সরল গরল-সংবিধান পুনর্মুদ্রণ ও লখিন্দরের বাসর by মিজানুর রহমান খান
সংবিধান পুনর্মুদ্রণে বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তোলার পরে পুরো সপ্তাহ কেটে গেল। সরকারি কোনো ভাষ্য মেলেনি। অবশ্য এও ঠিক, ‘মুই কী হনু রে’ যে এর প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে। প্রবাদ আছে, হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল। তদুপরি ভাবি, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তো পোস্টকার্ড আমলে নেন।
তাতেই মেলে মাইলফলক রায়। উপরন্তু খোদ মাননীয় প্রধান বিচারপতি সংবিধান পুনর্মুদ্রণে প্রকাশ্যে মত দেন। তারপর তা যা খুশি তা-ই ছাপা হয়। আর প্রথম আলো অন্তত পোস্টকার্ডের চেয়ে বহুল পঠিত। তাই ক্ষীণ আশা আইন মন্ত্রণালয় পাত্তা না দিতে পারে, মহামান্য আপিল বিভাগ তো আছেন।
এর আগে ২১ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে এই কলামে লেখাটি বেরোয়। সেদিনই এ নিয়ে কথা বলতে ডাকে বাংলাভিশন ও এনটিভি। এনটিভিতে ছিলেন আবদুল মতিন খসরু। আওয়ামী সাংসদ, সাবেক আইনমন্ত্রী। সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত বিশেষ কমিটিরও তিনি সদস্য। তিনি আমার লেখা সমর্থন বা নাকচ কোনোটিই করলেন না। বলেছিলাম, সংবিধান ছাপা নিয়ে এমন ছিনিমিনি বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। তিনি বললেন, প্রথম আলোতে প্রকাশিত নিবন্ধের মন্তব্য নিষ্ঠুর হয়েছে কি না জানি না, তবে প্রিম্যাচিউর (অকালিক) হয়েছে। কারণ তিনি মনে করেন, পুনর্মুদ্রিত সংবিধান খসড়ামাত্র। এটা দেশের বিদ্যমান সংবিধান নয়। তবে আলোচনার একপর্যায়ে তিনি বললেন, আইন মন্ত্রণালয়ের কেরানিরা সংবিধান সংশোধন করতে পারেন না। তিনি এমনকি একটি তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানান। এও বললেন, আইনমন্ত্রী যদি বলে থাকেন যে, পুনর্মুদ্রিত সংবিধান বাংলাদেশের কার্যকর সংবিধান, তাহলে তা ঠিক নয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি দেখি, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও আইনমন্ত্রীর বক্তব্য ইত্তেফাক-এ পাশাপাশি মুদ্রিত। মওদুদ পুনর্মুদ্রিত সংবিধান স্থগিত করার দাবি জানান। তাঁর কথায়, সুপ্রিম কোর্ট বাহাত্তরের আটটি অনুচ্ছেদ জ্যান্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এখন পরিবর্তন আনা হয়েছে ৫০ স্থানে। এটা বেআইনি। তিনি দোষীদের শাস্তি দাবি করেন। এম কে আনোয়ার অন্যত্র বলেন, এ যে বুদ্ধিবৃত্তিক চুরি। আইনমন্ত্রী ২২ ফেব্রুয়ারি তাঁর মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগের কুশীলবদের উপস্থিতিতে সিরডাপ মিলনায়তনে বলেন, ‘রায়ের আলোকে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করেছি। এটাই কার্যকর থাকবে।’ এখানে বলে নেই, ভুলশুদ্ধ ভিন্ন বিতর্ক। আইনমন্ত্রীর কথাই আইনি মনে করি। ১০ ফেব্রুয়ারিতে মুদ্রিত সংবিধানই কার্যকর সংবিধান।
আচ্ছা, আপিল বিভাগের নবনিযুক্ত চারজন বিচারক কোন সংবিধান রক্ষার শপথ নিলেন? প্রধান বিচারপতি কোন সংবিধানের অধীনে শপথ পাঠ করালেন? আমরা তাঁদের মনের খবর জানি না। তবে ধরে নেব, সদ্য মুদ্রিত টাটকা সংবিধানই হবে, বাসি সংবিধান নয়। বাসি ফুল পূজায় লাগে না। আইন কমিশনের ধীমান সদস্য মো. আবদুল মোবারক। আইনের হাঁড়ির খবর রাখেন। তাঁর শরণ নেই। তিনি যা বলেন, তা অকাট্য। তিনি কারও মনে করাকরির ইতি ঘটান। ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ৭৮ ধারা অনুযায়ী, পুনর্মুদ্রিত সংবিধানই বাংলাদেশের সংবিধান। আদালত সেটাই আমলে নেবেন। সুতরাং আমরা কোনোভাবেই প্রিম্যাচিউর বা আগাম মন্তব্য করিনি।
পুনর্মুদ্রিত সংবিধান এখনো কেন সহজলভ্য নয়। কেন ওয়েবসাইটে অচলটাই আছে, তা এক রহস্য। আইনমন্ত্রী প্রথম আলোর প্রতিবেদক হারুন আল রশীদকে খোঁড়া যুক্তি দেন, ‘পুনর্মুদ্রিত সংবিধান অনেক ক্ষেত্রেই সংযোজন ও বিয়োজন হবে। তাই এটা বিতরণ করা হচ্ছে না। বিশেষ সংসদীয় কমিটির কাজের সুবিধার জন্য লিমিটেড (সীমিত) কিছু কপি ছাপা হয়েছে। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সংসদের চলতি অধিবেশনেই একটি সম্পূর্ণ সংবিধান পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।’ সিঁধ কেটে সংবিধান চুরির পর এখন তা নিয়ে লুকোচুরি শুরু হয়েছে। দেশের কার্যকর সংবিধানে নাগরিক শরিকানা থাকবে না কেন। আইনমন্ত্রীর উচিত ছেলে-ভুলানো ছড়া লেখা।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ফুলকোর্টের বৈঠক ছিল। হাইকোর্টের সকল বিচারকের সভা। প্রধান বিচারপতি সভাপতি। জানা যায়, সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রশ্ন উঠল। এখান থেকে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শের বিধান তুলে নেওয়ার বিষয়ে প্রথম রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল ১৬ ফেব্রুয়ারি, প্রথম আলোতেই। শুনেছি, প্রধান বিচারপতি ফুলকোর্টে মুদ্রণপ্রমাদের কথা উল্লেখ করেন। আইনমন্ত্রীর জবানিতে প্রথম মুদ্রণপ্রমাদের খবর আমরা দেখি প্রথম আলোতেই, ২০ ফেব্রুয়ারি।
১৯ ফেব্রুয়ারি ফুলকোর্টে বিচারকদের মনে ১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রশ্ন জ্বলে ওঠাই স্বাভাবিক। কারণ মুদ্র্রণপ্রমাদ না হলে ১ ফেব্রুয়ারি ২০১০ যেদিন আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনীর রায় দিলেন, সেদিন থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১১ সংবিধান মুদ্রণের দিন পর্যন্ত নিম্ন আদালতের শয়ে শয়ে বদলি, পদোন্নতিসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত অবৈধ হয়ে পড়ে। এটা একটা জলবৎ তরলং বিষয়। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা কেমন, দেখুন।
২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যরাত। দেশ টিভিতে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ নিয়ে মুখোমুখি বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম ও আবদুল মতিন খসরু। উপস্থাপক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের প্রশ্নের জবাবে আমীর-উল ইসলামের বক্তব্য শুনে লা-জওয়াব। বুকে শেলের মতো বেঁধে। কারণ আইনমন্ত্রীর বক্তব্য তিনি নাকচ করেন। আর এতে প্রধান বিচারপতিও বিদীর্ণ হন। এমনকি রক্তাক্ত হয় তাঁরই অমর কীর্তি মাসদার হোসেন মামলা। ১১৬ অনুচ্ছেদ থেকে এখন ‘সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ’ তুলে নেওয়া মানে নিম্ন আদালতের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা। কিন্তু ব্যারিস্টার আমীর বললেন, এর মধ্যে তিনি কোনো মুদ্রণপ্রমাদ দেখেন না। আমরা আশা করব, এ বিষয়ে তাঁর কাছ থেকে আরও বিস্তারিত জানার সুযোগ আমাদের হবে। তবে ভিন্নমত গণতান্ত্রিক স্পর্ধা। তাই বিনীতভাবে বলব, তাঁর ওই ব্যাখ্যা সমর্থন করার কোনো সুযোগ নেই।
আবদুল মতিন খসরু দেশ টিভিতে ওই দিন বলেন, যে সাংবাদিক কঠোর মন্তব্য করেছেন, তিনি দেখাননি কোথায় ত্রুটিবিচ্যুতি হলো। এ রকম জানার আগ্রহ আরও অনেকের কাছ থেকে জেনেছি।
বর্তমান প্রধান বিচারপতি পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ের মূল লেখক। তিনি তাঁর হাইকোর্টের রায়ে প্রস্তাবনাসহ আটটি কিংবা সাকল্যে ১০টি অনুচ্ছেদ চিহ্নিত করেন এবং তা জ্যান্ত করার নির্দেশ দেন। পঞ্চম সংশোধনী দিয়ে সংবিধানে আরও যত পরিবর্তন আনা হয়, তা তিনি ‘প্রজাতন্ত্রের স্বার্থে’ মার্জনা করেন। এর মানে হলো বাদবাকি যেমন ছিল সেভাবে টিকে থাকবে। আপিল বিভাগ করলেন কি, এর মধ্যে রংতুলির মাত্র তিনটা পোঁচ দিলেন। এতে হাইকোর্টের রায়ের তিনটি বস্তুর চেহারা বদলে গেল। তাঁরা অবশ্য সামরিক ফরমানে সংশোধিত ৪৪, ৯৬, ১০২ অনুচ্ছেদ ও বাকশালসংক্রান্ত ষষ্ঠ(ক) ভাগ বিলোপ নিয়ে আলোচনা করেন। মার্জনা করেন। এটা না করলেও চলত। আপিল বিভাগের অবরপ্রাপ্ত একজন মাননীয় বিচারককে বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করি। বাড়তি এই চারটি জায়গায় তুলি তো না চালালেও পারতেন। ঈষৎ লেপ্টে গেল নাকি? উত্তর এল: অস্পষ্ট ছিল। তাই স্পষ্ট করেছি। পাঠক, এটা কিন্তু মোটেই জুয়েল আইচের ম্যাজিক নয়। আপনিও সহজে ধরতে পারবেন বিষয়টি। কারণ ২০০৫ সালে আমরা হাইকোর্টের রায় পাই। সেই থেকে পরের পাঁচ বছরে আপনারা কেউ কি শুনেছেন, বিচারপতি খায়রুল হক নতুন করে বাকশালের পুনর্জন্ম ঘটিয়েছেন? আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ দেশের সব দল কি হাইকোর্টের রায়ে নিষিদ্ধ হয়ে পড়েছিল? জিয়ার ইজ্জত নিয়ে অনেক চেঁচামেচি আমরা শুনেছি। কিন্তু কেউ কি শুনেছেন, উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিলুপ্ত হয়েছে? স্রেফ একটা নোটিশ দিয়ে বিচারপতিদের বাড়ি পাঠানোর বিধান ফিরে এসেছে? বিচারকদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে? বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চিড়েচ্যাপটা হয়ে গেছে। কিংবা কি শুনেছেন কেউ, মৌলিক অধিকার বলবৎকরণে হাইকোর্ট আর রিট নেবেন না। সে জন্য নতুন সাংবিধানিক আদালত বসবে? কোনো পাগলেরও বলার কথা নয় যে, পঞ্চম সংশোধনী মামলায় বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ এমন রায় দিয়েছিলেন। আর ভাগ্যিস, আপিল বিভাগ তা ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন! সে জন্যই আমি আপিল বিভাগের একজন সংশ্লিষ্ট বিচারককে বলেছি, আপনারা এখানে খামোখাই হাত দিয়েছেন। এক গরু দুবার জবাই হয়েছে। অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি কমেনি। বেড়েছে।
আইন মন্ত্রণালয় আসলে যা করেছে, তাতে ‘কানার হাতে কুড়ালের’ গল্পই স্মরণ করিয়ে দেয়। তারা এলোপাতাড়ি কুড়াল চালিয়েছে। যেমন পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের ৪৬ পৃষ্ঠার ফুটনোট ব্যাখ্যা করলে এ-ই দাঁড়ায় যে, হাইকোর্ট চতুর্থ সংশোধনীর সেই বিধান পয়দা করেছেন, যাতে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতিসহ সব বিচারককে শুধু একটা নোটিশ দিয়ে অপসারণ করতে পারেন। আপিল বিভাগ তা খণ্ডন করেছে। ২১ পৃষ্ঠায় ৪৪ অনুচ্ছেদের ফুটনোটের কথা হলো তেমনই। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক হাইকোর্ট বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়েছিলেন। সংসদকে বলেছিলেন, হাইকোর্ট আর লাগবে না। এখন সাংবিধানিক আদালত বা ট্রাইব্যুনাল দিয়ে চালানো হবে!
তবু বলছি, আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের ক্যানভাসটা ঠিকই রাখলেন। সেখানে শুধু তিনবার তুলির আঁচড় কাটলেন। প্রথম আঁচড়ে নাগরিকত্বের পরিচয় (৬ অনুচ্ছেদ) বাঙালি না হয়ে বাংলাদেশি হলো। সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদে ৩ক নামে সেনা ফরমানের একটি ডাস্টবিন আছে। হাইকোর্ট ওটা অবশ্য ইতিহাসের ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করতে বলেছিলেন। আপিল বিভাগ রাজি হননি। তাই তাঁরা তাঁদের দ্বিতীয় আঁচড়ে ওই ডাস্টবিনটা রেখে দিলেন। তৃতীয় আঁচড় ৯৫(১) অনুচ্ছেদে। এখানে বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির পরামর্শের বিধান জিন্দা করার মন্ত্র ছিল। তা আইনসম্মত মনে করেননি আপিল বিভাগ।
আসুন, এখন আমরা দেখি হাইকোর্টের চিহ্নিত দুই গন্ডা অনুচ্ছেদ কীভাবে জ্যামিতিক হারে বাড়ল। প্রতিটা পরিবর্তন খুঁটিয়ে দেখলাম। কর টিপে গুনলাম। সুপ্রিম কোর্টের দোহাই দিয়ে একটা কমা কিংবা তারকাচিহ্ন অদলবদলও বিবেচনায় নিলাম। গুনে দেখি, আগের লেখায় যা প্রায় ৫০ বলেছিলাম, সেটা আসলে প্রায় ৭০। প্রায় ৭০টি অনুচ্ছেদে নানা মাত্রা ও ঢঙে পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে।
আইন মন্ত্রণালয় বিশেষ কমিটির কাছে প্রস্তাব করেছিল প্রায় তিন ডজন অনুচ্ছেদ পরিবর্তনে। সেখানে ‘বিশদভাবে পরীক্ষা করে দেখা দরকার’ বলে প্রায় ১০টি অনুচ্ছেদের উল্লেখ ছিল। সেগুলোর একটিরও উল্লেখ হাইকোর্ট বা আপিল বিভাগের রায়ে ছিল না। অথচ আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তাঁরা সেখান থেকে সাতটি অনুচ্ছেদ (৬৬, ৯৩, ৯৯, ১০৭, ১২২, ১৪৭ ও ১৪৮) বদলে দিয়েছেন। এর পরও কি সংসদ অবমাননা ঘটেনি?
প্রায় ৬০টি অতিরিক্ত স্থানে (আইন মন্ত্রণালয়ের একটি নথিতে বলা আছে, পরিবর্তন আনা হয়েছে ৪১টি অনুচ্ছেদে) অবৈধভাবে আনা পরিবর্তনের তাৎপর্য স্থানাভাবে আলোচনা সম্ভব নয়। আগের লেখায় দালাল আইন জ্যান্ত করার কথা বলেছি। এবারে ৯৩ ও ৯৯ অনুচ্ছেদ নিয়ে আলোচনা না করলেই নয়। এই দুটোই আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলের ‘বাজির ঘোড়া’ স্মরণ করিয়ে দেয়। সংসদ ভেঙে গেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসবে। তখন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান অধ্যাদেশ জারি করতে পারবেন না। তাঁর সেই ক্ষমতা হরণ করা হয়েছে। সেটা ওয়ান-ইলেভেনের তিক্ত অভিজ্ঞতাপ্রসূত কি? ‘নখদন্তহীন’ দুদক যাতে থাবা বিস্তার করতে না পারে, অধ্যাদেশ দিয়ে আর যাতে কেউ ‘বিরাজনৈতিকীকরণ’ না করতে পারে, সে জন্য কি?
৯৯ অনুচ্ছেদটি এখন ভাঁড়। এ রকম উদ্ভট ‘মুদ্রণপ্রমাদ’ অন্যত্র চোখে পড়েনি। বাহাত্তরের মূল অনুচ্ছেদ ঢোকানো হয়েছে। দৃশ্যত এর একটা প্রভাব পড়েছে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে। ১০ ফেব্রুয়ারির আগের বিধানমতে অবসরপ্রাপ্ত হাইকোর্টের বিচারকেরা আপিল বিভাগে ওকালতি করতে পারতেন। এখন তাঁদের সেই অধিকার চলে গেছে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারকেরা যাতে প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টার পদ নিতে পারেন, সে জন্য ত্রয়োদশ সংশোধনীতে একটা দায়মুক্তির বিধান করা হয়। এখন করেছে কি, বাহাত্তরের অনুচ্ছেদটি প্রতিস্থাপন শেষে একটি ব্র্যাকেটের মধ্যে এভাবে লেখা হয়েছে, [আধা-বিচার বিভাগীয় পদ অথবা প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টার পদ]। এর সামনেও কোনো শব্দ নেই। পেছনেও নেই। বিচ্ছিন্ন, অসম্পূর্ণ, অর্থহীন একটি বাক্য। আবার ইংরেজি পাঠে ‘কোয়াসি জুডিশিয়াল’ কথাটি ছাপা হয়নি। আমরা যদি ৯৯ অনুচ্ছেদের বর্তমান উপশিরোনাম বিবেচনায় নিই, তাহলে দ্যোতনা তৈরি হয়। উপশিরোনাম হলো, অবসর গ্রহণের পর বিচারকগণের অক্ষমতা। নিচে লেখা, প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টা। তার মানে এ পদ নিতে তাঁরা অক্ষম থাকবেন। আমরা অবশ্য গলা ফাটিয়ে সেটাই চাইছি। প্রধান বিচারপতিরা যাতে আর প্রধান উপদেষ্টা না হন। কিন্তু এভাবে অপরিচ্ছন্ন উপায়ে কেন? সামগ্রিকভাবে লখিন্দরের বাসরঘর তৈরির এ কোন সর্বনাশা চেষ্টা প্রতীয়মান হচ্ছে?
তবে যা-ই হোক না কেন, সংবিধান পুনর্মুদ্রণে পৃথকভাবে হাইকোর্ট, আপিল বিভাগ ও জাতীয় সংসদের অবমাননা ঘটেছে। কোনোটিই মামুলি নয়।
একবার আপিল বিভাগের একটি আদেশ এক প্রবীণ আইনজীবী জাল করেছিলেন। এর সমুদয় নথিপত্র আমাদের হস্তগত হয়। তৎকালীন প্রধান বিচাপতির কাছে আমি ব্যক্তিগতভাবে নালিশ দিই। দ্রুত তদন্ত কমিটি হয়। তার বিহিত দিতে আপিল বিভাগের নয়জন বিচারপতি প্রধান বিচারপতির কক্ষে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেছিলেন। সেটা ছিল এক ব্যক্তির জামিন-জালিয়াতি। এবারে তো সংবিধান-জালিয়াতি। আমরা যদি মেনে নিই যে, এটা আমাদের সংবিধান নয়। আগেরটাই সংবিধান। এটা খসড়ামাত্র। তাহলেও প্রশ্ন থাকে, প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন নিয়ে, সর্বোচ্চ আদালতের বিধান নিয়ে নয়-ছয়ের ঘটনা যে ঘটল, তার কোনো প্রতিকার লাগবে না?
পাদটীকা: ব্যারিস্টার মো. আবদুল হালিম গতকাল বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের কপি না পাওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। গত ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত আমাদের প্রতিবেদন ও নিবন্ধের বরাত দেন। ব্যারিস্টার হালিম ১১৬ অনুচ্ছেদের পুনর্মুদ্রণ বিষয়ে হাইকোর্ট বিভাগের কাছে একটি সুয়োমোটো রুল জারির আবেদন জানান। কিন্তু আদালত বলেন, সংবাদপত্রের ভিত্তিতে সবকিছু করা যায় না। পুনর্মুদ্রিত সংবিধান পাওয়া যাবে অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
এর আগে ২১ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে এই কলামে লেখাটি বেরোয়। সেদিনই এ নিয়ে কথা বলতে ডাকে বাংলাভিশন ও এনটিভি। এনটিভিতে ছিলেন আবদুল মতিন খসরু। আওয়ামী সাংসদ, সাবেক আইনমন্ত্রী। সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত বিশেষ কমিটিরও তিনি সদস্য। তিনি আমার লেখা সমর্থন বা নাকচ কোনোটিই করলেন না। বলেছিলাম, সংবিধান ছাপা নিয়ে এমন ছিনিমিনি বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। তিনি বললেন, প্রথম আলোতে প্রকাশিত নিবন্ধের মন্তব্য নিষ্ঠুর হয়েছে কি না জানি না, তবে প্রিম্যাচিউর (অকালিক) হয়েছে। কারণ তিনি মনে করেন, পুনর্মুদ্রিত সংবিধান খসড়ামাত্র। এটা দেশের বিদ্যমান সংবিধান নয়। তবে আলোচনার একপর্যায়ে তিনি বললেন, আইন মন্ত্রণালয়ের কেরানিরা সংবিধান সংশোধন করতে পারেন না। তিনি এমনকি একটি তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানান। এও বললেন, আইনমন্ত্রী যদি বলে থাকেন যে, পুনর্মুদ্রিত সংবিধান বাংলাদেশের কার্যকর সংবিধান, তাহলে তা ঠিক নয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি দেখি, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও আইনমন্ত্রীর বক্তব্য ইত্তেফাক-এ পাশাপাশি মুদ্রিত। মওদুদ পুনর্মুদ্রিত সংবিধান স্থগিত করার দাবি জানান। তাঁর কথায়, সুপ্রিম কোর্ট বাহাত্তরের আটটি অনুচ্ছেদ জ্যান্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এখন পরিবর্তন আনা হয়েছে ৫০ স্থানে। এটা বেআইনি। তিনি দোষীদের শাস্তি দাবি করেন। এম কে আনোয়ার অন্যত্র বলেন, এ যে বুদ্ধিবৃত্তিক চুরি। আইনমন্ত্রী ২২ ফেব্রুয়ারি তাঁর মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগের কুশীলবদের উপস্থিতিতে সিরডাপ মিলনায়তনে বলেন, ‘রায়ের আলোকে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করেছি। এটাই কার্যকর থাকবে।’ এখানে বলে নেই, ভুলশুদ্ধ ভিন্ন বিতর্ক। আইনমন্ত্রীর কথাই আইনি মনে করি। ১০ ফেব্রুয়ারিতে মুদ্রিত সংবিধানই কার্যকর সংবিধান।
আচ্ছা, আপিল বিভাগের নবনিযুক্ত চারজন বিচারক কোন সংবিধান রক্ষার শপথ নিলেন? প্রধান বিচারপতি কোন সংবিধানের অধীনে শপথ পাঠ করালেন? আমরা তাঁদের মনের খবর জানি না। তবে ধরে নেব, সদ্য মুদ্রিত টাটকা সংবিধানই হবে, বাসি সংবিধান নয়। বাসি ফুল পূজায় লাগে না। আইন কমিশনের ধীমান সদস্য মো. আবদুল মোবারক। আইনের হাঁড়ির খবর রাখেন। তাঁর শরণ নেই। তিনি যা বলেন, তা অকাট্য। তিনি কারও মনে করাকরির ইতি ঘটান। ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ৭৮ ধারা অনুযায়ী, পুনর্মুদ্রিত সংবিধানই বাংলাদেশের সংবিধান। আদালত সেটাই আমলে নেবেন। সুতরাং আমরা কোনোভাবেই প্রিম্যাচিউর বা আগাম মন্তব্য করিনি।
পুনর্মুদ্রিত সংবিধান এখনো কেন সহজলভ্য নয়। কেন ওয়েবসাইটে অচলটাই আছে, তা এক রহস্য। আইনমন্ত্রী প্রথম আলোর প্রতিবেদক হারুন আল রশীদকে খোঁড়া যুক্তি দেন, ‘পুনর্মুদ্রিত সংবিধান অনেক ক্ষেত্রেই সংযোজন ও বিয়োজন হবে। তাই এটা বিতরণ করা হচ্ছে না। বিশেষ সংসদীয় কমিটির কাজের সুবিধার জন্য লিমিটেড (সীমিত) কিছু কপি ছাপা হয়েছে। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সংসদের চলতি অধিবেশনেই একটি সম্পূর্ণ সংবিধান পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।’ সিঁধ কেটে সংবিধান চুরির পর এখন তা নিয়ে লুকোচুরি শুরু হয়েছে। দেশের কার্যকর সংবিধানে নাগরিক শরিকানা থাকবে না কেন। আইনমন্ত্রীর উচিত ছেলে-ভুলানো ছড়া লেখা।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ফুলকোর্টের বৈঠক ছিল। হাইকোর্টের সকল বিচারকের সভা। প্রধান বিচারপতি সভাপতি। জানা যায়, সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রশ্ন উঠল। এখান থেকে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শের বিধান তুলে নেওয়ার বিষয়ে প্রথম রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল ১৬ ফেব্রুয়ারি, প্রথম আলোতেই। শুনেছি, প্রধান বিচারপতি ফুলকোর্টে মুদ্রণপ্রমাদের কথা উল্লেখ করেন। আইনমন্ত্রীর জবানিতে প্রথম মুদ্রণপ্রমাদের খবর আমরা দেখি প্রথম আলোতেই, ২০ ফেব্রুয়ারি।
১৯ ফেব্রুয়ারি ফুলকোর্টে বিচারকদের মনে ১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রশ্ন জ্বলে ওঠাই স্বাভাবিক। কারণ মুদ্র্রণপ্রমাদ না হলে ১ ফেব্রুয়ারি ২০১০ যেদিন আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনীর রায় দিলেন, সেদিন থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১১ সংবিধান মুদ্রণের দিন পর্যন্ত নিম্ন আদালতের শয়ে শয়ে বদলি, পদোন্নতিসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত অবৈধ হয়ে পড়ে। এটা একটা জলবৎ তরলং বিষয়। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা কেমন, দেখুন।
২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যরাত। দেশ টিভিতে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ নিয়ে মুখোমুখি বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম ও আবদুল মতিন খসরু। উপস্থাপক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের প্রশ্নের জবাবে আমীর-উল ইসলামের বক্তব্য শুনে লা-জওয়াব। বুকে শেলের মতো বেঁধে। কারণ আইনমন্ত্রীর বক্তব্য তিনি নাকচ করেন। আর এতে প্রধান বিচারপতিও বিদীর্ণ হন। এমনকি রক্তাক্ত হয় তাঁরই অমর কীর্তি মাসদার হোসেন মামলা। ১১৬ অনুচ্ছেদ থেকে এখন ‘সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ’ তুলে নেওয়া মানে নিম্ন আদালতের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা। কিন্তু ব্যারিস্টার আমীর বললেন, এর মধ্যে তিনি কোনো মুদ্রণপ্রমাদ দেখেন না। আমরা আশা করব, এ বিষয়ে তাঁর কাছ থেকে আরও বিস্তারিত জানার সুযোগ আমাদের হবে। তবে ভিন্নমত গণতান্ত্রিক স্পর্ধা। তাই বিনীতভাবে বলব, তাঁর ওই ব্যাখ্যা সমর্থন করার কোনো সুযোগ নেই।
আবদুল মতিন খসরু দেশ টিভিতে ওই দিন বলেন, যে সাংবাদিক কঠোর মন্তব্য করেছেন, তিনি দেখাননি কোথায় ত্রুটিবিচ্যুতি হলো। এ রকম জানার আগ্রহ আরও অনেকের কাছ থেকে জেনেছি।
বর্তমান প্রধান বিচারপতি পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ের মূল লেখক। তিনি তাঁর হাইকোর্টের রায়ে প্রস্তাবনাসহ আটটি কিংবা সাকল্যে ১০টি অনুচ্ছেদ চিহ্নিত করেন এবং তা জ্যান্ত করার নির্দেশ দেন। পঞ্চম সংশোধনী দিয়ে সংবিধানে আরও যত পরিবর্তন আনা হয়, তা তিনি ‘প্রজাতন্ত্রের স্বার্থে’ মার্জনা করেন। এর মানে হলো বাদবাকি যেমন ছিল সেভাবে টিকে থাকবে। আপিল বিভাগ করলেন কি, এর মধ্যে রংতুলির মাত্র তিনটা পোঁচ দিলেন। এতে হাইকোর্টের রায়ের তিনটি বস্তুর চেহারা বদলে গেল। তাঁরা অবশ্য সামরিক ফরমানে সংশোধিত ৪৪, ৯৬, ১০২ অনুচ্ছেদ ও বাকশালসংক্রান্ত ষষ্ঠ(ক) ভাগ বিলোপ নিয়ে আলোচনা করেন। মার্জনা করেন। এটা না করলেও চলত। আপিল বিভাগের অবরপ্রাপ্ত একজন মাননীয় বিচারককে বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করি। বাড়তি এই চারটি জায়গায় তুলি তো না চালালেও পারতেন। ঈষৎ লেপ্টে গেল নাকি? উত্তর এল: অস্পষ্ট ছিল। তাই স্পষ্ট করেছি। পাঠক, এটা কিন্তু মোটেই জুয়েল আইচের ম্যাজিক নয়। আপনিও সহজে ধরতে পারবেন বিষয়টি। কারণ ২০০৫ সালে আমরা হাইকোর্টের রায় পাই। সেই থেকে পরের পাঁচ বছরে আপনারা কেউ কি শুনেছেন, বিচারপতি খায়রুল হক নতুন করে বাকশালের পুনর্জন্ম ঘটিয়েছেন? আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ দেশের সব দল কি হাইকোর্টের রায়ে নিষিদ্ধ হয়ে পড়েছিল? জিয়ার ইজ্জত নিয়ে অনেক চেঁচামেচি আমরা শুনেছি। কিন্তু কেউ কি শুনেছেন, উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিলুপ্ত হয়েছে? স্রেফ একটা নোটিশ দিয়ে বিচারপতিদের বাড়ি পাঠানোর বিধান ফিরে এসেছে? বিচারকদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে? বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চিড়েচ্যাপটা হয়ে গেছে। কিংবা কি শুনেছেন কেউ, মৌলিক অধিকার বলবৎকরণে হাইকোর্ট আর রিট নেবেন না। সে জন্য নতুন সাংবিধানিক আদালত বসবে? কোনো পাগলেরও বলার কথা নয় যে, পঞ্চম সংশোধনী মামলায় বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ এমন রায় দিয়েছিলেন। আর ভাগ্যিস, আপিল বিভাগ তা ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন! সে জন্যই আমি আপিল বিভাগের একজন সংশ্লিষ্ট বিচারককে বলেছি, আপনারা এখানে খামোখাই হাত দিয়েছেন। এক গরু দুবার জবাই হয়েছে। অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি কমেনি। বেড়েছে।
আইন মন্ত্রণালয় আসলে যা করেছে, তাতে ‘কানার হাতে কুড়ালের’ গল্পই স্মরণ করিয়ে দেয়। তারা এলোপাতাড়ি কুড়াল চালিয়েছে। যেমন পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের ৪৬ পৃষ্ঠার ফুটনোট ব্যাখ্যা করলে এ-ই দাঁড়ায় যে, হাইকোর্ট চতুর্থ সংশোধনীর সেই বিধান পয়দা করেছেন, যাতে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতিসহ সব বিচারককে শুধু একটা নোটিশ দিয়ে অপসারণ করতে পারেন। আপিল বিভাগ তা খণ্ডন করেছে। ২১ পৃষ্ঠায় ৪৪ অনুচ্ছেদের ফুটনোটের কথা হলো তেমনই। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক হাইকোর্ট বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়েছিলেন। সংসদকে বলেছিলেন, হাইকোর্ট আর লাগবে না। এখন সাংবিধানিক আদালত বা ট্রাইব্যুনাল দিয়ে চালানো হবে!
তবু বলছি, আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের ক্যানভাসটা ঠিকই রাখলেন। সেখানে শুধু তিনবার তুলির আঁচড় কাটলেন। প্রথম আঁচড়ে নাগরিকত্বের পরিচয় (৬ অনুচ্ছেদ) বাঙালি না হয়ে বাংলাদেশি হলো। সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদে ৩ক নামে সেনা ফরমানের একটি ডাস্টবিন আছে। হাইকোর্ট ওটা অবশ্য ইতিহাসের ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করতে বলেছিলেন। আপিল বিভাগ রাজি হননি। তাই তাঁরা তাঁদের দ্বিতীয় আঁচড়ে ওই ডাস্টবিনটা রেখে দিলেন। তৃতীয় আঁচড় ৯৫(১) অনুচ্ছেদে। এখানে বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির পরামর্শের বিধান জিন্দা করার মন্ত্র ছিল। তা আইনসম্মত মনে করেননি আপিল বিভাগ।
আসুন, এখন আমরা দেখি হাইকোর্টের চিহ্নিত দুই গন্ডা অনুচ্ছেদ কীভাবে জ্যামিতিক হারে বাড়ল। প্রতিটা পরিবর্তন খুঁটিয়ে দেখলাম। কর টিপে গুনলাম। সুপ্রিম কোর্টের দোহাই দিয়ে একটা কমা কিংবা তারকাচিহ্ন অদলবদলও বিবেচনায় নিলাম। গুনে দেখি, আগের লেখায় যা প্রায় ৫০ বলেছিলাম, সেটা আসলে প্রায় ৭০। প্রায় ৭০টি অনুচ্ছেদে নানা মাত্রা ও ঢঙে পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে।
আইন মন্ত্রণালয় বিশেষ কমিটির কাছে প্রস্তাব করেছিল প্রায় তিন ডজন অনুচ্ছেদ পরিবর্তনে। সেখানে ‘বিশদভাবে পরীক্ষা করে দেখা দরকার’ বলে প্রায় ১০টি অনুচ্ছেদের উল্লেখ ছিল। সেগুলোর একটিরও উল্লেখ হাইকোর্ট বা আপিল বিভাগের রায়ে ছিল না। অথচ আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তাঁরা সেখান থেকে সাতটি অনুচ্ছেদ (৬৬, ৯৩, ৯৯, ১০৭, ১২২, ১৪৭ ও ১৪৮) বদলে দিয়েছেন। এর পরও কি সংসদ অবমাননা ঘটেনি?
প্রায় ৬০টি অতিরিক্ত স্থানে (আইন মন্ত্রণালয়ের একটি নথিতে বলা আছে, পরিবর্তন আনা হয়েছে ৪১টি অনুচ্ছেদে) অবৈধভাবে আনা পরিবর্তনের তাৎপর্য স্থানাভাবে আলোচনা সম্ভব নয়। আগের লেখায় দালাল আইন জ্যান্ত করার কথা বলেছি। এবারে ৯৩ ও ৯৯ অনুচ্ছেদ নিয়ে আলোচনা না করলেই নয়। এই দুটোই আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলের ‘বাজির ঘোড়া’ স্মরণ করিয়ে দেয়। সংসদ ভেঙে গেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসবে। তখন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান অধ্যাদেশ জারি করতে পারবেন না। তাঁর সেই ক্ষমতা হরণ করা হয়েছে। সেটা ওয়ান-ইলেভেনের তিক্ত অভিজ্ঞতাপ্রসূত কি? ‘নখদন্তহীন’ দুদক যাতে থাবা বিস্তার করতে না পারে, অধ্যাদেশ দিয়ে আর যাতে কেউ ‘বিরাজনৈতিকীকরণ’ না করতে পারে, সে জন্য কি?
৯৯ অনুচ্ছেদটি এখন ভাঁড়। এ রকম উদ্ভট ‘মুদ্রণপ্রমাদ’ অন্যত্র চোখে পড়েনি। বাহাত্তরের মূল অনুচ্ছেদ ঢোকানো হয়েছে। দৃশ্যত এর একটা প্রভাব পড়েছে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে। ১০ ফেব্রুয়ারির আগের বিধানমতে অবসরপ্রাপ্ত হাইকোর্টের বিচারকেরা আপিল বিভাগে ওকালতি করতে পারতেন। এখন তাঁদের সেই অধিকার চলে গেছে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারকেরা যাতে প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টার পদ নিতে পারেন, সে জন্য ত্রয়োদশ সংশোধনীতে একটা দায়মুক্তির বিধান করা হয়। এখন করেছে কি, বাহাত্তরের অনুচ্ছেদটি প্রতিস্থাপন শেষে একটি ব্র্যাকেটের মধ্যে এভাবে লেখা হয়েছে, [আধা-বিচার বিভাগীয় পদ অথবা প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টার পদ]। এর সামনেও কোনো শব্দ নেই। পেছনেও নেই। বিচ্ছিন্ন, অসম্পূর্ণ, অর্থহীন একটি বাক্য। আবার ইংরেজি পাঠে ‘কোয়াসি জুডিশিয়াল’ কথাটি ছাপা হয়নি। আমরা যদি ৯৯ অনুচ্ছেদের বর্তমান উপশিরোনাম বিবেচনায় নিই, তাহলে দ্যোতনা তৈরি হয়। উপশিরোনাম হলো, অবসর গ্রহণের পর বিচারকগণের অক্ষমতা। নিচে লেখা, প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টা। তার মানে এ পদ নিতে তাঁরা অক্ষম থাকবেন। আমরা অবশ্য গলা ফাটিয়ে সেটাই চাইছি। প্রধান বিচারপতিরা যাতে আর প্রধান উপদেষ্টা না হন। কিন্তু এভাবে অপরিচ্ছন্ন উপায়ে কেন? সামগ্রিকভাবে লখিন্দরের বাসরঘর তৈরির এ কোন সর্বনাশা চেষ্টা প্রতীয়মান হচ্ছে?
তবে যা-ই হোক না কেন, সংবিধান পুনর্মুদ্রণে পৃথকভাবে হাইকোর্ট, আপিল বিভাগ ও জাতীয় সংসদের অবমাননা ঘটেছে। কোনোটিই মামুলি নয়।
একবার আপিল বিভাগের একটি আদেশ এক প্রবীণ আইনজীবী জাল করেছিলেন। এর সমুদয় নথিপত্র আমাদের হস্তগত হয়। তৎকালীন প্রধান বিচাপতির কাছে আমি ব্যক্তিগতভাবে নালিশ দিই। দ্রুত তদন্ত কমিটি হয়। তার বিহিত দিতে আপিল বিভাগের নয়জন বিচারপতি প্রধান বিচারপতির কক্ষে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেছিলেন। সেটা ছিল এক ব্যক্তির জামিন-জালিয়াতি। এবারে তো সংবিধান-জালিয়াতি। আমরা যদি মেনে নিই যে, এটা আমাদের সংবিধান নয়। আগেরটাই সংবিধান। এটা খসড়ামাত্র। তাহলেও প্রশ্ন থাকে, প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন নিয়ে, সর্বোচ্চ আদালতের বিধান নিয়ে নয়-ছয়ের ঘটনা যে ঘটল, তার কোনো প্রতিকার লাগবে না?
পাদটীকা: ব্যারিস্টার মো. আবদুল হালিম গতকাল বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের কপি না পাওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। গত ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত আমাদের প্রতিবেদন ও নিবন্ধের বরাত দেন। ব্যারিস্টার হালিম ১১৬ অনুচ্ছেদের পুনর্মুদ্রণ বিষয়ে হাইকোর্ট বিভাগের কাছে একটি সুয়োমোটো রুল জারির আবেদন জানান। কিন্তু আদালত বলেন, সংবাদপত্রের ভিত্তিতে সবকিছু করা যায় না। পুনর্মুদ্রিত সংবিধান পাওয়া যাবে অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments