রেলওয়ের নিয়োগ বাণিজ্য-ঘুষের টাকা তুলে জিএমকে পৌঁছে দিত ৯ সদস্যের টিম by ভূঁইয়া নজরুল
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে সাড়ে তিন হাজার পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য হয়েছে। আর এ ঘুষের টাকা পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ইউসুফ আলী মৃধার কাছে পৌঁছে দিতে মাঠপর্যায়ে রেলওয়ে কর্মকর্তা ও রেল শ্রমিক লীগের ৯ জনের একটি টিম কাজ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
রেলওয়ের শ্রমিক ও কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার মাধ্যম হিসেবে কাজ করা ৯ ব্যক্তি হলেন জিএমের মেয়ের জামাই ও বিভাগীয় প্রকৌশলী-১ (ঢাকা) আরমান হোসেন, জিএমের ভগ্নিপতি বুলবুল, রেলওয়ের অতিরিক্ত প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান, সিনিয়র ওয়েলফেয়ার অফিসার গোলাম কিবরিয়া, চিফ পার্সোনাল অফিসের প্রধান সহকারী সিরাজুল হক, বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হুমায়ুন কবির ও সম্পাদক হাবিবুর রহমান আকন্দ, শ্রমিক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক শেখ লোকমান হোসেন এবং প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম।
এ বিষয়ে রেল শ্রমিক লীগের নেতা মোখলেছুর রহমান বলেন, 'জিএমের ব্যক্তিগত ল্যাপটপে তল্লাশি চালালে অনেক গোপন তথ্য বেরিয়ে আসবে। ওই ল্যাপটপে ঘুষের মাধ্যমে কাদের নিয়োগ দেওয়া হবে তার একটি তালিকা রয়েছে এবং জাতীয় রেল শ্রমিক লীগের দেওয়া একটি তালিকাও রয়েছে।'
মোখলেছুর আরো বলেন, 'পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের সাড়ে তিন হাজার পদে কোনোটিতে টাকা ছাড়া নিয়োগ হয়নি। সর্বনিম্ন তিন লাখ থেকে সর্বোচ্চ ছয় লাখ টাকা, যা গড়ে চার লাখ টাকা হতে পারে। সেই হিসাবে তিন হাজার ৫৬৯ পদে ১৪২ কোটি ৭৬ লাখ টাকার নিয়োগ বাণিজ্য হয়েছে।'
গত বছরের প্রথমার্ধে রেলওয়ের ৪২টি পদে তিন হাজার ৫৬৯ জন লোক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে লিখিত পরীক্ষা হলেও এখনো নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। আশির দশকের পর গত বছরে প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি ছিল সবচেয়ে বেশি জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া। জানা যায়, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘুষের লেনদেন হয়েছে সহকারী লোকোমোটিভ মাস্টার গ্রেড-২ (১৮২টি), জুনিয়র অডিটর (১৪০টি), সুইপার (২৪৮টি), ট্রলিম্যান (১৪৩টি), ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিস (৪০০টি), চৌকিদার (১১২টি) পদে। এ ছাড়া নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান থাকা খালাসি (১৪৪১টি) ও অ্যাটেনডেন্ট (১৪৩টি) পদেও ঘুষের টাকার লেনদেন চলছে।
ঘুষ ছাড়া চাকরি হয়নি জানিয়ে পলোগ্রাউন্ড মাঠের পাশে রেলওয়ে হিসাব শাখার অডিটর আবদুল করিম অভিযোগ করে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার মেয়ে জুনিয়র অডিটর পদে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও শুধু টাকা না দেওয়ার কারণে তাকে চাকরি দেওয়া হয়নি। প্রয়োজনে আমার মেয়ের পরীক্ষার খাতা বের করলেই সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসবে। টাকা ছাড়া রেলওয়েতে একটি নিয়োগও হয়নি। সর্বনিম্ন তিন লাখ থেকে সর্বোচ্চ ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত একেকটি পদে নেওয়া হয়েছে।'
একই পদে লিখিত পরীক্ষায় ঠাকুরগাঁও জেলা থেকে একমাত্র উত্তীর্ণ প্রার্থী মোহাম্মদ মনসুর আলম বলেন, 'আমার রোল নম্বর ৫৬১০১৬। ঠাকুরগাঁও থেকে শুধু আমিই মৌখিক পরীক্ষা দেওয়ার পরও চাকরি হয়নি শুধু টাকা না দেওয়ার কারণে।'
পোষ্য কোটায় চাকরি না পাওয়া অন্য এক অভিভাবক পাহাড়তলী রেলওয়ে কারখানার চাকুরে আবদুল করিম বলেন, 'নিয়োগ পরীক্ষার খাতা পেনসিল দিয়ে মূল্যায়ন করার কোনো রেকর্ড না থাকলেও রেলওয়ের নিয়োগে তা হয়েছে। যার কাছ থেকে বেশি টাকা পাওয়া যাবে তার খাতায় নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যেই পেনসিল দিয়ে পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করা হয়েছে।'
ঘুষ আদায়ের প্রক্রিয়া : অনুসন্ধানে জানা যায়, ইউসুফ আলী মৃধা এই নিয়োগ বাণিজ্যে একা টাকা সংগ্রহ করেননি। এ জন্য ৯ জনের বিশেষ একটি টিম মাঠপর্যায়ে কাজ করছে। সবাই বিভিন্নভাবে ঘুষের পরিমাণ নিশ্চিত করে রেলওয়ের জিএম ইউসুফ আলী মৃধার কাছে পাঠিয়ে দিত। জিএম সরাসরি চিফ পার্সোনাল অফিসের প্রধান সহকারী সিরাজুল হকের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করতেন। এ ছাড়া চট্টগ্রামে মাঠপর্যায়ে শ্রমিক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক শেখ লোকমান হোসেন এবং প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সিরাজুল ইসলামের মাধ্যমে টাকা আদায় করে জিএমের কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো। আর এ প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ করতেন কেন্দ্রীয় রেল শ্রমিক লীগের সভাপতি হুমায়ুন কবির ও সম্পাদক হাবিবুর রহমান আকন্দ। সভাপতি ও সম্পাদকের ছাড়পত্র ছাড়া তা জিএম পর্যন্ত পৌঁছত না।
রেল শ্রমিক লীগের এ প্রক্রিয়া ছাড়াও রেল কর্মকর্তাদের মধ্যে রেলওয়ের অতিরিক্ত প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান ও সিনিয়র ওয়েলফেয়ার অফিসার গোলাম কিবরিয়ার মাধ্যম হয়ে টাকা জিএমের কাছে পৌঁছে যেত।
রেলওয়ের এক শ্রমিক লীগ নেতা জানান, জিএমের মেয়ের জামাই ও বিভাগীয় প্রকৌশলী-১ (ঢাকা) আরমান হোসেন 'ট্রলিম্যান' পদে নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক থাকায় তাঁর মাধ্যমে ঘুষের টাকা জিএমের কাছে গেছে। এ ছাড়া নিয়োগ প্রক্রিয়ায় চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য জিএমের বোনের জামাই বুলবুল নামের আরো এক ব্যক্তি দালাল হিসেবে কাজ করেছেন।
তবে নিয়োগ বাণিজ্যে শ্রমিক লীগের সম্পৃক্ততা নেই জানিয়ে রেলওয়ে শ্রমিক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হুমায়ুন কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নিয়োগে টাকার লেনদেন হয়েছে শুনেছি, কিন্তু এতে আমার কিংবা সম্পাদকের সম্পৃক্ততা ছিল না। কোনো পদে তিন লাখের কম টাকায় নিয়োগ হয়নি- এ ধরনের খবর আমার কাছেও এসেছে।'
হুমায়ুন কবির আরো বলেন, 'শ্রমিক লীগের দায়িত্বে থাকায় ৪০ শতাংশ পোষ্য কোটায় চাকরিপ্রার্থীদের চাকরি দেওয়ার জন্য তদবির করেছি। তবে এতে টাকার কোনো লেনদেন হয়নি।'
নিয়োগ কমিটিতে অনিয়ম : ঘুষ বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে রেল নিয়োগ বিধি অমান্য করে নিয়োগ কমিটি করা হয়েছে। নিয়োগ বিধি অনুযায়ী তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগে ৪ নম্বর গ্রেডভুক্ত বিভাগীয় কর্মকর্তাকে আহ্বায়ক করতে হবে কিন্তু তা অমান্য করে 'ট্রলিম্যান' পদে নবম গ্রেডভুক্ত জুনিয়র কর্মকর্তাকে আহ্বায়ক করা হয়েছে। এই জুনিয়র কর্মকর্তা হলেন জিএমের মেয়ের জামাই আরমান হোসেন, যিনি কিছুুদিন আগে সহকারী প্রকৌশলী ময়মনসিংহ ও বর্তমানে বিভাগীয় প্রকৌশলী-১ ঢাকার দায়িত্বে রয়েছেন। এ ছাড়া সহকারী লোকোমাস্টার গ্রেড-২ ও ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিস পদে নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে অতিরিক্ত প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী হাফিজুর রহমানকে।
রেলওয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, 'লোকোমাস্টার পদে আহ্বায়কের জন্য বিভাগীয় প্রকৌশলী (লোকো) আহ্বায়কের পদ পেতে পারতেন কিন্তু তাঁকে দেওয়া হয়নি। অনিয়মের জন্য একজনকে উভয় পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।'
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে রেলওয়ের চিফ পার্সোনাল অফিসার গাউস আল মনিরের চেম্বারে গতকাল বুধবার দুপুরে গেলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে তাঁর মোবাইল ফোনে কালের কণ্ঠের পরিচয়ে মেসেজ দিয়ে ফোন করার পরও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। একইভাবে রেলওয়ের জিএমকে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
No comments