পারিবারিক শিক্ষা বনাম সামাজিক মূল্যবোধ by মোঃ আসাদুল্লাহ

সামাজিক পর্যায়ে গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধের বিকাশ ও সহনশীলতার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির প্রাথমিক স্তর হলো পরিবার। পারিবারিক পর্যায়ে মূল্যবোধ সম্পর্কে শিশুর ধারণা পরিণত বয়সে তার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ভূমিকার ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়। অনেক পরিবারের মধ্যে মূল্যবোধের চর্চা নেই।


কোনো কোনো ক্ষেত্রে পারিবারিক বন্ধনের জায়গাটি শিথিল হওয়ায় মানুষের মনে সহমর্মিতাবোধ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে_ এমন নজিরও বিরল নয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত ধর্মীয় অনুশাসন অনুপস্থিতই থাকছে ব্যক্তি কিংবা পারিবারিক জীবনে। এ অবস্থায় পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি বা সহমর্মিতাবোধের কোনো শিক্ষাই সঞ্চারিত হচ্ছে না পরিবারে বা সমাজে। এর পরিণতিতে মানুষ সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে সমাজের অন্য সবার প্রতি তার অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের বিষয়টি সুকৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছে। তাই পারিবারিক পর্যায়ে শিশুর আত্তীকৃত দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাসগুলোর বিকাশ কিংবা এর বিপরীতে নতুন বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণ, ক্ষুদ্র পারিবারিক গণ্ডির বাইরে ব্যক্তির বৃহত্তর ভূমিকা, নাগরিক দায়িত্ববোধ, মতামত, ন্যায়পরায়ণতা ও আত্মবিশ্বাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ব্যক্তির মানসে প্রোথিত হওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতার কারণে সমাজ ব্যবস্থায় যে বৈষম্যের সম্পর্ক বিদ্যমান তার প্রভাব পরিলক্ষিত হয় জাতীয় জীবনে। মৌলিক বিশ্বাস ও স্বার্থের ঐক্য না থাকলে সমঝোতার ও সহযোগিতার অভাব দেখা দেয়। সে জন্য ব্যক্তির মাঝে তার জাতীয় পরিচয়, জাতীয় স্বার্থ, মানবাধিকার, উন্নতি, অগ্রগতি, জাতীয় সংহতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়া প্রয়োজন।
সামাজিক অসহনশীলতার মাত্রা সমাজের সব স্তরেই কমবেশি বিদ্যমান। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষিতজনের মাঝে অসহনশীলতার মাত্রা তুলনামূলকভাবে চোখে পড়ে বেশি। মানুষ যত শিক্ষিত হবে, তার আচরণও তত মার্জিত, সহনশীল হবে; কিন্তু বাস্তবে তা অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত থাকছে। যদিও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মূল্যবোধ কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেক উন্নত। সামাজিক কাঠামোর ভিত্তিমূলেই যদি আস্থাহীনতার উদ্ভব ঘটে, তাহলে সহনশীলতার আশা দুরাশায় পরিণত হবে। মানুষের আস্থাহীনতার মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে। শিক্ষার্থী-শিক্ষক, নাগরিক-সরকার, অভিভাবক-সন্তান, স্বামী-স্ত্রী, নিয়োগকর্তা-কর্মচারী, মালিক-ভাড়াটিয়া প্রত্যেকের মাঝেই এক ধরনের আস্থাহীনতার উন্মেষ ঘটেছে। যেটি মোটেই কাম্য নয়। এ ছাড়া শারীরিক নির্যাতন, বিবাহ বিচ্ছেদের মহামারী, ভেজাল পণ্যে বাজার সয়লাব, নাগরিক কর্তৃক আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা, অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ, অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনসহ নানাবিধ অস্থিরতার নিদর্শন আমাদের চোখের সামনেই রয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে মানুষের মানবিকতা বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। শহুরে সমাজ আর গ্রামীণ সমাজের মাঝে সামাজিক সহনশীলতার একটা সুস্পষ্ট ব্যবধান চোখে পড়ে। বাংলাদেশে যে ধরনের সামাজিক অনাচার, অসঙ্গতি চলছে তা দূর হওয়া বাঞ্ছনীয়। সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বলতে হয়, আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন ব্যয়ের পরিমাণ নিয়ে সমাজে বসবাস করলেও সমাজের কোনো কোনো অংশে এক ধরনের স্বীকৃতি মিলছে। অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোও কেমন যেন পরোক্ষভাবেই অবৈধ আয়ের ব্যাপারে উৎসাহ দিচ্ছে। সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আইনানুগ পদ্ধতি অনেকের কাছে হাস্যকর, বিদ্রূপাত্মক, দুর্বলতার নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। এভাবেই ধীরে ধীরে মানবিকতা, নৈতিকতার বিলুপ্তি ঘটছে। সবচেয়ে বড় কথা, মূল্যবোধের অবক্ষয়ই এ মানসিকতা সৃষ্টির জন্য দায়ী। তারপরও অপ্রকাশ্যে হলেও আজও কিন্তু আমরা দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনের কথা বলি, নীতিবানকে সমীহ করি, ন্যায়বিচারকে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করি। তাই সহনশীলতার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে ব্যক্তি পর্যায় থেকে। কেননা ব্যক্তির সমন্বয়ে পরিবার, পরিবারের সমন্বয়ে সমাজ, সমাজের সমন্বয়ে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের সমন্বয়ে বিশ্ব। ব্যক্তি পর্যায় থেকে প্রত্যেকের মধ্যে বিবেকবোধ জাগ্রত হলে অবশ্যই বিনির্মাণ করা সম্ভব একটি সহনশীল সমাজ। ব্যক্তি জীবনে উত্তম গুণাবলির চর্চায় ধর্মীয় অনুশাসন এবং পারিবারিক পর্যায়ে মূল্যবোধের লালন অত্যাবশ্যক। দরকার সীমাহীন প্রয়োজনের অন্তরালে বিদ্যমান লোভের আগ্রাসন কমানো। বোধশক্তি জাগ্রত করে বিদ্যমান সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা। কেননা বোধশক্তির বিনাশে বধশক্তির বিকাশ, অব্যাহত প্রশ্রয়ে চিরস্থায়ী নিবাস।

স মোঃ আসাদুল্লাহ :শিক্ষক, ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট)
ধংযধফঁষষধয.নফ@মসধরষ.পড়স

No comments

Powered by Blogger.