লিবিয়া-সীমান্তে প্রবাসী শ্রমিকদের দুর্দশা by রবার্ট ফিস্ক
হাজার হাজার মানুষ এক স্বরে উচ্চকণ্ঠে বলছে, ‘মিসরের সেনাবাহিনীকে চাই—আমাদের সেনাবাহিনী এখানে নেই কেন?’ এরা উদ্বাস্তু, এরা গরিব, এরা অসুস্থ। সম্পদশালীরা তো গাদ্দাফির নিয়ন্ত্রণাধীন অবশিষ্ট জমিন ছেড়ে পালিয়েছে বেশ আগেই। ময়লা-আবর্জনা মাড়িয়ে এসব মানুষ জড়ো হয়েছে সীমান্তবর্তী স্টেশনে। কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া,
সোহাগ, আসিয়ুত ও বন্দ্বীপের হাজারো গ্রামের অধিবাসী এরা। সবার সঙ্গে সস্তা কাপড় ও বিছানাপত্র বোঝাই বিশালকায়, উদ্ভট দর্শন, অতি ভারী মালপত্রের বোঝা।
মিসরের যে হাজারো মানুষ লিবিয়া থেকে সীমান্ত পেরিয়ে তিউনিসিয়ায় ঢুকছে, তাদের রক্ষা করতে মিসরীয় সেনাবাহিনী তিউনিসিয়ায় যেতে পারে না। গত সোমবার মিসরীয় নৌবাহিনী কালোরঙা এক ফ্রিগেট নিয়ে এসেছিল। সঙ্গে নিয়ে গেছে এক হাজার পুরুষ, নারী ও শিশু। উদ্দাম, ঝোড়ো বাতাসের মধ্যে তারা দেশের উদ্দেশে যাত্রা করেছে।
যেকোনো দয়ার জাহাজের থেকে বড় সীমান্তের দুর্দশা। হয়তো সাত হাজার অথবা আট হাজার মানুষ। এই সংখ্যা তাদের যন্ত্রণা প্রকাশে যতটা অপারগ, ততটাই অসম্পূর্ণ। লিবিয়ার শেষ বাধা পেরিয়ে তিউনিসিয়ায় পৌঁছার যাত্রাপথের ক্লেশ। লিবীয়রা তাদের পেটায়—আর যখন তারা তিউনিসিয়ায় পৌঁছাল, বেন গার্ডেনের তরুণেরা তাদের পেটায়, কাছের শহরে তাদের কাজে এরা ভাগ বসাতে পারে—এই শঙ্কায়। মিসরীয়রা এখানে কাজের সন্ধানে আসেনি। হাজার হাজার বাংলাদেশিও নয় (তিউনিসে বাংলাদেশের কোনো দূতাবাসও নেই), চীনারা নয়, ফিলিপিনোরাও নয়। এককালে তৃতীয় বিশ্ব বলে যা বোঝানো হতো, সেই তৃতীয় বিশ্বের এক প্রকৃত স্বৈরশাসকের দ্বারা দুর্দশার শিকার হয়ে, গৃহহীন ও কর্মহীন মানুষ হয়ে এরা সেখানে গেছে।
কালোরঙা চামড়ার জ্যাকেট পরা তিউনিসীয় এক নিরাপত্তা পুলিশের হাতে স্টেয়র রাইফেল। সাংবাদিকদের উদ্দেশে সে চেঁচিয়ে বলল, ‘কতজন এসেছে দেখেছেন? হাজার হাজার মানুষ ঢুকলে তিউনিসিয়ার চেহারাটা কেমন দেখাবে? গিয়ে সচক্ষে দেখে আসুন।’ সীমান্ত থেকে লিবিয়া অংশে দেখলাম কংক্রিটের দেয়াল ঠেলছে বহু মানুষ। লিবিয়ার সবুজ কাস্টমস স্টেশনের কাছে তাদের বামন মনে হলো। তিউনিসিয়ার দুরবস্থা আমাদের দেখিয়ে দেওয়ার জন্য সেনা কর্মকর্তাদের গালি খেতে হলো সেই পুলিশকে।
তথাপি তিউনিসীয়রা সদয় আচরণও করছিল। নিজেদের গাড়িতে করে মিসরীয় কৃষিশ্রমিকদের তারা নিয়ে যাচ্ছিল উদ্বাস্তু শিবিরে। সবেমাত্র এই শিবির স্থাপন করা হয়েছে। যারা কায়রোর বিমান ধরতে এবং জেরজেস পোতাশ্রয়ে যেতে জেরবা বিমানবন্দরে পৌঁছাতে পারছিল, তাদের খণ্ডকালীন ভিসা লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। তিউনিসিয়ায় আসা এসব মানুষ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে রুটি, পানি আর কম্বল।
মিসরের পতাকাসংবলিত সাদারঙা টি-শার্ট পরিহিত মিসরীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা আমাদের জানালেন, তিনি তাঁর স্বদেশবাসীকে সহায়তার জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে এখানে এসেছেন। মোবারকের দুর্নীতিপরায়ণ শাসনের সময়ে এমনটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। তাঁর মুখেও তিউনিসীয়দের প্রশংসা।
যদি এক লাখ উদ্বাস্তু তিউনিসিয়া ও মিসরের উদ্দেশে ইতিমধ্যে লিবিয়া ত্যাগ করে থাকে, তবে ত্রিপোলির স্বৈরশাসকের কাছে দায়িত্বপরায়ণতার চূড়ান্ত হিসাব কী রকম দাঁড়ায়? তাঁর সবুজগ্রন্থ অনুযায়ী তিনি তো জনগণের হাতেই ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছেন। গত সপ্তাহে ত্রিপোলিতে এক পোস্টারে দেখলাম লেখা আছে, ‘সবখানে জনগণের কংগ্রেস ও কমিটি ছাড়া কোনো গণতন্ত্র নয়’—অর্থহীন এক কথা। তাহলে কী হবে রাস জফিরের এসব মানুষের? তাদের কোনো কংগ্রেস বা কমিটি নেই। কেবল বাড়িমুখো কঠিন রাস্তা অথবা উত্তাল সমুদ্র। সোমবার সকালে মিসরীয় নৌবাহিনী তাদের উদ্ধারে এসেছিল। কিন্তু মাত্র এক হাজার ধারণক্ষমতার একটি ফ্রিগেট নিয়ে এল তারা। মিসরীয় ব্যানারে ভরপুর আর ঘাটে মিসরীয় নৌসেনাদের উপস্থিতির মাঝে শালাতেইনের জেরজেসে পৌঁছালে তো শুধু বেদনা ও দীনতা থেকে উদ্ধার পাওয়া গেল। মোবারককে উচ্ছেদের পর এটা মিসরের প্রথম সামরিক অভিযান। নৌসেনা ও নাবিকেরা ভালোভাবেই জানেন, তাঁদের ওপর বিশ্ববাসীর ক্যামেরা। তাঁরা শিশুদের নিয়ে নৌযানে তুলেছেন, লাঠিতে ভর দিয়ে চলা বৃদ্ধদের স্বাগত জানিয়েছেন, মিসরের ঊর্ধ্বভাগ থেকে আসা অবশিষ্ট কৃষকদের জড়িয়ে ধরেছেন।
জাহাজের লাউড স্পিকারে বাজানো হচ্ছিল ‘আল হেলমেল আরাবি’—‘আরব স্বপ্ন’। এটি আরব ঐক্যের প্রাচীন গান। তখন ৫০ মাইল দূরে সীমান্ত এলাকা থেকে কয়েকটি বাসে করে আরও কয়েক শ মিসরীয় প্রবাসী শ্রমিককে নিয়ে আসা হলো।
মিসরীয় নৌবাহিনীর নিজস্ব ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদকও ছবি তুললেন মধ্য ও পরিণত বয়সী কৃষিশ্রমিকদের। প্রায় সবার হাতে মাটিলাগা কম্বল আর প্লাস্টিক ব্যাগে তাঁদের যা ছিল সব।
তিউনিসিয়ার সীমান্তে গাদাগাদি করে থাকা এসব মানুষ বাড়ি ফিরে পরে কী ঘটবে? মিসরের অর্থনীতির ওপর শোচনীয় আঘাত আসবে। বাংলাদেশ ও তুরস্কের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় আঘাত লাগবে লিবিয়াতেই। তাদের কনস্ট্রাকশন প্ল্যান্ট ও জ্বালানিকেন্দ্র আর তেল-গ্যাসক্ষেত্রগুলো এখন তো খালি পড়ে আছে।
এ লেখা যখন লিখছি তখন মিসরের আরও চারটি নৌযান তিউনিসিয়ার পথে। এই টাস্কফোর্স ব্রিটিশ ও মার্কিন নাগরিকদের বের করে নেওয়ার উদ্যোগের থেকে বড়। কিন্তু সীমান্তে বাড়তে থাকা ঘরমুখো শ্রমিকদের সবাইকে ফিরিয়ে নিতে এটাও যথেষ্ট নয়।
দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক, মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ।
মিসরের যে হাজারো মানুষ লিবিয়া থেকে সীমান্ত পেরিয়ে তিউনিসিয়ায় ঢুকছে, তাদের রক্ষা করতে মিসরীয় সেনাবাহিনী তিউনিসিয়ায় যেতে পারে না। গত সোমবার মিসরীয় নৌবাহিনী কালোরঙা এক ফ্রিগেট নিয়ে এসেছিল। সঙ্গে নিয়ে গেছে এক হাজার পুরুষ, নারী ও শিশু। উদ্দাম, ঝোড়ো বাতাসের মধ্যে তারা দেশের উদ্দেশে যাত্রা করেছে।
যেকোনো দয়ার জাহাজের থেকে বড় সীমান্তের দুর্দশা। হয়তো সাত হাজার অথবা আট হাজার মানুষ। এই সংখ্যা তাদের যন্ত্রণা প্রকাশে যতটা অপারগ, ততটাই অসম্পূর্ণ। লিবিয়ার শেষ বাধা পেরিয়ে তিউনিসিয়ায় পৌঁছার যাত্রাপথের ক্লেশ। লিবীয়রা তাদের পেটায়—আর যখন তারা তিউনিসিয়ায় পৌঁছাল, বেন গার্ডেনের তরুণেরা তাদের পেটায়, কাছের শহরে তাদের কাজে এরা ভাগ বসাতে পারে—এই শঙ্কায়। মিসরীয়রা এখানে কাজের সন্ধানে আসেনি। হাজার হাজার বাংলাদেশিও নয় (তিউনিসে বাংলাদেশের কোনো দূতাবাসও নেই), চীনারা নয়, ফিলিপিনোরাও নয়। এককালে তৃতীয় বিশ্ব বলে যা বোঝানো হতো, সেই তৃতীয় বিশ্বের এক প্রকৃত স্বৈরশাসকের দ্বারা দুর্দশার শিকার হয়ে, গৃহহীন ও কর্মহীন মানুষ হয়ে এরা সেখানে গেছে।
কালোরঙা চামড়ার জ্যাকেট পরা তিউনিসীয় এক নিরাপত্তা পুলিশের হাতে স্টেয়র রাইফেল। সাংবাদিকদের উদ্দেশে সে চেঁচিয়ে বলল, ‘কতজন এসেছে দেখেছেন? হাজার হাজার মানুষ ঢুকলে তিউনিসিয়ার চেহারাটা কেমন দেখাবে? গিয়ে সচক্ষে দেখে আসুন।’ সীমান্ত থেকে লিবিয়া অংশে দেখলাম কংক্রিটের দেয়াল ঠেলছে বহু মানুষ। লিবিয়ার সবুজ কাস্টমস স্টেশনের কাছে তাদের বামন মনে হলো। তিউনিসিয়ার দুরবস্থা আমাদের দেখিয়ে দেওয়ার জন্য সেনা কর্মকর্তাদের গালি খেতে হলো সেই পুলিশকে।
তথাপি তিউনিসীয়রা সদয় আচরণও করছিল। নিজেদের গাড়িতে করে মিসরীয় কৃষিশ্রমিকদের তারা নিয়ে যাচ্ছিল উদ্বাস্তু শিবিরে। সবেমাত্র এই শিবির স্থাপন করা হয়েছে। যারা কায়রোর বিমান ধরতে এবং জেরজেস পোতাশ্রয়ে যেতে জেরবা বিমানবন্দরে পৌঁছাতে পারছিল, তাদের খণ্ডকালীন ভিসা লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। তিউনিসিয়ায় আসা এসব মানুষ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে রুটি, পানি আর কম্বল।
মিসরের পতাকাসংবলিত সাদারঙা টি-শার্ট পরিহিত মিসরীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা আমাদের জানালেন, তিনি তাঁর স্বদেশবাসীকে সহায়তার জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে এখানে এসেছেন। মোবারকের দুর্নীতিপরায়ণ শাসনের সময়ে এমনটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। তাঁর মুখেও তিউনিসীয়দের প্রশংসা।
যদি এক লাখ উদ্বাস্তু তিউনিসিয়া ও মিসরের উদ্দেশে ইতিমধ্যে লিবিয়া ত্যাগ করে থাকে, তবে ত্রিপোলির স্বৈরশাসকের কাছে দায়িত্বপরায়ণতার চূড়ান্ত হিসাব কী রকম দাঁড়ায়? তাঁর সবুজগ্রন্থ অনুযায়ী তিনি তো জনগণের হাতেই ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছেন। গত সপ্তাহে ত্রিপোলিতে এক পোস্টারে দেখলাম লেখা আছে, ‘সবখানে জনগণের কংগ্রেস ও কমিটি ছাড়া কোনো গণতন্ত্র নয়’—অর্থহীন এক কথা। তাহলে কী হবে রাস জফিরের এসব মানুষের? তাদের কোনো কংগ্রেস বা কমিটি নেই। কেবল বাড়িমুখো কঠিন রাস্তা অথবা উত্তাল সমুদ্র। সোমবার সকালে মিসরীয় নৌবাহিনী তাদের উদ্ধারে এসেছিল। কিন্তু মাত্র এক হাজার ধারণক্ষমতার একটি ফ্রিগেট নিয়ে এল তারা। মিসরীয় ব্যানারে ভরপুর আর ঘাটে মিসরীয় নৌসেনাদের উপস্থিতির মাঝে শালাতেইনের জেরজেসে পৌঁছালে তো শুধু বেদনা ও দীনতা থেকে উদ্ধার পাওয়া গেল। মোবারককে উচ্ছেদের পর এটা মিসরের প্রথম সামরিক অভিযান। নৌসেনা ও নাবিকেরা ভালোভাবেই জানেন, তাঁদের ওপর বিশ্ববাসীর ক্যামেরা। তাঁরা শিশুদের নিয়ে নৌযানে তুলেছেন, লাঠিতে ভর দিয়ে চলা বৃদ্ধদের স্বাগত জানিয়েছেন, মিসরের ঊর্ধ্বভাগ থেকে আসা অবশিষ্ট কৃষকদের জড়িয়ে ধরেছেন।
জাহাজের লাউড স্পিকারে বাজানো হচ্ছিল ‘আল হেলমেল আরাবি’—‘আরব স্বপ্ন’। এটি আরব ঐক্যের প্রাচীন গান। তখন ৫০ মাইল দূরে সীমান্ত এলাকা থেকে কয়েকটি বাসে করে আরও কয়েক শ মিসরীয় প্রবাসী শ্রমিককে নিয়ে আসা হলো।
মিসরীয় নৌবাহিনীর নিজস্ব ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদকও ছবি তুললেন মধ্য ও পরিণত বয়সী কৃষিশ্রমিকদের। প্রায় সবার হাতে মাটিলাগা কম্বল আর প্লাস্টিক ব্যাগে তাঁদের যা ছিল সব।
তিউনিসিয়ার সীমান্তে গাদাগাদি করে থাকা এসব মানুষ বাড়ি ফিরে পরে কী ঘটবে? মিসরের অর্থনীতির ওপর শোচনীয় আঘাত আসবে। বাংলাদেশ ও তুরস্কের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় আঘাত লাগবে লিবিয়াতেই। তাদের কনস্ট্রাকশন প্ল্যান্ট ও জ্বালানিকেন্দ্র আর তেল-গ্যাসক্ষেত্রগুলো এখন তো খালি পড়ে আছে।
এ লেখা যখন লিখছি তখন মিসরের আরও চারটি নৌযান তিউনিসিয়ার পথে। এই টাস্কফোর্স ব্রিটিশ ও মার্কিন নাগরিকদের বের করে নেওয়ার উদ্যোগের থেকে বড়। কিন্তু সীমান্তে বাড়তে থাকা ঘরমুখো শ্রমিকদের সবাইকে ফিরিয়ে নিতে এটাও যথেষ্ট নয়।
দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক, মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ।
No comments