গদ্যকার্টুন-একটি হাস্যময় অভিযান by আনিসুল হক
বছর দুয়েক আগের কথা। আমেরিকার হিউস্টনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মিলনমেলা বসেছে। তার মূল বিষয় ছিল মুক্তিযুদ্ধ। ঢাকা থেকে গেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, আক্কু চৌধুরী প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কিছু প্রদর্শনযোগ্য জিনিসও নেওয়া হয়েছে প্রদর্শনীর জন্য।
এর মধ্যে একটা আয়োজন হলো মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্মিলনী ও স্মৃতিচারণা। হিলটন হোটেলে নাসির উদ্দীন ইউসুফের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন একজন মধ্যবয়সী বাংলাদেশি। মোটাসোটা ধরনের মানুষ। চেহারার মধ্যেই একটা ভালোমানুষি ভাব। তিনি নাসির উদ্দীন ইউসুফের সামনে এসে সটান দাঁড়িয়ে পড়লেন। সৈনিকের কায়দায় অভিবাদন জানালেন পা ঠুকে, হাত চোখ বরাবর তুলে। তারপর তাঁরা পরস্পরকে ধরলেন জড়িয়ে। শুরু হলো কান্না। দুজনই কাঁদছেন।
নাসির উদ্দীন ইউসুফ বললেন আমাকে, ‘চিনেছ? এ হলো মুনির। আমার মুক্তিযোদ্ধা দলের মুনির। জানো, কত দিন পরে যে মুনিরের সঙ্গে দেখা হলো!’
মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিতর্পণ পর্বে মুনির যখন তাঁর মহাবিপজ্জনক অপারেশনের গল্প করছিলেন, শ্রোতারা হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছিল।
গল্প বলার সেই ঢংটা আমি ভুলতে পারি না। বারবার মনে হয়, তাঁর মতো করে যদি গল্প বলতে পারতাম!
মুনির এখন বাংলাদেশে। আমেরিকা থেকে চলে এসেছেন। এখন ফেনীতে ভাইদের বাড়ি বানানোর কাজ নিয়ে ব্যস্ত। আজ পয়লা মার্চ। স্বাধীনতার চার দশক পূর্তির এই বছরে স্বাধীনতার মাসের আজ প্রথম দিন। গদ্যকার্টুনে কী লেখা যায়? মনে হলো, মুক্তিযোদ্ধা মুনিরের সেই গল্পটা তাঁর জবানিতেই শুনি না কেন?
আবু তাহের মোহাম্মদ মুনির উদ্দিন তাঁর পুরো নাম।
তিনি বলছেন:
আমরা, সেক্টর টুর গেরিলারা, ঢাকায় নানা অভিযানে অংশ নিচ্ছি। মাসটা, যত দূর মনে পড়ে, অক্টোবর। ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে খবর এল, টাকা দরকার। আমাদের ছেলেরা ঠিকভাবে সেখানে খাবার পাচ্ছে না। টাকা জোগাড় করো।
তখন আমরা ঠিক করলাম, আমরা একটা ব্যাংক ডাকাতি করব। আমাদের কমান্ডার রেজাউল করিম মানিক, পরে শহীদ হন, উনিও পল্টনের। সহকারী কমান্ডার নাসির উদ্দীন ইউসুফ, তিনিও পল্টন এলাকার। তখন আমাদের চোখ পড়ল জোনাকি সিনেমা হলের কাছে পলওয়েল সুপার মার্কেটের মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকের ওপর। এই ব্যাংক ডাকাতি করতে হবে। আমরা রেকি করে এলাম দুই দিন। তখন মার্কেটটা ছিল একতলা। নিচে ব্যাংকটা চালু হয়েছে আর রাস্তার বিপরীত দিকে কতগুলো অসমাপ্ত দোকানের কাজ চলছে। একজন গাট্টাগোট্টামতো দ্বাররক্ষী রাইফেল হাতে সেই ব্যাংকের দরজায় বসে থাকে। তার চোখ থাকে ওই দোকানগুলোর নির্মাণকাজের দিকে। রাস্তার দিকে সে তাকায় না। দুই দিনই আমরা সেই একই দৃশ্য দেখলাম।
তারপর আমরা অপারেশনের পরিকল্পনা করে ফেললাম। আসাদ (রাইসুল ইসলাম আসাদ, এখন খ্যাতিমান অভিনেতা) সঙ্গে নেবে একটা স্টেনগান। আমি নেব একটা খেলনা পিস্তল। দারোয়ানের কাছ থেকে রাইফেলটা কেড়ে নিতে পারলেই বাকি কাজ হয়ে যাবে।
