আরব জাগরণ-‘আমিই রাষ্ট্র’ বনাম ‘আমরাই জনগণ’ by ফারুক ওয়াসিফ
যুগের পর যুগ আরবরা একজন মুক্তিদাতার জন্য প্রার্থনা করেছে। স্বপ্ন দেখেছে, একদিন কোনো এক বীর এসে তাদের মুক্তি দেবে ভেতরের আর বাইরের সমস্যা থেকে। তাদের আশা যখন তলানিতে প্রায়, তখনই তার আগমন ঘটল। বিশ্ববাসীও তার অপেক্ষায়ছিল এবংতাকে পাওয়া মাত্র জানাল অভিবাদন।
সেই বীর আরবকে জাগালো এবং পথে পথে মাতম উঠল বিদ্রোহের। অবাক হয়ে তারা দেখল, সেই বীর এত দিন ঘুমিয়ে ছিল তাদেরই মনের মধ্যে; হতাশা, ক্রোধ, অপমান আর বিপন্নতার যন্ত্রণা হয়ে, পরিবর্তনের আশা হয়ে, জাগরণের সংকল্প হয়ে। তারা আবিষ্কার করল, সেই বীর তারা নিজেরাই। স্বয়ং জনগণই সেই প্রতিশ্রুত নায়ক। খবর রটে গেল: এই বীরের নাম জনগণ, এর চেহারা তারুণ্যে ভরপুর, এর প্রকাশ বিদ্রোহে।
ইরাক-আফগানিস্তান, গাজা-লেবাননে তখন গণবিধ্বংসী গণতন্ত্র নাজেল হচ্ছিল। বোমাবর্ষণে নিরীহ নর-নারী-শিশুর মৃত্যু দেখে যন্ত্রণায় বুজে যেতে চেয়েছিল আমাদের চোখ। তবু চোখ খোলা রেখেই একের পর এক দেশের ধর্ষণ দেখতে হয়েছিল আমাদের। সেই যন্ত্রণার কিছুটা উপশম দিল চলমান আরব মহাবিদ্রোহ। সেই গণহত্যা সম্প্র্রচারের বিবিসি আর আল-জাজিরাতেই দেখলাম গণজাগরণের সরাসরি সম্প্রচার। এক মিসরীয় তরুণ বলেছেন, ‘এত দিন আমরা টেলিভিশন দেখেছি, এখন টেলিভিশন আমাদের দেখছে। এর জন্যই ছিল আমাদের অপেক্ষা।’
আমাদের শেখানো হয়েছিল, যুদ্ধ আর আগ্রাসনের মাধ্যমেই গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম আর মতপ্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষাটা জান-মালের বিনিময়েই হয়েছিল এবং ইরাক থেকে আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন থেকে সুদান পর্যন্ত ছিল তার ভুক্তভোগীরা। ধন্যবাদ জাতিসংঘ, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের’ পঞ্চপাণ্ডব তথা যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেন-ফ্রান্স-জার্মানি-অস্ট্রেলিয়াকে। বাড়তি আরেকটা শিক্ষাও মিলছিল বলকান অঞ্চলের শৌখিন বিপ্লবগুলোতে। সেখানে পশ্চিমা-সমর্থিত দলকে ক্ষমতায় আনতে অর্থের জোর, আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রচার এবং কূটনীতির ঘূর্ণি দেখানো হয়েছিল। এসব ঘটনা দেখাচ্ছিল, বিপ্লব-গণতন্ত্র-দিনবদলের চাবিকাঠি আর জনগণের হাতে নেই। ওপরতলার এলিট, সেনাবাহিনী, এনজিও আর মিডিয়াই পরিবর্তন যা ঘটানোর ঘটিয়ে দেবে; জনগণের কাজ টেলিভিশন দেখে হাততালি দিয়ে যাওয়া। সিভিকো-মিলিটারি-করপোরেট গণতন্ত্রে জনগণ উবে গিয়েছিল, ছিল কেবল ক্রেতা ও দর্শক। ফুকুয়ামা সাহেবরা বুঝিয়েছিলেন, ইতিহাস সৃষ্টিকারী জনগণ একটা রূপকথা। এখন সাদার জায়গায় কালো প্রেসিডেন্ট কিংবা পুরুষের বদলে নারী প্রধানমন্ত্রীই দিনবদলের উপমা।
শেখানো হয়েছিল, আরব মানেই মুসলমান, মুসলমান মাত্রই গণতন্ত্রের অনুপযুক্ত। তাদের একদল সন্ত্রাসী, অন্যরা ভেড়ার পাল। বোঝানো হয়েছিল, প্রযুক্তি ও আধুনিকতা যেমন পাশ্চাত্যের আমদানি, গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমও তাই। এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার মাটি ও মনে এসব ফলে না। দরকার হাইব্রিড ধ্যান-ধারণা, যার একমাত্র পরিবেশক সাবেক ঔপনিবেশিক দেশগুলো, যাদের ব্যবস্থার ডাকনাম সাম্রাজ্যবাদ। এই শিক্ষা অকাতরে দেওয়া হয় এবং আমরা আরও কাতর ও নিরাশ হতে থাকি। ভাবি, এভাবেই হাতড়াতে হাতড়াতে আর কাতরাতে কাতরাতে চলতে হবে আমাদের।
এরই মধ্যে তিউনিসিয়ার এক যুবক গায়ে আগুন দিয়ে দাবানল ধরিয়ে দিল। এক মাসের মাথায় সেদেশের শাসক লেজে আগুন নিয়ে পালালেন। পরের মাসে দুনিয়া কাঁপানো ১৮ দিনের যুববিদ্রোহে মিসরের ফেরাউনের পতন হলো। এখন লিবিয়ায় গণবিদ্রোহে গাদ্দাফির টুঁটি টিপে ধরেছে তাঁরই জনগণ। সমগ্র আরবের স্বৈরশাহিরা ইয়া নফসি ইয়া নফসি করছেন। জানলাম, আরবেও মানুষ আছে, জনগণ আছে। তাদেরও জীবন একটাই এবং সেই জীবনের অধিকারের জন্য তারা আত্মদানেও পিছপা হয় না। এভাবে আরব বিদ্রোহ আবার ইতিহাসের কর্তাশক্তি হিসেবে জনগণকে ফিরিয়ে আনল। এই জনগণ ব্যক্তিসমূহের সমষ্টি না, জাতি হিসেবে মিসরীয় বা আরব বা তিউনিসীয় না কেবল। তারা এখন বৈশ্বিক জনগণের প্রতিনিধি, মানবতার দিশারি। যুদ্ধ, আগ্রাসন, সন্ত্রাস দমন, আবু গারাইব কারাগারের বিনিময়ে পাওয়া গণবিধ্বংসী গণতন্ত্র তারা চায় না। তাদের গণতন্ত্র বোমাসহযোগে নাজিল হয় না, মার্কিন দূতাবাস থেকে পরিচালিত হয় না এবং তাকে পাহারা দিতে মার্কিন সেনাঘাঁটি-সজ্জিত মীরজাফরদের প্রয়োজন পড়ে না। এই গণতন্ত্র সৃষ্টি করে জনগণ, তারাই এর প্রহরী। তারা নিছক নির্বাচিত সরকার চাইছে না, তারা চাইছে অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার ও সংবিধান পরিষদ। মিসরের সংগ্রামীদের সম্মেলনে এই দাবিই সর্বসম্মতভাবে পাস হয়েছে। একই রকম দাবি তুলেছে তিউনিসিয়ার বিদ্রোহীরাও। পুরাতনের ধারাবাহিকতা তাদের কাম্য নয়, তারা চায় অতীতের শাসনকাঠামো ও শাসক-সংস্কৃতির সঙ্গে পূর্ণ বিচ্ছেদ। এটাই আরব জাগরণের বিপ্লবী লক্ষণ।
সব প্রজন্মের সামনেই একটা মিশন আসে, কেউ পালন করে আর কেউ এড়িয়ে যায়। আরবের তরুণ-তরুণীরা সে রকম এক মিশনই পালন করছে। রাষ্ট্র বদলানোর আগে তারা বদলে ফেলছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি। সার্বভৌমত্বহীন দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সার্বভৌম হতে চাইছে সমাজ। রাষ্ট্র তাদের নয় বলে তারা রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে। জনতার এই সার্বভৌম ক্ষমতাই দিনবদলের চাবিকাঠি। স্বৈরশাসকেরা বিসমার্কের মতো করে বলতে চাইছে ‘আমিই রাষ্ট্র’, আর মানুষ বলছে ‘আমরাই জনগণ’, আমরা সকলক্ষমতার উৎস। এই গণক্ষমতাকে যতটা পারা যায়, যতদূর পারা যায় টিকিয়ে রাখাই এই মুহূর্তের দায়িত্ব।
এটা তাই নতুন ধরনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠারও লড়াই। রাজনৈতিক দল নেই বলে সামাজিক শক্তি এর কারিকা শক্তি। তবে বড় ও দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তনের জন্যচাই কোনো না কোনো সাংগঠনিক কাঠামো। তার জন্যতড়িঘড়ি নির্বাচনের বদলে দীর্ঘমেয়াদিপরিবর্তন প্রক্রিয়াই শ্রেয়। তাতে করে নতুন জাগ্রত ছাত্র-জনতা নিজেদের সংগঠিত করার সুযোগ পাবে। শাসনব্যবস্থা বদলানো হয়তো এক যুগের সাধনার ব্যাপার। তবে যে বোতলবন্দী জিন বেরিয়ে পড়েছে, তাকে আর বোতলে ঢোকানো যাবে না। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে ছিপি আটকানো যায় না। এখন আরব জনতার পাশে এসে দাঁড়ানো দরকার গোটা দুনিয়ার গণমানুষকে। যুদ্ধ-দমন-পীড়ন আর শোষণে জর্জর বর্তমান দুনিয়ায় আরব বিদ্রোহগুলো কেবল আশার আলোই জ্বালায়নি, তারা রাজপথের সাম্য দেখাচ্ছে এবং লিখছে ময়দানের গণতন্ত্রের অ-আ-ক-খ। তাদের এখন দরকার বিশ্বজনতার সমর্থন। বিশেষত, যখন পশ্চিমা সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা দিগন্তে মাথা তুলছে।
ভোগবাদ আর আধুনিকতার ফুরফুরা মোহে ডুবিয়ে যে তারুণ্যকে করা হচ্ছিল প্রতিষ্ঠাকাতর পঙ্গপাল, বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে তারা ‘এই প্রথম তারা গর্বিত হচ্ছে নিজেকে নিয়ে, দেশ নিয়ে, আত্মপরিচয় নিয়ে।’ তারা আজ সত্যিকার ব্যক্তিস্বাধীনতার দাবি জানাচ্ছে, এগিয়ে আনছে জাতীয় স্বাধীনতা। তারা চায় মানুষের মতো জীবন এবং পাশ্চাত্যের নাগরিকের সমান মর্যাদা। এভাবে ঔপনিবেশিক আধিপত্য আর যুদ্ধবাজ শক্তির থাবা তারা আলগা করছে। প্রলেতারিয়েতের পাশাপাশি হাজির হচ্ছে নাজুক মধ্যবিত্ত প্রিক্যারিয়েত। লাগাতার শ্রমিক ধর্মঘটের সমান্তরালে আসছে ছাত্র-তরুণের গণ-অভ্যুত্থান। তারা বলতে চাইছে, মানুষ ক্ষমতার নাটবল্টু নয়, মানুষই ইতিহাসের নির্মাতা।
অন্যদিকে পশ্চিমা-এলিট মহল পড়েছে প্রবাদ কথিত মাইনকা চিপায়। তারা যেসব তথাকথিত সেক্যুলার শাসককে সমর্থন করে, তাঁরা গণতন্ত্রের শত্রু। আবার আরব বা লাতিন আমেরিকার জনগণ যাদের নির্বাচিত করে, তাদেরও পছন্দ নয় পশ্চিমের। গণতন্ত্রের ঘর আমদানীকৃত সেক্যুলারিজম করেন না বলে তিনি প্রায়ই বাপের বাড়িতে নাইওর যান। সেখান থেকে ড্রোন-বোমা-ষড়যন্ত্র-সন্ত্রাসবিরোধী আইন আর উন্নয়ন ও আগ্রাসনের রূপে, এনজিও ও ন্যাটোবাহিত হয়ে নাজিল হন তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলোতে। যে গণতন্ত্র জনগণকে বাদ দিয়ে সেক্যুলারিজম চায়, তা টিকবে না। গণতন্ত্র জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা এবং জনমুখী হলে জনগণও বাঁচে, সেক্যুলারিজমও বাঁচে। কিন্তু বাঁচে না পরাশক্তির দাপট আর তাদের দেশীয় খেদমতগারেরা। সে জন্যই মিসরে মার্কিন-পছন্দ ইসলামি ব্রাদারহুড আর তিউনিসিয়ায় সাবেক সরকারের আমলা-মন্ত্রীদের নিয়ে তলে তলে চলছে চক্রান্ত। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্যের স্নায়ুকেন্দ্র মিসর।আমেরিকা একে সহজে ছাড়বে না, ইসরায়েলও তাই মরিয়া। ডলার আসক্ত সেনাবাহিনী ও সিভিল সোসাইটির এলবারাদিরা তাদের হয়ে সদাপ্রস্তুত।
তাই ইরাক-আফগানিস্তানের লাখ লাখ নিরীহ মানুষের রক্তে চোবানো হাত নাচিয়ে টনি ব্লেয়ার যখন বলেন, ‘মিসরে আমরা আমাদের ধরনে সমর্থিত নির্বাচিত সরকারের’ গণতন্ত্র চাই, তখন হাসি পায়। আলজেরীয় বিপ্লবী ফ্রাঞ্জ ফ্যানো বলেছিলেন, ‘তারা গণতন্ত্র ও মানবতাবাদের নামে মুখে ফেনা তুলে ফেলে কিন্তু যেখানেই গণতন্ত্র দেখা দেয়, সেখানেই তাকে বানচাল করে; যেখানেই মানুষ দেখে, সেখানেই তাকে হত্যা করে।’ তারা দেখাত সন্ত্রাসবাদের ভয়, আর আরববাসী ভীত ছিল অপশাসনে। তারা আরব জনতাকে উপহার দিয়েছিল আল-কায়েদা, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আর আগ্রাসন। আর আরব তাদের উপহার দিল গণতন্ত্রের জন্য এক মহাকাব্যিক বিদ্রোহ।
পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা সবজান্তা। আরব বিদ্রোহের ঢেউকে তাঁরা ‘ডোমিনো ইফেক্ট’ নাম দিয়েছেন। না জেনেই তাঁরা তাঁদের চরম ভয়ের নাম উচ্চারণ করেছেন। তাঁরা যে জঘন্য আরব শাসনব্যবস্থা সৃষ্টি করেছিলেন, এটা শেষ হবে তারই ধ্বংসে। তাঁরা সৃষ্টি করেছিলেন ইসরায়েল আর এক বশংবদ শাসকশ্রেণী। দুটোই আজ আক্রান্ত। এই নিখিল-আরব ইন্তিফাদা, শেষ পর্যন্ত মিলতে পারে ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদার সঙ্গে। ইন্তিফাদা বা গণ-অভ্যুত্থানই যে কার্যকর পথ, আরব মহাবিদ্রোহের এই শিক্ষাটি ফিলিস্তিনিদের সাহস জোগাবে। ইসরায়েলের শান্তিবাদী লেখক ইউরি আভেনরি লিখেছেন, ‘কী হবে একদিন যখন লাখে লাখে ফিলিস্তিনি মিছিল করে ইসরায়েলের বর্ণবাদী দেয়ালের সামনে আসবে এবং তা ভেঙে ফেলবে? কী হবে যখন লেবাননের আড়াই লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুহারা ইসরায়েলের উত্তর সীমান্তে সমবেত হবে? কী হবে যদি জনতার ঢল রামাল্লার মানারা স্কয়ার এবং নাবলুসের টাউন হল স্কয়ারে ইসরায়েলি সেনাদের মুখোমুখি হয়? সবই ঘটবে টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে। সঙ্গে থাকবে ফেসবুক ও টুইটার, আর থাকবে গোটা দুনিয়ার রুদ্ধশ্বাস দৃষ্টি।’
এখন ফিলিস্তিনি যুব প্রজন্মও জানে, গুলি ও বোমার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব। এরই শিক্ষা তিউনিস থেকে তাহরির স্কয়ার, পার্ল স্কয়ার থেকে বেনগাজি পর্যন্ত ছড়ানো। এই শিক্ষা তারা ভুলবে না।
ওবামা এখন মানবিক হস্তক্ষেপের নামে লিবিয়ায় সেনা পাঠানোর চিন্তা করছেন। ভাবছেন ইরাকের মতো লিবিয়াতেও সেনাঘাঁটি করবেন, দালাল শাসক বসাবেন, কবজা করবেন তেলসম্পদ। ক্ষমতার ব্যাধি এটাই, হাতে বন্দুক থাকলে বুদ্ধিনাশ হয়। জনাব ওবামা, মুক্ত মধ্যপ্রাচ্যের প্রসব বেদনাকে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাতের বেদনায় রূপান্তরিত করবেন না। আরব বহুপ্রতীক্ষিত গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের সোপানে পা রেখেছে।আপনার দেশেও শ্রমজীবী মানুষ আজ বিক্ষোভ করছে, আপনি সেগুলো সামলান। বাকি বিশ্বকে তাদের নিজেদের লড়াই লড়তে দিন। মুক্তি কেউ কাউকে দিতে পারে না, তা অর্জন করে নিতে হয়।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
ইরাক-আফগানিস্তান, গাজা-লেবাননে তখন গণবিধ্বংসী গণতন্ত্র নাজেল হচ্ছিল। বোমাবর্ষণে নিরীহ নর-নারী-শিশুর মৃত্যু দেখে যন্ত্রণায় বুজে যেতে চেয়েছিল আমাদের চোখ। তবু চোখ খোলা রেখেই একের পর এক দেশের ধর্ষণ দেখতে হয়েছিল আমাদের। সেই যন্ত্রণার কিছুটা উপশম দিল চলমান আরব মহাবিদ্রোহ। সেই গণহত্যা সম্প্র্রচারের বিবিসি আর আল-জাজিরাতেই দেখলাম গণজাগরণের সরাসরি সম্প্রচার। এক মিসরীয় তরুণ বলেছেন, ‘এত দিন আমরা টেলিভিশন দেখেছি, এখন টেলিভিশন আমাদের দেখছে। এর জন্যই ছিল আমাদের অপেক্ষা।’
আমাদের শেখানো হয়েছিল, যুদ্ধ আর আগ্রাসনের মাধ্যমেই গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম আর মতপ্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষাটা জান-মালের বিনিময়েই হয়েছিল এবং ইরাক থেকে আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন থেকে সুদান পর্যন্ত ছিল তার ভুক্তভোগীরা। ধন্যবাদ জাতিসংঘ, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের’ পঞ্চপাণ্ডব তথা যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেন-ফ্রান্স-জার্মানি-অস্ট্রেলিয়াকে। বাড়তি আরেকটা শিক্ষাও মিলছিল বলকান অঞ্চলের শৌখিন বিপ্লবগুলোতে। সেখানে পশ্চিমা-সমর্থিত দলকে ক্ষমতায় আনতে অর্থের জোর, আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রচার এবং কূটনীতির ঘূর্ণি দেখানো হয়েছিল। এসব ঘটনা দেখাচ্ছিল, বিপ্লব-গণতন্ত্র-দিনবদলের চাবিকাঠি আর জনগণের হাতে নেই। ওপরতলার এলিট, সেনাবাহিনী, এনজিও আর মিডিয়াই পরিবর্তন যা ঘটানোর ঘটিয়ে দেবে; জনগণের কাজ টেলিভিশন দেখে হাততালি দিয়ে যাওয়া। সিভিকো-মিলিটারি-করপোরেট গণতন্ত্রে জনগণ উবে গিয়েছিল, ছিল কেবল ক্রেতা ও দর্শক। ফুকুয়ামা সাহেবরা বুঝিয়েছিলেন, ইতিহাস সৃষ্টিকারী জনগণ একটা রূপকথা। এখন সাদার জায়গায় কালো প্রেসিডেন্ট কিংবা পুরুষের বদলে নারী প্রধানমন্ত্রীই দিনবদলের উপমা।
শেখানো হয়েছিল, আরব মানেই মুসলমান, মুসলমান মাত্রই গণতন্ত্রের অনুপযুক্ত। তাদের একদল সন্ত্রাসী, অন্যরা ভেড়ার পাল। বোঝানো হয়েছিল, প্রযুক্তি ও আধুনিকতা যেমন পাশ্চাত্যের আমদানি, গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমও তাই। এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার মাটি ও মনে এসব ফলে না। দরকার হাইব্রিড ধ্যান-ধারণা, যার একমাত্র পরিবেশক সাবেক ঔপনিবেশিক দেশগুলো, যাদের ব্যবস্থার ডাকনাম সাম্রাজ্যবাদ। এই শিক্ষা অকাতরে দেওয়া হয় এবং আমরা আরও কাতর ও নিরাশ হতে থাকি। ভাবি, এভাবেই হাতড়াতে হাতড়াতে আর কাতরাতে কাতরাতে চলতে হবে আমাদের।
এরই মধ্যে তিউনিসিয়ার এক যুবক গায়ে আগুন দিয়ে দাবানল ধরিয়ে দিল। এক মাসের মাথায় সেদেশের শাসক লেজে আগুন নিয়ে পালালেন। পরের মাসে দুনিয়া কাঁপানো ১৮ দিনের যুববিদ্রোহে মিসরের ফেরাউনের পতন হলো। এখন লিবিয়ায় গণবিদ্রোহে গাদ্দাফির টুঁটি টিপে ধরেছে তাঁরই জনগণ। সমগ্র আরবের স্বৈরশাহিরা ইয়া নফসি ইয়া নফসি করছেন। জানলাম, আরবেও মানুষ আছে, জনগণ আছে। তাদেরও জীবন একটাই এবং সেই জীবনের অধিকারের জন্য তারা আত্মদানেও পিছপা হয় না। এভাবে আরব বিদ্রোহ আবার ইতিহাসের কর্তাশক্তি হিসেবে জনগণকে ফিরিয়ে আনল। এই জনগণ ব্যক্তিসমূহের সমষ্টি না, জাতি হিসেবে মিসরীয় বা আরব বা তিউনিসীয় না কেবল। তারা এখন বৈশ্বিক জনগণের প্রতিনিধি, মানবতার দিশারি। যুদ্ধ, আগ্রাসন, সন্ত্রাস দমন, আবু গারাইব কারাগারের বিনিময়ে পাওয়া গণবিধ্বংসী গণতন্ত্র তারা চায় না। তাদের গণতন্ত্র বোমাসহযোগে নাজিল হয় না, মার্কিন দূতাবাস থেকে পরিচালিত হয় না এবং তাকে পাহারা দিতে মার্কিন সেনাঘাঁটি-সজ্জিত মীরজাফরদের প্রয়োজন পড়ে না। এই গণতন্ত্র সৃষ্টি করে জনগণ, তারাই এর প্রহরী। তারা নিছক নির্বাচিত সরকার চাইছে না, তারা চাইছে অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার ও সংবিধান পরিষদ। মিসরের সংগ্রামীদের সম্মেলনে এই দাবিই সর্বসম্মতভাবে পাস হয়েছে। একই রকম দাবি তুলেছে তিউনিসিয়ার বিদ্রোহীরাও। পুরাতনের ধারাবাহিকতা তাদের কাম্য নয়, তারা চায় অতীতের শাসনকাঠামো ও শাসক-সংস্কৃতির সঙ্গে পূর্ণ বিচ্ছেদ। এটাই আরব জাগরণের বিপ্লবী লক্ষণ।
সব প্রজন্মের সামনেই একটা মিশন আসে, কেউ পালন করে আর কেউ এড়িয়ে যায়। আরবের তরুণ-তরুণীরা সে রকম এক মিশনই পালন করছে। রাষ্ট্র বদলানোর আগে তারা বদলে ফেলছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি। সার্বভৌমত্বহীন দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সার্বভৌম হতে চাইছে সমাজ। রাষ্ট্র তাদের নয় বলে তারা রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে। জনতার এই সার্বভৌম ক্ষমতাই দিনবদলের চাবিকাঠি। স্বৈরশাসকেরা বিসমার্কের মতো করে বলতে চাইছে ‘আমিই রাষ্ট্র’, আর মানুষ বলছে ‘আমরাই জনগণ’, আমরা সকলক্ষমতার উৎস। এই গণক্ষমতাকে যতটা পারা যায়, যতদূর পারা যায় টিকিয়ে রাখাই এই মুহূর্তের দায়িত্ব।
এটা তাই নতুন ধরনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠারও লড়াই। রাজনৈতিক দল নেই বলে সামাজিক শক্তি এর কারিকা শক্তি। তবে বড় ও দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তনের জন্যচাই কোনো না কোনো সাংগঠনিক কাঠামো। তার জন্যতড়িঘড়ি নির্বাচনের বদলে দীর্ঘমেয়াদিপরিবর্তন প্রক্রিয়াই শ্রেয়। তাতে করে নতুন জাগ্রত ছাত্র-জনতা নিজেদের সংগঠিত করার সুযোগ পাবে। শাসনব্যবস্থা বদলানো হয়তো এক যুগের সাধনার ব্যাপার। তবে যে বোতলবন্দী জিন বেরিয়ে পড়েছে, তাকে আর বোতলে ঢোকানো যাবে না। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে ছিপি আটকানো যায় না। এখন আরব জনতার পাশে এসে দাঁড়ানো দরকার গোটা দুনিয়ার গণমানুষকে। যুদ্ধ-দমন-পীড়ন আর শোষণে জর্জর বর্তমান দুনিয়ায় আরব বিদ্রোহগুলো কেবল আশার আলোই জ্বালায়নি, তারা রাজপথের সাম্য দেখাচ্ছে এবং লিখছে ময়দানের গণতন্ত্রের অ-আ-ক-খ। তাদের এখন দরকার বিশ্বজনতার সমর্থন। বিশেষত, যখন পশ্চিমা সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা দিগন্তে মাথা তুলছে।
ভোগবাদ আর আধুনিকতার ফুরফুরা মোহে ডুবিয়ে যে তারুণ্যকে করা হচ্ছিল প্রতিষ্ঠাকাতর পঙ্গপাল, বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে তারা ‘এই প্রথম তারা গর্বিত হচ্ছে নিজেকে নিয়ে, দেশ নিয়ে, আত্মপরিচয় নিয়ে।’ তারা আজ সত্যিকার ব্যক্তিস্বাধীনতার দাবি জানাচ্ছে, এগিয়ে আনছে জাতীয় স্বাধীনতা। তারা চায় মানুষের মতো জীবন এবং পাশ্চাত্যের নাগরিকের সমান মর্যাদা। এভাবে ঔপনিবেশিক আধিপত্য আর যুদ্ধবাজ শক্তির থাবা তারা আলগা করছে। প্রলেতারিয়েতের পাশাপাশি হাজির হচ্ছে নাজুক মধ্যবিত্ত প্রিক্যারিয়েত। লাগাতার শ্রমিক ধর্মঘটের সমান্তরালে আসছে ছাত্র-তরুণের গণ-অভ্যুত্থান। তারা বলতে চাইছে, মানুষ ক্ষমতার নাটবল্টু নয়, মানুষই ইতিহাসের নির্মাতা।
অন্যদিকে পশ্চিমা-এলিট মহল পড়েছে প্রবাদ কথিত মাইনকা চিপায়। তারা যেসব তথাকথিত সেক্যুলার শাসককে সমর্থন করে, তাঁরা গণতন্ত্রের শত্রু। আবার আরব বা লাতিন আমেরিকার জনগণ যাদের নির্বাচিত করে, তাদেরও পছন্দ নয় পশ্চিমের। গণতন্ত্রের ঘর আমদানীকৃত সেক্যুলারিজম করেন না বলে তিনি প্রায়ই বাপের বাড়িতে নাইওর যান। সেখান থেকে ড্রোন-বোমা-ষড়যন্ত্র-সন্ত্রাসবিরোধী আইন আর উন্নয়ন ও আগ্রাসনের রূপে, এনজিও ও ন্যাটোবাহিত হয়ে নাজিল হন তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলোতে। যে গণতন্ত্র জনগণকে বাদ দিয়ে সেক্যুলারিজম চায়, তা টিকবে না। গণতন্ত্র জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা এবং জনমুখী হলে জনগণও বাঁচে, সেক্যুলারিজমও বাঁচে। কিন্তু বাঁচে না পরাশক্তির দাপট আর তাদের দেশীয় খেদমতগারেরা। সে জন্যই মিসরে মার্কিন-পছন্দ ইসলামি ব্রাদারহুড আর তিউনিসিয়ায় সাবেক সরকারের আমলা-মন্ত্রীদের নিয়ে তলে তলে চলছে চক্রান্ত। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্যের স্নায়ুকেন্দ্র মিসর।আমেরিকা একে সহজে ছাড়বে না, ইসরায়েলও তাই মরিয়া। ডলার আসক্ত সেনাবাহিনী ও সিভিল সোসাইটির এলবারাদিরা তাদের হয়ে সদাপ্রস্তুত।
তাই ইরাক-আফগানিস্তানের লাখ লাখ নিরীহ মানুষের রক্তে চোবানো হাত নাচিয়ে টনি ব্লেয়ার যখন বলেন, ‘মিসরে আমরা আমাদের ধরনে সমর্থিত নির্বাচিত সরকারের’ গণতন্ত্র চাই, তখন হাসি পায়। আলজেরীয় বিপ্লবী ফ্রাঞ্জ ফ্যানো বলেছিলেন, ‘তারা গণতন্ত্র ও মানবতাবাদের নামে মুখে ফেনা তুলে ফেলে কিন্তু যেখানেই গণতন্ত্র দেখা দেয়, সেখানেই তাকে বানচাল করে; যেখানেই মানুষ দেখে, সেখানেই তাকে হত্যা করে।’ তারা দেখাত সন্ত্রাসবাদের ভয়, আর আরববাসী ভীত ছিল অপশাসনে। তারা আরব জনতাকে উপহার দিয়েছিল আল-কায়েদা, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আর আগ্রাসন। আর আরব তাদের উপহার দিল গণতন্ত্রের জন্য এক মহাকাব্যিক বিদ্রোহ।
পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা সবজান্তা। আরব বিদ্রোহের ঢেউকে তাঁরা ‘ডোমিনো ইফেক্ট’ নাম দিয়েছেন। না জেনেই তাঁরা তাঁদের চরম ভয়ের নাম উচ্চারণ করেছেন। তাঁরা যে জঘন্য আরব শাসনব্যবস্থা সৃষ্টি করেছিলেন, এটা শেষ হবে তারই ধ্বংসে। তাঁরা সৃষ্টি করেছিলেন ইসরায়েল আর এক বশংবদ শাসকশ্রেণী। দুটোই আজ আক্রান্ত। এই নিখিল-আরব ইন্তিফাদা, শেষ পর্যন্ত মিলতে পারে ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদার সঙ্গে। ইন্তিফাদা বা গণ-অভ্যুত্থানই যে কার্যকর পথ, আরব মহাবিদ্রোহের এই শিক্ষাটি ফিলিস্তিনিদের সাহস জোগাবে। ইসরায়েলের শান্তিবাদী লেখক ইউরি আভেনরি লিখেছেন, ‘কী হবে একদিন যখন লাখে লাখে ফিলিস্তিনি মিছিল করে ইসরায়েলের বর্ণবাদী দেয়ালের সামনে আসবে এবং তা ভেঙে ফেলবে? কী হবে যখন লেবাননের আড়াই লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুহারা ইসরায়েলের উত্তর সীমান্তে সমবেত হবে? কী হবে যদি জনতার ঢল রামাল্লার মানারা স্কয়ার এবং নাবলুসের টাউন হল স্কয়ারে ইসরায়েলি সেনাদের মুখোমুখি হয়? সবই ঘটবে টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে। সঙ্গে থাকবে ফেসবুক ও টুইটার, আর থাকবে গোটা দুনিয়ার রুদ্ধশ্বাস দৃষ্টি।’
এখন ফিলিস্তিনি যুব প্রজন্মও জানে, গুলি ও বোমার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব। এরই শিক্ষা তিউনিস থেকে তাহরির স্কয়ার, পার্ল স্কয়ার থেকে বেনগাজি পর্যন্ত ছড়ানো। এই শিক্ষা তারা ভুলবে না।
ওবামা এখন মানবিক হস্তক্ষেপের নামে লিবিয়ায় সেনা পাঠানোর চিন্তা করছেন। ভাবছেন ইরাকের মতো লিবিয়াতেও সেনাঘাঁটি করবেন, দালাল শাসক বসাবেন, কবজা করবেন তেলসম্পদ। ক্ষমতার ব্যাধি এটাই, হাতে বন্দুক থাকলে বুদ্ধিনাশ হয়। জনাব ওবামা, মুক্ত মধ্যপ্রাচ্যের প্রসব বেদনাকে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাতের বেদনায় রূপান্তরিত করবেন না। আরব বহুপ্রতীক্ষিত গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের সোপানে পা রেখেছে।আপনার দেশেও শ্রমজীবী মানুষ আজ বিক্ষোভ করছে, আপনি সেগুলো সামলান। বাকি বিশ্বকে তাদের নিজেদের লড়াই লড়তে দিন। মুক্তি কেউ কাউকে দিতে পারে না, তা অর্জন করে নিতে হয়।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments