কালের পুরাণ-মধ্যবর্তী নির্বাচনের জুজু ও দিন না-বদলের রাজনীতি by সোহরাব হাসান
যখন লিবিয়ায় আটকে পড়া হাজার হাজার বাংলাদেশি অবর্ণনীয় দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করছেন, যখন তাঁদের কেউ কেউ সর্বস্ব হারিয়ে খালি হাতে দেশে ফিরে বিমানবন্দরেই আহাজারি করছেন, তখন আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাঁদের প্রতি মৌখিক সান্ত্বনা জানানোরও প্রয়োজন বোধ করেন না। অতীতের মতো তাঁরা কাদা-ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত।
সোমবার টিভির খবরে শুনলাম, প্রধানমন্ত্রী লিবিয়ায় আটকে পড়া বাংলাদেশিদের উদ্ধারে পররাষ্ট্র এবং শ্রম ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। তারা কি প্রশংসনীয় কাজ করল, দেশবাসী জানে না। তবে পরদিন পত্রিকায় আতঙ্কজনক খবর বের হয়েছে, ত্রিপোলির বাংলাদেশ দূতাবাস লুট হয়েছে, কয়েকজন কর্মকর্তাকে জিম্মি করা হয়েছে। দূতাবাসের বাইরে দুই তরুণী নিহত হয়েছেন অস্ত্রধারীদের হাতে। দূতাবাসের সামনে হাজার হাজার বাংলাদেশি আশ্রয় ও সাহায্যের আশায় ভিড় করেছিলেন, তাঁদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, দূতাবাসের কেউ জানেন না। গোটা লিবিয়ায় এখন নৈরাজ্য চলছে, হিংসা ছড়িয়ে পড়ছে, বেঘোরে মানুষ মারা যাচ্ছে।
এ ধরনের ঘটনায় যেকোনো দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বেরই যারপরনাই উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমাদের মন্ত্রী-নেতাদের চামড়া বেশ পুরু। তাঁরা সহজে উদ্বিগ্ন হন না। সোমবার যে শতাধিক লিবিয়া-প্রবাসী দেশে ফিরে এসেছেন, তাতে সরকারের কোনো কৃতিত্ব নেই। তাঁরা এসেছেন নিয়োগদাতা কোম্পানির সহায়তায়। ভাগ্যবিড়ম্বিত এই মানুষগুলোকে সহমর্মিতা ও সহানুভূতি জানাতে মন্ত্রী-সচিব দূরে থাক, মন্ত্রণালয়েরও কোনো প্রতিনিধিও বিমানবন্দরে যাননি। যাননি ‘দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’ স্লোগান নিয়ে পরবর্তী নির্বাচনে জয়ের খোয়াব দেখা বিরোধী দলেরও কেউ। অথচ সরকারি ও বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীরা বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরলে মহাসমারোহে তাঁদের অভ্যর্থনা জানাতে দলীয় কর্মীরা প্রায়ই বিমানবন্দরে গিয়ে যানজটকবলিত নগরের রাস্তা বন্ধ করে দিতে দ্বিধা করেন না।
লিবিয়া-ফেরত বাংলাদেশিরা সেখানকার প্রবাসী ও স্বদেশি নাগরিকদের দুরবস্থার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা ভয়াবহ ও দুঃস্বপ্নের মতো। আমরা টিভিতে দেখেছি, রাস্তায় লাশ পড়ে আছে। গাদ্দাফির পেটোয়া বাহিনী অস্ত্র হাতে প্রতিপক্ষকে তাড়া করছে। যে যেখানে পারে লুটপাট করছে। দেশটির স্বঘোষিত ত্রাণকর্তা মুয়াম্মার গাদ্দাফি ভাড়াটে লোকদের জন্য অস্ত্রের মালখানা খুলে দিয়েছেন, দেশে রক্তের গঙ্গা বইয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর গুণধর পুত্র শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করার প্রতিজ্ঞা করেছেন। যদিও বেনগাজিসহ দেশের অধিকাংশ শহর ও এলাকা বিদ্রোহীদের দখলে। এ অবস্থায় সেখানে প্রতিটি মানুষকে প্রাণ হাতের মুঠোয় করে চলতে হয়। প্রতিবেশী তিউনিসিয়া ও মিসরে যাওয়ার জন্য যাঁরা সীমান্তে জড়ো হয়েছেন, তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নেই।
যে দূতাবাসকে আমরা আটকে পড়া বাংলাদেশিদের উদ্ধার ও দেশে ফেরত পাঠানোর শেষ ভরসা ভেবেছি, সেই দূতাবাসের কর্মকর্তারা এখন জিম্মি। হায় মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ! হায় মানবতা! এদিকে গণবিদ্রোহের শুরুতেই বাংলাদেশে লিবিয়ার রাষ্ট্রদূত গাদ্দাফির সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছেন। এ অবস্থায় আমাদের এগোতে হবে ধীরেসুস্থে। মাথা গরম করা চলবে না। ভবিষ্যতে সেখানে কোন ধরনের সরকার আসবে, কারা দেশ চালাবে, তার ওপর নজর রাখতে হবে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতা নিতে হবে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগেই বাংলাদেশ সরকারকে চেষ্টা চালাতে হবে দ্রুত বাংলাদেশিদের ফেরত আনার ব্যবস্থা করার। যেকোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত প্রবাসীদের জীবন বিপন্ন করতে পারে।
এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হলো, লিবিয়ায় ৪০-৫০ হাজার বাংলাদেশির খাদ্য, আশ্রয় ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আত্মীয়স্বজন তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনার দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন বিভিন্ন এলাকায়। তাঁদের কান্না ও ক্ষোভ কি ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনীতিকদের স্পর্শ করেছে? মনে হয় না। অন্তত তাঁদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে তার ছাপ নেই। লিবিয়া-প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে শ্রমিক যেমন আছেন, তেমনি আছেন শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীও। কর্নেল (অব.) আবদুর রশীদ নামের আরও একজন বাংলাদেশিকে লিবিয়া সরকার আশ্রয় দিয়েছে, যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। একসময় এই কর্নেল রশীদ নাকি মুয়াম্মার গাদ্দাফির সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। যেই সরকার একজন স্বঘোষিত খুনিকে উপদেষ্টা নিয়োগ করতে পারে, সেই সরকার জনগণের কল্যাণে কিছু করতে পারে না।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গাদ্দাফিকে নিয়ে এখন যতই ঠাট্টা-মশকরা করা হোক না কেন, স্নায়ুযুদ্ধের সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। গাদ্দাফি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে আমেরিকার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন, আবার পশ্চিমকে আশ্বস্ত করেছেন সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানের কথা জানিয়ে। বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির বিরুদ্ধে গ্রিনবুক প্রচারের পাশাপাশি ফারুক-রশীদ চক্রকে সাহায্য-সমর্থন করেছেন। কিন্তু ১৯৮৮ সালের লকারবি বিমান হামলার পর তাঁর প্রতি পশ্চিমাদের মোহ কাটতে থাকে। এবারও গণবিদ্রোহের সূচনায় তিনি আল-কায়েদার প্রতি সব দোষ চাপিয়ে পশ্চিমাদের সমর্থন লাভের চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু পশ্চিমারা অত নির্বোধ নয় যে তারা গাদ্দাফির ফাঁদে পা দেবে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র লিবিয়ার ওপর অবরোধ আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ নিন্দা প্রস্তাব নিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ বিশ্বনেতারা বলেছেন, এখনই গাদ্দাফিকে চলে যেতে হবে। এর পরও যদি তিনি চলে না যান, তাহলে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলবে, মানুষ মরবে। অর্থনীতি ধ্বংস হবে। আর যত দিন যাবে তত অনিশ্চিত হয়ে পড়বে আটকে পড়া প্রবাসীদের জীবন।
কিন্তু আমরা এই দেশে যারা আছি তাদের জীবন কতটা নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত? প্রতিদিন সন্ত্রাসীদের হাতে নারী-শিশু জীবন দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ জীবন দিচ্ছে। ক্ষমতার ২৬ মাসের মাথায় এসে সরকার সবকিছু যেন তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। সরকার যে কাজে হাত দেয়, তা তার বিপক্ষে চলে যায়। সরকারি দল একে বিরোধীদের ষড়যন্ত্র বলে কাটাতে চাইছে, আর বিরোধী দল দেখছে গণবিদ্রোহের পূর্বাভাস হিসেবে।
ঘরে-বাইরে এখন বাংলাদেশের মানুষ মহা সমস্যায় আছে, ভবিষ্যতে সমস্যাগুলো যে মহাসংকটে রূপ নেবে, তা নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল—কারও মাথাব্যথা নেই। থাকলে তারা অপ্রয়োজনীয়, ফালতু ও তুচ্ছ বিষয়গুলো নিয়ে এত ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ত না। মানুষকে বাঁচানোর উপায় নিয়ে উভয় পক্ষ আলোচনায় বসত, সরকার নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিত, বিরোধী দল সরকারি পরিকল্পায় ভুল থাকলে ধরিয়ে দিত, সৎ পরামর্শ দিত। কিন্তু বিরোধী দল ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছে, তারা সংসদে যাবে না। তাহলে আলোচনাটি হবে কোথায়?
এই মুহূর্তে দেশের মানুষের প্রধান সমস্যা নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, শেয়ারবাজারে ধস এবং আটকে পড়া শ্রমিকদের দেশে ফিরিয়ে আনা। কিন্তু সরকারি ও বিরোধী দল বাহাসে লিপ্ত হয়েছে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ, গণ-আদালতে বিচার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকা না-থাকা নিয়ে। নতুন বিমানবন্দর বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি এখন জরুরি নয়। জরুরি হলো নিত্যপণ্যের দাম কমানো, জরুরি হলো শেয়ারবাজারের ধস ঠেকানো।
বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ইতিমধ্যে সরকারকে মধ্যবর্তী নির্বাচন দিয়ে ‘মানসম্মান’ নিয়ে বিদায় নিতে বলেছেন, যেন মধ্যবর্তী নির্বাচন হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সরকার মধ্যবর্তী নির্বাচন না দিলে মানসম্মান নিয়ে কি বিদায় নিতে পারবে না? মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সাম্প্রতিক যে জনবিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছে, তাতে বিএনপির নেতারা অনেকখানি চাঙা। তাঁরা মনে করছেন, বাংলাদেশেও সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ তেতে আছে। তাঁদের এ ধারণা হয়তো অসত্য নয়। তবে বিরোধী দল ডাক দিলেই যে মানুষ দলে দলে রাস্তায় নেমে আসবে, সেই ভরসা কম। মানুষ কার পেছনে কাতারবন্দী হবে—খালেদা জিয়া, তারেক জিয়া বা কোকো জিয়ার? তাঁদের শাসনামলে কী হয়েছে, তা কি জনগণ এত সহজেই ভুলে যায়নি। বিএনপি ক্ষমতায় নেই, কিন্তু তাদের দুর্নীতি ও অপশাসনের জের এখনো দেশবাসীকে বইতে হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বর্তমান সরকারের অপকীর্তি। এভাবে ‘এ’ দলকে বাদ দিয়ে ‘বি’ দলকে কিংবা ‘বি’ দলকে বাদ দিয়ে ‘এ’ দলকে ক্ষমতায় আনার মহড়া দিতে মানুষ রাজি নয়।
দুই বছরের জরুরি শাসনের অবসানের পর মানুষ আশায় বুক বেঁধে দিনবদলের স্লোগানের প্রতি আস্থা রেখে আওয়ামী লীগকে ব্যাপকভাবে বিজয়ী করেছিল। কিন্তু দুই বছরের মাথায় এসে তারা দেখতে পারছে, কিছুই বদলাচ্ছে না। বিএনপির চেয়ারপারসনের বক্তব্যের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তাঁকে সংসদে এসে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি জানাতে বলেছেন। মধ্যবর্তী নির্বাচন কেন করা যাবে না, সেই যুক্তি সরকারি দল তুলে ধরবেন বলে জানিয়েছেন।
জাতীয় সংসদে মহাজোটের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। সে কারণে অনাস্থা ভোটে বিরোধী দলের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এখন বিপুল ভোটে বিজয়ী সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানানো কিংবা মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি তোলার ক্ষেত্র যে ক্ষমতাসীন দলই করে দিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। অনেক গুজব হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। আমরা সেসব গুজবে কান দিতে চাই না।
এবারে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতি পদে স্ববিরোধিতায় ভুগছে। তারা একদিকে তাদের নির্বাচনী প্রতীক নৌকায় ইসলামী ব্যাংকের লোগো লাগিয়েছে (বিশ্বাস না হলে বিশ্বকাপ উপলক্ষে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন মোড়ে স্থাপিত নৌকাগুলো দেখে আসতে পারেন) অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলছেন, ইসলামী ব্যাংক জঙ্গিদের অর্থায়ন করছে। তাহলে জনগণ কোনটি বিশ্বাস করবে? সরকার কি জেনেশুনে মৌলবাদী প্রতিষ্ঠানটির কাছে নতি স্বীকার করেছে? বাংলাদেশে কি আর একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেল না, যেটি বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে ঢাকা মহানগরের সৌন্দর্যবর্ধনের দায়িত্ব নিতে পারত।
সরকার অনেক টাকা খরচ করে উপজেলা নির্বাচন করেছে, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের জন্য অফিস ও গাড়ি বরাদ্দ করেছে, কিন্তু তাঁদের হাতে ক্ষমতা দিতে চাইছে না। এ নিয়ে গায়ে কাফনের কাপড় পরে আন্দোলনও হয়েছে। কিন্তু সাংসদেরা একবিন্দু কর্তৃত্বও ছাড়তে নারাজ।
সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে ক্ষমতায় এসেছে, কথায় কথায় বিএনপির সঙ্গে তাদের যে আদর্শগত পার্থক্য আছে, তা বলে বেড়ায়—বিএনপি স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, সাম্প্রদায়িতাকে উসকে দিচ্ছে, সংবিধানের মৌলনীতি বদলে দিয়েছে। আর আওয়ামী লীগ হলো খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষ দল। অতএব কোনোভাবেই বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের তুলনা চলে না। সাধারণ মানুষও তাদের এই কথায় আস্থা রেখে ভোট দিয়েছিলেন। এখন দেখছেন, আওয়ামী লীগ নেতারা মুখে যতই আদর্শের কথা বলুন, কাজে তার প্রতিফলন নেই। পুনর্মুদ্রিত সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা, বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্মের সহাবস্থান নিশ্চিত করা হয়েছে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও যখন একে সাংঘর্ষিক মনে করেন না, তখন হাসি সংবরণ করতে পারি না। তাহলে আর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সাংঘর্ষিক অবস্থান কি শুধুই ক্ষমতার? কেবল সাইনবোর্ড পাল্টিয়ে, মুখে আদর্শের কথা বললে যে দেশ ও জনগণের দিনবদল হয় না, সে কথাটি তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
এ ধরনের ঘটনায় যেকোনো দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বেরই যারপরনাই উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমাদের মন্ত্রী-নেতাদের চামড়া বেশ পুরু। তাঁরা সহজে উদ্বিগ্ন হন না। সোমবার যে শতাধিক লিবিয়া-প্রবাসী দেশে ফিরে এসেছেন, তাতে সরকারের কোনো কৃতিত্ব নেই। তাঁরা এসেছেন নিয়োগদাতা কোম্পানির সহায়তায়। ভাগ্যবিড়ম্বিত এই মানুষগুলোকে সহমর্মিতা ও সহানুভূতি জানাতে মন্ত্রী-সচিব দূরে থাক, মন্ত্রণালয়েরও কোনো প্রতিনিধিও বিমানবন্দরে যাননি। যাননি ‘দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’ স্লোগান নিয়ে পরবর্তী নির্বাচনে জয়ের খোয়াব দেখা বিরোধী দলেরও কেউ। অথচ সরকারি ও বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীরা বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরলে মহাসমারোহে তাঁদের অভ্যর্থনা জানাতে দলীয় কর্মীরা প্রায়ই বিমানবন্দরে গিয়ে যানজটকবলিত নগরের রাস্তা বন্ধ করে দিতে দ্বিধা করেন না।
লিবিয়া-ফেরত বাংলাদেশিরা সেখানকার প্রবাসী ও স্বদেশি নাগরিকদের দুরবস্থার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা ভয়াবহ ও দুঃস্বপ্নের মতো। আমরা টিভিতে দেখেছি, রাস্তায় লাশ পড়ে আছে। গাদ্দাফির পেটোয়া বাহিনী অস্ত্র হাতে প্রতিপক্ষকে তাড়া করছে। যে যেখানে পারে লুটপাট করছে। দেশটির স্বঘোষিত ত্রাণকর্তা মুয়াম্মার গাদ্দাফি ভাড়াটে লোকদের জন্য অস্ত্রের মালখানা খুলে দিয়েছেন, দেশে রক্তের গঙ্গা বইয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর গুণধর পুত্র শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করার প্রতিজ্ঞা করেছেন। যদিও বেনগাজিসহ দেশের অধিকাংশ শহর ও এলাকা বিদ্রোহীদের দখলে। এ অবস্থায় সেখানে প্রতিটি মানুষকে প্রাণ হাতের মুঠোয় করে চলতে হয়। প্রতিবেশী তিউনিসিয়া ও মিসরে যাওয়ার জন্য যাঁরা সীমান্তে জড়ো হয়েছেন, তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নেই।
যে দূতাবাসকে আমরা আটকে পড়া বাংলাদেশিদের উদ্ধার ও দেশে ফেরত পাঠানোর শেষ ভরসা ভেবেছি, সেই দূতাবাসের কর্মকর্তারা এখন জিম্মি। হায় মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ! হায় মানবতা! এদিকে গণবিদ্রোহের শুরুতেই বাংলাদেশে লিবিয়ার রাষ্ট্রদূত গাদ্দাফির সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছেন। এ অবস্থায় আমাদের এগোতে হবে ধীরেসুস্থে। মাথা গরম করা চলবে না। ভবিষ্যতে সেখানে কোন ধরনের সরকার আসবে, কারা দেশ চালাবে, তার ওপর নজর রাখতে হবে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতা নিতে হবে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগেই বাংলাদেশ সরকারকে চেষ্টা চালাতে হবে দ্রুত বাংলাদেশিদের ফেরত আনার ব্যবস্থা করার। যেকোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত প্রবাসীদের জীবন বিপন্ন করতে পারে।
এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হলো, লিবিয়ায় ৪০-৫০ হাজার বাংলাদেশির খাদ্য, আশ্রয় ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আত্মীয়স্বজন তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনার দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন বিভিন্ন এলাকায়। তাঁদের কান্না ও ক্ষোভ কি ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনীতিকদের স্পর্শ করেছে? মনে হয় না। অন্তত তাঁদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে তার ছাপ নেই। লিবিয়া-প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে শ্রমিক যেমন আছেন, তেমনি আছেন শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীও। কর্নেল (অব.) আবদুর রশীদ নামের আরও একজন বাংলাদেশিকে লিবিয়া সরকার আশ্রয় দিয়েছে, যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। একসময় এই কর্নেল রশীদ নাকি মুয়াম্মার গাদ্দাফির সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। যেই সরকার একজন স্বঘোষিত খুনিকে উপদেষ্টা নিয়োগ করতে পারে, সেই সরকার জনগণের কল্যাণে কিছু করতে পারে না।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গাদ্দাফিকে নিয়ে এখন যতই ঠাট্টা-মশকরা করা হোক না কেন, স্নায়ুযুদ্ধের সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। গাদ্দাফি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে আমেরিকার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন, আবার পশ্চিমকে আশ্বস্ত করেছেন সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানের কথা জানিয়ে। বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির বিরুদ্ধে গ্রিনবুক প্রচারের পাশাপাশি ফারুক-রশীদ চক্রকে সাহায্য-সমর্থন করেছেন। কিন্তু ১৯৮৮ সালের লকারবি বিমান হামলার পর তাঁর প্রতি পশ্চিমাদের মোহ কাটতে থাকে। এবারও গণবিদ্রোহের সূচনায় তিনি আল-কায়েদার প্রতি সব দোষ চাপিয়ে পশ্চিমাদের সমর্থন লাভের চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু পশ্চিমারা অত নির্বোধ নয় যে তারা গাদ্দাফির ফাঁদে পা দেবে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র লিবিয়ার ওপর অবরোধ আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ নিন্দা প্রস্তাব নিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ বিশ্বনেতারা বলেছেন, এখনই গাদ্দাফিকে চলে যেতে হবে। এর পরও যদি তিনি চলে না যান, তাহলে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলবে, মানুষ মরবে। অর্থনীতি ধ্বংস হবে। আর যত দিন যাবে তত অনিশ্চিত হয়ে পড়বে আটকে পড়া প্রবাসীদের জীবন।
কিন্তু আমরা এই দেশে যারা আছি তাদের জীবন কতটা নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত? প্রতিদিন সন্ত্রাসীদের হাতে নারী-শিশু জীবন দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ জীবন দিচ্ছে। ক্ষমতার ২৬ মাসের মাথায় এসে সরকার সবকিছু যেন তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। সরকার যে কাজে হাত দেয়, তা তার বিপক্ষে চলে যায়। সরকারি দল একে বিরোধীদের ষড়যন্ত্র বলে কাটাতে চাইছে, আর বিরোধী দল দেখছে গণবিদ্রোহের পূর্বাভাস হিসেবে।
ঘরে-বাইরে এখন বাংলাদেশের মানুষ মহা সমস্যায় আছে, ভবিষ্যতে সমস্যাগুলো যে মহাসংকটে রূপ নেবে, তা নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল—কারও মাথাব্যথা নেই। থাকলে তারা অপ্রয়োজনীয়, ফালতু ও তুচ্ছ বিষয়গুলো নিয়ে এত ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ত না। মানুষকে বাঁচানোর উপায় নিয়ে উভয় পক্ষ আলোচনায় বসত, সরকার নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিত, বিরোধী দল সরকারি পরিকল্পায় ভুল থাকলে ধরিয়ে দিত, সৎ পরামর্শ দিত। কিন্তু বিরোধী দল ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছে, তারা সংসদে যাবে না। তাহলে আলোচনাটি হবে কোথায়?
এই মুহূর্তে দেশের মানুষের প্রধান সমস্যা নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, শেয়ারবাজারে ধস এবং আটকে পড়া শ্রমিকদের দেশে ফিরিয়ে আনা। কিন্তু সরকারি ও বিরোধী দল বাহাসে লিপ্ত হয়েছে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ, গণ-আদালতে বিচার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকা না-থাকা নিয়ে। নতুন বিমানবন্দর বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি এখন জরুরি নয়। জরুরি হলো নিত্যপণ্যের দাম কমানো, জরুরি হলো শেয়ারবাজারের ধস ঠেকানো।
বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ইতিমধ্যে সরকারকে মধ্যবর্তী নির্বাচন দিয়ে ‘মানসম্মান’ নিয়ে বিদায় নিতে বলেছেন, যেন মধ্যবর্তী নির্বাচন হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সরকার মধ্যবর্তী নির্বাচন না দিলে মানসম্মান নিয়ে কি বিদায় নিতে পারবে না? মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সাম্প্রতিক যে জনবিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছে, তাতে বিএনপির নেতারা অনেকখানি চাঙা। তাঁরা মনে করছেন, বাংলাদেশেও সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ তেতে আছে। তাঁদের এ ধারণা হয়তো অসত্য নয়। তবে বিরোধী দল ডাক দিলেই যে মানুষ দলে দলে রাস্তায় নেমে আসবে, সেই ভরসা কম। মানুষ কার পেছনে কাতারবন্দী হবে—খালেদা জিয়া, তারেক জিয়া বা কোকো জিয়ার? তাঁদের শাসনামলে কী হয়েছে, তা কি জনগণ এত সহজেই ভুলে যায়নি। বিএনপি ক্ষমতায় নেই, কিন্তু তাদের দুর্নীতি ও অপশাসনের জের এখনো দেশবাসীকে বইতে হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বর্তমান সরকারের অপকীর্তি। এভাবে ‘এ’ দলকে বাদ দিয়ে ‘বি’ দলকে কিংবা ‘বি’ দলকে বাদ দিয়ে ‘এ’ দলকে ক্ষমতায় আনার মহড়া দিতে মানুষ রাজি নয়।
দুই বছরের জরুরি শাসনের অবসানের পর মানুষ আশায় বুক বেঁধে দিনবদলের স্লোগানের প্রতি আস্থা রেখে আওয়ামী লীগকে ব্যাপকভাবে বিজয়ী করেছিল। কিন্তু দুই বছরের মাথায় এসে তারা দেখতে পারছে, কিছুই বদলাচ্ছে না। বিএনপির চেয়ারপারসনের বক্তব্যের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তাঁকে সংসদে এসে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি জানাতে বলেছেন। মধ্যবর্তী নির্বাচন কেন করা যাবে না, সেই যুক্তি সরকারি দল তুলে ধরবেন বলে জানিয়েছেন।
জাতীয় সংসদে মহাজোটের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। সে কারণে অনাস্থা ভোটে বিরোধী দলের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এখন বিপুল ভোটে বিজয়ী সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানানো কিংবা মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি তোলার ক্ষেত্র যে ক্ষমতাসীন দলই করে দিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। অনেক গুজব হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। আমরা সেসব গুজবে কান দিতে চাই না।
এবারে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতি পদে স্ববিরোধিতায় ভুগছে। তারা একদিকে তাদের নির্বাচনী প্রতীক নৌকায় ইসলামী ব্যাংকের লোগো লাগিয়েছে (বিশ্বাস না হলে বিশ্বকাপ উপলক্ষে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন মোড়ে স্থাপিত নৌকাগুলো দেখে আসতে পারেন) অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলছেন, ইসলামী ব্যাংক জঙ্গিদের অর্থায়ন করছে। তাহলে জনগণ কোনটি বিশ্বাস করবে? সরকার কি জেনেশুনে মৌলবাদী প্রতিষ্ঠানটির কাছে নতি স্বীকার করেছে? বাংলাদেশে কি আর একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেল না, যেটি বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে ঢাকা মহানগরের সৌন্দর্যবর্ধনের দায়িত্ব নিতে পারত।
সরকার অনেক টাকা খরচ করে উপজেলা নির্বাচন করেছে, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের জন্য অফিস ও গাড়ি বরাদ্দ করেছে, কিন্তু তাঁদের হাতে ক্ষমতা দিতে চাইছে না। এ নিয়ে গায়ে কাফনের কাপড় পরে আন্দোলনও হয়েছে। কিন্তু সাংসদেরা একবিন্দু কর্তৃত্বও ছাড়তে নারাজ।
সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে ক্ষমতায় এসেছে, কথায় কথায় বিএনপির সঙ্গে তাদের যে আদর্শগত পার্থক্য আছে, তা বলে বেড়ায়—বিএনপি স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, সাম্প্রদায়িতাকে উসকে দিচ্ছে, সংবিধানের মৌলনীতি বদলে দিয়েছে। আর আওয়ামী লীগ হলো খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষ দল। অতএব কোনোভাবেই বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের তুলনা চলে না। সাধারণ মানুষও তাদের এই কথায় আস্থা রেখে ভোট দিয়েছিলেন। এখন দেখছেন, আওয়ামী লীগ নেতারা মুখে যতই আদর্শের কথা বলুন, কাজে তার প্রতিফলন নেই। পুনর্মুদ্রিত সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা, বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্মের সহাবস্থান নিশ্চিত করা হয়েছে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও যখন একে সাংঘর্ষিক মনে করেন না, তখন হাসি সংবরণ করতে পারি না। তাহলে আর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সাংঘর্ষিক অবস্থান কি শুধুই ক্ষমতার? কেবল সাইনবোর্ড পাল্টিয়ে, মুখে আদর্শের কথা বললে যে দেশ ও জনগণের দিনবদল হয় না, সে কথাটি তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments