর করেন পারিবারিক শ্রমের ওপর, যা লাভ হয় তার অনেকটাই খরচ হয়ে যায় দৈনন্দিন অভাব মেটাতে। বছর শেষে বিনিয়োগযোগ্য সঞ্চয় প্রায় থাকে না বললেই চলে। তাই তাঁকে আবার ঋণ নিতে হয়। একবার ঋণ নেওয়া শুরু হলে এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। ক্ষুদ্রঋণের চরিত্রই হলো এমন যে একজন যতটা না স্বাবলম্বী হবেন, তার চেয়ে বেশি কার্যকর হবে তাঁর অবস্থান ধরে রাখার লড়াই। অর্থাৎ তিনি ‘দারিদ্র্যসীমা’ থেকে ‘দুর্ভিক্ষসীমা’য় পড়ে যাবেন না।
এ ছাড়া দারিদ্র্যের সংজ্ঞা এখন পাল্টে গেছে। শুধু দৈনিক মাথাপিছু ২২০০ ক্যালরি খাদ্যশক্তি গ্রহণ নয়, এখন দেখতে হয় ঋণগ্রহীতা তাঁর সন্তানকে স্কুলে পাঠাচ্ছেন কি না, তাঁর বাড়িতে নলকূপ আছে কি না, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা আছে কি না, অসুখ-বিসুখে চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন কি না ইত্যাদি। এসবের খরচ আছে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রাথমিক স্তরে স্কুলে ভর্তির হার ৯৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে, ৫৫ শতাংশ পঞ্চম শ্রেণী অবধি পড়ছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা বেড়েছে। এগুলো তো এমনি এমনি হয়নি। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয়েই এসব অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। যার বাড়িতে খড়ের চাল ছিল, সেখানে এখন টিন; ছেলেমেয়েদের পায়ে স্যান্ডেল, নারীদের গায়ে ব্লাউজ—এসব তো আলাদিনের চেরাগ দিয়ে হয়নি। গ্রামের মানুষের হাতে টাকা এসেছে, সে বাজারে যাচ্ছে, খরচ করছে। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে গ্রামের মানুষের কাছে যে বিপুল পরিমাণ চলতি মূলধন পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, তার ইতিবাচক প্রতিফলন চোখ মেলে তাকালেই দেখা যায়।
এযাবৎ সব প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে ১৪৭০ বিলিয়ন টাকা ক্ষুদ্রঋণ হিসেবে মানুষের হাতে পৌঁছে দিয়েছে, যাঁদের অধিকাংশ নারী। গ্রামীণ ব্যাংকসহ সব এনজিও (৬১৩টি) এযাবৎ তিন কোটি ৫৯ লাখ মানুষকে ঋণসুবিধা দিয়েছে। এর প্রয়োজন হতো না, যদি সরকারি ব্যাংকগুলো তাদের ভল্টে টাকা জমিয়ে না রেখে গরিব মানুষকে ঋণ দিত।
আর একটি বিষয় ভেবে দেখা দরকার। প্রায় এক লাখ ৩৭ হাজার নারী-পুরুষ ক্ষুদ্রঋণদানকারী সংগঠনগুলোতে চাকরি করছেন। এটা একটা বিশাল কর্মিবাহিনী। তাঁদের কথাও সমাজকে ভাবতে হবে। যেখানে সমস্যা আছে, সেখানে বিকল্প ধারণার উদ্ভাবন দরকার, তার সফল প্রয়োগ দরকার।
ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে বেশ কিছু মন্দ লোক ঢুকে পড়েছেন। তাঁরা বড় বড় গাড়ি হাঁকাচ্ছেন, ঘন ঘন বিদেশে যাচ্ছেন। তাঁদের চুরি-বাটপাড়ির কারণে পুরো খাতটিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই আবর্জনা সাফ করতে হবে সবাইকে নিয়ে। তবে নেতিবাচক দিকগুলো সামনে এনে ইতিবাচক দিকগুলো অস্বীকার করার প্রয়োজন নেই। অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এগোতে হবে সামনের দিকে, আরও ভালো কর্মসূচি নিয়ে।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক, গবেষক।
mohi2005@gmail.com
No comments