ভালো চলছে না জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় by আহমেদ সজল

দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। ছোটখাটো সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ৪১ বছর স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা ধরে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়টি অগ্রযাত্রা সমুন্নত রেখেছে। তবে সম্প্রতি তাতে ছন্দপতন ঘটেছে। শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত মান, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, জ্ঞানের রাজ্যে অবাধ বিচরণ, গণতান্ত্রিক পরিবেশ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।


আরেকটু খোলাসা করে বললে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে যে কর্তৃপক্ষ তারা এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছে না। সর্বত্র একটা দায়িত্ব ও জবাবদিহিহীনতার মনোভাব বিরাজমান। এই পরিবেশ অবশ্য একদিনে তৈরি হয়নি।
একচেটিয়াভাবে চর দখলের মতো করে বিশ্ববিদ্যালয়কে দখল করলে কী ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান উপাচার্য দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এ ক্ষেত্রে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে '৭৩-এর অধ্যাদেশ জারি আছে কোনোটিই তার ব্যতিক্রম হয়নি। আর এ ঘটনা যে শুধু এই সরকারের আমলেই ঘটেছে তাও নয়। যারাই ক্ষমতায় আসে তারাই এ নিয়মের সদ্ব্যবহার করে। যা-ই হোক ড. শরীফ এনামুল কবির রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে গবেষণার পাশাপাশি উপাচার্য হিসেবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সেশনজটও কমিয়েছেন ধারণাতীত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ক্ষতি তার হাত ধরে হয়েছে সে উদাহরণও রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা নতুন নতুন জ্ঞান অনুসন্ধান করেন, জ্ঞানের ধারা সৃষ্টি করে জাতিকে আলোকিত নেতৃত্বের পথে এগিয়ে নেন। এই প্রক্রিয়ায় কাণ্ডারির ভূমিকায় থাকেন শিক্ষকরা। আর শিক্ষক হিসেবে বাছাই করা হয় তাদের, যারা মেধাবীদের মধ্যে অধিকতর মেধাবী। মেধা, বুদ্ধি, জ্ঞান ও মননে চৌকস। দুঃখের বিষয়, বর্তমান উপাচার্য এই বিধানটিকে খুব বেশি আমলে নেননি। কোনো কোনো বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ফলধারীকে বাদ দিয়ে নিয়োগ দিয়েছেন নিজের বিবেচনায়। এ ক্ষেত্রে গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে দু'জন মেধাবী শিক্ষার্থীর প্রতি জুলুম করা হয়েছে নির্মমভাবে। শুধু রাজনৈতিক বিবেচনা থাকলেও এটিকে একটি কারণ হিসেবে ধরা যেত, তিনি এমন ব্যক্তিদের নিয়েছেন যাদের নামে থানায় হত্যা প্রচেষ্টা মামলা রয়েছে। প্রত্যেক নির্বাচনের আগে গড়পড়তা শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর শিক্ষক সমিতির নির্বাচন সামনে রেখে ৩২ জনকে নিয়োগ দেওয়া হলে জোরেশোরে আলোচনা শুরু হয়। অন্তত তিনটি বিভাগে নিয়োগ দিয়েছেন যেসব বিভাগের শিকক্ষরা সম্মিলিতভাবে চিঠির মাধ্যমে জানিয়েছেন_ আমাদের বিভাগে যথেষ্ট শিক্ষক রয়েছে, নতুন নিয়োগ অপ্রয়োজনীয়। একজন অধিকতর কম মেধাবীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিলে সেই অযোগ্যতার ভার বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় ৪০ বছর বহন করতে হয়, বিষয়টি আমরা বেমালুম ভুলে গেছি। এর দায়ভার নিশ্চয়ই আমাদের সবাইকে নিতে হবে। পাশে যে চাটুকারের দল থাকে ভুল করলেও তারা স্তুতিগান গেয়ে চলেন। সব সরকারের আমলেই তারা ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদন করেন। ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ হত্যাকাণ্ড এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক কলঙ্কজনক অধ্যায়। শিক্ষকরাও বলছেন, জুবায়ের হত্যার প্রেক্ষাপট একদিনে তৈরি হয়নি। কৌশলে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনকে বিভক্ত করে বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত করে রাখার ফল এই হত্যাকাণ্ড। সংবাদপত্রে 'উপাচার্যপন্থি' ছাত্রলীগ বলে একটি সংগঠনের নাম শোনা যায়। উপাচার্যপন্থি গ্রুপের নেতাকর্মীদের দাপটে ক্যাম্পাসবাসীকে তটস্থ থাকতে হয় সারাক্ষণ। একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ১৩ জনের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সেই তদন্ত প্রতিবেদনে কী ছিল কাউকে জানানো হয়নি আজ পর্যন্ত। এতে যেমন প্রকৃত আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে, তেমনি অনেকেই পুরোমাত্রায় জড়িত না হয়েও আজীবনের জন্য বহিষ্কার হয়েছেন বলেও সন্দেহ জন্মাতেই পারে। বর্তমানে শিক্ষক সমাজের ব্যানারে শিক্ষকদের একটি অংশ আন্দোলন করে চলেছে। প্রথমে আট দফা থাকলেও এখন উপাচার্যের পদত্যাগই তাদের একমাত্র দাবি। উপাচার্যের পক্ষের শিক্ষকরাও আছেন মাঠে। সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে শুধু এতটুকু অনুধাবন করা সম্ভব যে, বিশ্ববিদ্যালয় ভালো চলছে না। শিক্ষার পরিবেশ সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আমরা এই বন্ধ্যত্ব ভাব থেকে পরিত্রাণ চাইছি। যেহেতু উপাচার্য আমাদের অভিভাবক তাকেই পথ বাতলে দিতে হবে, তিনি যেটা ভালো মনে করেন; আলোচনা কিংবা যেভাবেই হোক, সেটা যদি তার পদত্যাগও হয়।

স আহমেদ সজল :শিক্ষার্থী, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব
বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.