জামিনসংক্রান্ত নিয়ম-রীতিতে পরিবর্তন কাম্য-ভুয়া কাগজ দাখিল ও প্রতারণা

জামিন ব্যক্তির মৌলিক অধিকার নয়, তবে এও ঠিক, যেকোনো সন্দেহভাজন অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত আইনের চোখে নির্দোষ। সে কারণে আদালত সাধারণত জামিন দিতে উদার মনোভাব দেখিয়ে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি দিন দিন নাজুক হয়ে পড়ছে। সর্বশেষ গুলশানের চাঞ্চল্যকর দম্পতি হত্যা মামলার দুই আসামির ভুয়া কাগজ দেখিয়ে লাপাত্তার ঘটনা আমাদের বিচলিত করেছে।


মূল ঘটনা বা এজাহার জাল করে তা আদালতে দাখিল করা হয়েছিল। দেখার বিষয় হলো, বাংলাদেশের প্রচলিত আদালত ব্যবস্থাপনায় দেখা যায়, আদালতের যত আদেশ আছে, তার মধ্যে জামিন আদেশ কখনো আটকে থাকে না। তুমুল তার গতি, তড়িৎ গতি হার মানে। বিশিষ্ট আইনবিদ মাহমুদুল ইসলামের মন্তব্য হচ্ছে, এর ধাপে ধাপে ‘তেলে’ চলে। হাইকোর্ট গুলশানের হত্যা মামলার সন্দেহভাজন দুই ঘাতককে জামিন দেন গত ২৩ জানুয়ারি। ওই সপ্তাহেই তাঁরা জেল থেকে ছাড়া পান।
ভুয়া কাগজপত্রে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাওয়ার ঘটনা আগেও অনেক ঘটেছে। আশুলিয়ায় জমি দখলের ঘটনায় ১০ ব্যক্তির আগাম জামিন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট। তাঁরা এর আগে জজকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছিলেন। তাঁরা নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ না করে হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নেন। এটা প্রতারণা। সার্বিকভাবে জামিন প্রশ্নে একটা বিরাট অস্থিরতা চলছে। এর অবসান দরকার। এ ব্যাপারে প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও প্রচেষ্টার আমরা সাফল্য কামনা করি। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বারকে আন্তরিক সহায়তা দিতে হবে।
জামিন-অযোগ্য ধারায়ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে জামিন হলো আদালতের ইচ্ছাধীন। সেই ইচ্ছা প্রয়োগে অবশ্যই বিচারিক মননের প্রতিফলন থাকতে হবে। বাংলাদেশের উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেওয়ার সাম্প্রতিক প্রবণতা আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। আড়াই মিনিটের কম সময়ে জামিন-অযোগ্য ধারায় আসামিরা জামিন পাচ্ছেন। ‘গণজামিন’ বলে কোনো কিছু আমাদের স্মরণকালের ইতিহাসে জানা ছিল না। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত দূরে থাক, পাঁচ-সাত বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত, যাঁরা যথেষ্ট সময় কারাবাস করেননি, তাঁদের জন্য জামিনের দরখাস্ত হাতে হাইকোর্টে দাঁড়াতে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা শতবার ভাবতেন। কিন্তু অনেক সময় এখন ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড কিংবা যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি অনেকেই জেলের দুয়ার দেখার আগেই বেরিয়ে পড়ছেন।
আগাম জামিনের অপব্যবহার এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে আপিল বিভাগকে এ জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হয়েছে। এমনকি যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও গণজামিনের প্রাপ্তিযোগ থেকে বঞ্চিত হন না। এই চিত্রের বিপরীত দিক হচ্ছে, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা আকসার হচ্ছে। পুলিশি রিপোর্ট যথাসময়ে হচ্ছে না। বিচার প্রলম্বিত হচ্ছে। গুলশানের হত্যা মামলার ক্ষেত্রে পুলিশ অভিযোগপত্র দিয়েছিল। এখানে এজাহারের বয়ান ও আইনজীবীর পরিচয় পুরোটাই ভুয়া। এর মানে হচ্ছে, প্রচলিত ব্যবস্থার অপব্যবহার খুব সহজেই সম্ভব হচ্ছে। সে কারণে বিদ্যমান ব্যবস্থাও বদলাতে হবে। আইনজীবী ও তাঁদের সহকারীদের বিষয়ে ডেটা ব্যাংক গড়তে হবে। বার কাউন্সিলকে সক্রিয় হতে হবে। জামিন দেওয়ার রীতিনীতিতেও পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।

No comments

Powered by Blogger.