আসাদ স্টেনগানটা নিল একটা কম্বলে পেঁচিয়ে। আমরা রওনা হলাম রিকশায়। আমি আর ফিরোজ একটা রিকশায়। আসাদ আরেকটায়। আরও বোধহয় জন আর ফেরদৌস ছিল। আরিফ নামের একজন মুক্তিযোদ্ধার বাবা ছিলেন পীরসাহেব। তাঁর ছিল কালো মরিস মাইনর গাড়ি। সেটা নিয়ে আরিফ ব্যাংকের উল্টো দিকে গিয়ে দাঁড় করাল। জন আগে থেকেই সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। সে সিগন্যাল দিল, অল ক্লিয়ার। আমি আর ফিরোজ এগিয়ে যেতে লাগলাম ব্যাংকের দিকে। স্টেনগান নিয়ে আসাদ রাস্তার এই ধারেই রিকশায় বসা। ২০০ গজ দূরে রাস্তায় দুটো পাকিস্তানি আর্মির ট্রাক দেখা যাচ্ছে।
আমি আর ফিরোজ রাস্তা পার হলাম। গিয়ে দেখি, বিধি বাম! প্রতিদিন দারোয়ান কনস্ট্রাকশনের দিকে মুখ করে বসে থাকে, আজ সে তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। আমাদের চোখের দিকে তার চোখ। তাই আর সরাসরি তার বুকে পিস্তল না ঠেকিয়ে প্রথমে ভেতরে গেলাম। আর তা দেখে আসাদ ভাবল, আমরা ব্যাংক ডাকাতির পরিকল্পনা বাদ দিয়েছি। সে তার স্টেনগান নিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করল।
আমি আর ফিরোজ বের হয়ে এলাম। আমি ফিরোজকে বললাম, ‘যা, আসাদকে ডেকে আন।’ ফিরোজ আসাদকে খুঁজতে গেল। আমি দেখলাম, দারোয়ান একটু অন্যমনস্ক হয়েছে। এই সুযোগ। আমার খেলনা পিস্তল তার পিঠে ঠেকিয়ে বললাম, ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধা, রাইফেলটা দিয়ে দাও, না হলে গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেব।’ দারোয়ান সঙ্গে সঙ্গে কাঁধ থেকে রাইফেল নামানোর চেষ্টা করতে লাগল। আমি এক হাতে খেলনা পিস্তল নিয়ে অন্য হাতে তার রাইফেল ধরে ঝুলে পড়লাম বাদুড়ের মতো। একফাঁকে তাকে ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে ফেললাম ব্যাংকের ভেতর। ম্যানেজারকে বললাম, ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধা, টাকা লুট করতে এসেছি। ভালোয় ভালোয় রাইফেলটা আপনার গার্ডকে ছাড়তে বলেন।’ ওই ম্যানেজারই সেদিন আমার জীবন বাঁচিয়েছিল। ম্যানেজার বলল, ‘রাইফেল ছাড়ো।’ দারোয়ান রাইফেল ছাড়ল। ততক্ষণে ফিরোজও এসে পড়েছে। আমার খেলনা পিস্তল উঁচিয়ে আমরা ক্যাশবাক্স থেকে টাকা বের করলাম। এখন নেব কীভাবে? কোনো ব্যাগ-থলে আনিনি। আমার শার্টটা খুললাম। সেই শার্টের ভেতর টাকা রাখা হলো।
আমরা বেরিয়ে আসছি। ততক্ষণে ব্যাংকের সামনে জনতার ভিড় লেগে গেছে। আমরা বেরোনো-মাত্র নদীর পানি দুই ভাগ হয়ে যাওয়ার মতো করে জনতা দুই ভাগে ভাগ হয়ে আমাদের রাস্তা করে দিল। রাস্তা পার হচ্ছি। শার্টের দুই হাতের ফাঁক গলে টাকা পড়তে লাগল। আর লোকজন তালি দিয়ে উঠল। তারা বলাবলি করতে লাগল, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা।
দৌড়ে গিয়ে আরিফের গাড়িতে উঠব। গাড়ি স্টার্ট দেওয়াই ছিল। ফিরোজ উঠেছে। আমি তখনো উঠিনি। অমনি আরিফ উত্তেজনায় গাড়ি চালাতে শুরু করে দিয়েছে। আমি লাফিয়ে গাড়ির জানালা ধরে আবার বাদুড়ঝোলার মতো ঝুলে রইলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর আরিফ গাড়ি থামাল। আমি ঠিকভাবে ভেতরে গিয়ে বসলাম। গাড়ি আমাদের নিয়ে গেল নওরতন কলোনিতে।
মুনির ভাই এরপর শোনালেন আরেকটা কাহিনি। তাঁরা, মুক্তিযোদ্ধারা, সবাই নৌকায় করে সীমান্ত থেকে ঢাকার দিকে আসতেন। ওইভাবে আসতে গিয়েই ব্রিজের কাছে পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে ফরিদপুরের জনা ত্রিশেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন। তাঁরাও একবার বিপদে পড়েছিলেন। নৌকায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আসছেন রাতের অন্ধকার চিরে। ঘুম ভাঙল তাঁর গুলির শব্দে। নৌকা থেকে লাফিয়ে নামলেন। গুলি আসছে ব্রিজের ওপর থেকে। নৌকাটা সরিয়ে ওই ওদিকে খাঁড়ির ভেতর নিয়ে যেতে পারলে গুলির রেঞ্জের বাইরে তাঁরা যেতে পারেন। কিন্তু একি! কে যেন তাঁর পা টেনে নিচে নিয়ে যেতে চাইছে তাঁকে। ছোটবেলায় শুনেছিলেন পানির মধ্যে শেকল থাকে। সেই শেকল পা ধরে টেনে মানুষকে ডুবিয়ে মারে। তিনি সেই শেকল ধরে টান মারলেন। উঠে এল সহমুক্তিযোদ্ধা ইফু। সে সাঁতার জানে না। তাকে বললেন, ‘তুই নৌকায় ওঠ।’ সে বলল, ‘উঠতে পারব না। আমার লুঙ্গি হারিয়ে গেছে।’
‘আরে রাখ তোর লুঙ্গি। আগে বাঁচ।’
এমনি করে তাঁরা পৌঁছালেন নিরাপদ একটা জনপদে। মুক্তিযোদ্ধারা একে একে জড়ো হয়েছেন সেখানে। তাঁরা থাকবেন কই? মুনির বলছেন: আমাদের ভাগ করে দেওয়া হলো, একেকজন থাকব একেকজন গ্রামবাসীর ঘরে। রাতটা পার করব। আমাকে দেওয়া হলো এক রিকশাওয়ালার সঙ্গে। গভীর রাতে আমি হাজির হলাম তার ঘরে। রিকশাওয়ালা তার বউকে ডেকে বলল, ‘মুক্তিযোদ্ধা আইছে, ভাত রান্দো।’
‘ভাত তো রান্দুম। তরকারি কী দিবা?’
‘মুরগিটা জবাই করো।’
‘ডিম-পাড়া মুরগি জবাই করবা?’
আমি বললাম, ‘না না, ডিমপাড়া মুরগি জবাই করতে হবে না। একটা ডিম ভেজে দিলেই হবে।’ যখন বলছি, তখনই মুরগিটা শেষবারের মতো কক করে উঠল। জবাই হয়ে গেছে।
মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের মোহাম্মদ মুনির উদ্দিন, গতকাল ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১১, ৪০ বছর আগের এক রিকশাওয়ালা পরিবারের সেই আতিথেয়তার কথা, ভালোবাসার কথা মনে করে টেলিফোনে কাঁদতে লাগলেন। তিনি এখন ফেনীতে। আমি বসে আছি ঢাকায়। টেলিফোনে তাঁর কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প রেকর্ড করে নিচ্ছি। কিসের গল্প, ফোনে শুধু আসছে মুনির ভাইয়ের কান্নার শব্দ। কাঁদতে কাঁদতেই তিনি বলেন, ‘সরি ভাই, আবেগপ্রবণ হয়ে যাচ্ছি।’
এই কান্নার সঙ্গে আমি আগে থেকেই পরিচিত। বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদত চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিতে যেতাম তাঁর বাসায়, ২০০২/২০০৩ সালে। প্রতিবার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়তেন শিশুর মতো।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বড় ভালোবাসার ধন। বড় দুর্বলতার জায়গা। মুক্তিযুদ্ধের অনেক বীরত্বের গল্প, হাসির ঘটনার সঙ্গেও অনেক ভালোবাসার অশ্রু মাখা আছে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
নাসির উদ্দীন ইউসুফ বললেন আমাকে, ‘চিনেছ? এ হলো মুনির। আমার মুক্তিযোদ্ধা দলের মুনির। জানো, কত দিন পরে যে মুনিরের সঙ্গে দেখা হলো!’
মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিতর্পণ পর্বে মুনির যখন তাঁর মহাবিপজ্জনক অপারেশনের গল্প করছিলেন, শ্রোতারা হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছিল।
গল্প বলার সেই ঢংটা আমি ভুলতে পারি না। বারবার মনে হয়, তাঁর মতো করে যদি গল্প বলতে পারতাম!
মুনির এখন বাংলাদেশে। আমেরিকা থেকে চলে এসেছেন। এখন ফেনীতে ভাইদের বাড়ি বানানোর কাজ নিয়ে ব্যস্ত। আজ পয়লা মার্চ। স্বাধীনতার চার দশক পূর্তির এই বছরে স্বাধীনতার মাসের আজ প্রথম দিন। গদ্যকার্টুনে কী লেখা যায়? মনে হলো, মুক্তিযোদ্ধা মুনিরের সেই গল্পটা তাঁর জবানিতেই শুনি না কেন?
আবু তাহের মোহাম্মদ মুনির উদ্দিন তাঁর পুরো নাম।
তিনি বলছেন:
আমরা, সেক্টর টুর গেরিলারা, ঢাকায় নানা অভিযানে অংশ নিচ্ছি। মাসটা, যত দূর মনে পড়ে, অক্টোবর। ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে খবর এল, টাকা দরকার। আমাদের ছেলেরা ঠিকভাবে সেখানে খাবার পাচ্ছে না। টাকা জোগাড় করো।
তখন আমরা ঠিক করলাম, আমরা একটা ব্যাংক ডাকাতি করব। আমাদের কমান্ডার রেজাউল করিম মানিক, পরে শহীদ হন, উনিও পল্টনের। সহকারী কমান্ডার নাসির উদ্দীন ইউসুফ, তিনিও পল্টন এলাকার। তখন আমাদের চোখ পড়ল জোনাকি সিনেমা হলের কাছে পলওয়েল সুপার মার্কেটের মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকের ওপর। এই ব্যাংক ডাকাতি করতে হবে। আমরা রেকি করে এলাম দুই দিন। তখন মার্কেটটা ছিল একতলা। নিচে ব্যাংকটা চালু হয়েছে আর রাস্তার বিপরীত দিকে কতগুলো অসমাপ্ত দোকানের কাজ চলছে। একজন গাট্টাগোট্টামতো দ্বাররক্ষী রাইফেল হাতে সেই ব্যাংকের দরজায় বসে থাকে। তার চোখ থাকে ওই দোকানগুলোর নির্মাণকাজের দিকে। রাস্তার দিকে সে তাকায় না। দুই দিনই আমরা সেই একই দৃশ্য দেখলাম।
তারপর আমরা অপারেশনের পরিকল্পনা করে ফেললাম। আসাদ (রাইসুল ইসলাম আসাদ, এখন খ্যাতিমান অভিনেতা) সঙ্গে নেবে একটা স্টেনগান। আমি নেব একটা খেলনা পিস্তল। দারোয়ানের কাছ থেকে রাইফেলটা কেড়ে নিতে পারলেই বাকি কাজ হয়ে যাবে।
আসাদ স্টেনগানটা নিল একটা কম্বলে পেঁচিয়ে। আমরা রওনা হলাম রিকশায়। আমি আর ফিরোজ একটা রিকশায়। আসাদ আরেকটায়। আরও বোধহয় জন আর ফেরদৌস ছিল। আরিফ নামের একজন মুক্তিযোদ্ধার বাবা ছিলেন পীরসাহেব। তাঁর ছিল কালো মরিস মাইনর গাড়ি। সেটা নিয়ে আরিফ ব্যাংকের উল্টো দিকে গিয়ে দাঁড় করাল। জন আগে থেকেই সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। সে সিগন্যাল দিল, অল ক্লিয়ার। আমি আর ফিরোজ এগিয়ে যেতে লাগলাম ব্যাংকের দিকে। স্টেনগান নিয়ে আসাদ রাস্তার এই ধারেই রিকশায় বসা। ২০০ গজ দূরে রাস্তায় দুটো পাকিস্তানি আর্মির ট্রাক দেখা যাচ্ছে।
আমি আর ফিরোজ রাস্তা পার হলাম। গিয়ে দেখি, বিধি বাম! প্রতিদিন দারোয়ান কনস্ট্রাকশনের দিকে মুখ করে বসে থাকে, আজ সে তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। আমাদের চোখের দিকে তার চোখ। তাই আর সরাসরি তার বুকে পিস্তল না ঠেকিয়ে প্রথমে ভেতরে গেলাম। আর তা দেখে আসাদ ভাবল, আমরা ব্যাংক ডাকাতির পরিকল্পনা বাদ দিয়েছি। সে তার স্টেনগান নিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করল।
আমি আর ফিরোজ বের হয়ে এলাম। আমি ফিরোজকে বললাম, ‘যা, আসাদকে ডেকে আন।’ ফিরোজ আসাদকে খুঁজতে গেল। আমি দেখলাম, দারোয়ান একটু অন্যমনস্ক হয়েছে। এই সুযোগ। আমার খেলনা পিস্তল তার পিঠে ঠেকিয়ে বললাম, ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধা, রাইফেলটা দিয়ে দাও, না হলে গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেব।’ দারোয়ান সঙ্গে সঙ্গে কাঁধ থেকে রাইফেল নামানোর চেষ্টা করতে লাগল। আমি এক হাতে খেলনা পিস্তল নিয়ে অন্য হাতে তার রাইফেল ধরে ঝুলে পড়লাম বাদুড়ের মতো। একফাঁকে তাকে ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে ফেললাম ব্যাংকের ভেতর। ম্যানেজারকে বললাম, ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধা, টাকা লুট করতে এসেছি। ভালোয় ভালোয় রাইফেলটা আপনার গার্ডকে ছাড়তে বলেন।’ ওই ম্যানেজারই সেদিন আমার জীবন বাঁচিয়েছিল। ম্যানেজার বলল, ‘রাইফেল ছাড়ো।’ দারোয়ান রাইফেল ছাড়ল। ততক্ষণে ফিরোজও এসে পড়েছে। আমার খেলনা পিস্তল উঁচিয়ে আমরা ক্যাশবাক্স থেকে টাকা বের করলাম। এখন নেব কীভাবে? কোনো ব্যাগ-থলে আনিনি। আমার শার্টটা খুললাম। সেই শার্টের ভেতর টাকা রাখা হলো।
আমরা বেরিয়ে আসছি। ততক্ষণে ব্যাংকের সামনে জনতার ভিড় লেগে গেছে। আমরা বেরোনো-মাত্র নদীর পানি দুই ভাগ হয়ে যাওয়ার মতো করে জনতা দুই ভাগে ভাগ হয়ে আমাদের রাস্তা করে দিল। রাস্তা পার হচ্ছি। শার্টের দুই হাতের ফাঁক গলে টাকা পড়তে লাগল। আর লোকজন তালি দিয়ে উঠল। তারা বলাবলি করতে লাগল, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা।
দৌড়ে গিয়ে আরিফের গাড়িতে উঠব। গাড়ি স্টার্ট দেওয়াই ছিল। ফিরোজ উঠেছে। আমি তখনো উঠিনি। অমনি আরিফ উত্তেজনায় গাড়ি চালাতে শুরু করে দিয়েছে। আমি লাফিয়ে গাড়ির জানালা ধরে আবার বাদুড়ঝোলার মতো ঝুলে রইলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর আরিফ গাড়ি থামাল। আমি ঠিকভাবে ভেতরে গিয়ে বসলাম। গাড়ি আমাদের নিয়ে গেল নওরতন কলোনিতে।
মুনির ভাই এরপর শোনালেন আরেকটা কাহিনি। তাঁরা, মুক্তিযোদ্ধারা, সবাই নৌকায় করে সীমান্ত থেকে ঢাকার দিকে আসতেন। ওইভাবে আসতে গিয়েই ব্রিজের কাছে পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে ফরিদপুরের জনা ত্রিশেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন। তাঁরাও একবার বিপদে পড়েছিলেন। নৌকায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আসছেন রাতের অন্ধকার চিরে। ঘুম ভাঙল তাঁর গুলির শব্দে। নৌকা থেকে লাফিয়ে নামলেন। গুলি আসছে ব্রিজের ওপর থেকে। নৌকাটা সরিয়ে ওই ওদিকে খাঁড়ির ভেতর নিয়ে যেতে পারলে গুলির রেঞ্জের বাইরে তাঁরা যেতে পারেন। কিন্তু একি! কে যেন তাঁর পা টেনে নিচে নিয়ে যেতে চাইছে তাঁকে। ছোটবেলায় শুনেছিলেন পানির মধ্যে শেকল থাকে। সেই শেকল পা ধরে টেনে মানুষকে ডুবিয়ে মারে। তিনি সেই শেকল ধরে টান মারলেন। উঠে এল সহমুক্তিযোদ্ধা ইফু। সে সাঁতার জানে না। তাকে বললেন, ‘তুই নৌকায় ওঠ।’ সে বলল, ‘উঠতে পারব না। আমার লুঙ্গি হারিয়ে গেছে।’
‘আরে রাখ তোর লুঙ্গি। আগে বাঁচ।’
এমনি করে তাঁরা পৌঁছালেন নিরাপদ একটা জনপদে। মুক্তিযোদ্ধারা একে একে জড়ো হয়েছেন সেখানে। তাঁরা থাকবেন কই? মুনির বলছেন: আমাদের ভাগ করে দেওয়া হলো, একেকজন থাকব একেকজন গ্রামবাসীর ঘরে। রাতটা পার করব। আমাকে দেওয়া হলো এক রিকশাওয়ালার সঙ্গে। গভীর রাতে আমি হাজির হলাম তার ঘরে। রিকশাওয়ালা তার বউকে ডেকে বলল, ‘মুক্তিযোদ্ধা আইছে, ভাত রান্দো।’
‘ভাত তো রান্দুম। তরকারি কী দিবা?’
‘মুরগিটা জবাই করো।’
‘ডিম-পাড়া মুরগি জবাই করবা?’
আমি বললাম, ‘না না, ডিমপাড়া মুরগি জবাই করতে হবে না। একটা ডিম ভেজে দিলেই হবে।’ যখন বলছি, তখনই মুরগিটা শেষবারের মতো কক করে উঠল। জবাই হয়ে গেছে।
মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের মোহাম্মদ মুনির উদ্দিন, গতকাল ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১১, ৪০ বছর আগের এক রিকশাওয়ালা পরিবারের সেই আতিথেয়তার কথা, ভালোবাসার কথা মনে করে টেলিফোনে কাঁদতে লাগলেন। তিনি এখন ফেনীতে। আমি বসে আছি ঢাকায়। টেলিফোনে তাঁর কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প রেকর্ড করে নিচ্ছি। কিসের গল্প, ফোনে শুধু আসছে মুনির ভাইয়ের কান্নার শব্দ। কাঁদতে কাঁদতেই তিনি বলেন, ‘সরি ভাই, আবেগপ্রবণ হয়ে যাচ্ছি।’
এই কান্নার সঙ্গে আমি আগে থেকেই পরিচিত। বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদত চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিতে যেতাম তাঁর বাসায়, ২০০২/২০০৩ সালে। প্রতিবার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়তেন শিশুর মতো।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বড় ভালোবাসার ধন। বড় দুর্বলতার জায়গা। মুক্তিযুদ্ধের অনেক বীরত্বের গল্প, হাসির ঘটনার সঙ্গেও অনেক ভালোবাসার অশ্রু মাখা আছে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments